আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মুহম্মদ মতিউর রহমান : তাঁকে অভিবাদন -খালিদ সাইফ



০.১ তাঁকে নিয়ে এভাবে কখনও ভাবা হয়নি। অথচ সেভাবেও ভেবেছেন কেউ কেউ; হ্যাঁ, তরুণদের মধ্যে থেকেই। তাদের কারো কারো কাছ থেকে জানা গেলে, সাহিত্য-চিন্তায় বিজাতীয় ভাবনা যখনই অাঁধার নামিয়ে এনেছে তখন তিনি তৌহিদবাদী চিন্তার আলোয় দেখিয়েছেন পথ। বিভ্রান্তি দূর হয়েছে, কেটে গেছে কৃষ্ণপক্ষের দীর্ঘ সময়। তাঁর সম্পর্কে যখন মেধাবীদের কেউ কেউ অকপটে খুলে বলেছে এসব কথা, তখন মূল্যায়নের পালাবদল না ঘটে যায় কোথায়।

এদেশে পরিশ্রুত ও পবিত্র সাহিত্য-সাংস্কৃতিক বাতাবরণ নির্মাণে একটি একটি করে ইট গেঁথে গড়ে তুলেছেন সুরম্য গৃহ। যে কাজেই হাত দিয়েছেন অনেক ভাবনা-চিন্তার পরই সেদিকে এগিয়ে গেছেন। আবেগের বশে সম্ভবত জীবনে কোনো কাজই করেননি-সাহিত্য তো নয়-ই। বরং সাহিত্যের জন্য তাঁর ভালোবাসা দেখে সত্যিই অবাক হতে হয়। একনিষ্ঠ সাধকের মতো তিনি কাজ করে গেছেন বিরামহীন।

কোনো বাধাকে কখনও মনে স্থান দেননি; প্রতিবন্ধকতার জঞ্জাল ঠেলে এগিয়ে গেছেন সম্মুখপানে। সারাজীবন স্থৈর্যের সঙ্গে আলো জ্বেলেছেন; সীমাবদ্ধতার অসীমতায় ধৈর্যচ্যুত হননি, আগামীর পরিব্রাজকদের জন্য মজবুত করে ঢেলে দিলেন ভিতরে কাঠামো। এই হলেন অধ্যাপক মুহম্মদ মতিউর রহমান। ০.২ সাহিত্য নিয়ে প্রথম যৌবনে কেমন মত্ত ছিলেন সে কথা বলতে পারবেন তাঁর ঐ সময়কার বন্ধু ও নিকট-জনরা। আর দীর্ঘ প্রবাস জীবনে যে তুলনাহীন সাংগঠনিক প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন সেটার দৃষ্টান্তও খুবই কম।

বাংলাদেশের অনেক কবি-লেখককে তিনি দুবাইতে নিয়ে গিয়ে পুরস্কার দিয়েছেন এ ইতিহাসও সবার জানা। কিন্তু আমরা জানি না কতখানি সাহিত্যমনা তিনি, কিংবা জানলেও সেটার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হই। পরবর্তীতে তিনি যখন দেশে ফিরে আসলেন তখন তরুণদের সঙ্গে সখ্য গড়ে উঠল। তাঁকে জানা-বোঝার অনেক সুযোগ তৈরি হলো। বোঝা গেল সাহিত্য-শিল্প-সংস্কৃতির প্রতি দরদ রক্ত-মাংসের সঙ্গে মিশে গেছে।

এই সাহিত্যপ্রেমই বিজয়ী করবে মুহম্মদ মতিউর রহমানকে। দেশে ফিরে আসার পর, আমাদের মনে হয়েছে, মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করেছেন কেবল সাহিত্যের দিকে, সংস্কৃতির প্রতি। দেশে আসার পর যদি আরও দশজনের মতো মনে করতেন যে টাকা উপার্জনের জন্য বাকি জীবনটাও ব্যয় করবেন, তাহলে কেউ তাঁকে নিষেধ করত না। কিন্তু মতিউর রহমান সাহেব সেদিকে পা বাড়াননি, তিনি জ্ঞান ও সৃষ্টিশীলতার প্রয়োজনকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। তার ব্যক্তিত্বকে বোঝার জন্য বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

