যে অসম্প্রদায়িক এবং উদারপন্থি চরিত্র সহস্র বছর ধরে বাঙ্গালী ধারন করে এসেছে তা পাকিস্তান - চেতনার বিপরীতধর্মী বলেই ১৯৪৭ সাল থেকেই তার বিরুদ্ধতা করে আসছিল পাকিস্তান। জাতি চেতনা তথা জাতীয় বিকাশের প্রশ্ন থেকেই মূলত মুক্তিযুদ্ধের সূত্রপাত ঘটে। মুক্তিযুদ্ধের পরে মৌলবাদী শক্তি তার পরাজয়কে একটি কৌশলগত পশ্চাদাপসরণ বলে ধরে নিয়ে এক নতুন আঙ্গিকে নিজেদেরকে বিন্যস্ত করে। নতুন প্রজন্মের দিকে দৃষ্টি রেখে মানুষের সহজাত ধর্মবিশ্বাসকে ব্যবহার করে প্রাত্যহিক জীবন যাত্রার সমস্যাবলী তথা ভাগ্যোন্নয়নের নিত্যদিনের সংগ্রামের ভিতরে উগ্র এবং মৌলবাদী চিন্তাধারা সংযুক্ত করে বাঙ্গালিয়ানা মুছে ফেলার এক নীল নকশা প্রণয়ন করে তারা। এর জন্য হাজার হাজার কোটি টাকার পুঁজি বিনিয়োগ ছাড়াও তারা নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার করে মৌলবাদী ভাবধারায় মগজধোলাইয়ের একটি বিশাল Network গড়ে তোলে।
এর ফলে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনা সমাজ জীবন থেকে ক্রমশ অপসৃত হতে থাকে। তাই ২০০৫ সাল পর্যন্ত আমরা দেখি যে ১৯৭১ সালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের রাষ্ট্রীয় ভাবে বিচার করার কোন উদ্যোগই নেয়া হয়নি। অপরাধ থেকে অব্যাহতি পেয়ে যাওয়ার একটি সংস্কৃতিও রাষ্ট্র তথা সমাজ জীবনে শিকড় গেড়ে বসে।
১৯৮১ সালে জাতিসংঘের মানবাধিকার ঘোষণায় বলা হয়, মানবজাতির ইতিহাসে খুব কম সময়ের মধ্যে বেশি মানুষ হত্যা করা হয় ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে। বাংলাদেশে অবস্থানরত ৯০ হাজার পাকিস্তানি সৈন্যের পক্ষে মাত্র ৯ মাসের যুদ্ধে এ গণহত্যা সম্ভবপর হতোনা, যদি তাদের এদেশীয় দোসররা সহযোগিতা না করত।
বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার করার জন্য বাংলাদেশ সরকার International Crimes (Tribunal) Act 1973 পাশ করলেও প্রধানতঃ ১৯৭৫ এ বঙ্গবন্ধু হত্যা ও তারপর জিয়াউর রহমান তথা এরশাদের স্বৈরশাসনের কারণে পরবর্তী সময়ে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়নি। কিন্তু থেমে থাকেনি বিচারের দাবি। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গোলাম আযমের প্রতিকী বিচার এবং তারপর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীতে বিভিন্ন সংগঠনের মঞ্চ থেকে এই দাবী তোলা অব্যাহত থাকে। সরকার ২০১০ সালে যুদ্ধাপরাধের বিচার করার জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। গত ২০১৩ সালের ২১ জানুয়ারী তারিখে ট্রাইবুনাল মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে এবং ২০১৩ সালের ৫ মার্চ তারিখে কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়।
আজ যখন মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবাধিকার বিরোধী কর্মকাণ্ডের বিচার শুরু হয়েছে তখন দেশী-বিদেশী মহল বিশেষ থেকে প্রচার করা হচ্ছে চলমান বিচার অস্বচ্ছ এবং ত্রুটিপূর্ণ। অথচ সব মানদণ্ডেই প্রকৃত ঘটনা তার বিপরীত।
(ক) ট্রাইব্যুনালের ঢালাওভাবে সমালোচনা
পৃথিবীর সকল যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের গঠন এবং বিচার প্রক্রিয়া নিয়েই সবসময় ঢালাওভাবে সমালোচনা করা হয়েছে। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালও এই সমালোচনার বাইরে ছিলনা। বিচার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর ধুয়া তোলা হয় যে, ট্রাইবুনালের বিচার কার্যক্রম স্বচ্ছ নয়।
