দিল ঠান্ডা তো দুনিয়া ঠান্ডা।
এটি ফিজিকস্ অভ দ্য ইমপসিবল: এ সায়েন্টিফিক এক্সপ্লোরেশন ইনটু দ্য ওয়ার্লড অভ ফেজার, ফোর্স ফিল্ড, টেলিপোর্টেশন এন্ড টাইম ট্রাভেল। বই এর অনুদিত দ্বিতীয় অংশ। প্রথম অংশ এখানে ক্লিক করুন।
“অসম্ভব” জিনিসটা আপেক্ষিক।
একজন পদার্থবিদ হিসেবে আমার অভিজ্ঞতা বলে, অসম্ভব জিনিসটা অনেক সময়ই আপেক্ষিক। বড় হয়ে উঠছি, এরকম একটা সময়ে একদিন আমার ভুগোল শিক্ষিকা ক্লাসে এসে পৃথিবীর ম্যাপ দেয়ালে ঝুলিয়ে দেখালেন, উত্তর আমেরিকার ও আফ্রিকার তীরভুমি। দেখোতো, তিনি বললেন, এই দুটোকে দেখে মনে হয়না, এদেরকে ঠিক একভাবে জোড়া লাগানো যাবে জিগস্ পাজল এর মত? বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানী ভাবেন, অনেকটা আগে এই দুটো আলাদা অংশ একটি বিশাল দানবীয় মহাদেশের অংশ ছিল। পরে তারা কোন ভাবে ভাগ হয়ে সরে যায়। এরপরে তিনি হেসে জানান, এটা বোকার মত কথা।
পৃথিবীতে এমন কোন শক্তি থাকতে পারে না যেটা এতটাই শক্তিশালী যে দুটো মহাদেশকে সম্পুর্ন ভাবে ঠেলে সড়িয়ে দেবে। এটা অসম্ভব।
এর পরের বছর আমাদের পড়তে হল ডায়নোসরদের নিয়ে। আমাদের শিক্ষক বললেন, শুনতে অবিশ্বাস্য লাগে না, এই বিশাল প্রানীগুলো একসময় পৃথিবীতে রাজত্ব করে গেছে, লক্ষ লক্ষ বছর ধরে? তারপর একদিন হঠাৎই অদৃশ্য হয়ে গেছে। কেউ জানে না কিভাবে তারা ধ্বংস হয়ে গেছে।
তবে অনেকে বলেন, আকাশ থেকে বিশাল বড় এক উল্কা এসে পৃথিবীতে পড়েছিল, তারই ফলে তারা শেষ হয়ে গেছে। এটা কি সম্ভব? আকাশ থেকে এতবড় উল্কার কথা ভাবাই যায় না। এগুলো শুধু বিজ্ঞানের কাল্পনিক কাহিনীতেই পাওয়া যায়।
এখন আমরা জানি, টেকটোনিকস প্লেট এর মাধ্যমে মহাদেশগুলো নড়ে চড়ে বেড়ায় আর ৬.৫ কোটি বছর আগে একটি দানবীয় আকারের উল্কা, যার ব্যাস ছিল ছয় মাইলেরও বেশি, পৃথিবীতে আঘাত করে শুধু ডায়নোসর না, সেই সময়ের পৃথিবীর বেশিরভাগ প্রানই ধ্বংস করেছে অথবা তাদের টিকে থাকার পরিবেশ নষ্ট করে দিয়েছে। আমার এই সংক্ষিপ্ত জীবনে আমি এমন অনেক ”অসম্ভব” কে বৈজ্ঞানিক ভাবে প্রমানিত সত্য সম্ভব হয়ে উঠতে দেখেছি বারে বারে।
তাহলে এটা কি সত্যিই অসম্ভব যে টেলিপোর্টেশন ব্যবহার করে আমরা একদিন এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় যেতে পারবো নিমেষের মধ্যে? এমন এক মহাকাশ বানানো কি সত্যিই অসম্ভব যেটা আলোর থেকেও বেশি গতিতে আমাদের নিয়ে যাবে অন্য কোন সুর্যের আলোয়?