দেশে ফিরে বিভিন্ন সাহিত্য সভায় তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। আমাদের বেড়ে উঠাটা শুরু হয়েছে উনাদের মতো গুরুজনদের হাত ধরেই। বিভিন্ন সাহিত্য আসরে তাঁর বক্তৃতা শুনে শুনে বেড়েছে সাহিত্য রুচি। সত্যি কথা তাঁর ভাবনার অনেক বিষয়ই তিনি তরুণদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন। আজ এতোদিন পর মনে হচ্ছে তাঁর কথাগুলো আসলে খুবই মূল্যবান ছিল।

তিনি সচেতন করেছেন বলেই অনেক তরুণ তাদের সাহিত্য চর্চার সঙ্গে ঈমানের জারককে মেশাতে পেরেছেন। অবশ্য শুধু তিনিই নন, আরও অনেকেই আমাদের মধ্যে রোপণ করে দিয়েছেন ঈমানের চারাগাছ। না হলে হয়ত-বা বল্গাহীন জীবনের স্রোতধারায় ভেসে যেত অনেক উদীয়মান সাহিত্য প্রতিভা। ০.৩ বল্গাহীন জীবনের যে স্রোতধারার কথা একটু আগে বলা হয়েছে, অনেক পাঠকের কাছে সে বিষয় অপরিচিত মনে হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের সমাজ-সংস্কৃতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ থাকলে তা না বোঝার কোনো কারণ নেই।

বাংলাদেশের মানুষ অত্যন্ত ধর্মভীরু ও সহজ-সরল। এ দেশের মানুষের এ সরলতার সুযোগ নিয়েই সাম্রাজ্যবাদী ও আধিপত্যবাদী শক্তি মানুষকে নিধর্মীকরণ করতে চায়। কারণ তারা মনে করে, তৌহিদি চেতনাই এ জনগণকে দিয়েছে একটি স্বতন্ত্র সংস্কৃতি ও আলাদা জীবনবোধ। সেই একেশ্বরবাদী চেতনাকে যদি গণমানুষের মন-মস্তিষ্ক থেকে সরিয়ে ফেলা যায়, তাহলে তাদের সবদিক দিয়ে পরাজিত করা কঠিন কোনো কাজ নয়। সেই নিধর্মীকরণ প্রকল্পের অস্ত্র রূপে দাঁড় করানো হয়েছে গণমাধ্যম ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাকে।

সারা পবিশ্বব্যাপীই সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যবাদী শক্তি তার এজেন্ডাকে বাস্তবায়ন করার জন্য কাজে লাগায় গণমাধ্যম ও সুযোগ সন্ধানী সংস্কৃতি কর্মীকে। পত্র-পত্রিকা ও রেডিও টেলিভিশনের মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য লাগাতার তারা অপপ্রচারের বান করতে থাকে। নানাভাবে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করে ধর্মহীন করা হয় এবং সেখান থেকে বেরিয়ে আসে ভোগসর্বস্ব ও দুনিয়ালোলুপ একটি শ্রেণী। মুসলিম দেশগুলোতে এ ধরনের এজেন্ডার বাস্তবায়ন খুব সাফল্যের সঙ্গে অব্যাহত রয়েছে এবং দেশগুলোর স্বকীয়-স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যকে চুড়মার করে ফেলা হচ্ছে। বুঝে না বুঝেই একশ্রেণীর মানুষ এ প্রচারণায় অগ্রসেনার ভূমিকা পালন করছে।

আধিপত্যবাদী সাংস্কৃতিক যুদ্ধে শিক্ষিত শ্রেণীই সহজে ঘায়েল হয়ে পড়ে। কারণ শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে তাদের একেবারে হীনমন্য করে ফেলা হয়। সাথে তথ্য সন্ত্রাসের নীল বান তো থাকেই। এভাবে চতুর্মুখী আক্রমণ চালিয়ে একটি জাতির সাংস্কৃতিক স্বকীয়তাকে ভেঙে চুরমার করে দেয়া হয়। আর যখন তার নিজস্ব সংস্কৃতি থাকে না তখন আসলে কোনো পরিচয়ই অবশিষ্ট থাকে না।

