আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অপমৃত্যু (ছোটগল্প)

আমার পৃথিবীটা অনেক ছোট,আর তাই সেটাকে অনেক বড় করার জন্যই আমার ব্লগে আসা...আমার মনে হয় আমি ভুল করিনি। আজকের চাঁদটা বুঝি একটু বেশিই উজ্জ্বল, অন্তত রায়হানের তাই মনে হচ্ছে। রাত প্রায় দুটো বাজে, রায়হান এই মূহুর্তে বসে আছে বাসার ছাদে। চাঁদের আলোয় পুরো ছাদটা আলোকিত হয়ে আছে। চারদিকটা একটা গা ছমছম করা নীরবতায় ঢাকা, কিন্তু রায়হানের এসব কোন বিকার নেই।

ও প্রাণভরে উপভোগ করছে ওর জীবনের শেষ রাতটা। ও সুইসাইড করবে একটু পরেই, সুইসাইড নোটটা ওর ঘরে বিছানার উপর রেখে এসেছে সে। সকালে রায়হানের আম্মু ওর রুমে গেলেই নোটটা পাবে আর ততক্ষণে ও চলে যাবে অনেক দূরের কোন জগতে। বাবা -মা দুজনই খুব কষ্ট পাবে এটা জানে রায়হান , একটামাত্র সন্তান বলে কথা। কিন্তু রায়হানের কিছুই করার নেই, ও অনেকটাই নিরুপায়।

বাবা -মার অসহায় মুখ দুটোর কথা ভাবতে ভাবতেই চোখটা বন্ধ করে রায়হান। সাথে সাথেই আর একটা মুখ ভেসে উঠে ওর সামনে, মুখটা রিয়ার। যার জন্য আজ সুইসাইড করতে যাচ্ছে রায়হান। দুজন দুজনকে খুব ভালবাসত ওরা। সুন্দর একটা সাজানো সংসারের স্বপ্নে বিভোর ছিল দুজনেই।

রায়হানের ইচ্ছে ছিল দুজন মিলে বিয়ের পর বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে একটা ছোটখাটো ফুটবল টিম করে ফেলবে। প্রায়ই বলত ও রিয়াকে এই কথা। আর রিয়া রেগেমেগে আগুন হয়ে বলত, "ইস, সখ কত! ফুটবল টিম! এতগুলো বাচ্চাকাচ্চা নিলে আমাকে আর খুঁজে পাওয়া লাগবে না "। রিয়ার ইচ্ছে ছিল ছোট্ট একটা সংসারের, দুটো ফুটফুটে বাচ্চা,একটা ছেলে -একটা মেয়ে। ছেলেটা অবিকল রায়হানের মত আর মেয়েটা অবিকল রিয়ার মত।

স্বপ্নের মত বয়ে চলা দিনগুলো হঠাৎই থমকে দাঁড়ায়। রিয়ার ব্লাড ক্যান্সার ধরা পড়ে। ডাক্তার সময় বেঁধে দেন আর মাত্র একটামাস বাঁচবে রিয়া। রায়হানের তখন পাগলপ্রায় অবস্থা, দিন রাত সবসময়ই হাসপাতালে রিয়ার বেডের পাশে বসে থাকত ও। খাওয়া, গোসল, ঘুম কোন কিছুরই ঠিক নেই, সারাক্ষণ ওর একটাই কাজ রিয়ার নিস্পাপ মুখপানে অপলক তাকিয়ে থাকা।

অবশ্য ডাক্তারের কথা ফলে না, একমাস না একুশতম দিনেই মারা যায় রিয়া। রিয়া মারা যাওয়ার পরদিন রিয়ার লেখা শেষ চিঠিটা হাতে পায় রায়হান। রিয়া ক্যান্সার ধরা পড়ার পরপরই লিখেছিল এটা আর ওর প্রিয় বান্ধবী লিয়াকে দিয়েছিল এই বলে যে ও মারা যাওয়ার পর যেন চিঠিটা রায়হানকে পৌঁছে দেয় লিয়া। সোনালি খামের ভিতরে থাকা চিঠিটা বের করে পড়তে শুরু করে রায়হান। প্রিয় জান, কেমন আছ? জানি খুব একটা ভাল নেই।

কারণ যখন তুমি এই চিঠিটা পড়ছ তখন আর আমি এই পৃথিবীতে নেই, চলে গেছি অনেক অনেক দূরের একটা জগতে। অথচ কি আশ্চর্য দেখ সেই দূরের জগত থেকেও আমি তোমার সাথে কথা বলে যাচ্ছি এই চিঠিটির মধ্য দিয়ে। কি দারুণ একটা ব্যাপার তাই না জান? নিশ্চয়ই আমার উপর খুব রেগে আছ তাই না? তোমাকে এভাবে একা ফেলে চলে গেলাম। রাগ করো না জান, ইচ্ছে করে যাইনি তো। নিয়তির কাছে হার মেনে চলে যেতে হল।

