গত ২৭ তারিখের প্রায় সব দৈনিক পত্রিকায় সরকারের প্রস্তাবিত 'বংগবন্ধু সিটি এবং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর' এর জন্যে ঢাকার সন্নিকটে ভূমি অধিগ্রহনের বিরুদ্ধে এবং ঐ প্রস্তাবের পক্ষে ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কে সমাবেশ ও মানববন্ধনের খবর টি প্রকাশিত হয়েছে। ভূমি অধিগ্রহনে যারা ক্ষতিগ্রস্থ হবে বলে মনে করা হচ্ছে তারা যখন ভুমি অধিগ্রহন প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছিলেন তখন কিছু মানুষ এই প্রস্তাবিত প্রজেক্টের পক্ষে মানববন্ধন করেছেন। বিভিন্ন পত্রিকায় এই খবরটি গুরুত্বের সাথে প্রকাশিত হলেও, ইংরেজী পত্রিকা ডেইলি স্টার অনেকটাই বাস্তবিক তথ্য ও পরিসংখ্যান তুলে ধরেছেন বিভিন্নজনের বরাত দিয়ে। তাদের প্রকাশিত তথ্য থেকে দেখা যায়, প্রস্তাবিত 'বংগবন্ধু সিটি এবং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর' নামের এই প্রজেক্টের জন্যে ২৫,১০০ একর জমির দরকার পড়বে যার মধ্যে প্রায় ৪৪% জমি অধিগ্রহন করা হবে 'আড়িয়াল বিল' নামের বাংলাদেশের অন্যতম একটি বিশাল জলাভূমি থেকে যার পরিবেশগত এবং প্রাকৃতিক আবাসনজনিত মূল্যমান ছাড়াও একটি ঐতিহাসিক পরিচয় আছে। স্থানীয় একটি সমাজকর্মীর বরাত দিয়ে ডেইলি স্টারের ঐ প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায় ঐ বিল সংলগ্ন জমি থেকে বৎসরে প্রায় ৪০,০০০ টন চাল উৎপন্ন হয় এবং প্রস্তাবিত এলাকা সংলগ্ন প্রায় অর্ধ মিলিয়ন মানুষ তাদের আয়-রোজগারের জন্যে ঐ জলাভূমির উপর নির্ভরশীল যেখান থেকে মাছ সহ অন্যান্য জলজ সম্পদ আহরনের মাধ্যমে বছরে প্রায় ৭০০-৮০০ মিলিয়ন টাকা অর্জিত হয়।
সুতরাং এটা পরিস্কার যে প্রস্তাবিত মেগা প্রজেক্টের জন্যে যে স্থানটি নির্বাচিত করা হয়েছে তা মূলত প্রাথমিক উৎপাদন ব্যবস্থা বা সহজ কথায় কৃষি এবং মৎস্য শিকারের জন্যে। আমার এই লেখার উদ্দেশ্য হলো রিও ডিক্লারেশনের একজন স্বাক্ষর প্রদানকারী হবার পরও বাংলাদেশ সরকার কি বিবেচনায় টেকসই উন্নয়ন বা sustainable development কে পাশ কাটিয়ে এই ধরনের মেগা প্রজেক্টের প্রস্তাব করে তা নিয়ে আলোচনা করা। আমার মনে হয় কদাচিত কোন বিবেকবান মানুষ এই প্রজেক্টের পক্ষে কথা বলবে। ডেইলি স্টারের প্রকাশিত খবরটির নিচে পাঠকদের মন্তব্য থেকেও তা ফুটে উঠেছে।
প্রথমত, আমি আলোচনা করতে চাই এই উন্নয়ন প্রস্তাবনার উপযোগিতা নিয়ে।
ঢাকা শহরে আমাদের একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর আছে যার ৫০-৬০% ক্ষমতা বলতে গেলে অব্যবহৃত থেকে যায়, দেশের কিছু বিমানবন্দর (যেমনঃ সৈয়দপুর, রাজশাহী) আর আন্তর্জাতিক রুটে ব্যবহৃত হয়না, ঢাকা শহরের ভিতর কুর্মিটোলা বিমান বন্দর বলতে গেলে অব্যবহৃতই থেকে যায়। এই বিমানবন্দরগুলোর সীমাবদ্ধতা বা সমস্যাগুলো দূর করা বাদ দিয়ে হঠাত এতবড় বিমানবন্দরের কি দরকার পড়লো তা বোধগম্য হলোনা। যেহেতু বিমানবন্দরটির নামকরন করা হচ্ছে সরকারী দলের প্রতিষ্ঠাতা নেতার নামে তাতে এই বিশাল প্রজেক্টের পিছনে রাজনৈতিক প্রনোদনাটাই বেশি কাজ করছে বোঝা যায়। একটি গনতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থায় কিছু উচ্চ শিক্ষিত মানুষদের হাত থেকে এই ধরনের অবাস্তব প্রস্তাবনা আসা আসলেই অপ্রত্যাশিত। সরকার যদি সত্যিই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্যে নতুন ট্রানজিট পয়েন্ট বানাতে চান, তবে তার উচিত হবে সমুদ্রবন্দরগুলোর ব্যাপকভাবে উন্নয়ন করার দিকে মনোনিবেশ করা।