কারণ, এই ট্রাইব্যুনালের আইনে স্বচ্ছ বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক মান রক্ষিত হয়নি। যদিও বিচার প্রক্রিয়ার আন্তর্জাতিক মান রক্ষার জন্য যেসব সূচক ব্যবহার করা হয় তার সবই এই আইনে অন্তর্ভুক্ত আছে। যেমন -
# অপরাধী যে ভাষা বোঝে সেই ভাষায় সমস্ত তথ্য প্রদান করার নিশ্চয়তা
# আসামী পক্ষকে যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের জন্য যথেষ্ট সময় ও তার পছন্দমত আইনজীবীর সাথে যোগাযোগের অধিকার প্রদান
# বিচারের সময় অভিযুক্তের উপস্থিতি এবং তার আইনজীবী না থাকলে রাষ্ট্রকর্তৃক তার পক্ষে আইনজীবী নিয়োগ প্রদান উভয় পক্ষকে সাক্ষ্য গ্রহণের সমান সুযোগ প্রদান, আসামীকে পরে আপীল করার সুযোগ প্রদান
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রসঙ্গে অন্যতম সমালোচনা করা হয় অভিযুক্তদের বিচারপূর্ব আটককে কেন্দ্র করে। বিষয়টি Amnesty International এবং Human Rights Watch সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাও সমালোচনা করেছে। অথচ অভিযুক্তদের অন্য ফৌজদারী মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছিল এবং আটকের এক মাসের মধ্যে অভিযুক্তদের মানবতাবিরোধী অপরাধে গ্রেফতার দেখানো হয়।
বিশ্বের অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধের ট্রাইবুনালের ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, জাতিসংঘের সমর্থনপ্রাপ্ত কম্বোডিয়ার খেমারুজ ট্রাইব্যুনালে প্রথম আসামীকে বিচার শুরুর ৮ বছর আগে আটক করা হয়েছিল। রুয়ান্ডা ট্রাইব্যুনালে ২ জন অভিযুক্তকে বিচারের মুখোমুখি হওয়ার আগে ১৬ বছর আটক রাখা হয়। এই ট্রাইব্যুনালে ১৫ জন অভিযুক্তকে রায় ঘোষণার আগে ১০ বছরেরও বেশি সময় আটক রাখা হয়। এমনকি আন্তর্জাতিক অপরাধের স্থায়ী আদালতেও প্রথম আসামীকে রায় প্রাপ্তির পূর্বে ৭ বছর আটক থাকতে হয়েছিল। সমালোচনায় আরও বলা হয়ে থাকে যে, সরকার রাজনৈতিক কারণে অভিযুক্তদের শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য বার বার আইন সংশোধন করছে।
এ্যামনেষ্টি ইন্টারন্যাশনালও একই কথা বলেছেন অথচ যুগোস্লোভিয়া ট্রাইব্যুনালের আইন ৪৬ বার সংশোধন করা হয়েছিল।
(খ) রায় পরবর্তী জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের উদ্বেগ:
আবুল কালাম আজাদ এবং কাদের মোল্লার রায় ঘোষণার পর UN Special Rapporteur on Extra Judicial, Summary or Arbitrary Executions এবং UN Special Rapporteur on the Independence of Judges and Lawyers উদ্বেগ প্রকাশ করে যে, বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রক্রিয়ায় -
# মৃত্যুদণ্ড চাপিয়ে দেয়ার সম্ভাবনা আছে।
# বিচার প্রক্রিয়া স্বচ্ছ না।
# প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই ট্রাইব্যুনাল বিতর্কিত।
(গ) UN Special Rapporteur দের উদ্বেগের বিপরীতে বাস্তব চিত্র :
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আবুল কালাম আজাদ পলাতক থাকায় তার অনুপস্থিতিতে বিচার হয়।
তার পক্ষে রাষ্ট্র নিজ খরচে আইনজীবী নিয়োগ দেয়। কিন্তু আজাদের পরিবার রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবীকে সামান্যতম সহযোগিতা করেননি। এ কারণে আবুল কালাম আজাদ অনেকটা undefended অবস্থায় থেকে যায় এবং জেরার মাধ্যমে তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রমাণের Contradiction তৈরি হয়নি। স্বাভাবিক কারনেই তার বিরুদ্ধে prosecution এর আনা অভিযোগ প্রমাণ হয়ে যায়। ট্রাইব্যুনাল ঐ সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে তাকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয়।