সাধারণভাবে এইসব চিন্তাকে অসম্ভব হিসেবেই দেখবেন এখনকার বিজ্ঞানীরা। এমনও তো হতে পারে, এই সব প্রযুক্তি বাস্তব হযে উঠবে আগামী কয়েক শত বছরে? অথবা পরের দশ হাজার বছরে? যখন মানব সভ্যতা আর বেশি উন্নত হয়ে উঠবে, জ্ঞান ও প্রযুক্তি হবে আরও সুক্ষ্ণ ও অসম্ভব রকমের দক্ষ? কে জানে হয়ত কয়েক লক্ষ বছেরে? কে বলতে পারে?
এটাকে আর একভাবে চিন্তা করা যেতে পারে, যদি আমরা কোন ভাবে এমন একটি উন্নত সভ্যতার সামনে পড়ে যাই, যাদের বিজ্ঞান আমাদের থেকে লক্ষ বছর উন্নত, কি হবে তখন? তাদের নিত্যদিনের সাধারণ জ্ঞান ও প্রযুক্তি আমাদের কাছে জাদুর মত মনে হবে। এই প্রশ্নটিই এই বইয়ের সবখানে ছড়িয়ে আছে। আজ যেটা অসম্ভব, সেটা কাল তো সম্ভবও হয়ে উঠতে পারে। আজ যেটা অসম্ভব, সেটা কি হাজার কিংবা লক্ষ বছর পরের প্রযুক্তিতেও অসম্ভব হয়ে থাকবে?
গত এক শতকে বিজ্ঞানে যে পরিমানে উন্নতি হয়েছে, বিশেষ করে কোয়ান্টাম ত্ব্বত্ত্ব ও সাধারণ আপেক্ষিকতার উদ্ভব ও উন্নয়নের ফলে আমরা একটা সাধারণ ধারনা করতে পারি, যদি সম্ভব হয়, কোন সময়ে এই ধরনের অসম্ভবগুলো সম্ভব হয়ে উঠবার সম্ভাবনা আছে।
আরও সব উন্নত ত্বত্ত্ব যেমন স্ট্রিং ত্বত্ত্ব এসে অনেক ধারনারই পরিবর্তন ঘটাচ্ছে। অনেক বিজ্ঞান কল্পগল্পে থাকা সম্ভাবনাকে এখন আবারও নতুন করে বিচার করে দেখা হচ্ছে। সমান্তরাল মহাবিশ্ব ও সময় পরিভ্রমনকে এখন সম্ভব হতে পারে সম্ভাবনার মধ্যে ফেলা হচ্ছে যেটা কিছুদিন আগেও অসম্ভব বলে গন্য হয়েছে বিজ্ঞানীদের দ্বারা। একবার চিন্তা করে দেখুন, মাত্র ১৫০ বছর আগেও এই ব্যপারগুলোকে সম্পুর্ন অসম্ভব অবাস্তব বলে ঘোষনা করা হয়েছিল সেগুলোর অনেকগুলোই এখন শুধু বাস্তবই নয়, দৈনন্দিন বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে।
জুলভার্ণ ১৮৬৩ সালে একটি কল্পগল্প লেখেন।
নাম ”প্যারিস ইন টোয়েন্টিনথ সেন্চুরী”। বইটি প্রকাশিত হয়নি কোন কারণে, তালাবন্ধ ছিল এতগুলো বছর। এরপরে পান্ডুলিপিটা তার নাতি আবিস্কার করে এবং তা প্রকাশ করা হয় ১৯৯৪ সালে। বইটিতে জুলভার্ণ দেখিয়েছিলেন ১৯৬০ সালের প্যারিস কিরকম হতে পারে। তার এই উপন্যাসটি এতরকম উন্নত প্রযুক্তিতে ভরা ছিল, যে কেউ সেই সময়ে একে অসম্ভব বলে রায় দিতেন নির্দ্বিধায়।
এতে ছিল ফ্যাক্স মেশিন, সারা পৃথিবী জুড়ে ছড়ানো এক যোগাযোগ ব্যবস্থা, কাচের তৈরি বিশাল সব শততলা দালান, গ্যাস দ্বারা চালিত গাড়ি এবং উচ্চগতিসম্পন্য শুন্যে ভাসমান ট্রেন এর কথা।
কিভাবে তিনি এই ভবিষ্যৎবানীগুলো করেছিলেন? তিনি তা পেরেছিলেন কারণ তিনি বিজ্ঞানের জগতে বাস করতেন। তার সঙ্গী সাথীরা ছিল সময়ের বড় বড় বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদ। তাদের কাছ থেকে তিনি জানতে পারতেন বিজ্ঞানের কোথায় কি ঘটছে, কোন সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে। এর সাথে যুক্ত হত বিজ্ঞানের মৌলিক বিষয়ে তার গভীর জ্ঞান।
