পূর্ব প্রকাশিতের পর
কম্পাসের ফোন পাবার পর থেকেই অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে আসতে শুরু করেছে মুসকানের জীবন। তার কৌশল কাজে লেগেছে। তীর নিশানা পে লাগ্ চুঁকা। মাঝের কয়েকদিন তার মনের উপর দিয়ে যে ঝড় বয়ে গেছে, আপাতত সেই ঝড় থেমেছে। এখন হঠাৎ ঝড়ের কবলে পড়ে বিধ্বস্থ হয়ে যাওয়া মনের ঘরটি পুনঃনির্মাণের পালা।
এই মুহুর্তে কম্পাস ও মুসকান বসে আছে মুখোমুখি।
ছিমছাম রেস্টুরেন্ট। মধ্যদুপুরের গ্যাদারিং শেষ হয়ে যাওয়াতে রেষ্টুরেন্ট প্রায় পুরোটাই ফাঁকা। মুসকান আজ পরেছে টুকটুকে লাল শাড়ি। লাল ব্লাউজ।
পায়েও পরেছে লাল রঙয়ের সেমি হিল জুতা। অতিরিক্ত ফর্সা মেয়েদের লাল শাড়িতে মানায় না। মুসকানকে মানিয়েছে। মনে হচ্ছে লাল ছাড়া অন্য কোনো রঙয়ের শাড়ি পরলে তাকে বেমানান লাগতো।
দীর্ঘক্ষণ নিরবে বসে থাকলো দু’জন।
কেউ কোনো কথা বলছে না। এর মাঝে ওয়েটার এসে দু’টো কোক দিয়ে গেছে। কোক দু’টো দাঁড়িয়ে আছে টেবিলের উপর। তাদের দিকেও কেউ খেয়াল করছে না।
প্রথমে কথা বললো মুসকান-
‘আমরা বোধয় কোক খেতে পারি।
বেশ আগে দিয়ে গেছে। সম্ভবত ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে!
মুসকানের এই হালকা রসিকতা গায়ে না মেখে কম্পাস বললো-
‘দেখো মুসকান, ‘আই লাভ য়্যূ’ টাইপ সস্তা আবেগী সংলাপ বলে বলে বাদাম খেয়ে বেড়ানোর উপযুক্ত সময় হচ্ছে ইন্টারমিডিয়েট ফাষ্ট ইয়ার। সেই সময় আমরা দু’জনেই অতিক্রম করে এসেছি। এছাড়া গতানুগতিক প্রেমের সংজ্ঞার সাথেও আমি একমত নই। আমি মনে করি প্রেম জৈবিক চাহিদার নিরব ভূমিকা।
তেতুল গাছের নিচে গিয়ে বসে থাকা। মুখে তেতুল দেয়া হবে না কিন্তু জিবে পানি টলটল করবে।
দেখো, অনেকে বলে, প্রেমের সাথে শারীরিক সম্পর্কের কোনো যোগসূত্র নেই। প্রেম হয় মনের সাথে মনের। এটা নির্ভেজাল মিথ্যে কথা।
আমি হলফ করে বলতে পারি প্রকৃতি যদি বিশেষ কোনো ব্যবস্থায় কোনো ছেলে বা মেয়েকে তার (বিশেষ) শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে, তাহলে সাথে সাথেই তার প্রেমিক বা প্রেমিকার মন থেকে সকল প্রেম মিলিয়ে যাবে। কলাগাছের সাথে প্রেম করে ঘর বাধার স্বপ্ন কেউ দেখে না। সুতরাং প্রেম মানেই বিয়ে এবং...
সুতরাং আমার মনে হয় আমরা সরাসরি মূল পয়েন্টে চলে আসতে পারি। ’
মুসকান কিছুটা কৌতূহল নিয়ে তাকালো কম্পাসের দিকে। কম্পাস বললো,
‘দেখো মুসকান, আমি অতি সাধারণ একটি ছেলে।
আমার জীবনে কোনো রসকস নেই। কাউকে দেবার মতও তেমন কিছু নেই আমার। আমি আমার জীবনকে নিয়ে একটু অন্যভাবে ভেবেছিলাম। আমার ভাবনার সেই জগৎটাকে সাজানোর জন্য আমাকে একা থাকা দরকার ছিল। মধ্যখানে তুমি এসে যুক্ত হলে।
বুঝতে পারছো আমি কী বলতে চাইছি?’
মুখে দুষ্টুমির হাসি ফুটিয়ে তুলে মুসকান মাথা নাড়লো উপর-নিচে, সে বুঝতে পারছে।
কম্পাস বললো, ‘কথাটাকে তুমি হালকাভাবে নিচ্ছ মুসকান। Please take it Seriously.