সমুদ্রপথ হিসেবে বাংলাদেশ সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরের অনন্য সম্ভাবনা থাকার পরও আমাদের সমুদ্রবন্দগুলো সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা এবং উন্নয়ন পরিকল্পনার অভাবে দেশের অর্থনীতিতে সেইভাবে ভূমিকা রাখতে পারছেনা। সিঙ্গাপুর আমাদের থেকে মাত্র ৬ বছর আগে স্বাধীন হলেও শুধু একটি বিমানবন্দর আর সমুদ্রবন্দর দিয়ে তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা চরমভাবে মজবুত করেছে।
দ্বিতীয়ত, সারা বিশ্ব যখন 'টেকসই উন্নয়ন' বা sustainable development এর পক্ষে জোরালো ভুমিকা পালন করছে, তখন একটি গ্রামীন পরিবেশ ধংস করে এই ধরনের মেগা প্রজেক্টের পরিকল্পনা একটি উলটো পথের যাত্রা। ১৯৯২ সালের ব্রাজিলের রিও ডি জেনারেশনে যে Rio Declaration on Environment and Development টি হয়েছিল, তাতে বাংলাদেশ একটি স্বাক্ষর প্রদানকারী দেশ হিসেবে ছিল। পাঠকদের সুবিধার জন্যে Rio Declaration এর মূল প্রস্তাবনাগুলি এখানে তুলে দিলাম-
• People are entitled to a healthy and productive life in harmony with nature.
• Development today must not threaten the needs of present and future generations.
• Nations have the right to exploit their own resources, but without causing environmental damage beyond their borders.
• Environmental protection shall constitute an integral part of the development process.
• Eradicating poverty and reducing disparities in living standards in different parts of the world are essential if we are to achieve sustainable development whilst meeting the needs of the majority of the people.
• Environmental issues are best handled with the participation of all concerned citizens.
• The polluter should, in principle, bear the cost of pollution.
• Sustainable development requires better scientific understanding of the problems. Nations should share knowledge and technologies to achieve the goal of sustainability.
এখানে সুস্পষ্টভাবে Sustainable development এর উপর জোর দেয়া হয়েছে অর্থ্যাত একইসাথে এবং সমভাবে সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং পরিবশগতভাবে উন্নয়ন নিশ্চিত করা।
কিন্ত, এই প্রজেক্ট বাস্তবায়িত হলে একটি বিশাল সংখ্যক মানুষ তাদের মূল পেশা থেকে নির্বাসিত হবে যা সামাজিক উন্নয়নের বিচ্যুতি, প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্যতা নষ্ঠ হবে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন যে হবে তার কোন সুষ্পষ্ট ধারনা অন্তত এখন পর্যন্ত নেই। এটাকে নিশ্চয় টেকসই উন্নয়ন বলা যাবেনা। সরকার যখন স্থানিক পরিবেশের প্রতি এইরকম অবিবেচকের মত আচরন করছে তখন উন্নত বিশ্ব থেকে বৈশ্বিক পরিবেশগত পরিবর্তনের ক্ষতিপূরন দাবী করার নৈতিক শক্তি কি রাখতে পারবে??
