আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সেদিনও বসন্ত ছিলো (৯)



আমান ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল এর চেয়ারম্যান চৌধুরী আমানুল্লাহ কবীর বসে আছেন নিজের অফিস রুমে। তার সামনে বহুদিনের বিশ্বস্থ সঙ্গী প্রতিষ্ঠানের জেনারেল ম্যানেজার দবিরুল আলম। মিষ্টার চৌধুরী বিকেল ৩ টায় জরুরী সভা ডেকেছেন। প্রতিষ্ঠানের সকল শ্রেণীর কর্মকর্তা কর্মচারীদেরকে উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছে। জরুরী ভিত্তিতে সবাইকে ডাকার কারণ -তিনি স্বপরিবারে আমেরিকা চলে যাচ্ছেন।

স্থায়ীভাবে। বাংলাদেশে তার যা বিষয় সম্পত্তি ছিল, সব বিক্রি করে দিয়েছেন। এই ইন্ডাষ্ট্রিও বিক্রি করা হয়ে গেছে। আমান ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল-এর শতভাগ মালিকানা কিনে নিয়েছেন এফবিসিসিআই এর সাবেক সভাপতি জনাব সালমান আউয়াল সাহেব। কিছুদিনের মধ্যেই সাইনবোর্ড বদল হবে।

আমানের জায়গায় বসবে সালমান। আমান সাহেব দেশ ছেড়ে স্থায়ীভাবে আমেরিকা চলে যাওয়ার কারণ একটু ভিন্ন। সারাবিশ্বের উপর অবৈধ খবরদারী করছে আমেরিকা। যে এবং যারাই আমেরিকার সামনে নতজানু কুর্ণিশ করছে না, তাদেরকেই তারা মিশিয়ে দিচ্ছে মাটির সাথে। কখনো তারা ইসরাঈলকে দিয়ে নিরীহ ফিলিস্তিনী পেটাচ্ছে।

কখনো তারা নিজেরাই হায়েনার মত ঝাঁপিয়ে পড়ছে ইরাকে, লেবাননে, আফগানে। তামাম বিশ্বের মানবতাবাদী মানুষ আমেরিকার এই ঘৃন্য মনোভাবের প্রতিবাদ করে আসছে যে যার মত করে। আমান সাহেব ঠিক করেছেন তিনি একটু অন্যভাবে এবং স্থায়ীভাবে প্রতিবাদ করবেন। প্রতিবাদের একটি ঝান্ডা গেড়ে রাখবেন খোদ্ আমেরিকায়। সেটা এরকম- যেহেতু উনার এবং উনার স্ত্রীর ডুয়েল সিটিজেনশীপ রয়েছে, যেহেতু তিনি আমেরিকার বৈধ নাগরিক, তাই সে দেশে তিনি বৈধভাবে যা ইচ্ছা, তাই করতে পারেন।

তাই তিনি দেশের সকল স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ একত্রে জমা করে সে টাকায় হোয়াইট হাউসের আইনানুগ বাধ্যতামূলক দূরত্বে পাঁচ’শ স্কয়ার ফিট জায়গা কিনেছেন। তিনি সেখানে একটি ঘর বানাবেন। টাওয়ার টাইপ ঘর। ইতিমধ্যে ঘরের নকশাও করা হয়ে গেছে। ঘরটির চূড়ায় থাকবে একটি সাদা পায়রা, পায়রাটির উভয় পায়ে থাকবে রক্তের লাল রং।

ঘরটির বাহির দিকের দেয়ালের রং থাকবে কালো। মুখ থাকবে হোয়াইট হাউসের দিকে। ঘরের সামনের বেলকনিতে সাদা পাথরে খোদাই করে নেইম ফলক লাগানো থাকবে। নেইম ফলকের অক্ষরগুলোও থাকবে কালো। সেখানে লেখা থাকবে- Black House বিশ্বের নির্যাতিত মানুষের পক্ষে সেটা হবে তার নিরব অথচ কন্টিনিউয়াস প্রতিবাদ।

