আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একটি অপমৃত্যু

একটা প্রস্তাব রাখার জন্য মিঠু বাড়ির সবাইকে ডাকল। এটা শেখ বাড়ির ব্যাপার। ইসমত শেখ সহ প্রায় সবাই সে মজলিশে যোগ দিয়েছে। গ্রামের শেষ কিনারে এ বাড়িটা। প্রায় সবাই অশিতি।

কেবল শাওন আর মিঠু কলেজে পড়ে। ওদের নিয়ে বাড়ির সবার অন্য রকম আশা। তবে অশিতিদের একটা ধর্ম আছে যত তাড়াতাড়ি তারা একমত হয় তত তাড়াতাড়ি আবার বিবাদ করে। সে বিবাদ ভয়ানক হতে পারে। ইকবাল জানতে চাইল তারা কি করবে? মিঠু বলল, "আমরা একটা অনুষ্ঠান করতে চাই।

" "অনুষ্ঠানে কি কি হবে?" ইসমত শেখ জিজ্ঞেস করল। "একটু গান-বাজনা, মিষ্টি মুখ এবং একটা খাসি জোব দেব। " "বেশ ভালো প্রস্তাব। তা খাসি কিনতে তো অনেক টাকার দরকার টাকা কে দেবে?" "আমরা সবাই ভাগ করে দেব। " ইকবাল বলল, "আমি দেব পাঁচশ টাকা।

" "তুই পাঁচশ দিলে হবে?" "আচ্ছা সাতশ দেব। " শাওন বলল, "আমিও সাতশ দেব। " ইকরাম বলল, "পাঁচশ দেব। ' হাসমত বলল, "তিনশ দেব। " ইলিয়াস বলল, "পাঁচশ দেব।

" করিম সবার দিকে তাকিয়ে আছে। সেতো একটা টাকাও দিতে পারবে না। ইসমত শেখ বলল, "করিমের কিছু দেওয়া লাগবে না। আমি দেব। " সালামত বলল, "আপনি একা দেবেন কেন আমিও দেব।

চাচা শুধু আমাদের সাথে থাকবে। " ফজলু বলল, 'চাচা আমার একটা প্রস্থাব আছে। " ইসমত শেখ বলল, "বল, কি বলতে চাস?" "মাথাটা আমি নেব। " ইকবাল বলল, "এ্যা মাথা আমি নেব। তুই কয় টাকা দিবি যে মাথা নিবি।

মাথা তুই পাবিনা। মাথা নেব আমি। " হাসমত বলল, "বললেই হলো। " ইলিয়াস বলল, "হবে না কেন? মাথা কি তোর বাপের?" ফজলু উঠে এসেই ইলিয়াসের কলার ধরে, "আমার বাপের মাথা। " হাসমত এসে ফজলুর ঘাড়ে পিঠে বসিয়ে দিল কতগুলি কিল ঘুষি।

শুরু হলো মহাগ্যাঞ্জাম। ইসমত শেখের মাথা ফেটে গেল। হাসমত সাথে সাথেই মারা গেল। হাসপাতালে যাওয়ার রাস্তায় ইসমত শেখ ও। রাত্রেই শুরু হয়ে গেল মামলার রফাদফা।

পুলিশ বাড়ি আসতে থাকল। ধরে নিয়ে গেল অনেককে। বাড়ির অবস্থা বদলে গেল। বাড়িতে কোন পুরুষ নেই। সবাই হাজতে।

অনেকের জেল হলো। কয়েকজন নিরুদ্দেশ। কেউ কেউ বাড়ি ফিরল। হঠাৎ ঝড়ে তচনছ হয়ে গেল শেখ বাড়ির গর্ব। ভেঙ্গে গেল ভালোবাসার দেওয়াল।

চার বছর কেটে গেল। আসামীরা গ্রামে ফিরতে শুরু করছে। আজ ইকবাল ফিরছে। সুমির বুকে যেন সাহস ফিরে এসেছে। আরতো মাত্র ক’টা বছর।

প্রতীার প্রতিটি প্রহরই অনেক বড় কয়েকশ বছরের বড়। কেবল ইকবালের ফেরা দেখেই এতগুলো বছর সুমির কাছে মাত্র ক'টা বছর বলে মনে হলো। ও জানালার আড়ালে দাঁড়িয়ে পথের দিকে তাকিয়ে আছে। হয়তো আরো কেউ ফিরবে। সে না হোক শাওন তবু তার মনে একটু সাহস জাগবে।

সুমির মনে ভেসে উঠল সেসব দিনগুলি। শাওন যখন নবম শ্রেণিতে পড়ে। ও ছোটবেলা থেকেই একটু দুষ্টু প্রকৃতির। তাই হয়তো তাকে বেশি ভালো লেগেছিল। মিঠু অনেক ভালো ছাত্র তাও তাকে পাত্তা দেয়নি।

