আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রক্সি সমাচার

জেগে, ঘুমিয়ে, আড্ডায়, গল্পে, প্রার্থনায়, কবিতায়, সিনেমায়- সবখানে শুধু স্বপ্ন দেখি। "প্রক্সি" শব্দটার সাথে আমার পরিচয় কলেজ জীবনে। স্কুলে নিতান্তই শান্ত-ভদ্র ছেলে ছিলাম। ক্লাস ফাঁকি দেওয়াতো দুরের কথা, না আসলে কেউ আমার হয়ে "প্রক্সি" দিবে তা চিন্তাতেই আসত না। ঝুম বৃষ্টি, রাস্তাঘাটে কেউ বের হয় নাই।

তারপরও দেখা যেত আমি এবং গুটিকয়েক বালক ঠিকই ক্লাস করতে হাজির । স্যাররা উপর দিয়ে আমাদের এমন সাহসিকতার প্রশংসা করলেও, আড়ালে-আবডালে নাকি আমাদের উপর তাদের অসন্তুষ্টির প্রকাশ করতেন । আমাদের জন্য যে তাদেরকে অন্তত টিফিন পিরিয়ড পর্যন্ত ক্লাস নেওয়া লাগত!! (এইজন্য বন্ধুদের কেউ কেউ আমাকে "আঁতেল" ও বলত !! ) যাই হোক, স্কুল পার হয়ে কলেজে আসলাম আর সাথে সাথে ফাঁকিবাজির দীক্ষাও নিলাম । সরকারী কলেজ (চট্টগ্রাম কলেজ), তাই প্রথমে চরম গা-ছাড়া ভাব। কলেজে উঠছি, বয়ঃসন্ধির উড়ু উড়ু মন , কেইবা ক্লাস করতে চায় !! কিন্তু ২মাস পড়েই ঘুড়ির সুতায় টান পড়ল।

প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় ফেল এবং সাথে সাথে DC (dis collegiate) !! অভিভাবকদের তলব করা হল। আমার আব্বাজানের সামনে আমাকে "shunting" দেওয়ার নামে স্যারেরা যে কী করল..... !! একেতো প্রথম ফেল করার অনুভূতি, তারওপর আবার বাসায় আব্বাজানের ঝাড়ি !! তাও হয়তো সহ্য করা যেত, কিন্তু যখন দেখলাম আমার চাইতেও ফাঁকিবাজ গুলা প্রক্সির গুণে ৯০% উপস্থিতি নিয়ে দাঁত কেলিয়ে ঘুরে বেড়াইতেছে, তখনই জীবনের প্রথম কঠিন সিদ্ধান্তটা নিলাম- আমাকে যে কোন উপায়ে "প্রক্সিবাজ" দের দলে নাম লেখাতে হবে । এবং এর ফলাফলও পেলাম নগদে। এরপর নূন্যতম ক্লাস না করেই আমি COLLEGIATE । ভালোয় ভালোয় কলেজজীবন পার করে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসলাম।

কিন্তু "ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে" । কিন্তু এবার "প্রক্সি" পেলো নতুন মাত্রা। শুধু ক্লাসেও না, আমরা এক একজন আমাদের বাপ-মা হিসেবেও প্রক্সি দিতে থাকলাম । এমনতর প্রক্সি দিতে যেয়ে কত যে মজার স্মৃতি জমা হইছে !! আজকে হঠাৎ সেসব ঘটনার পাহাড় ঘাটতে গিয়ে কিছু অবিস্মরণীয়/ কিংবদন্তীতুল্য ঘটনা মনে পড়ে গেলো। ঘটনা ১ : ক্লাসে দারুণ অনিয়মিত রফিক।

প্রতিদিন রাতে কার্ড খেলার পর ভোরে ঘুমিয়ে কেইবা সকাল সকাল ক্লাস করতে পারে !! তারউপর আবার একটা ইনকোর্সে নাম্বার পেলো অল্প। স্যারতো মহাক্ষ্যাপা রফিকের উপর। কয়েকদিন ধরে ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে খোজার পর একদিন ক্লাসে রফিকের ক্লান্ত-বিদ্ধস্ত বদনখানি দেখা গেল শেষ বেঞ্চে ঘুমন্ত অবস্থায় !! স্যার রাগে গর্জে উঠলেন : "এই ছেলে এটা কি ঘুমানোর জায়গা !!" রফিক তখনও ঘুমিয়ে । আশেপাশে তার সঙ্গী-সাথিরা অনেক কায়দা-কসরত করে তাকে ঘুম থেকে উঠালো। হঠাৎ গভীর ঘুম থেকে উঠে বেচারা তখন কিছুই বুঝে উঠতে পারতেছে না।