এখানে মৃত্যুদণ্ড চাপিয়ে দেয়ার সুযোগ নেই।
স্বচ্ছ বিচার প্রক্রিয়া সংক্রান্ত আন্তর্জাতিকভাবে যে সকল মানদণ্ড বিবেচনা করা হয়, তার সব কিছু এই ট্রাইব্যুনাল আইনে নিশ্চিত করা হয়েছে যা এই লেখার শুরুতে উল্লেখ করা হয়েছে। তাছাড়া ট্রাইব্যুনালের প্রতিটি কার্যক্রম অভিযুক্তদের আইনজীবীরা নিয়মিত অংশ গ্রহণ করেছে। ট্রাইব্যুনালের অস্বচ্ছতার অভিযোগ এনে প্রতিটি কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করা চরম স্ববিরোধীতা। তাছাড়া ট্রাইব্যুনালের প্রতিটি সাক্ষ্য প্রমাণ একই সাথে বিচারক, অভিযুক্ত স্বয়ং, তার আইনজীবী এবং প্রসিকিউশনের আইনজীবীদের সামনে Computer এর মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়।
সকল প্রকার মিডিয়ার সামনে প্রকাশ্যে ট্রাইব্যুনালের জামিন শুনানী, অভিযোগ গঠন, সাক্ষ্য প্রমাণসহ সকল প্রকার কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে থাকে এবং সকল মিডিয়া তা প্রকাশ করে। বাংলাদেশের প্রচলিত বিচার ব্যবস্থায় পুলিশ হেফাজতে নির্জন কক্ষে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। অথচ মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদেরকে তার পরিবর্তে সরকারী সেফহোমে তার আইনজীবীদের উপস্থিতিতে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই অভিযুক্তরা দাবী করে আসছে যে, ট্রাইব্যুনালের গঠন এবং বিচারক নিয়োগ পদ্ধতি বিতর্কিত। দু'টি বিষয় নিয়েই অভিযুক্তরা উচ্চ আদালতের দারস্থ হলে তা খারিজ তারপরও অদ্ভূতভাবে অভিযুক্ত পক্ষ প্রতিনিয়ত ট্রাইব্যুনালকে বিতর্কিত বলার পাশাপাশি ট্রাইব্যুনালের সকল কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেছে।
এক মুহূর্তের জন্যও ট্রাইব্যুনাল বর্জন করেনি।
International Crimes (Tribunal) Act 1973 একিট Domestic Law এই আইনের অধীনে অভিযুক্তকে জামিন দেয়ার বিধান না থাকায় দেলওয়ার হোসেন সাইদীর জামিনের আবেদন খারিজ করে দেয়া হয়। শুধুমাত্র বাংলাদেশের এই আইনেই নয়, বিশ্বের অন্যান্য মানবতাবিরোধী ট্রাইব্যুনালের আইনেও জামিনের কোনো বিধান ছিল না। এছাড়া বাংলাদেশের ট্রাইব্যুনাল আইনে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ আছে যে বিচারকের পরিবর্তনের সময় মামলার কার্যক্রম যেখানে শেষ হয়েছিল, নতুন বিচারক যোগদান করার পর ঠিক সেখান থেকেই কার্যক্রম শুরু হবে। এক্ষেত্রে কাদের মোল্লার মামলার পুনঃবিচার করার কোনো সুযোগ ছিল না।
এছাড়াও বাংলাদেশ নিশ্চয় গৌরবান্বিত বোধ করতে পারে যে বাংলাদেশের এই ট্রাইব্যুনাল বিশ্বের ইতিহাসে প্রথমবারের মত ধর্ষণকে গণহত্যা হিসাবে গন্য করেছে - যে দৃষ্টান্ত এর পরে গঠিত বিশ্বের অন্যান্য সকল ট্রাইব্যুনালের অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে।
বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের বাজেট কাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত ধরা হয়েছে ১.৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। কিন্তু হেগের স্থায়ী আন্তর্জাতিক অপরাধের আদালতের বর্তমান বার্ষিক বাজেট ১৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। প্রথম দশ বছরে এ আদালতে ৮০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ হলেও বিচার হয়েছে মাত্র ১জন আসামীর। এ পর্যন্ত যুগস্লোভিয়া এবং রুয়ান্ডার প্রতিটি ট্রাইব্যুনালে খরচ হয়েছে ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