শাওনের মাঝেই সে খুঁজে দেখেছিল তার প্রতিমূর্তি। সবার অন্তরালে সে মন দিয়েছিল শাওনকে। শাওন যেন তারই মনের মত করে তৈরি। কেবল বাবা জানতো। তাই তার মনের উপর কোন বাধা দেয়নি।

তাকে বলেছিল, "সুমি জীবন ছেলে খেলা নয়। আগে জীবনকে সুন্দর করে সাজাও তার পর দেখবে সব পেয়েছ। বাবা আজ নেই। শাওনও জেলে। এস.এস.সি পাশের পর শাওন বলেছিলো, "তুই আমার জন্য অপেক্ষা করতে পারবি?" "পারব।

আমি সারা জীবন ধরে তোমার জন্য অপো করব। " "আমি এম.এ পাশ করে তোকে বিয়ে করব। মাকে নিয়ে শহরে থাকব। ছোট্ট একটা ঘর ভাড়া নেব। " সুমি একবাক্যে রাজি হয়েছিল।

প্রতি অন্ধকার রাত্রে শাওন জানালার পাশে আসতো বলে সুমি জানালা খুলে রাখতো। আজও সে জানালা খোলা থাকে। কেউ আসে না। সুমি একাকী জানালায় দাঁড়িয়ে শাওনের অপো করে। দক্ষিণা বাতাস ওর কানে কানে বলে যায় শাওন আসবেই।

ওর মনের ঘরেও বাতাস লাগে। ও আরো জেগে থাকতে চায়। ওর সমস্ত শরীর অজানা আনন্দে কেঁপে ওঠে। যখন মনে পড়ে খালার বাড়ি থেকে আসার সময় অনেক মেঘ করেছিল। বাবা গরু-বাছুর ঘরে নিতে হবে বলে ওকে রেখে দ্রুত বাড়ি এসেছিল।

ও নীরবে পথ চলছিল। হঠাৎ কে যেন পিছন থেকে ওকে জড়িয়ে ধরল। ঘাড়ে গালে কতগুলি চুমু দিতে দিতে ঠোঁট পর্যন্ত এলো। সুমি ঠোঁট ধরে বসল। ঘুরে দেখল শাওন।

ও শাওনকে আরো জড়িয়ে ধরল। বৃষ্টিও ওদের ঝেপে ধরল। এসব কেবল সুমির মনে ধরা দেয় বাস্তবে দেয় না। গ্রাম সীমান্তের বটগাছটি দেখা যায়। পথ একেবারে পরিষ্কার।

সুমি মনে মনে কতবার শাওনকে ফিরে আসতে দেখছে তার কোন হিসেব নেই। কতবার ওর মন ঐ বটগাছ পর্যন্ত দৌড়িয়েছে তা কেউ জানে না। হয়তো সুমি নিজেও। "মা, শাওনরা কতদিন জেলে গেছে?" "কেন, তোর কি দরকার? ওরা আমাদের শত্রু। ওদের হিসেব করতে হবে না।

" "না, এমনি জিজ্ঞেস করলাম। মানে আব্বা কতদিন মরছে তার একটা হিসেব রাখতাম। " "তা প্রায় সাত বছর। " "আব্বা মাত্র সাত বছর মরছে? আমারতো মনে হয় আরো বেশি হবে। তুমি হিসেব জান না।

" "তোর বাবার এ খবরটাও আমার ভুল হবে?" "না, মানে; মনে হয় বাবা অনেক দিন মরেছে। " বাবার মৃত্যুর হিসাবের সাথে শাওনের ফেরার হিসেব করছে। বাবার কথা হিসেব করলে মনে হয় এইতো সেদিন। কিন্তু শাওনের কথা মনে পড়লে মনে হয় গত জনমেরও আগের জনমে। সুমি আবার গিয়ে জানালায় দাঁড়ায়।

শাওনও খুব তাড়াতাড়ি একদিন ফিরবে। মা বারণ করলেও চুপিচুপি শাওনের সাথে দেখা করবে। সেদিন মাঝ রাতে হঠাৎ সুমির ঘুম ভাঙ্গল। শুনতে পেল মিঠু ফিরে এসেছে। সুমি থর ফর করে উঠল।

কিন্তু মা জানলে সমস্যা হবে তাই কান পেতে মিঠুর কথা শুনল। কিন্তু কেউ শাওনের কথা জিজ্ঞেস করল না। অবশেষে মিঠুই বলল। কিন্তু যা বলল তা খুবই ভালো খবর। তবু সুমির হৃদয় চৌচির হয়ে গেল।

এ মামলার আর কোন আসামী নেই সবাই আজই ছাড়া পেয়েছে। শাওন কোথায় গেল সে নাকি জেলে যায়নি। তবে কোথায় গেল? এতোদিন কোথায় আছে? কি করছে? কেন বাড়ি ফিরে এলো না? সুমির মনে বহু প্রশ্ন জাগল। কিন্তু কোন উত্তর এলো না। ও একেবারে নীরব হয়ে গেল।

