আমি ভাল নই!
একথা সবাই মানেন যে, এসময়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন রাষ্ট্র পরিচালনায় সক্ষম নেতৃত্ব। রাষ্ট্রপরিচালনায় সরাসরি অংশগ্রহণ ও অবদান রাখেন রাজনীতিক, বেসামরিক প্রশাসন ও সামরিক ক্যাডারভূক্ত কর্মকর্তা ও কর্মচারী, টেকনিক্যাল বিশেষজ্ঞ (প্রকৌশলী, কৃষিবিদ, ডাক্তার, স্থপতি, পরিকল্পনাবিদ, শিল্পব্যবস্থাপক, ব্যবসা-এক্সিকিউটিভ, ব্যাংক বিশারদ, সমাজসেবী, একাউন্টেন্টস্, এনজিও ইত্যাদি), বুদ্ধিজীবি (শিক্ষক, আইনবিদ, সাংবাদিক, শিল্পী, লেখক-সাহিত্যিক, সংস্কৃতিসেবী, ক্রীড়াবিদ ইত্যাদি), শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, ব্যাংকার প্রমুখ পেশাজীবিগণ। এদের মধ্যে রাষ্ট্রপরিচালনায় সবার শীর্ষে থাকেন রাজনীতিকগণ। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে রাষ্ট্র পরিচালনায় নেতৃত্ব দেন। আর অন্যরা আসেন প্রযোগিতামূলক পরীক্ষায় যাচাই বাছাইয়ের মাধ্যমে।
সামরিক কর্মকর্তা তৈরী করতে হলে যেমন সামরিক একাডেমি, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় সহ আরো অনেক পেশাভিত্তিক প্রশিক্ষণের দরকার হয়। তেমনি বেসামরিক প্রশাসন ক্যাডার সার্ভিসের কর্মকর্তাদেরকেও বিপিএটিসি ও বিসিএস প্রশাসন একাডেমিতে, বিচার বিভাগের কর্মকর্তাদেরকে বিচার প্রশাসন ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে, ব্যাংকারদেরকে আইবিএম-এ, পুলিশ বিভাগের কর্মকর্তাদেরকে পুলিশ একাডেমি ও কলেজে, কূটনৈতিক ক্যাডারের কর্মকর্তাদেরকে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে, শিক্ষা প্রশাসকদেরকে নায়েম-এ (ন্যাশনাল একাডেমি ফর এডুকেশনাল ম্যানেজমেন্ট), পরিকল্পনাবিদদেরকে পরিকল্পনা ও উন্নয়ন একাডেমিতে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হয়। ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার, এনজিও, ব্যবসা-বানিজ্য ও শিল্পক্ষেত্রের এক্সিকিউটিভদের নিজ নিজ পেশায় নেতৃত্বদানে সক্ষম দক্ষ ও বিশেষজ্ঞ হতে হলে পেশাগত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হয়। মানসম্মত ও দক্ষ ক্রীড়াবিদ বা খেলোয়াড় এবং সঙ্গীত শিল্পী হতে হলেও দেশে ও বিদেশে উপযুক্ত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ নিতে হয়। বলাবাহুল্য, এদের সকলেরই কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে ন্যুনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকে।
অনুরূপ, রাজনৈতিক নেতাকর্মী তৈরী করতেও দলসমূহের মধ্যে বা বাইরে উপযুক্ত শিক্ষা ও প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা থাকা দরকার। যেহেতু তাঁরা দেশ পরিচালনা করেন, দেশের শ্রেণী, পেশা ও কর্মজীবি সহ সবার উপরে তাদের অবস্থান এবং তাদেরই সিদ্ধাšত ও কর্মের উপর দেশ, জাতি ও জনগণের কল্যান-অকল্যান নির্ভরশীল। কিন্তু রাজনৈতিক নেতা কর্মীদের জন্য দেশ চালাবার উপযোগী কোনোরূপ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা বাংলাদেশে নেই। যার ফলে, রাজনৈতিক ক্যাডার বা কর্মীদের সম্পর্কে জনগণের মনে ভীতি ও অশ্রদ্ধার মনোভাব দেখা যায়, যা দেশের জন্য অকল্যানকর।
আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতাকর্মীরা জনগণকে উদ্বুদ্ধ ও সংগঠিত করতে গিয়ে আত্মত্যাগী হয়েই বিদ্রোহী হয়েছেন, জীবন দিয়েছেন, দীপাšতর বা জেল খেটেছেন, অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করেছেন, প্রচলিত শিক্ষা পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন এবং পরিশেষে সফলতাও অর্জন করেছেন।
সেই পরিস্থিতিতে আন্দোলন ও সংগ্রামের পদ্ধতি ছিল এক কথায় বৈরী ও নেতিবাচক এবং তখন তা-ই ছিল সঠিক। কারণ অহিংস ও সহিংস সকল আন্দোলনেরই লক্ষ্য ছিল বিদেশী শাসক-শোষক বিতাড়ন ও স্বাধীনতা অর্জন। জনগণ সেসব নেতিবাচক ও সাংঘর্ষিক কর্মসূচী সানন্দে গ্রহণ করেন। ১৯৫২এর ভাষা আন্দোলন থেকে ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ পর্যšত সকল আন্দোলনের কর্মসূচীর সফল বা¯তবায়ন সেই সাক্ষ্যই বহন করে। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৭১ সনের ৭ই মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স মাঠে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে ঐতিহাসিক ভাষণ রেখেছিলেন তা পাকি¯তান ভাঙ্গার এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার সাক্ষ্যই বহন করে।
সেই ভাষণই মূলত সমগ্র জাতিকে চূড়াšত ভাবে স্বাধীনতার পক্ষে সুদৃঢ়ভাবে ঐক্যবদ্ধ করে। যার ফলে ২৫শে মার্চের ভয়াল রাত থেকে ১৫ই ডিসেম্বর পর্যšত পাকি¯তানি হানাদারদের ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ অগ্রাহ্য করেই জাতি ১৬ই ডিসেম্বরের বিজয়কে স্বাগত জানিয়েছে।
স্বাধীন জাতি রাষ্ট্র পরিচালনায়, নেতৃত্বের ধরন ও আন্দোলনের পদ্ধতি ভিন্ন রকম। পরিস্থিতি সাপেক্ষে এখানে প্রয়োগবাদী রাষ্ট্রনায়ক সুলভ নেতৃত্ব আর আন্দোলনের পদ্ধতি হতে হবে অবৈরী ও ইতিবাচক। স্বশিক্ষিত, প্রজ্ঞাবান, সৎ ও ত্যাগী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের প্রতি ভক্তিশ্রদ্ধা রেখেই উললেখ করছি, দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, বিগত কালে বাংলাদেশের রাষ্ট্র পরিচালনায় রাষ্ট্রনায়কসুলভ নেতৃত্বের অভাব প্রবলভাবে অনুভূত হয়েছে।
পুরনো স্টাইলের নেতৃত্ব ও আন্দোলন (হরতাল, অবরোধ, হিংসাত্মক ও ধ্বংসাত্মক কর্মসূচী) গণবিরোধী তথা আত্মঘাতী হয়েছে। জনগণও তা স্বতঃস্ফুর্তভাবে মেনে নেয়নি। ফলে, রাজনীতিকগণ বিদেশী উপনিবেশিক শাসক-শোষকদের মতই জনগণের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দুর্বৃত্তায়নের শিকার হয়েছেন এবং অভ্যন্তরীন উপনিবেশ কায়েম রেখেছেন।
একটি স্বাধীন জনগনতান্ত্রিক দেশের উপযুক্ত নেতৃত্ব গঠনে প্রচেষ্টা নেয়া না হলে, বাংলাদেশের উন্নতির স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে। বিদেশী পুঁজি ও উদ্যোক্তা আমদানীর মত হয়তো তখন দেশ-শাসক আমদানী করেই দেশ চালাতে হবে।