সিয়েরালিয়ন এবং কম্বোডিয়ার খেমাররুজ ট্রাইব্যুনালের ব্যয় প্রতি বছর ৩০-৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এসব ট্রাইব্যুনালের গড়পরতা আসামীর জন্য খরচ ১৫-২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
জাতিসংঘের দু'জন বিশেষজ্ঞ, ক্রিষ্টফ হেইনস্ ও গ্যাব্রিয়েলা কনাউল যারা জাতিসংঘের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং বিচারক ও আইনজীবীদের স্বাধীনতা সংক্রান্ত বিষয়ক বিশেষ প্রতিবেদক বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক আইন আদালত কর্তৃক আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের ফাঁসির আদেশের বিরুদ্ধে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এরা আরও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যে অন্যান্য অভিযুক্তরাও মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন। এরা একদিকে বলছেন যে এ বিচার প্রক্রিয়ার গুরুত্ব বিবেচনা করে এবং মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার সম্ভাবনা থাকার কারণে এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে ট্রাইব্যুনাল যেন ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে।
তারা আরও বলেছেন মৃত্যুদণ্ড তখনই দেওয়া যায় যখন জাতিসংঘের নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সংক্রান্ত যে চুক্তি রয়েছে এবং বাংলাদেশ যার একটি অংশগ্রহণকারী রাষ্ট্র, তার নিয়মনীতি মেনে অভিযুক্তদের জন্য সবরকম নিরাপত্তা বজায় রাখা হয়।
তাঁরাও অভিযুক্ত এবং তাদের শুভানুধ্যায়ীরা ট্রাইব্যুনালের নিরপেক্ষতা নিয়ে যে প্রশ্ন সামনে এনেছেন তাঁদের এই অভিযোগ ভিত্তিহীন। তারা বলেছেন যে তারা জানতে পেরেছেন এই আদালতে অভিযুক্তদের ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে এবং তাদের জন্য অত্যন্ত বৈরী পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে। অথচ বিপরীতটাই সত্য। স্বাক্ষীসহ সংশ্লিষ্টদের ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে, এই অভিযোগ আছে।
তাছাড়া নানা ছুতা-নাতায় আদালতের কাজ বিলম্বিত করছেন। ট্রাইব্যুনালের বিচারক ও আইনজীবীরা নির্বাহী বিভাগ থেকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছেন না। তাদের বক্তব্যে একথারও প্রতিধ্বনি পাওয়া গেছে যে প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই ট্রাইব্যুনালটি প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। যদিও ট্রাইব্যুনালের খসড়া প্রণয়নের সঙ্গে বিশেষভাবে যুক্ত ছিলেন জার্মানীর দু'জন আইনজীবী যাঁরা Nuremburg Trial এর খসড়াও প্রণয়ন করেছেন।
প্রশ্ন তোলা যায় বাংলাদেশের ২০০৪ সাল থেকে বাংলাদেশে যে সকল বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং গুমের মত অপরাধ সংঘটিত হয়ে এসেছে যার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানবাধিকার কর্মীরা শত ঝুঁকি নিয়েও প্রতিবাদ জানিয়েছে, এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, তখন কিন্তু জাতিসংঘের এই বিশেষজ্ঞরা কোনো সাড়া দেন নাই, এমনকি কোনো বিবৃতিও দেন নাই।
