আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

টাঙ্গাইলের বধ্যভূমি ও গণহত্যার ইতিহাসঃ ‘‘ আর্টিজেন বিলডিং-এর অন্ধকূপে অবস্থিত অজ্ঞাত বদ্ধভূমি ’’



১৯৭১ ! সারা দেশে মুক্তিকামী মানুষের স্বাধীনতার স্বপ্ন । স্বাধীনতা... স্বাধীনতা... স্বাধীনতা চাই । চাই মুক্ত পাখির মত উড়তে...। আর নয় বেনিয়া শাসকের জুলুম ; অত্যাচার ; নিপীড়ন । প্রায় দুইশত বছরের শাসন-শোষণের অবসানের জন্য বাঙালী জাতি মরিয়া হয়ে উঠে ।

এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম... এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম ! ২৫ মার্চ , ১৯৭১ ! সেদিন রাতে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার নির্দেশে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ইতিহাসের সবচেয়ে নির্মম ও জঘন্য হত্যাকান্ড চালায় । ২৬ মার্চ , ১৯৭১ চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষনা দেয়া হয় । তারপর সারা দেশে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ ! মুক্তিযুদ্ধে প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষ শহীদ হয় । টাঙ্গাইল জেলায়ও চলে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ । এখানেও ন’মাসের যুদ্ধে শহীদ হন অসংখ্য বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষ ! যেখানে মানুষকে ধরে এনে বধ করা হত সে স্থান কে বলা হয় বধ্যভূমি ।

টাঙ্গাইলেও রয়েছে বেশ কিছু বধ্যভূমি ও গণহত্যা কবলিত স্থান । ধারাবাহিকভাবে আমরা সেগুলো সম্পর্কে জানব । আজ জানব- পাকুটিয়া /আর্টিজেন বিলডিং-এ অবস্থিত বধ্যভূমির অজানা কিছু কথা । টাঙ্গাইল শহরের পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত প্যারাডাইস পাড়া ও কলেজ পাড়ার মধ্যবর্তী স্থানে পাকুটিয়া বিলডিংটির অবস্থান । এর বর্তমান নাম আর্টিজেন বিলডিং ।

এটি পাকুটিয়া জমিদারদের জমিদারীর একটি অংশ ছিল । পরে এটি বিক্রি হয়ে যায় অর্টিজেনদের কাছে । কথিত আছে এই বাড়ির ভেতরে একটি কূপ ছিল । জমিদারী আমলে কূপটি বাড়ির নানা কাজে ব্যবহৃত হত । ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে এই বাড়িটি ছিল বদর বাহিনীর ক্যাম্প ।

আল-বদর বাহিনীর লোকজন সদর্পে তাদের কার্যক্রম চালাত এই বাড়িটিতে বসে । যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তারা শহর এবং আশপাশ থেকে বিভিন্ন সময়ে স্থানীয় লোকজন কে ধরে এনে এখানে বন্দী করে রাখত । পরে তাদেরকে হত্যা করে সেই গভীর কূপে ফেলে দিত ! হাতুরি দিয়ে পিটিয়ে , গুলি করে , আবার কখনোবা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হত তাঁদেরকে ! এভাবে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বদর বাহিনীর সদস্যরা অসংখ্য সাধারণ মানুষকে ধরে এনে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে কূপে ফেলত ! আল-বদর বাহিনীর সেই নিষ্ঠুর , নির্বিচার হত্যাকান্ডের সাক্ষি হয়ে আছে বর্তমান আর্টিজেন বিলডিং-এর এই কূপ । কিন্তু ক’পটি তৎকালীন সময়ে ভরাট করে বন্ধ করে দেয়া হয় । যার ফলে এখন এটি আর বদ্ধভূমি হিসেবে পরিচিত নয় ।

ইতিহাসের সাক্ষি এই বদ্ধভূমিটি আজ মানুষ ভুলে গিয়েছে । বর্তমান প্রজন্মের কাছেও এটি অজানা । কিন্তু সেই সময়ের প্রত্যক্ষদর্শী কিছু সংখ্যক মানুষ আজও ভুলতে পারেনি পাকুটিয়া বিলডিং-এর অন্ধকূপের বদ্ধভূমি ! যেখানে ঘুমিয়ে আছে ’৭১-এ শহীদ হওয়া কোন পিতা , ভাই , বন্ধু... ! মাটি আর কংক্রিটে ভরাট হওয়া এই বদ্ধভূমিটি আজ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছে ! এখানে নেই কোন সংস্কার । সংস্কার হবে কিভাবে ! এটাতো মানুষের কাছে অজানা । এছাড়া তৎকালীন সরকারও কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি ।

এখানে নেই কোন স্মৃতিফলক । অতএব সংস্কার না হওয়াটা অসম্ভব কিছু নয় । ঘুমিয়ে থাকা ওই শহীদেরা কি ভাবছে আমাদের কে ? তাঁরা কি আমাদের ধীক্কার দিচ্ছে ? নাকি ধীক্কার দিতেও আমাদের প্রতি তাদের করুণা হয় !? ‘‘ হে শহীদ ! তোমরা আমাদের ক্ষমা কর । আমরা তোমাদের যোগ্য উত্তরসূরী হতে পারিনি ! আমরা রক্ষা করতে পারিনি তোমাদের রক্তের দান । শোধ করতে পারিনি তোমাদের ঋণ ! হ্যাঁ ! আমরা শুধু এই কথা বলেই বার বার পার পেয়ে যাই ।

কিন্তু কেন আমরা শহীদের মর্যাদা রক্ষা করতে পারিনি ? কেন রক্তের ঋণ শোধ করতে পারিনি ? ৩০ লক্ষ শহীদের প্রাণের বিনিময়ে আমরা যে দেশটিকে পেলাম কেন সেই দেশটিকে দুর্নিতীগ্রস্থ দেশে পরিণত করলাম? না...একটি স্মৃতিসৌধ তৈরী করা আর স্বাধীনতা / বিজয় দিবসে ফুল দেয়াটাই শহীদদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব পালন করা নয় । এটুকু করা মানেই কর্তব্য আর ভালোবাসা প্রকাশ করা নয় । আমরা যদি আমাদের দেশে যেটুকু সম্পদ আছে সেটুকু সততার সাথে সমবন্টন করতাম , দেশকে অর্থনৈতিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতাম তাহলেই এই ৩৯ বছরে শহীদের রক্তের ঋণ শোধ করার ধাপে আমরা কিছুটা এগিয়ে যেতে পারতাম !

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.