এই সবটুকু এক করে, তিনি তার কল্পনার ট্রেনটিকে ছুটিযে দিতেন দিক-দিগন্তে। তিনি যেহেতু বিজ্ঞান কল্প কাহিনী লিখতেন, বাস্তবতা কিংবা তৎকালীন বৈজ্ঞানিক বিধি নিষেধ তার চিন্তার লাগামকে টেনে ধরতে পারতো না। এরই মাধ্যমে তিনি লিখে গেছেন একের পর এক সফল বিজ্ঞান কল্পকাহিনী, যেগুলোর অনেকটাই এখন সত্য।
দুঃখজনক হলেও সত্য, তার সময়ের অনেক প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানী তার চিন্তাধারার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। তারা ঘোষনা দিয়ে দিয়েছিলেন, এধরনের প্রযুক্তি সম্পুর্নই অসম্ভব।
লর্ড কেলভিন, সম্ভবত তার সময়ের শ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক *তাকে স্যার আইজ্যাক নিউটনের পাশে ওয়েস্ট মিনিস্টার এ্যাবিতে কবর দেয়া হয়েছিল* ঘোষনা দিয়েছিলেন, বাতাসের চেয়ে ভারী কোন বস্তুর পক্ষে আকাশে ভেসে বেড়ানো সম্ভব না। এক্স-রে নিয়ে যেটা দেখানো হচ্ছে তা সম্পুর্ন ভুয়া। আর রেডিও? তার তো কোন ভবিষ্যৎই নেই।
লর্ড র্যাদারফোর্ড, অনুর নিউক্লিয়াস আবিস্কারক, তিনি স্পষ্ট করে বলেছিলেন, এটা ব্যবহার করে নিউক্লিয়ার বোমা বানানো স্রেফ গল্পকথা। সেই সময়ের রসায়নবিদরা জোড়ালভাবে মানতেন, তথাকথিত পরশপাথর, যেটা দিয়ে কিনা লোহাকে সোনায় বদলে ফেলা যায়, বৈজ্ঞানিক ভাবে অসম্ভব একটি কাজ।
এখনকার এটম স্ম্যাশার দিযে আমরা সীসার অনুকে সোনার অনুতে বদলে দিতে পারি। একবার চিন্তা করে দেখুন, বর্তমান যুগের টেলিভিশন, কম্পিউটার এবং ইন্টারনেট সেই সময়ে কেমন অসম্ভব শোনাতো।
এইতো, অল্পকিছুদিন আগেও, কৃষ্ণগহ্বরকে কল্পকাহিনী বলে মানা হতো। আইনস্টাইন নিজেই ১৯৩৯ সালে একটি গবেষনাপত্র লিখে গেছেন যাতে স্পষ্ট করে প্রমাণ করা আছে, কৃষ্ণগহ্বর তৈরি হওয়া আদৌ সম্ভব না। তারপরেও আজ আমরা হাবল টেলিস্কোপ এবং চন্দ্র এক্স-রে টেলিস্কোপ ব্যবহার করে প্রমান করতে পেরেছি, আমাদের আশেপাশে কাছে দুরে হাজারো কৃষ্ণগহ্বর এর অস্তিত্ব আছে।
যেকারণে এই প্রযুক্তিগুলোকে অসম্ভব বলে রায় দেয়া হয়েছিল তার কারণ খুব সরল, এই প্রযুক্তিগুলোর পেছনে যে বিজ্ঞান কাজ করছে, তা সেই সময়ে অজানা ছিল। সেই সময়ের বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের পূর্নতার অভাব, বিশেষ করে আনবিক পর্যায়ে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান না থাকার কারণে তাদের কাছে যে বিষয়গুলো অসম্ভব মনে হয়েছিল, এতে অবাক হবার কিছু নেই।
চলবে
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।