আজকে যারা '৭১ এ মানবতাবিরোধী অপরাধে বিচারাধীন বাংলাদেশের মুক্তিকামী, মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের মানুষের কাছে তারা দোষী বলে চিহ্নিত এবং নৈতিকভাবে দোষী বলে প্রমাণিত। তাদের জন্য জাতিসংঘের প্রতিবেদকদের এই উদ্বেগ প্রকাশ একটু অসংগত এবং দৃষ্টিকটু হয়ে যায় না কি? এবং ৭১ এর যারা ভুক্তভোগী, যাদের মা, বাবা, ভাই, বোন, বন্ধু, স্বজন, প্রতিবেশী এদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হয়েছেন, এদের নৃশংসতায় যাদের জীবন ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে, যারা অপমানের চরম প্রান্তে, নির্যাতনের চরম প্রান্তে দাঁড়িয়ে শুধুমাত্র প্রাণটুকু নিয়ে নিজের ভিটামাটি ছেড়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন, আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন মানবেতর পরিবেশে তাদের পক্ষে এরা সেদিন কখনো কি কিছু বলেছেন? কিছুই না। তার প্রমাণ 'ষাটজনের সাক্ষ্য' (Testimony of Sixty) যেটা প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭১ সালের ২১ অক্টোবর এবং যাতে বলা হয়েছিল হত্যা, ধর্ষণ, লুট, অগ্নিসংযোগের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের শিকার হয়ে প্রাণ দিতে হয়েছে বাংলাদেশের ত্রিশ লক্ষ মানুষকে, পঙ্গু হতে হয়েছে শত শত মানুষকে, হতে হয়েছে নিঃস্ব, সর্বহারা, নির্যাতিত ও ধর্ষিত হয়েছেন দুই লক্ষ নারী। উল্লেখ্য যে সেই সময়ে, সেই মাসেই জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ অধিবেশনরত ছিল। মাদার তেরেসার নেতৃত্বে ষাটজন মানবতাবাদী মানুষ ভারতে শরনার্থী শিবির আর বাংলাদেশে পাকহানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর, আল শামস্ এর তান্ডবলীলা অবলোকন করে অঙ্ফ্যাম এর তদানীন্তন পরিচালক প্রণীত সেই সাক্ষ্যে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন সেই সব বিশ্ব সম্প্রদায়ের, যারা তখন পর্যন্ত কোনো রকম প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেননি, তাদের প্রতি আহ্বান করেছিল এই বলে 'এখনই অধিবেশনরত জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ অবিলম্বে পাঁচ সদস্যের একটি নির্বাহী দল মহাসচিবের নেতৃত্বে নিয়োগ দিক, যার ক্ষমতা থাকবে ভারত ও পাকিস্তানে (অর্থাৎ বাংলাদেশ, বিশ্ব সমাজ তখনও যে দেশকে পাকিস্তানের অঞ্চল মনে করত) জরুরি তহবিল বরাদ্দ করা, ত্রাণ কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য তহবিলের নিশ্চয়তা বিধান করা।
' জাতিসংঘ কিন্তু সে সময় তা করেনি।
আজকে তাহলে মানবতাবিরোধী অপরাধে যারা অভিযুক্ত শুধুমাত্র তাদের বাঁচাতে এত আকুতি কেন ? ' ৭১ এর এই হত্যাকারীরা ৪১ বছর ধরে শুধুমাত্র যে আইনের উর্ধ্বে থেকে গেছে তা নয় তারা দাপটে বাংলাদেশে রাষ্ট্র, সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করেছে এবং নিজেদের শক্তিশালী করেছে। এখন বাংলাদেশের আইনস্বীকৃত সর্বোচ্চ শাস্তি থেকেও তারা রক্ষা পেলে- এই বিষয়টি বাংলাদেশের জনগণ কোন বিবেকে মেনে নেবে?
কৌশলগতভাবে মানুষ প্রতিটি ঘটনায় হয় নীরব থাকতে অথবা সরব হতে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ৭১ এর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের নায়কদের আইনের উর্ধ্বে থাকার ব্যাপারে সম্পূর্ণ নীরবতা এবং এখন তাদের রক্ষার জন্য এত সরব হওয়া বাংলাদেশের মানুষের কাছে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা কতখানি অটুট রাখবে?
###
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।