জানালার গ্রীলের মত ও যেন জড় পদার্থ। দিন চলছে। সুমির অপোর শেষ নেই। বার বছর কাটল। মা তাকে বিয়ে দিতে পারছে না।

বহু ছেলে দেখতে এসে এসে ফিরে গেছে। কারণ, কেউ বুঝতে পারছে না। কেবল জানালায় দাঁড়িয়ে চলে দিন গোণা। শাওন, আর কত অপো? নাকি তুমি আমায় ভুলে গেছ? তোমার জন্য তোমার সুমি সব পারে। কাছে এসে বলে যাও তুমি আমাকে ভুলে গেছ আমি তোমাকে সারা জীবন মনে রাখলেও তোমাকে একটি বারও আমার কথা মনে করতে বলব না।

তবু সত্য কথাটা বলে যাও। আমি সত্যকে ভালোবাসি আর তোমাকে বিশ্বাস করি। বিশ্বাস করি বলে আজও পথ চেয়ে বসে আছি। মা সুমির বিয়ে ঠিক করল। পাশের গ্রামের সুমন।

কোম্পানিতে চাকরি করে। ঢাকায় থাকে। বাড়িতে শুধু একটা মা। সুমিকে দেখে তার মা'র দারুণ পছন্দ। সমস্যা বয়সটা।

তাতে কি মেয়ের নামেতো কোন কলঙ্ক নেই। তাই বিয়েটা পাকা করে গেল সামনের শুক্রবার। আজ সুমির বিয়ে। অপোর সাথী সেই পুরনো জং ধরা জানালার গ্রীল ধরে দাঁড়াল। দু'চোখ জলে ঝাপসা দিয়ে এলো।

এতো কালও সে শাওনের ছিল। শাওন একদিনের জন্য হলেও তার কাছে ফিরে আসবে। শাওনকে ছাড়া তার ভাবনাগুলো অন্য কারো হতে পারে না। যার কথা ভাবতে ভাবতে তার চোখে ঘুম নেমে আসতো, যার ডাকে সকালের ঘুম ভাঙ্গতো সে আজ তার পর হয়ে যাবে। সুমি এই বিরাট মিথ্যাকে মেনে নিতে পারছে না।

কিন্তু উপায়তো আর নেই। আর কত অপেক্ষা? সমাজতো আর এ অপো মানছে না। সমাজের চোখে তার বয়স পার হয়ে গেছে। তাকে বিয়ে দিতে হবে। পাড়ার ছেলেরা ভালো চোখে দেখে না।

তার পরও সে থাকতো যদি জানতো, শাওন ফিরে আসবেই। সে আসা হাজার বছর পর হলেও। সুমি স্বামীর গৃহে যাওয়ার জন্য সাজছে। সাথে তার স্বামী সুমন। গ্রাম সীমান্তের বটগাছের তলে অনেক লোকের ভীড়।

ওরা আরো এগিয়ে গেল। একজন আত্মহত্যা করছে। বটগাছের ডালে এখনও ঝুলে আছে। লোকটাকে কেউ চেনেনা। হয়তো কোন ভিন গাঁও থেকে এসেছে।

মুখ ভর্তি লম্বা লম্বা দাড়ি, মাথার চুল অনেক বড় বড়। স্বাস্থ্যটা ভেঙ্গে গেছে। ওরা দু'জন দাঁড়াল। লোকটাকে চেনার চেষ্টা করল। কিন্তু কেউ বলতে পারল না সে কে।

একজন বলল, গতকাল তাকে এ গ্রামে হেঁটে আসতে দেখছে। তাকে জিজ্ঞেস করেছিল চাচা কেমন আছেন? সুমি বলল, "চলো, আমরা চলে যাই। " "লাশটা দেখে যাই। " "কি দরকার আছে?" "দরকার না থাকলেও। " লাশ নামিয়ে আনা হলো।

গ্রামের লোক ভরে গেছে। কেউ একজন বলল, "মনে হয়, আমাদের শাওন। " নামটা শুনতেই সুমি আতকে উঠল। লোক ঠেলাঠেলি করে লাশের কাছে গেল। তার চোখে পানি ভরে উঠল।

সুমি পানি গোপনে মুছে ফেলল। তোমার জন্য আমি কিছুই পারলাম না। এক ফোঁটা অশ্রুও না। গোপনে সে অশ্রু আমি মুছে ফেললাম। তুমি কোন এতদিন পরে এমন ভাবে এলে।

এভাবে না ফিরলেও পারতে। আমি জানি আমার এটা তুমি মেনে নিতে পারনি। কারণ, যে আগুন নিয়ে এসেছিলে সে আগুনে পানির পরিবর্তে ডিজেল পেয়ে তুমি নিজেকে জ্বালি দিলে। আমি জানি তোমার অনেক কষ্ট হয়েছে। আমার অপেক্ষা স্বার্থক হলো না।

০৪.১১.২০০৯ইং কোম্পানিগঞ্জ, সিলেট। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.