নিতান্ত আবেগের বশবর্তী হয়ে সকল সম্পত্তি বিক্রি করে দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণে তার কোনো পিছুটানও ছিল না। উনার একমাত্র সন্তান তাকে জানিয়ে দিয়েছে তাঁর সম্পদের এক কানাকড়িও সে জীবনে স্পর্শ করবে না। তাহলে মরে গেলে কী হবে এই সম্পদ দিয়ে... ‘স্যার কি কোনো কারণে চিন্তিত?’ চোখ খুললেন মিষ্টার আমান। এতক্ষণ তিনি রিভলভিং চেয়ারে চোখ বন্ধ করে ভাবছিলেন। দবির সাহেবের কথায় তিনি একটু নড়ে বসলেন।

‘ দবির সাহেব!’ ‘জ্বী স্যার,’ ‘ আপনারা কি আমার উপর রাগ করেছেন?’ ‘ কী যে বলেন স্যার, আপনার উপর রাগ করার কি কোনো যুক্তি আছে?’ ‘ যুক্তি সবকিছুতেই আছে। এই যে আমি আপনাদের সকলের দীর্ঘদিনের পরিশ্রমে গড়ে উঠা ফ্যাক্টরীটি বিক্রি করে দিয়ে বাইরে চলে যাচ্ছি, এই অন্যায়টির জন্যও তো আমার উপর আপনারা যুক্তিসঙ্গতভাবেই রাগ করতে পারেন। পারেন না?’ ‘ না স্যার, অফিসের কারো মনে আপনার প্রতি কোনো ক্ষোভ নেই। তবে সকলেরই একটি কারণে মন খারাপ। ’ ‘ কী কারণ?’ ‘ এই তো স্যার, আপনার মত উদার মনের মানুষের নির্দেশে আর কাজ করার সুযোগ পাবে না।

আপনার মত এমন আরেকজন মালিক পাবে না, চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীকেও বুকে জড়িয়ে ধরার মত বিশাল বুক রয়েছে যার। কিছু মনে করবেন না স্যার। সামনে প্রশংসা করা ঠিক না। আমাদের নবীজী বলেছেন- “কেউ তোমার সামনে প্রশংসা করলে তার মুখে মাটি ছুড়ে দিও কারণ সেই স্তুতিকারক তোমার বন্ধু নয়”। আপনি তো স্যার সারা জীবনের জন্যই চলে যাচ্ছেন।

আর তো কখনো আপনাকে সামনে পাবো না। তাই আপনি আমার মুখে মাটি ছুড়ে মারেন কিংবা ইচ্ছা করলে সেন্ডেলও ছুড়ে মারতে পারেন। তবুও আজ আমি একটি কথা বলবোই। আপনি যেমন ফেরেশতার মত মানুষ আমি আমার জীবনেও দেখি নি। কখনো আর দেখতেও চাইবো না।

’ বলেই আচমকা চেয়ার থেকে উঠে পড়লেন দবির সাহেব। টেবিল পেরিয়ে আমান সাহেবের কাছে গিয়ে উনার বুকের সাথে মাথা ঠেকিয়ে বাচ্চা ছেলেদের মত হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে দিলেন। আমান সাহেবের চোখও ভিজে উঠলো। তার সৌভাগ্য, এমন কিছু লোককে তিনি তার প্রতিষ্ঠানে সহকর্মী হিসেবে পেয়েছিলেন। অনেক কষ্টে দবির সাহেবকে শান্ত করলেন মিষ্টার আমান।

দবির সাহেবও টিসু দিয়ে ভেজা চোখ মুছলেন। মিস্টার আমান বললেন- ‘ দেখুন দবির সাহেব, আমি জানি আপনারা সবাই আমাকে কতটা ভালবাসেন। তবে আমাকে ফেরেশতার মত মানুষ ভাববেন না। মানুষ দোষে গুণে থাকে। ফেরেশতারা কখনো দোষ করেন না কারণ, তাদেরকে দোষ করার ক্ষমতাই দেয়া হয় নি।