সেই সময় আর তাকে সেনাবাহিনী দিয়ে পরাজিত করার প্রয়োজন হয় না। এমনিই তার কপালে লেখা হয়ে যায় পরাজয়ের চিহ্ন। পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের মতো বাংলাদেশেও আধিপত্যবাদী ও সম্প্রসারণবাদী শক্তি বলয়ের আওতামুক্ত নয়। সাংস্কৃতিকভাবে এ জাতিকে পরাজিত করার লক্ষ্যে প্রতিনিয়ত অাঁটা হচ্ছে নতুন নতুন ষড়যন্ত্র। তাই এই আগ্রাসী ষড়যন্ত্রকে মোকাবিলা করার জন্য থাকতে হবে দূরদর্শী পরিকল্পনা।

সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে রুখে দেয়ার জন্য গড়ে তুলতে হবে অজস্র কবি, শিল্পী, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার। সিনেমা পরিচালক, গীতিকার ও সংবাদপত্রকর্মী। অধ্যাপক মুহম্মদ মতিউর রহমান এ ধরনের ব্যক্তিদের পৃষ্ঠপোষকতার জন্যই সারাজীবন কাজ করে গেছেন। সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদী কর্মকৌশলের বিপরীতে একেশ্বরবাদী সংস্কৃতি চর্চা ও লেখনী চর্চার মাধ্যমে তিনি আসলে সম্প্রসারণবাদেরই মোকাবিলা করেছেন। এই তাঁর ভূমিকা কখনও বিস্মৃত হবার নয়।

০.৪ তাঁর সাথে আমাদের প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে বাংলা সাহিত্য পরিষদের একটি সাহিত্য সভায়। আজ বোঝা যাচ্ছে কেন বিভিন্ন সাহিত্য অনুষ্ঠানে তিনি এত উৎসাহের সঙ্গে যোগ দিতেন। সাহিত্যের একজন ছাত্র হিসেবেও এ বিষয়টি তাঁর কাছে পরিষ্কার ছিল যে সাহিত্য ও আদর্শ প্রচারের এক গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হতে পারে। তাছাড়া বাংলা সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য লেখকদের উদ্দেশ্যহীন সাহিত্যচর্চা ও শিল্প সৃষ্টি তাকে তৃপ্ত করতে পারেনি। তাছাড়া শিল্পের জন্য শিল্প তত্ত্ব তাঁর মতো একজন সদর্থক চিন্তার অধিকারী মানুষের সমর্থন করার কথা নয়।

শেষ পর্যন্ত তিনি বাংলা সাহিত্য ও বিশ্বসাহিত্যের মধ্যে ভোগের প্রতি পক্ষপাতিত্ব ছাড়া আর কিছু দেখেননি। তাই তাঁর নিজ সমাজের সংস্কৃতি ও মূল্যবোধকে তিনি লেখার বিষয় করেছেন। মূলত প্রাবন্ধিক ও সমালোচক হিসেবেই সমধিক পরিচিত তিনি। প্রবন্ধ যে চিন্তাকে ধারণ করে সম্প্রসারিত হয়েছে সেটার মূল বক্তব্য এক। অর্থাৎ যে জীবনবোধে তাঁর বিশ্বাস সেই ইসলামই সাহিত্যচিন্তার প্রতিটি স্তরকে প্রভাবিত করেছে।

আসলে তিনি মনে করেছেন ঐ উৎস মূল থেকে প্রেরণা না নিলে সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিরোধই গড়ে তোলা সম্ভব হবে না। ফলে তাঁর প্রবন্ধের ভাষা অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন, স্ববিরোধিতা সেখানে একেবারে অনুপস্থিত। আজ থেকে প্রায় বার বছর আগে কবি নাঈম মাহমুদের সঙ্গে যাওয়া হয়েছিল তাঁর মীরপুরের প্রাসাদোপম সমকালিক নির্মাণশৈলী সমৃদ্ধ বাড়িতে। তিনি তখন নতুনই দীর্ঘ প্রবাস জীবন শেষ করে দেশে ফিরেছেন। আমাদেরকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখিয়েছেন তাঁর বাড়ি।