প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়, বি এন পি এর গত ১৯৯১-১৯৯৬ শাসনামলে বগুড়ায় একটি আঞ্চলিক বিমানবন্দর স্থাপনের পরিকল্পনা প্রনয়ন করে অনেকদূর কাজ এগিয়েও যায় কিন্তু পরবর্তিতে যখন বোঝা গেল যে এটা একটা লাভজনক কিছু হবেনা তখন যতটুকু উন্নয়ন হয়েছিল তা বিমান বাহিনীর জন্যে দিয়ে দেয়া হয়। একইভাবে, তারা ২০০১-২০০৬ শাসনামলে বগুড়ায় এশিয়ান উইমেন্স ইউনিভার্সিটি করতে চাইলেও, তার ভবিষ্যতের উপযোগিতা চিন্তা করে পরবর্তিতে সে পরিকল্পনা থেকে সরে এসে চট্টগ্রামে স্থাপন করার পরিকল্পনা নেয়।
যদিও বর্তমান সরকার 'বংগবন্ধু সিটি এবং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর' উন্নয়নের জন্যে ক্ষতিগ্রস্থদের ক্ষতিপূরন দেবার কথা ভালোভাবেই স্বীকার করেছে কিন্তু তাতে কি ওই মানুষগুলোর এতদিনের পেশার বা অবস্থার সাথে যে বসবাস তার অনুরুপ হবার নিশচয়তা কি দিতে পারবে!! তারা ক্ষতিপূরনের নগদ টাকা পেয়ে শহরে বিশেষত ঢাকা শহরে এসে অন্য পেশায় নিয়োজিত হবার চেষ্টা করবে তাতে কতখানি সফল হবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই।
একথা সত্য যে এই প্রকল্প পূর্ন বাস্তবায়িত হলে অনেকের কর্মসংস্থান হবে, কিন্তু বাংলাদেশে একটি প্রকল্প শুরু থেকে বাস্তবায়িত হওয়া পর্যন্ত যে সময়ক্ষেপন হয় সেইরকম সময়কালে এই বাস্তুচ্যুত লোকগুলো কি করবে সেটাও অনিশ্চিত। এই ক্ষতি গুলোকে বিবেচনা করে এবং বর্তমান বিমানবন্দরগুলোকে উন্নয়নের সম্ভাব্যতা যাচাই না করে এই ধরনের প্রকল্প নেয়া একটি বড় ধরনের অবাস্তব সিদ্ধান্ত এবং আনাড়িপনা। লোকমুখে শোনা যায়, এই মেগা প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ৫০০০ কোটি টাকা। আমাদের মত গরীব দেশের এই বিলাসিতা করার সুযোগ কই বোধগম্য হয়না।
রিও ডিক্লারেশনের আরেকটি অন্যতম প্রস্তাবনা ছিল- যে কোন উন্নয়ন প্রস্তাবনার পরিবেশগত সমীক্ষা বা Environmental Impact Assessment (EIA) চালানোর পর স্থান নির্বাচন করা।
কিন্তু ডেইলি স্টারের রিপোর্ট দেখে দেখা যায় এই প্রকল্পে EIA করার পরিকল্পনা করা হয়েছে ভূমি অধিগ্রহনের পরে এবং তা করা হবে যারা ওই প্রকল্পে বিনিয়োগ করবে। এই ধরনের কাজ অবাস্তবিক, বিভ্রান্তিকর এবং মোটের উপর শঠতা যা ঐ এলাকার মানুষের কারিগরি ব্যাপারে অজ্ঞতার কারনে করা হচ্ছে। এখানে যে ব্যাপারগুলো হতে পারে- এক, যদি EIA করে দেখা যায় যে নির্বাচিত জায়গা প্রস্তাবিত প্রকল্পের জন্যে সঠিক নয়, তাহলে অধিকৃত ভুমি কি ফিরে দেয়া হবে নাকি অন্য কি করা হবে!! দুই, যারা বিনিয়োগ করবেন তারা স্বভাবতই প্রকল্পটি হারাতে চাইবেন না সেক্ষেত্রে EIA এর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন অবশ্যি উঠবে।
একটি গনতান্ত্রিক সরকার উন্নয়নের এত বড় প্রকল্প হাতে নেবার আগে অবশ্যই বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিবে বলেই ধরে নেওয়া হয় যদি তারা সত্যি জনগনের ভালো-মন্দ নিয়ে চিন্তা করে। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে এই প্রকল্পের জন্যে কোন পরিকল্পনাবিদ, পরিবেশবিদ, ভূতত্ববিদ, প্রকৌশলী পেশাদার সংগঠনের পরামর্শ নেয়া হয়নি।
এই সরকার ইতিমধ্যে ঢাকার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নামকরনের জন্যে অযৌক্তিকভাবে বিশাল অংকের টাকা ব্যয় করেছে, এখন তার চেয়েও কয়েক গুন টাকা বেশি ব্যয় করে আরেকটি ‘unsustainable’ উন্নয়নের দিকে যাচ্ছে দেশের বিদ্যমান অনেক অনেক সমস্যার সমাধান না করা পূর্বক যা আসলেই সমর্থনযোগ্য নয়। সরকার যদি এই টাকা খরচ করে গভীর সমুদ্র বন্দর স্থাপন বা অন্য বন্দরগুলোর আধুনিকায়নের কথা চিন্তা করতো তা বরং আরো বেশি প্রশংসাযোগ্য হতো কারন তাতে সামাজিক ক্ষতি এতটা হতো না। কিন্তু শুধু নিজস্ব দলীয় রাজনৈতিক উচ্চাশার কারনে দেশের সম্পদের ক্ষতি করে এতবড় প্রকল্পের পরিকল্পনা করা আমাদের জন্যে দুর্ভাগ্যজনক এবং একইসাথে চরমভাবে অপ্রত্যাশিত।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।