ঘুম থেকে উঠে ফ্যালফ্যাল করে সে স্যারের মুখের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। স্যারতো অগ্নিমূর্তি ধারণ করে তার সামনে এসে দাঁড়াল। বললেন, " এটা কি মগের মুল্লুক পেয়েছ নাকি !! ক্লাসও করবা না আবার ক্লাসে আসলে পড়ে পড়ে ঘুমাবা !! দেখি তোমার মোবাইলটা দাও, তোমার বাবার সাথে এখনই কথা বলব। " রফিক যথারীতি মাথা নিচু করে তার মোবাইল বের করে তার বাবাকে ফোন দিলো। বাবা ফোন ধরতেই তার হাত থেকে মোবাইলটা এক অর্থে কেড়েই নিলো স্যার।

স্যারঃ হ্যালো, আপনি কি রফিকের বাবা ?? বাবাঃ হ্যা। আপনি কে ?? স্যারঃ আমি রফিকের স্যার বলছি। আপনার ছেলেতো চরম ফাঁকিবাজ, নিয়মিত ক্লাস করে না। বাবাঃ বলেন কি !! স্যারঃ হ্যা, সত্যি বলছি। এমনিতেই সে ক্লাসে আসে না, আবার আসলেও শেষ বেঞ্চে বসে ঘুমায়।

শেষ ইনকোর্স পরীক্ষাটাতেও সে কম মার্কস পাইছে। বাবাঃ "কি বলেন !! হারামজাদাটা ঐখানে যেয়েও শুধরালো না !! আমি এত কষ্ট করে তাকে মাসে মাসে টাকা পাঠাই আর সে কিনা ঐ টাকা দিয়া মৌজ-মাস্তি করে !! আজকে থেকে ওরে টাকা পাঠানো বন্ধ !! ওরে আজকেই আমি ত্যাজ্যপুত্র করমু। ওর গুষ্ঠিটাই হইছে এমন...............আমার মাথার ঘাম পায়ে ফেলানো টাকা ওর মত কুলাঙ্গারের পিছনে ঢালার চাইতে ফকিররে দিয়া দেওয়াও ভালো .." এইবারতো স্যার নিজেই ঘামা শুরু করলেন। কই উনি কথা শুনাবেন, সেখানে এখন নিজেই পড়লেন ফাপড়ে !! স্যার বিব্রতমুখে একবার রফিকের মলিন মুখের দিকে তাকালেন। তারপর মোবাইলে- স্যারঃ না না, কি যে বলেন !! ত্যাজ্যপুত্র করবেন কেন !! ঢাকাতে নতুন আসলে অনেকেরই অনেক ধরনের সমস্যা হয়।

নতুন পরিবেশের সাথে মিলিয়ে চলতে গেলে ঝামেলায় পড়ে। টাকা পাঠানো বন্ধ করার দরকার নেই !! টাকা পাঠান নিয়মিত আর মাঝে মাঝে ছেলের একটু খোজখবর রাখিয়েন, এই আর কি !! বাবাঃ ঠিক আছে স্যার, আজকে আপনি বললেন দেখেই ঐ কুলাঙ্গারটা বেচে গেলো। আপনি ওরে একটু দেখে রাইখেন। (এই বলেই মোবাইল সংযোগ বিচ্ছিন্ন) স্যারের হাত থেকে মোবাইলটা ফেরত নিয়ে রফিক আবার তার সীটে বসে পড়ল। স্যারও তার ক্লাস নেওয়ার দিকে মনোযোগ দিলেন।

ঐদিকে রফিকের বাবা (!!) তখন হলের ক্যান্টিনে বসে রফিকের অনারে নাস্তা চিবুচ্ছে !! (আসল কাহিনী হল, রফিক আগে থেকেই আন্দাজ করতে পেরেছিলো যে এমন কিছু ঘটতে পারে। তাই সে তার সিনিয়র রুমমেটকে রাজী করিয়েছিলো "বাবা"র চরিত্রে কথা বলার জন্য !! বিনিময় হল "সকালের নাস্তা !!" ) ঘটনা ২ : এই ঘটনা ঘটছে আমার সাথেও । আমিও আবার আগের ঘটনার রফিকের মতই কিনা !! তবে পার্থক্য হচ্ছে, রফিক সারারাত কার্ড খেলে সকালে ঘুমিয়ে ক্লাস মিস করে, আর আমি সারারাত ঘুমিয়ে এবং সাথে সাথে সকালটাও ঘুমিয়ে পার করে ক্লাস মিস করি !! তো আমি এক স্যারের ক্লাসে যথারীতি টানা তিনদিন অনুপস্থিত । এবং ফলস্বরুপ উপস্থিতির খাতা থেকে আমার নাম কাটা গেল। নিয়ম হচ্ছে তিনদিন পর কেউ উপস্থিত হলে তার অভিভাবকের সাথে কথা বলার সাপেক্ষে স্যার খাতায় পুনরায় নাম তুলবেন।

সেটা কোন সমস্যা ছিলো না, কারণ আব্বা জোগাড় করা আসলে কোন ব্যাপারই না !! সমস্যা হল, স্যার ঐদিন কারও আব্বার সাথে কথা বলতে রাজী ছিলেন না। উনার একটাই কথা আমাদের মায়ের সাথে কথা বলবেন । আমিতো পড়লাম মহা ফাপড়ে। আব্বা না হয় সহজলভ্য, কিন্তু আম্মা কোথায় পাই !! শেষে ক্লাসের এক বান্ধবীকে রাজী করালাম "আম্মা"র ভুমিকায় অভিনয় করতে । প্ল্যান হচ্ছে আমার ডাক আসার আগেই ও চুপিসারে বের হয়ে যাবে ক্লাস থেকে এবং তারপর ফোন আসলে ধরে আমার আম্মা হিসেবে কথা বলবে।