সবচেয়ে ভালো লেগেছিল লেখা ও পড়ার ঘর, তিনি খুব আনন্দের সঙ্গেই দেখিয়েছিলেন এই কক্ষটি। তখন আমাদের মনে হয়েছিল সব মানববাদী ও আখিরাতমুখী লেখকের যেন এমন একটি করে লেখাপড়ার কক্ষ হয়। তবু সেদিন তাঁর সেই বাড়ি-গাড়ি ও অর্থনৈতিক সচ্ছলতা দেখে আমরা খুশি হতে পারিনি। তখন কেবলই মনে হয়েছে, এই সচ্ছলতার বিনিময়ে আমরা হারিয়েছি বাংলা সাহিত্যের একজন শক্তিশালী প্রাবন্ধিককে। প্রবাসকালীন জীবনে তিনি যে লেখা জোখা একেবারে ছেড়ে দিয়েছিলেন মোটেও তা নয়, কিন্তু বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে তাঁর একটি বড় ধরনের বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়েছিল।

পরবর্তীতে সেই বিচ্ছিন্নতা কাটিয়ে উঠতে তাঁর আরও অনেক দিন সময় লেগেছে। প্রবাস বাসের বছরগুলিতে তিনি যদি দেশেই থাকতেন তাহলে হয়ত আমরা তাঁর কাছ থেকে আরও বেশি সুন্দর লেখা পেতে পারতাম। তবে এ নিয়ে হা-হুতাশ করে লাভ নেই; যার যতটুকু দেবার তিনি ততটুকুই আসলে দেবেন। ০.৫ একটা সময় পাড়ি দিয়ে অধ্যাপক মুহম্মদ মতিউর রহমান হয়ে উঠেছেন অনুপ্রেরণার কেন্দ্রবিন্দু। বর্তমানে সাহিত্যের জন্য একটি জীবন ব্যয় করা দুর্বল মানুষের পক্ষে আর সম্ভব নয়।

অত্যন্ত সাহসের সঙ্গে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজ করেছেন, লেখালেখির পাশাপাশি গড়ে তুলেছেন সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সংগঠন ও ফাউন্ডেশন। এ ক্ষেত্রে ফররুখ একাডেমির কথা উল্লেখ করা যায়। ফররুখ একাডেমি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি সময়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ দাবি পূরণ করেছেন। আসলে ফররুখের সামনে তুলে ধরা দরকার। অধ্যাপক সাহেব এই গুরুত্ব উপলব্ধি থেকেই প্রতিষ্ঠানিক ফররুখ চর্চার একটি ক্ষেত্র প্রস্তুত করলেন।

এভাবে সাহিত্য-সংস্কৃতির জন্য কাজ করে করে তিনি নিজেই পরিণত হয়েছেন একটি প্রতিষ্ঠানে। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস অজস্র লেখা ও সেই লেখাগুলোর মাঝে যে চিন্তা স্বকীয় দ্যুতি নিয়ে বিরাজমান, সে-চিন্তার কোনো ক্ষয় নেই। মুহম্মদ মতিউর রহমান যে সাহিত্য সৃষ্টি করেন এবং যে সংস্কৃতির পরিপুষ্টি চেয়েছেন তা যে আগামীতে গণমানুষের সমর্থন লাভ করবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সাহিত্য রচনা করে সুস্থ ধারার সাহিত্য-সংস্কৃতি নির্মাণে তিনি যে ভূমিকা রেখে গেলেন সেটার গুরুত্ব অপরিসীম। তাঁর দেখানো পথে ভবিষ্যতে আরও অজস্র লেখক এগিয়ে আসবেন এবং মানুষকে তারা প্রভাবিত করবেন, ভূমিকা রাখবেন সুস্থ চিন্তা মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার কাজে।

এভাবেই অমর হয়ে থাকেন একজন সৎ সাহিত্যিক তাঁর উন্নত চিন্তার জন্য। অধ্যাপক মুহম্মদ মতিউর রহমানের চিন্তারও কোনো ক্ষয় নেই। খোদা তায়ালা তাঁকে সুস্থ রাখুন এবং দীর্ঘজীবী করুন।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।