ফেসবুক চষে বেড়ানোর সময় মাঝে-মাঝেই স্ক্রিনের ডানদিকে অনেকের ছবি ভেসে ওঠে, ‘পিপল ইউ মে নো’ বলে। কখনও তাকালেও বেশিরভাগ সময়েই তা চোখ এড়িয়ে যায়। সেদিন রাতে হঠাৎ করে একটা মুখের দিকে তাকিয়ে কীরকম আটকে গেলাম। মনে হতে লাগল,এই মানুষটাকে কোথায় যেন দেখেছি। কিন্তু কয়েকটা মুহূর্ত কিছুতেই মনে করতে পারলাম না কী সূত্রে তার সঙ্গে পরিচয়, কোথায় প্রথম দেখা।
আর তারপরই মাথায় যেন একটা ভারি পাথর আছড়ে পড়ল। ‘আরে ! এ যে আমার হারিয়ে যাওয়া মেঘবালিকা !
জীবনপটে বজ্রের মতো আছড়ে পড়ে হঠাৎ মিলিয়ে যাওয়া বন্ধুটিকে আমি চিনতে পারলাম না? আত্নগ্লানিতে মনটা তেতে উঠলো। কিন্তু পরক্ষনেই মনে হল,এই মার্চের কুসুম কুসুম গরমে মেঘবালিকা ফেসবুকে কী করছে ? আগের বছরই তো বিনা নোটিশে সে পারি জমিয়েছে সেই সাম্রাজ্যে,যেখানে ফেসবুক,ইন্টারনেট কোনকিছুরই সংযোগ পাওয়া যায় না। কিংবা কে জানে,হয়তো দরকারই পড়েনা। এত খুশি,এত ঝরনা,এত মদি-মদিরা যে ফেসবুক-টেসবুক ব্যবহারের কথা কারো মনেই হয়না।
তাহলে মেঘবালিকা আবার সেখান থেকে আমার জানলার ডানদিকে কেন উঁকি মারছিল ?
প্রশ্নটা খচখচ করে বিঁধতেই আমি সার্চ দিয়ে মেঘবালিকার প্রোফাইলে গেলাম,আর তখনই একটা মস্ত ঝাঁকুনি খেয়ে ফিরে এলাম বাস্তবে। ‘ফেসবুক থেকে ওর অ্যাকাউন্টটা তাহলে এখনো ডিলিট হয়নি(করা হয়নি)। ’ মালিক দুনিয়া থেকে চলে যাওয়ার পরও সে রয়ে গেছে,আপন খেয়ালে,। সহজ প্রশ্নগুলোই সব গুবলেট করে দিল‘কী আশ্চর্য ! যে পৃথীবিতে নেই,সে ফেসবুকে থাকতে পারে? দিব্যি তাকে বন্ধুত্বের আহবান জানাতে পারে অন্যকেউ। আর সে নিজেও হাসিমুখে ভেসে উঠতে পারে অন্যের পর্দায়।
এ তো নতুন ধরনের প্রক্সি ! যেখানে মৃত মানুষ জীবিতের হয়ে প্রক্সি দিতে পারে। হতে পারে তারা দুজন একই লোক,কিন্তু মৃত আর জীবিতের মাঝের দেয়াল ভেঙ্গে ফেলা তো চাট্টিখানি কথা নয় !
এটা মনে হতেই বুকটা ধরে এলো। উঠে দাঁড়ালাম,পানি খেলাম,ভরা জোসনায় কিছুন ভিজলাম তবুও বুক থেকে পাথর সরলো না। আচ্ছা,আজ রাতে যদি আমি মারা যাই,কাল ভোরের সুর্য ওঠার আগেই ? তারপর আমি কারো স্মৃতিতে থাকি না থাকি জুকারবার্গের আজব দুনিয়ায় তো থেকে যাব,কাদা মাখা মুখে ফোকলা হাসি নিয়ে উঁকি মারবো এর-ওর জানালায় ? ‘ওগো আমায় বন্ধু বানাবে’ বলে নিঃশব্দে স্মাইলি দেব? ভিতরটা কান্নায় ভেঙ্গে গেলেও স্মাইলি দেয়া ছাড়া উপায়ও নেই আমার। কারণ,ফেসবুক তো মৃতের অনুভূতি গ্রহনের ভাষা জানেনা।
তার মুলুকে সবাই জীবিত,চিরজীবিত। সকলেই শোভন। অজস্র ছবির নিচের অসংখ্য ‘লাইক। ’ প্রতিটি মুহুর্তে নতুন হয়ে উঠছে সবাই।
ছাত্রজীবনে ‘প্রক্সি’ শব্দটা সবারই খুব পরিচিত।
আমরা সবাই কোন না কোন সময় বন্ধুদের বলেছি‘,ক্লাসে থাকতে পারছি না। আমরা রোল-নম্বরটা ডাকলে প্রেজেন্ট প্লিজ বলতে যেন ভুল না হয়। ’ কাস শেষে কিংবা পরদিন গিয়ে জিজ্ঞেস করেছি-প্রেজেন্ট দিয়েছিলি তো ? জবাবে ওরা ঘাড় কাত করলে তা বিশ্বাস করেছি মনের অজান্তেই। স্কুলে ব্যাপারটা হতো না বললেই চলে,কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ঘটেছে অহরহই। নিজ অভিজ্ঞতা থেকে বলছি,অন্যর রোল-কলে সাড়া দেয়া বেশ কঠিন।
গলায় দু চামচ উত্তেজনা বেশি থাকে,তাই। ধরা খাওয়ার জন্য এতটুকই যথেষ্ট।
কিন্তু ফেসবুকে কেউ যদি আমি না থাকার পরও আমার হয়ে প্রক্সি দেয় ? আমায় চেনেনা,জানেনা অথচ এমন অনেকের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতে আমার নামের আড়ালে থেকে ? ধরে নিচ্ছি, মৃত্যুর পরও শুধু অনুভূতিটুকু থাকবে। তখন কেমন লাগবে আমার ? মনে আঘাত লাগবে ? কে জানে !
মেঘবালিকার অ্যাকাউন্ট দেখে উত্তেজিত হওয়ার মুহুর্তে মনে হয়েছিল,কাউকে আমার পাসওয়ার্ডটা বলে যাব,যেন আমি গত হওয়ার পর অ্যাকাউন্টটা ডিলিট করে দিতে পারে। পরে মনে হলো,থাক না যেমন আছে।
মাঝে-মাঝে অন্যের জানালায় বেশ উঁকি-ঝুঁকি মারবে। তারপর মনে হলো,এমন কাউকে খুঁজে বের করতে হবে,আমি না থাকলেও যে আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে। অন্তত নামটুকু। আর তখন আমাকে থুড়ি ! আমার ফেসবুক অস্তিত্বের ঝুড়িতে জমা পড়া বন্ধুত্বের আবেদন নিমেশে ‘অ্যাকসেপ্টল্ট’ হবে। আমার নামটাও ‘প্রেজেন্ট প্লিজ’ বলে উঠবে গোটা পৃথীবিকে।
তখন কে গো বলে সেই প্রভাতে আমি নেই ?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।