আরো একটি কারণ আছে। বলতে একটু সংকুচ লাগছে, তবুও বলি- মানুষ কিন্তু ফেরেশতা থেকেও শ্রেষ্ঠ। সৃষ্টির প্রথম মানুষ বাবা আদমকে সৃষ্টি করার পর কিন্তু আল্লাহ পাক আদমকে বলেন নি ফেরেশতাকে সেজদা করতে। বরং ফেরেশতাদেরকেই বলেছিলেন-আদমকে সেজদা করো। ’ ‘ স্যরি স্যার।

’ ‘ আরো না, এখানে স্যরি টরির ব্যাপার না। জাষ্ট একটি তথ্য আপনাকে জানালাম। যান, একটু তদারকি করুন। তিনটার সময় তো সবাইকে নিয়ে বসতে হবে। ভাল কথা, দেখবেন, ওখানে কান্নাকাটি করে কোনো সিন্ক্রিয়েট করবেন না।

তাহলে কাজের কথা কিছুই বলা হবে না। ’ বড় সাহেবের ঘর থেকে বেরিয়ে আসলেন জিএম জনাব দবিরুল আলম। তিনি যতবারই বড় সাহেবের কাছে একটু সময় নিয়ে এসেছেন, ততবারই কিছু না কিছু তথ্য নিয়ে ফিরতে পেরেছেন। উনার দুর্ভাগ্য, এই লোকটিকে আগামীকাল থেকে আর পাশে পাওয়া যাবে না। অফিস মিলনায়তনে সবাই জড়ো হয়েছেন।

সুনসান নিরবতা। অত্যন্ত ভাবগম্ভীর পরিবেশ। পুরো ‘হল’টাকে মরা বাড়ির মত লাগছে। আমান সাহেব দবিরুল আলমকে ইশারায় কাছে ডাকলেন। বললেন, ‘আপনাদের মধ্য হতে কারো কিছু বলার থাকলে শক্ত মনের কাউকে দিয়ে বলাবেন।

যেন কথার মধ্যে আবার আপনার মত কেঁদে টেদে না দেয়। ’ ‘ জ্বী স্যার। ’ ‘ সবার জন্য দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করতে বলেছিলাম। করেছেন?’ ‘ জ্বী স্যার। ’ ‘ বলেছিলাম এই অফিসের সুইপার, ঝাড়–দার থেকে শুরু করে জিএম পর্যন্ত সবার জন্য আমার পক্ষ থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা করে চেক তৈরি করতে।

সবার জন্য সমান টাকা। এই টাকা তো পজিশন ও যোগ্যতার বিনিময়ে না। এটা আমার বিদায়ী ভালবাসা। আর আমার এই প্রতিষ্ঠানের সকলের জন্যই তো আমার ভালবাসা সমান। কাজটা ভুল করছি না তো ম্যানেজার সাহেব?’ ‘ জ্বী না স্যার, ঠিক আছে।

’ ‘ চেক তৈরি করা শেষ হয়েছে?’ ‘ হয়েছে স্যার। ’ ‘ গুড, একাউন্টেন্ট সাহেবকে বলুন ওগুলো নিয়ে আসতে। আমি প্রোগ্রাম শুরু হওয়ার আগেই সই করতে চাই। আমি নিজ হাতে তাদেরকে আমার শেষ শুভেচ্ছাটুকু দিয়ে যেতে চাই। ’ ‘ আচ্ছা স্যার।

’ তিনটা পঁয়ত্রিশ মিনিটে বিদায় সভা শুরু হলো। অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পক্ষ থেকে কথা ছিল একজন বলবেন। কিন্তু একে একে সাতজন বললেন। আমান সাহেব বাঁধা দিলেন না। বলুক।

আর তো বলার সুযোগ পাবে না মানুষগুলো। সবশেষে বিদায়ী বক্তব্য রাখতে শুরু করলেন মিষ্টার আমান। উঠে দাঁড়ালেন তিনি। তিনি লক্ষ্য করলেন তার পা দু’টো কাঁপছে। বুক শুকিয়ে যাচ্ছে।