তাই, সময় ও পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্র পরিচালনায় যে সব রাজনৈতিক দল ও গ্রুপ এবং নেতাকর্মী আত্মনিয়োগ করবেন, তাঁদের জন্য প্রচলিত শিক্ষার পরেও রাষ্ট্র পরিচালনা বিষয়ক তত্ত্ব, তথ্য, জ্ঞান ও ব্যবহারিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। এ বিষয়টি নিয়ে স্বশিক্ষিতি, প্রজ্ঞাবান সৎ ও ত্যাগী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকেই উদ্যোগী হতে হবে। সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় আইন বিধি প্রনয়ন সহ সহযোগিতামূলক মনোভাব ও কর্মপরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
নেতৃত্বের সংকট নিয়ে প্রচুর আলোচনা সমালোচনা হলেও সংকট মোচনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার কোনো চিন্তা ও পরিকল্পনা রাজনৈতিক দলসমূহের আছে কি না জানি না। তবে বিভিন্ন দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করলে আশানুরূপ নেতৃত্বসুলভ আচরনের লক্ষণ খুঁজে পাওয়া যায় না।
আজকের দিনে যে কোন ব্যক্তি বা দলকে সততা, নিষ্ঠা ও ত্যাগের পাশাপাশি দেশের খাদ্য, বস্ত্র, আশ্রয়, চিকিৎসা, শিক্ষা, ভূমি, কৃষি, শিল্প প্রভৃতি সমস্যা সম্ভাবনা ও সমাধান ; গ্রাম ও শহরÑনগর, রাজনীতি-অর্থনীতি-সমাজনীতি, আইন নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা, মানবসম্পদ, পানি ও সামুদ্রিক সম্পদ, খনিজ, বনজ ও প্রাকৃতিক সম্পদ, ব্যবসা বানিজ্য, পররাষ্ট্র, আঞ্চলিক ও আšতর্জাতিক বিষয়াদি, দুর্যোগ ও ত্রান, সাহিত্য সংস্কৃতি ইতিহাস ও ঐতিহ্য, তথ্যপ্রযুক্তি, প্রকৌশল বিজ্ঞান ও কম্পিউটার, নীতি ,ধম ওর্ দর্শন, নেতৃত্বের গুণাবলী প্রভৃতি সম্পর্কে মৌলিক ধারনা, প্রয়োগিক জ্ঞান, সম্যক উপলব্ধি এবং যে কোন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের প্রজ্ঞা অর্জনের মাধ্যমেই তবে রাজনীতিতে থাকতে হবে। তার জন্য সরকারী উদ্যোগে রাজনৈতিক কর্মিদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যব¯থা বা প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা প্রয়োজন।
সনাতনি প্রথায় কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গতানুগতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে, আর সিনিয়র নেতা বা কর্মীর শিষ্য বা ভক্ত হয়ে স্বাক্ষী গোপাল স্বরূপ নেতাকর্মী হওয়ার পুরনো ধ্যান-ধারনা ও রীতি এখন অচল। মনে রাখতে হবে, রাজনীতিতে ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্ক দ্বান্দ্বিক বা যৌক্তিক। আবেগ ভক্তি করুনা স্নেøহ মায়া মমতা এসব আদব কায়দা বা নম্র আচরণ হিসেবে গণ্য হতে পারে এবং তার প্রয়োজনও আছে কিন্তু তা দিয়ে রাজনৈতিক মেধা ও প্রজ্ঞার বিকাশ হয় না।
‘ক ভাই যেখানে আমরা আছি সেখানে’ জিগির বা শ্লোগানধর্মী রাজনীতির খোলস ও বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে এসে ‘ক’ ভাইয়ের সঙ্গে যুক্তি তর্কে ঐক্যমতে এসেই তবে রাজনীতি করতে হবে। কেবলমাত্র উপযুক্ত রাজনৈতিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমেই পারেন নেতা-কর্মীরা নিজেদের বিজ্ঞান মনষ্ক ও যুক্তিনির্ভর করে গড়ে তুলতে এবং চিন্তা-চেতনায় জ্ঞানে-প্রজ্ঞায় আত্মনির্ভরশীল হয়ে রাষ্ট্র পরিচালনায় নেতৃত ¡দানে সক্ষম হতে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।