মুসকানের আবারও হাসি এসে গিয়েছিল। বহু কষ্টে হাসি কন্ট্রোল করলো। চেহারায় যথাসম্ভব সিরিয়াস ভাব আনার চেষ্টা করে বললো-
‘শুনো কম্পাস।
তোমার কী আছে আর কী নেই, সেটা নিয়ে আমার কোনো মাথা ব্যথা নেই। আমাকে খুব কিছু দিতে হবে, সেটা তোমাকে কে বলেছে? আমি তোমার কাছ কখনো কিছু চাইবো না। এমন কি সুখও না। সুখ আমি নিজেই খোঁজে নেব। আমি বিশ্বাস করি কেউ কাউকে সুখী করতে পারে না।
সুখী হতে হয় নিজে থেকে। নিজের ইচ্ছায়, আত্মবিশ্বাসে, কর্মকান্ডে। আমি শুধু তোমার কাছে থাকার বৈধ অধিকারটুকু চাই। আর কিছু না। এর বেশি কিছু না।
তুমি বলেছ তুমি তোমার জীবনকে নিয়ে ভিন্নভাবে ভেবেছিলে। তোমার সেই ভাবনার জগতে আমি কখনো প্রবেশ করবো না। আমি শুধু কাছে থেকে দেখে যাব তোমাকে, নিরবে, নিঃশব্দে। তুমি থাকলে তোমার মত। তুমি তোমার কল্পনার এক্সপেরিমেন্ট নিয়ে মাথা ঘামালে।
আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলাম তোমার মাথার পেছনে। কখনো এক মগ কফি এনে আলতো করে রেখে দিলাম তোমার সামনে। ধোঁয়াউড়া কফিতে চুমুক দিতে দিতে কাজ করলে তুমি। মন চাঙ্গা করে উদ্দমী গতিতে কাজ করতে পারলে। ভেবে দেখো, আমার কল্যাণে কিন্তু তুমি তোমার কাজেই আরো গতি পাবে।
’
নিরবে শুনে যাচ্ছিলো কম্পাস। সে ভেবে পাচ্ছে না এই নাছোড় মেয়েটাকে কী করে বিদায় করবে তার জীবনে প্রবেশ করা থেকে। কম্পাস জানে মেয়েটির এই মোহ অতি সাময়িক। এই ঘোর একদিন, খুব তাড়াতাড়িই একদিন কেটে যাবে। তখন যে কেবল মেয়েটিই কষ্ট পাবে, তা না, মাঝখান থেকে তার জীবনটাও এলোমেলো করে দিয়ে যাবে।
কম্পাস বললো, ‘চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটা যে এখনই নিয়ে ফেলতে হবে, এমন তো কোনো কথা নেই। আরো কয়েকটা দিন ভেবে দেখলে কেমন হয়?’
মুসকান বললো, ‘এখানে এত ভাবাভাবির কী আছে?’
‘তবুও পুরো ব্যাপারটি আবার গোড়া থেকে চিন্তা করে দেখলে...’
‘শুনো কম্পাস, চিন্তা-ভাবনার কাজ আমি অনেক আগেই শেষ করে ফেলেছি। আমার ডিসিশান ফাইনাল। এবার তোমার যা বলার আছে-বলো। ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে বলার দরকার নাই।
এক শব্দে বলবা- Yes অথবা No.
‘দেখো মুসকান, জীবনের সব প্রশ্নের জবাব হ্যাঁ অথবা না দিয়ে হয় না। একটু ভেবে চিন্তে....
কথা শেষ করতে না দিয়েই উঠে দাঁড়ালো মুসকান। ‘থাকো তুমি তোমার ভাবা-চিন্তা নিয়ে। আমি যাচ্ছি। তোমার সাথে আর কখনো দেখা হবে না।
মাঝে কিছুদিন তোমাকে বিরক্ত করলাম। পারলে ক্ষমা করে দিও। তুমি বলেছো আমি তোমার মা’কে রক্ত দিয়ে বাঁচিয়েছি বলে তুমি আমার প্রতি কৃতজ্ঞ। যে কোনো বিনিময়েই তুমি এই ঋণ শোধ করতে চাও।
শুনো, শুধু এই কারণে তুমি আমাকে বিয়ে করো-আমি সেটা চাইবো না।
তুমি আজ থেকে নিজেকে মুক্ত ভাবতে পারো। তোমার মায়ের প্রয়োজনে আমি রক্ত দিয়েছি। আমি না দিলেও কেউ না কেউ দিত। এ নিয়ে তোমার সংকোচবোধ করার দরকার নেই। এটা আহামরি বড় কিছু না।
আমি এটা ইচ্ছা করেই করেছিলাম। যাতে তুমি আমার কাছে আস। এখন ব্যাপারটা যদি দাঁড়ায় এমন যে, আমি তোমাকে ভালবাসছি আর তুমি চাইছো ঋণ শোধ করতে, তাহলে তো হবে না।
ভাল থেকো,’ বলেই কম্পাসকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই হনহন করে বেরিয়ে গেল মুসকান। তার চলে যাওয়ার দিকে অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে চেয়ে রইলো কম্পাস।
... চলবে
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।