ভেতর থেকে কথা বের করতেও স্বাভাবিকের’চে বেশি জোর দিতে হচ্ছে। তিনি বলতে আরম্ভ করলেন- “প্রিয় সহকর্মীবৃন্দ, আপনাদের সবাইকে আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই। আজ থেকে সতের বছর আগে মাত্র একত্রিশ হাজার টাকা মূলধন নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিলাম আমি। ছোট্ট একটি দোকান করে শুরু হয়েছিল আমার যাত্রা। দোকানের নাম ছিল ‘আমান ডিপার্টমেন্টাল স্টোর’।

অই দোকানের মালিক কাম সেলস্ম্যান ছিলাম আমি একাই। আল্লাহর রহমতে আমার ব্যবসায় আস্তে আস্তে উন্নতি হতে থাকে। বাড়তে থাকে ব্যবসার পরিধি। সেই সঙ্গে বাড়তে থাকে ম্যান পাওয়ারও। একে একে আপনারা এসে যুক্ত হতে থাকেন আমার সাথে।

আপনাদের সকলের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এবং আন্তরিক সহযোগিতায় এক সময় গড়ে উঠে ‘আমান ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল। ’ আজ এই প্রতিষ্ঠানে আপনারা একুশ শ’ সাতান্ন জন মানুষ জড়িয়ে আছেন। আপনারা আপনাদের সন্তানের মত বড় আপন করে এই প্রতিষ্ঠানকে বুকে আগলে রেখেছেন। সত্য বলতে আমার দ্বিধা নেই, আপনাদের সহযোগিতা না পেলে আজ আমি আজকের এই অবস্থানে এসে দাঁড়াতে পারতাম না। আমি পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকি, আপনাদের কথা কখনো ভুলতে পারবো না।

” পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখ মুছলেন মিষ্টার আমান। পুরো হলে ফুসফুস কান্নার শব্দ শুনা গেল। নিজেকে কন্ট্রোল করে আবারো শুরু করলেন তিনি- “ আপনারা কেউ কেউ জানেন আবার অনেকেই হয়ত জানেন না, আমার একটি সন্তান আছে এবং সে আমার সাথে যাচ্ছে না। আপনাদের মনে হয়ত এই প্রশ্ন দেখা দিতে পারে যে, আমি আমার ছেলেকে বিষয়-সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করছি। আপনাদের কারো মনে যাতে আমাকে নিয়ে মন্দ ধারণা সৃষ্টি না হয়, সে জন্য আমি আজ আমার জীবনের একান্ত কিছু কথা আপনাদের বলতে চাই।

আমার ছেলের বয়স তখন ছয়। সেই সময় হুট করে তার মা মারা গেলেন। তখন সবেমাত্র ব্যবসা শুরু করেছি আমি। সারাদিন ব্যবসার পেছনে সময় দিতে হয়। পড়লাম মহা সমস্যায়! ব্যবসা দেখবো নাকি মা মরা ছেলেটিকে দেখবো।

ধারাবাহিক উপন্যাস পূর্ব প্রকাশিতের পর আত্মীয়-স্বজনের চাপাচাপিতে অনেক ভেবে-চিন্তে মূলত আমার ছেলেটির কথা ভেবেই আমি দ্বিতীয় বিয়ে করলাম। আমার এই কাজটিকে আমার ছেলে সহজভাবে নিতে পারেনি। তার ধারণা হলো, তার মায়ের মৃত্যুর জন্য আমিই দায়ী। কারণ যেদিন আমার প্রথম স্ত্রী জাহানারা মারা যায়, সেদিন সকাল ৭টায় আমি দোকান খুলতে বের হবো। তখন জাহানারা আমাকে বললো, ‘ আজ দোকান না খুললে হয় না?’ আমি বললাম ‘কেন? কী হয়েছে?’ সে বললো, ‘কেমন জানি শরীরটা ভাল লাগছে না।

