আমি তোমাকেই বলে দেব, কি যে একা দীর্ঘ রাত আমি হেটে গেছি বিরান পথে! আমি তোমাকেই বলে দেব, সেই ভুলে ভরা গল্প; কড়া নেড়ে গেছি ভুল দরজায়!
নেটওয়ার্কে বসেই চমকে উঠলাম! রঙ্গন!! হ্যাঁ রঙ্গনইতো। তবে নিশ্চয় কেউ ওর নিক-টা লগইন করেছে। তাই হবে হয়ত। কারন যে বন্ধুটি প্রায় একবছর আগে মারা গেছে, সেতো ইন্টারনেট ব্যাবহার করতে পারে না। কিন্তু কে ওর নিক ব্যাবহার করছে, তা জানার আগ্রহটাকে দমিয়ে রাখতে পারলাম না।
চ্যাটে গিয়ে লিখলাম, “? ? ?” উত্তর এল প্রায় সাথে সাথে, “! ! !” আবার লিখলাম, “ . . .” এবার উত্তর এল, “_ _ _” লিখলাম “* * *” উত্তর এল “# # #” বুঝলাম এভাবে এগুনো যাবে না, যে ব্যাটা চ্যাটে বসেছে, সে বেশ বুদ্ধিমান আছে। রঙ্গনও বেশ বুদ্ধিমান ছিল। সব দিক দিয়েই সেরা, যাকে বলে একদম পারফেক্ট। স্কুলে সব সময় প্রথম পাঁচ জনের মধ্যে রেজাল্ট করত। খেলাধুলাতেও ছিল প্রায় একই রকম।
কোন খেলাটা পারত না ও, কার্ড থেকে শুরু করে ক্রিকেট ফুটবল সব কিছুতেই ওস্তাদ। চেহারাও ছিল বেশ; লম্বা নাক, কুচকুচে কালো চোখ, আর মুখে অমায়িক হাসিতো সব সময় লেগেই আছে। ওকে দেখে একবার আমার মা মন্তব্য করেছিলেন, “ছেলেরাও এতো সুন্দর হয়!” সবচেয়ে বড় কথা ও ছিল চরম আড্ডাবাজ, আমাদের আড্ডার প্রাণ। প্রেমও করত বেশ। ক্লাশ এইটে আমরা যখন হন্যে হয়ে ভালবাসার মানে খুজে বেড়াই; রঙ্গন তখন থেকেই চুটিয়ে প্রেম করে।
আর যেন তেন প্রেম নয়, একে বারে সত্যিকারের প্রেম। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকটা সময় পার করেও আমাদের বন্ধুদের অনেকেই আছে যারা এখনও এটাই ঠিক করতে পারেনি, কোন মেয়েটাকে তাদের ভাল লাগে! অথচ রঙ্গন শুধু একজনের সাথেই প্রেম করত সেই ক্লাস এইট থেকেই। আমি ওকে প্রায় বলতাম, “দোস্ত তোদের প্রেম দেখে আমার হিংসে হয়।
আমি কখনই ওদের প্রেমে নজর লাগাতে চাই-নি। সায়েন্সের এই যুগে এই ব্যাপারটির কোন ভিত্তি নেই; কার যানি কু নজর পড়ে গেল তাদের প্রেমে।
দিনটি আমার আজো মনে আছে, ৬ জানুয়ারী; আমার জন্মদিনের ঠিক তিনদিন পর। সকালে আমি ছাদের উপর বায়োকেমিস্ট্রি পড়ছি। আমার পোষা কবুতরগুলো বাক-বাকুম করতে করতে এগিয়ে এলে অল্পো কিছু খাবার ছড়িয়ে দিচ্ছি। এমন সময় রনির কল এল, হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠতেই কবুতরগুলো ডানা ঝাপটে উড়ে চলে গেল। রিসিভ করতেই রনির কান্নাভেজা কন্ঠ, “রঙ্গন আর আমাদের মাঝে নেইরে . .. ...” আমি প্রায় চিৎকার দিয়ে উঠলাম, “ধ্যাৎ কি বলছিস এসব! ওর আজ আমাদের বাড়ি আসার কথা, আমার জন্মদিনের পার্টিতে যোগ দিতে পারেনি তাই আজ আসবে।
” বেশ কিছুটা সময় লাগল বুঝে উঠতে, একটা রোড এক্সিডেন্ট আমাদের প্রিয় বন্ধুটিকে নিয়ে গেছে অনেক দূর। বাইক নিয়ে ছুটে গেলাম, প্রিয় বন্ধুটিকে শেষ বারের মত দেখতে। বায়োলজি ল্যাবে কত প্রাণী দ্বিধাহীন ভাবে ব্যবচ্ছেদ করেছি, সেই আমি রঙ্গনের ক্ষত বিক্ষত মুখের দিকে তাকাতে পারি না। বারবার চোখ বাষ্পরুদ্ধ হয়ে যায়।
আমি চ্যাটে লিখলাম, “কি ব্যাপার? কে তুমি?” উত্তর এল, “শালা তুমি ধরলি কবে থেকে?” এটা রঙ্গনের মুদ্রাদোষ কথায় কথায় শালা বলে।