তুমি তো সবসময়ই বলতে we are made for each other, জান তোমার কি এখনো মনে হয় we are made for each other? আমাকে ক্ষমা করো, তোমার ফুটবল টিমটা করে দিতে পারলাম না। ভালই হল, এখন থেকে আর কেউ তোমার সাথে একটুতেই রাগ করবে না, এটা ওটা নিয়ে বায়নাও ধরবে না, আর কেউ তোমাকে সময়মত খাওয়া, গোসলের জন্য বলবে না, আর কেউ তোমার বাইরে বের হওয়া নিয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করবে না। আর কেউ বলবে না" তুমি একটা shameless। " আর কেউ তোমার এলোমেলো চুলগুলো দুহাতে আঁচড়ে দেবে না, আদর করে জড়িয়ে ধরে বলবে না" ভালবাসি তোমায়"। রাত হলে তোমার মেসেজ টোনটা আর বিরক্ত করবে না তোমায়, কেউ আর বলবে না "good night Jan, sweet dreams "।

রাত দুপুরে কেউ আর আব্দার করবে না, বলবে না "নিয়ে যাও না জান যেকোনোভাবে আমাকে তোমার কাছে। "তবে খুব খুব মিস করব তোমায় পাগলু। মিস করব তোমার আদর, মিস করব তোমার পাগলের মত ভালবাসা। মিস করব তোমার জড়িয়ে ধরা। তবে সত্যি বলতে কি এই অল্প কদিন ভালবেসে আমি যা পেয়েছি হাজার বছর ভালবেসেও কেউ তা পাবে না।

অনেক ধন্যবাদ তোমাকে জান। এই চিঠিটা লিখছি আর ভাবছি ইস এখন যদি একটু তোমায় জড়িয়ে ধরে কাঁদতে পারতাম। কিন্তু তা তো আর সম্ভব না। খুব কাঁদছ চিঠিটা পড়ে তাইনা?মারা যাওয়ার পরও তোমাকে কাঁদিয়েই যাচ্ছি, কি নিষ্ঠুর আমি তাইনা?জান, আমাকে ভুলে যেও না কিন্তু। সবসময় মনে করো আমার কথা।

কিন্তু খবরদার, আমার কথা ভেবে একদমই মন খারাপ করবে না। ভাববে আমি তোমার পাশেই আছি। জান আগের মতই এখনো প্রতিদিন আমার জন্য একটা করে কবিতা লিখবে কিন্তু। না হলে কিন্তু ভূত হয়ে এসে তোমার ঘাড় মটকে দেব! হা হা হা ...আচ্ছা জান বলত এক জীবনে একটা মানুষকে আর কতটাই ভালবাসা যায়? আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করব জান, তুমি মারা যাওয়ার পর চলে এসো আমার কাছে। মন দিয়ে পড়াশোনা করবে আর নিয়মিত খাওয়াদাওয়া -গোসল করবে কিন্তু।

আমি নেই বলে সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করবে না একদমই। অনেক অনেক ভাল থাকবে কিন্তু। অনেক সুন্দর একটা জীবন হবে তোমার। ফুটফুটে সুন্দর একটা মেয়ে বিয়ে করবে আর একটা ফুটবল টিম...হা হা হা। তবে মারা যাওয়ার পর কিন্তু তুমি শুধুই আমার।

মনে থাকে যেন। তখন কিন্তু কাউকে তোমার ভাগ দেব না আমি। ভাল থেক। অনেক অনেক ভালবাসি তোমায়, আমার নিজের থেকেও বেশি। Bye forever. তোমার টুনটুনি।

চিঠিটা শেষ এখানেই। চিঠিটা পড়ে অনেক কেঁদেছে রায়হান আজ সারাটাদিন। চিঠিটা পড়েই ও সুইসাইড এর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রথমে ভেবেছিল ফ্যানে রশি বেঁধে তাতে ঝুলে পড়বে। পরে জানালা দিয়ে রাতের চাঁদটা দেখে আর লোভ সামলাতে পারল না রায়হান।

এমন জোছনা রাত খুব প্রিয় ছিল রিয়ার। সিদ্ধান্ত পাল্টে বাসার ছাদে চলে আসে রায়হান। ওদের বাসাটা পাঁচতলা। পাঁচতলার ছাদ থেকে নিচের পিচঢালা রাস্তাটায় ঝাপিয়ে পড়লেই ও চলে যাবে ওর রিয়ার কাছে। এতক্ষণ ধরে বন্ধ করে থাকা চোখটা মেলে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় রায়হান।

আস্তে আস্তে হেঁটে এসে ছাদের রেলিংটা ধরে দাড়ায় ও। স্ট্রীট লাইটের আলো আর চাঁদের আলো মিলেমিশে পিচঢালা রাস্তাটা একেবারে আলোকিত করে রেখেছে। শেষবারের মত আকাশের দিকে তাকিয়ে চাঁদটা দেখে রেলিংএর উপর উঠে দাঁড়ায় রায়হান। পিচঢালা রাস্তাটার দিকে তাকিয়েই চোখটা ভিজে আসে রায়হানের। ওইতো রিয়া, নিচে দাঁড়িয়ে আছে রায়হানের প্রিয় নীল রঙের একটা শাড়ি পড়ে আর হাতছানি দিয়ে ডাকছে ওকে।

"আসছি আমি রিয়া "...বলেই হাসিমুখে রেলিং থেকে নিচে ঝাঁপিয়ে পড়ে রায়হান ... ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১১ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।