অস্থির অস্থির লাগছে। মাথায় ভোতা ধরণের যন্ত্রণা করছে। অবশ্য সিরিয়াস কিছু না। ’ জাহানারার প্রায়ই মাথা ব্যথা করতো। আমি তাকে বললাম, ‘তুমি তৈরি হয়ে থেকো।

বিকেলে এসে তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো। ’ জাহানারা তখন হাসিমুখে বললো, ‘ঠিক আছে। ’ তারপর যথারীতি আমাকে নাস্তা করে খাওয়ালো। প্রতিদিনের মত বাড়ির গেইট পর্যন্ত এসে আমাকে এগিয়েও দিল। আমি একটু সামনে আসার পর শুধু একবার ডাকলো, ‘এ্যাই! শুনছো?’ আমি পেছনে ফিরে তাকালাম।

‘কিছু বলবে?’ সে বললো, ‘না, কিছু না। তুমি যাও। আর শুনো, কম্পাসকে দিয়ে আমি দুপুরের খাবার পাঠালে ওর কাছে আধা কেজি জলপাই কিনে দিও তো। খুব জলপাই খেতে ইচ্ছে করছে। ’ আমি দোকানে চলে এলাম।

সকাল এগারটায় জাহানারা মারা গেল। তারপর আমার ছেলের কাছে আমি ভিলেন বনে গেলাম। তার ধারণা হলো তার মা’র মৃত্যু আমার কারণেই হয়েছে। সকালে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে তার মা মারা যেত না। মা মারা যাওয়ার পর সে নাওয়া-খাওয়া বন্ধ করে দিল।

দুই দিনের মাথায় তার ছোট খালা এসে তাকে নিজের কাছে নিয়ে গেল। আমাকে বলে গেল- ‘দুলাভাই, বাচ্চা ছেলেতো, মনে ধারণ ক্ষমতার’চে বেশি আঘাত পেয়েছে। তাই সামলিয়ে উঠতে পারছে না। কয়দিন থাকুক আমাদের সাথে। মনটা ভাল হোক, তখন ফিরিয়ে নিয়ে আসবেন।

’ দুই মাস পর আমার আত্মীয় স্বজন সবাই মিলে আমার দ্বিতীয় বিয়ের ব্যবস্থা করলেন। সবারই এক কথা। আমার জন্য না হলেও ছেলের দেখাশুনার জন্য একজন মায়ের দরকার। বিয়ের পর ছেলেকে ওরা দিয়ে গেল আমার কাছে। আমি আবিস্কার করলাম আমার প্রতি ছেলের ক্ষোভ কমে নি, বরং আরো বেড়েছে।

সে আমাকে জানিয়ে দিল-জীবনে সে আমার দেয়া অন্ন স্পর্শও করবে না। পড়লাম মহা সমস্যায়। এখন কী করি? ছেলেটি কি আমার চোখের সামনে দিনে দিনে না খেয়ে মারা যাবে? তখন আমি একটি কৌশল করলাম। ছোট্ট একটি মিথ্যার আশ্রয় নিতে হলো আমাকে। আর এ কাজে আমাকে সাহায্য করলো কম্পাসের ছোট খালা।

কম্পাসকে তার খালার মাধ্যমে বিশ্বাস করানো হলো যে, তার মায়ের কিছু টাকা ব্যাংকে জমা আছে। সে চাইলে সেই টাকায় তার খাওয়া-দাওয়াসহ সকল খরচ চলতে পারে। কম্পাস শুধু জিজ্ঞেস করেছিল, ‘মা টাকা পেলেন কোথায়?’ তাকে জানানো হলো, মা উনার বাবার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে যে জমি জমা পেয়েছিলেন, সেগুলো বিক্রি করে সেই টাকাই ব্যাংকে রাখা হয়েছে। ছোট্ট কম্পাস আমাদের এই চালাকী ধরতে পারলো না। সে রাজি হলো।

আমার ছোট্ট ছেলেটির সাথে এই ছোট্ট প্রতারণাটুকু আমাকে করতে হলো। এছাড়া আর কোনো উপায়ও ছিল না আমার। সেই থেকে ছেলে আলাদা হয়ে গেলে আমার থেকে। তার ছোট খালা এসে খরচ করে দিয়ে যায়। আমার নতুন স্ত্রী তাকে আলাদা রান্না করে দেয়।