আমি লিখলাম, “রঙ্গন!?” “নয়ত কে?” “কিন্তু রঙ্গনতো. .. ...” “মরে গেছে, এইতো?” “হ্যাঁ . .. ...” আচ্ছা কিভাবে প্রমান দেব আমিই রঙ্গন ” “বলতো তোর সাথে আমার শেষ দেখা কবে হয়েছিল?” “৬ জানুয়ারী। “ “হয়নি. .. ...” “তার আগে ১৬ ডিসেম্বর। বিজয় দিবসের র্যালীতে। তুই লাল ফতুয়া পরেছিলি আর আমি সবুজ” “ঐ দিন আমরা কয়টা সিগারেট খেয়েছিলাম?” “তুই খাসনি আর আমাকেও খেতে নিষেধ করেছিলি। “ “কিন্তু তুইতো সিগারেট খাইছিলি।
“ “হ্যাঁ দুটা একটা তোর ভাগের আর একটা আমার ভাগের। “ “ঐ দিন তুই আমাকে একটা গালি দিয়েছিলি, মনে পড়ে?” “মনে পড়বেনা ক্যানরে ভাড়ুয়া ” আমি পুরো কনফিউজ্ড হয়ে গেলাম। এসব অন্য কারও জানার কথা নয়। ঐ দিন ও আমাকে সিগারেট অফার করলে বলেছিলাম ছেড়ে দিয়েছি। ও অবাক হয়ে বলল ‘কেন?’ “গালফ্রেন্ড নিষেধ করেছে।
“ “সিগারেট খারাপ জিনিষ ছেড়ে দিবি ভাল কথা, কিন্তু ভাড়ুয়ার মত গালফ্রেন্ডের কথায় কেন? সিজান গালফ্রেন্ডের জন্য নিজেকে চেঞ্জ করে ফেলা খারাপ দেখায়!” ঐ দিন আমি ওর কথার কোন উত্তর দিতে পারি নাই।
আমি পুরো উল্লাসিত হয়ে প্রশ্ন করলাম, “এটা কিভাবে সম্ভব হল দোস্ত?” উত্তর এল সবকিছু বাবার জন্য . .. ...। “ আবার মনে পড়ে গেল শেষ দিনের কথা; রঙ্গনের বাবা একজন বিজ্ঞানী। ঐ সময় একটা কন্ফারেন্সে দেশেই ছিলেন। ডাক্তার যখন ঘোসনা দিয়ে দিয়েছে, রঙ্গন আর বেঁচে নেই; এমন সময় ওর বাবা সেখানে উপস্থিত।
তারপর কিসব যন্ত্রপাতি লাগিয়ে ওর বাবা ঠিক আধাঘন্টার মধ্যে অ্যামেরিকা চলে গেলেন। সবাই বলছিল বাবার মন এত সহযে ছেলের মৃত্যু মেনে নিতে পারে না। রঙ্গনকে ঐ দিনই শেষ দেখেছিলাম। এরপর কখনও ভাবিনি রঙ্গনকে আবার আমাদের মাঝে পাব। আবার চ্যাট হবে কল্পনাতেও ভাবিনি।
কিবোর্ডের উপর আমার আঙ্গুল ঝড় তুলল, “তোকে খুব মিস করতাম দোস্ত! পদ্মার পাড়ে আড্ডায় তোকে খুব মিস করি। কাউকে হাতের মাঝে লুকিয়ে সিগারেট খেতে দেখলে তোর কথা মনে পড়ে যায়। “ “পদ্মার পাড়ে একা একা ঘুরার সময় আমিও তোদের খুব মিস করি। “ আমার আঙ্গুল আবার কি-বোর্ডে ঝড় তুলল, “পদ্মার পাড়ে মানে!? তুই দেশে? কবে ফিরলি?? কল দিসনি কেন???” প্রায় সাথে সাথে উত্তর এল,”দেশেতো আসি নি। বাবা একটা ভার্চুয়াল জগৎ সৃষ্টি করেছে, সেখানে মানুষের মেমরী পুরোপুরি স্ক্যান করে দেয়া যায়।
এতে সে জগতে ঐ মানুষের একটি কপি তৈরী হয়। এই সিস্টেমটার নাম হচ্ছে ‘প্রক্সিলাইফ’। আমি হচ্ছি প্রক্সি লাইফের প্রথম মানুষ। “ যে আগ্রহ নিয়ে চ্যাট শুরু করেছিলাম তা পুরোপুরি মরে গেল। আর চ্যাট করতে ইচ্ছে হচ্ছিল না, তাই মিথ্যে হলেও লিখলাম, “দোস্ত কাজ আছে, এখন উঠি।
পরে চ্যাট হবে ; বাই। “
রঙ্গনকে খুব মিস করি, বিশেষ করে চ্যাটে। ওর বাবা আদো কোন বিজ্ঞানী নন, তাই সায়েন্স ফিকসানের মধ্যমে ওকে বাঁচিয়ে রাখার চেস্টা করলাম। যদিও ও আমার সৃত্মিতে আজো অমর, আর থাকবেও তাই! যেখানেই থাকিস, ভাল থাকিস দোস্ত। (গল্পে ফিকসান অংশ ব্যাতিত সকল ঘটনা সত্য।
)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।