তো মাহেন্দ্রক্ষণ এগিয়ে আসল। আমার আম্মা (!!) ক্লাস থেকে চুপিসারে বেরিয়ে গেলেন। কিন্তু বিধিবাম। আমার রোল আসার আগেই আরেকজনের সাথে স্যারের ঝামেলা লেগে গেল। স্যারতো ঐ ছেলেটারে ঝেড়েই যাইতেছে।

এদিকে আমার রোল আসার কোন খবর নাই। অনেকক্ষণ পর আমার রোল আসল। আমিও স্যারের সামনে যেয়ে হাসিমুখে বললাম, "স্যার, আমি অসুস্থ ছিলাম তাই আসতে পারি নি। " স্যারঃ দেখেতো মনে হয় না অসুস্থ ছিলা !! দেখি তোমার আম্মাকে ফোন দাও। (আমি হাসিমুখে ফোন বের করে।

) আমিঃ হ্যালো আম্মা !! ঐপাশ থেকেঃ (কিছুক্ষণ চুপ এবং এরপর একটা ফ্যাসফ্যাসে গলা কোনরকমে বলে উঠল) ইয়ে আমিতো খাইতেছি .......... (ফ্যাসফ্যাসে গলার রহস্য বুঝা গেল। উনি অপেক্ষা করতে করতে শেষমেষ আমার নামে ক্যান্টিনে যেয়ে খাওয়া শুরু করেছেন। মুখভর্তি খাবার নিয়ে উনি এখন আমার আম্মার ভুমিকায় কথা বলছেন !! ) এদিকে আমার অবস্থা কাহিল। এ অবস্থায় স্যারকে ফোন দিলে গাধীটা উলটাপালটা কি না কি বলে ফেলে !! আমি শুকনো মুখে স্যারকে বললাম: "স্যার, আমার মায়ের কয়েকদিন থেকেই জ্বর আর সর্দি-কাশি লেগে আছে। উনার কথা বুঝতে আপনার একটু সমস্যা হতে পারে।

" স্যারঃ তোমরা কি যে করনা !! অসুস্থ মাকেও শান্তিতে থাকতে দাও না। যাও উনার কথা বলা লাগবে না। পরবর্তীতে এমন টা যেন আর না হয় !! নিয়মিত ক্লাস করবে। আমিও বিগলিতভাবে বললাম: অবশ্যই স্যার। এখন থেকে আর একটা ক্লাসও মিস দিব না ।

(ঐদিন আসলেই বড় বাচা বেচে গিয়েছিলাম। ) ঘটনা ৩: এই ঘটনাটা আমার বন্ধুর বন্ধুর (!!) মুখ থেকে শোনা। সে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনার্স শেষ করেছে। সে যে কলেজে পড়ত সেখানে নাকি নিয়ম অনেক কড়া। কোন কারণে ডিসকলেজিয়েট হলে টেস্ট পরীক্ষা দিতে দেয় না।

আর টেস্ট না দিতে পারলেতো ফাইনালই মিস। তো তার এক বন্ধু (ধরি) সোহেল ডিসকলেজিয়েটদের কাতারে পরেছে টেস্টের আগে। অভিভাবক তলব করা হয়েছে। সেও তার এলাকার এক বড় ভাইকে ঠিক করেছে তার অভিভাবক হিসেবে। প্ল্যানমত সাক্ষাতকারের দিন সোহেল আর তার অভিভাবক (!!) হাজির হল কলেজে।

একজন একজন করে অভিভাবক বিভাগীয় প্রধানের রুমে ঢুকতেছে। ছাত্ররা উদ্বিগ্ন মুখে বাইরে অপেক্ষা করছে সাক্ষাতকারের ফলাফল জানার জন্য। সোহেলের অভিভাবকের ডাক আসায় ঐ বড় ভাই ঢুকলেন রুমে। যেহেতু স্যার আগে থেকেই "প্রক্সি অভিভাবক" সম্পর্কে অভিজ্ঞ ছিলেন তাই প্রথমেই অভিভাবক কি করেন, কোথায় থাকেন ইত্যাদি জিজ্ঞেস করে সত্যতার পরীক্ষা করে নিচ্ছিলেন। তো রুমে ঢুকার সাথে সাথেই স্যার জিজ্ঞেস করলেন,"আপনি কি সোহেলের অভিভাবক ??" অভিভাবক শুকনো গলায় বললেনঃ জী।

স্যারঃ কী করেন আপনি ?? অভিভাবকঃ জী স্যার, এই কলেজে মাস্টার্সে পড়ি !! (বেচারা স্যারের গম্ভীর চাহনি দেখে মুখ ফসকে সত্যটাই বলে ফেলেছে !! ) ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.