একটু বড় হয়ে সে ঘোষণা করলো, সে আর আমার বাড়ীতেও থাকতে চায় না। কারণ জিজ্ঞেস করা হলে সে বললো, বাবারটা খাচ্ছি না, কিন্তু বাবার ঘরে তো থাকছি। আমি এটাও চাই না। যদি থাকতে হয়, তাহলে আমি যে রুমে থাকি সেটার ভাড়া প্রতি মাসে নিতে হবে আমার কাছ থেকে। পনের স্কয়ার ফিটের রুমে থাকি আমি।

রান্না বান্নায় গ্যাস ব্যবহার করি, বিদ্যুৎ-পানি ব্যবহার করি। সব মিলিয়ে মাসে এক হাজার টাকা দেব আমি। বাগানে হাটাহাটি করার জন্য আরো একশ’ টাকা। আমার দিকে তাকিয়ে বললো- চৌধুরী সাহেব, ‘আপনি রাজি আছেন?’ আমার চোখে পানি এসে গেল। ছেলে আমাকে চৌধুরী সাহেব বলে সম্বোধন করছে।

কত বছর হয়ে গেছে তার মুখে বাবা ডাক শুনি না! আমি বললাম- ‘ ছেলে বাবাকে-থাকা খাওয়া বাবৎ বিল পে করছে-ব্যাপারটি কি সুন্দর দেখাবে?’ সে জানালো, ‘এখানে সুন্দর-অসুন্দরের প্রশ্ন না। প্রশ্ন হল সহ্য-অসহ্যের। ’ আমি তার কথা শুনে বোকার মত চেয়ে রইলাম। সে বললো- ‘থাকা-খাওয়া সহ অতি স্বাভাবিক যে অধিকারগুলো আমার মায়ের ভোগ করার কথা ছিল, সেগুলো আমার মা ভোগ করতে পারেন নি। তাকে বঞ্চিত করা হয়েছে।

আমার মাকে সুখের দিনের স্পর্শ পেতে দেয়া হয় নি। তার আগেই দুর্দিনের সাথে তাকেও বিদায় দেয়া হয়েছে, ফ্যামিলি থেকে। যে ব্যবসা, যে টাকার জন্য আমার মাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ হয় নি, যার ফলে মাকে আমার চলে যেতে হয়েছে পৃথিবী ছেড়ে, সেই ব্যবসার টাকায় বিলাসী জীবন-যাপন করার ক্ষমতা আমার নেই। এটা আমি সহ্যও করতে পারবো না, সহ্য করতে চাইবোও না। ’ ছেলের বয়সের তুলনায় বেশি পরিণত যুক্তির কাছে আমি দুর্বল হয়ে গেলাম।

তাকে কী বলবো, কীভাবে বলবো, বুঝতে পারছিলাম না। অবশেষে ছেলের জেদের কাছে আমাকে নতি স্বীকার করতে হলো। সে আমার হাতে এগার’শ টাকা ধরিয়ে দিয়ে বললো, ‘এটা গত মাসের বিল। ’ চোখ মুছে মুছে সেই টাকা হাতে নিতে হলো আমাকে। ” আমান সাহেবের চোখে আবারো পানি এসে গেল।

তিনি মাথা নিচু করে আবারো চোখ মুছলেন। তারপর বললেন- “তবে ছেলে আমাকে সহ্য করতে না পারলেও যে মহিলাকে বিয়ে করার কারণে আমার উপর তার রাগ, বিচিত্র কোনো কারণে সে তার সেই ছোট মা’কে আবার খুব পছন্দ করতে লাগলো। মাঝে-মধ্যে আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার পর দু’জন মিলে আইসক্রীম কিনে খায়। গল্প-গুজব করে। আমার ২য় স্ত্রী শাহানাও ছেলেকে খুব ভালবাসে।

