পরাঞ্জয়ী...
বিবস্ত্র অবস্থায় উঠে দাঁড়ালো জমির আলী। প্রখর রোদে খাঁ খাঁ করছে চারদিক। যেন কোন মরুভূমির বুকে দাঁড়িয়ে আছে সে। সূর্যটা মাথার মাত্র এক হাত উপরেই তাপ ছড়াচ্ছে তীব্র আকারে। ঘাড় ঘুরিয়ে একবার চারদিকে দেখে নিল জমির আলী।
আশেপাশের সবাইই বিবস্ত্র, নাঙ্গা। অথচ কারও দিকে কারোরই খেয়াল নেই। সবাই উদ্ভ্রান্তের মত ছুটাছুটি করছে। কি এক দিশেহারা আতঙ্কে দিক্বিদিক জ্ঞানশূন্য সবাই! জমির আলী কতকটা বিভ্রান্ত। কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না।
সামনেই একজনকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে সাদা ধবধবে পোশাকের কয়েকজন। তাদেরকে ঠিক মানুষ ভাবতেও বাঁধলো জমির আলীর। কেমন যেন অতি-প্রাকৃত গঠন-গাঠন তাদের। আর যাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সে তারস্বরে চিৎকার করছে আর বলছে "আমাকে আর একবার সুযোগ দাও, আর একটিবার পৃথিবীতে প্রেরণ কর, আমি সৎপথে সৎ জীবন যাপন করব"। কিন্তু কেউ তার কথায় কান দিচ্ছে বলে মনে হল না।
এবার জমির আলীর বিভ্রান্তি কিছু কাটলো। "তবে কি.........." মনে মনে ভাবলো সে। "তবে কি পূন:রুত্থানের দিন এটা?" ভয়ে ভুরু কুচকে গেল তার!
জমির আলীর ডাক পড়ল দৈব বাণীতে। সভয়ে এগিয়ে গেল সে আরশের দিকে। এবার স্পষ্ট আওয়াজে দৈববাণী শুনলো সে "তোমাকে বিনা বিচারে সবচেয় নিকৃষ্টতম নরকে প্রেরণ করা হবে, তুমি স্বেচ্ছায় অগ্রসর হবে নাকি তোমাকে আগুনের শেকল দিয়ে টেনে নিয়ে যেতে হবে?" ভয়ে থর থর করে কেঁপে উঠলো সে।
সভয়ে কাঁপা কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো " প্রভু,আমার আমল নামা কি আমি দেখতে পাবনা?জানতে পারব না আমার অপরাধ?" আবার দৈববাণী "কি জানতে চাও? তুমি এমনই পাপী এবং অভিশপ্ত যে তোমার একলার জন্যই একাত্তরটি আমলনামা ব্যবহার করতে হয়েছে। শিউরে উঠলো জমির আলী। বলার মত কোন ভাষায় যোগাচ্ছে না তার মুখে। আমতা আমতা করে বললো "কিন্তু প্রভু আমি তো ঈমানের সহিত পৃথিবীতে বসবাস করেছি, নামায পড়েছি,রোযা রেখেছি! " চুপ কর বেত্তমিজ!" আবার আরশ কাঁপানো ধমক "ঈমান???? কোথায় তোমার ঈমান? দেশপ্রেম ঈমানের একটি অঙ্গ। অথচ তুমি শোষকশ্রেনীর হয়ে সেই দেশের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছ।
কোথায় ছিল ঈমান যখন হাজার মানুষকে তোমারই সাহায্যে হত্যা করা হয়েছে, ধর্ষণ করা হয়েছে মাতৃরূপী নারীকে? নামায পড়ে অযু থাকা অবস্থাতেই তুমি অসংখ্য মানুষের হত্যার প্রত্যক্ষ সহযোগীতা করেছ, রোযা রাখা অবস্থায় অসংখ্য নারীকে তুলে দিয়েছ নররূপী পশুর হাতে!" জমির আলী সভয়ে বলে ওঠে "ওরা পাপীষ্ট বিধর্মী এবং কাফির ছিল প্রভু"! "আমি কি সেই বাণী তোমাদের কাছে পাঠাইনি যে যার যার ধর্ম তারা যেন স্বাধীন ভাবে পালন করতে পারে। কাফিরের শাস্তি দেবার জন্য আমি আছি, তুমি কে তার শাস্তি বিধানের?" জমির আলী এবার নিশ্চুপ। কিছুক্ষন চুপ করে থেকে সে বলে "প্রভু, আমি তো শাসক শ্রেণীর পক্ষে কাজ করেছি। নাগরিকত্বের মূল কথাই তো শাসকদের অনুগত থাকা। তাছাড়া সেটা ছিল একটা গৃহযুদ্ধ!" আবার আরশ কেঁপে ওঠে গগনবিদারী হুংকারে "শাসকের সংজ্ঞা জানো তুমি? অধীনস্ত জনগনের সকল প্রকার সুযোগ সুবিধা দেখা, তাদের স্বাধীন মত প্রকাশের অন্তরায় না হওয়া, সর্বোপরি তাদের অধিকার সমূহের নিশ্চয়তা প্রদানই শাসকের কাজ।
কিন্তু এর একটাও কি তোমার তথাকথিত শাসকরা করেছিল?তারা শাসক নয়, শোষক! রে পাপীষ্ঠ! তোর এত বড় ধৃষ্টতা যে তুই এখনও তাকে গৃহযুদ্ধ বলছিস?!""