এতবেশি ভালবাসে যে, একদিন সে আমাকে জানালো, সে কোনো দিন মা হতে চায় না। কারণ জিজ্ঞেস করলে সে বললো, ‘তার নিজের সন্তান হলে হয়ত কম্পাসকে আর এখনকার মত ভালবাসতে পারবে না। ” আমান সাহেব উপস্থিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দিকে এবার চোখ তুলে তাকালেন। এতক্ষণ তিনি কথা বলেছেন নিচের দিকে তাকিয়ে। সবগুলো মানুষের চোখ ছলছল করছে।

তিনি বললেন- “গতকাল শেষবার আমি আমার ছেলের সাথে কথা বলেছি। তাকে বলেছি সে চাইলে এই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব নিতে পারে। আমার হিসাবে না নিক, মূল্য ধরে নিয়ে যেতে পারে। পরে আমাকে আমার টাকা শোধ করে দেবে। সে কী বলেছে জানেন? সে বলেছে, ‘দেখো বাবা, তুমি কিছু মনে করো না।

আমি আমার জীবনকে কারো সাহায্য ছাড়াই দাঁড় করাতে চাই। আমি জানি তোমার অনেক টাকা আছে। এত টাকা যে, আমি হয়ত এক জীবনে সেগুলো গুনেও শেষ করতে পারবো না। কিন্তু আমার জীবনে অনেক টাকার দরকার নেই। আমার দরকার অন্যকিছু।

এক সময় একটু ভালবাসার জন্য কাঙাল ছিলাম আমি। আমার মা আমাকে বঞ্চিত করে স্বার্থপরের মত চলে গেল। আর তুমি.....’ [দীর্ঘ আঠার বছর পর এই প্রথম ছেলে আমাকে বাবা বলে ডাকলো। আমাকে তুমি করে বললো। ] সে আরো বললো, ‘তোমার প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই বাবা।

কোনো চাহিদাও নেই। তুমি যদি পশ্চিমাদের মত তোমার সকল বিষয় সম্পত্তি কোনো কুকুর বা বিড়ালের নামে উইল করে দিয়ে যাও, তবুও আমার কোনো কষ্ট হবে না। ’ আমি তখন বলেছি, ‘তাহলে তুইও চল আমাদের সাথে। ওখানে গিয়ে না হয় নিজের মত আলাদা হয়ে থাকবি। ’ সে বলেছে, ‘এই মাটির সাথে আমার মা মিশে আছে।

এদেশের মাটি শুকলে আমি আমার মায়ের গন্ধ পাই। এই মাটি ছেড়ে তো আমি যাব না বাবা। তোমরা যাও। ভাল থেকো। ” উপস্থিত সকলের প্রতি দৃষ্টি দিয়ে আমান সাহেব বললেন- “ আগামীকাল থেকে আপনাদের সাথে আর কখনো দেখা হবে না।

ইতিমধ্যে আপনাদের সকলের হাতে আমার পক্ষ থেকে বিদায়ী উপহার পৌছে দেয়া হয়েছে। আমি চাই আপনারা আগের মতই আন্তরিকতা দিয়ে এই প্রতিষ্ঠানে কাজ করবেন। যদিও আমি মালিকানা বিক্রি করে দিয়েছি, কিন্তু বিক্রির শর্ত হচ্ছে এখানকার কাউকেই ছাটাই করা যাবে না। নতুন মালিক রাজী হয়েছেন। উনি খুব ভাল লোক।

আমার থেকে তো অবশ্যই ভালো। উনি আপনাদেরকে এতবেশি ভালবাসা দিয়ে পরিচালনা করবেন যে, অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আমার ভালবাসা তার ভালবাসার কাছে ছোট মনে হবে। আপনারা বাধ্য হবেন আমাকে ভুলে যেতে। ’ সবাই একসাথে কান্নাজড়িত কন্ঠে শব্দ করে উঠলো- আমরা সেটা চাই না। আমরা সেটা চাই না।

সকলের চোখের পানিকে সাথে নিয়ে বিদায় নিলেন চৌধুরী আমানুল্লাহ কবীর। ..চলবে

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.