বাঁচার কোন পথই খোলা নেই বুঝতে পারছিল জমির আলী। তাই শেষ চেষ্টা হিসেবে সে বললো "আমি পরবর্তীতে ইসলামী রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেছি, তার সভাপতিও ছিলাম। আমি ইসলামের স্বপক্ষে কাজ করেছি প্রভু!" দৈববাণী হল " না তোমরা ইসলামের স্বার্থে কোন দল প্রতিষ্ঠা করোনি, আমার সহজ সরল মানুষ গুলোকে বোকা বানানোর জন্য ইসলাম শব্দটি ব্যবহার করেছ। কোমলমতি কিশোর কিশোরীদের মগজ ধোলাই করে তাদের ব্যবহার করেছ নিজেদের প্রতিষ্ঠা আর ধন-সম্পদ প্রাপ্তির সিঁড়ি হিসেবে। ইসলামের পক্ষের চেয়ে নিজেদের দলে ভেড়াতেই বেশি সচেষ্ট ছিলে তোমরা।
আমি সকল জ্ঞানের অধিকারী এবং সর্বজ্ঞ জেনেও তুমি আমার কাছেও ছল চাতুরীর আশ্রয় নিতে দ্বধান্বিত নও। তাহলে আমার আশরাফুল মাখলুখেত সাথে না জানি কত ছলচাতুরি করেছ!!তোমার এক মাত্র শাস্তি অনন্তকালের নরকবাস!!" ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে চিৎকার করে উঠলো জমির আলী। তার মাথার ঘিলু টগবগ করে ফুটছে সূর্যের তাপে। তার হাতে পায়ে আগুলের শেকল পরানো হল। সেই তাপে তার নাড়ি-ভুঁড়ি ফুটতে শুরু করলো।
সে চিৎকার করছে "বাঁচাও বাঁচা, কেউ সাহায্য কর" তার অদূরেই দাঁড়িয়ে ছিল দুর্গা নামের সেই মেয়েটি যাকে তারই ইশারায় পাকিস্তানিরা ক্যাম্পে উঠিয়ে নিয়ে যায়। দূর্গা চিৎকার করেছিল সেইদিন" ও জমির ভাই আমারে বাঁচাও, আমার এমন সর্বনাশ কইরনা। আমি তুমার বইনের মত!" শোনেনি জমির আলী। মুখ বিকৃত করে বলেছিল "মর্ কাফের বাচ্চা"! দূর্গা আজ অট্ট হাসিতে ফেটে পড়লো। বললো "মর শালা কাফেরের বাচ্চা"!
শুক্কুর আলীর বাড়িতে যেদিন আর্মি নিয়ে রেইড করলো জমির আলী, শুক্কুরের বউ ধানের গোলার মধ্যে পালিয়ে ছিল, কোলে ছিল ১১ মাসের ছেলে।
ছেলে যাতে না কাঁদে তাই তার মুখে হাত চাপা দিয়ে রেখেছিল শুক্কুরের বউ। হাতের চাপে চিরদিনের মত কান্না থেমে যায় বাচ্চাটির। স্বর্গের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তাকে খেলতে দেখল জমির। বাচ্চাটি মুখ তুলে চেয়ে দেখলো একবার তারপর বললো "মর কাফেরের বাচ্চা!" এখনও বিরতিহীন চিৎকার করছে জমির আলী। ছটফট করছে নিজেকে মুক্ত করতে।
পারছে না। ..................................ধড়মড়িয়ে উঠলো জমির আলী। ঘামে বিছানা বালিশ তার শরীর সব ভিজে একাকার। এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল সে। স্বপ্ন দেখছিল বুঝেও ভয় কাটেনা তার।
মেয়ে তিনার মথা খুব মনে পড়ছে তার। তিনা বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার সময় বলেছিল "তোমার পাপ তোমার পিছু ছাড়বে না কোনদিন"! তবে কি.......................!! কপালে ভাঁজ পড়ে জমির আলীর।
মনে পড়ে ৭১'এর কথা। চোখের সামনে দেখতে পায় আঙ্গুল কেঁটে ফেলা রক্তাক্ত হাত নিয়ে জামাল শেখ, হায়েনার দাঁত আর নখের আঁচড় শরীরে নিয়ে অপমানে লজ্জায় নিজের শাড়িতে ঝুলে থাকা আমিরণের লাশ, প্রসব বেদনায় কাতরাতে থাকা বীণা দাস,কাকের ঠুকরে খাওয়া চেহারা নিয়ে নাম না জানা অসংখ্য মৃত দেহ, দেখতে পায় স্বাধীনতা পরবর্তি বিদ্ধস্ত বাংলাদেশ, পাকিস্তানি বীজ গর্ভে ধারণ করা কিছু অপমনিত নারী, ছেলেহারা মা, স্বামী হারা নববধূ। সবাই অসীম ঘৃণায় তাকিয়ে আছে জমির আলীর দিকে।
চিৎকার করে বলছে "মর্,মর্,মর্ কাফেরের বাচ্চা"। রাগে গর্জে ওঠে জমির আলী। বালিশের নীচে রাখা নিজের পিস্তলটা নিয়ে গুলি করে........ঠা ঠা ঠা ঠা..............
সংবাদ পত্রের শিরোনাম: কুখ্যাত রাজাকার এবং দেশদ্রোহী জমির আলীর আত্মহত্যা। উচ্ছসিত বাঙ্গালী!"
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।