পূর্ব প্রকাশিতের পর
মুসকানের মন ভাল নেই। এমনটি তার হয় মাঝে-মধ্যে। আর তখন সে সোজা চলে যায় দক্ষিণের জানালা ঘেঁসা ছোট্ট চিলে কোঠায়। এই ঘরটিকে সে একটু অন্যরকম করে সাজিয়ে রেখেছে। দরজায় হালকা সবুজ রংয়ের পর্দা টানানো।
মেঝেয় কালো কার্পেট। পঁচিশ ওয়াটের একটি নীলাভ বাল্ব লাগিয়ে রাখা হয়েছে। দরজা বন্ধ করে লাইট জ্বালিয়ে দিলে অনেকটা চায়নিজ চায়নিজ ভাব চলে আসে। ঘরটির নাম সে দিয়েছে “শান্তি ঘর”।
মুসকানের যখন খুব মন খারাপ করে, তখন শান্তি ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়।
তখন আলো-অন্ধকারের মাঝামাঝি একটা অবস্থা তৈরি হয়। সে ওখানে হাত পা ছেড়ে লম্বা হয়ে শুয়ে থাকে। মেডিটেশন করে। চোখ বন্ধ করে আস্তে আস্তে পৃথিবীর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা, তারপর মনের বাড়ি বানানো, সেই বাড়ির বাগানে বিকেলবেলা ধোঁয়া উড়া কফির মগ হাতে পায়চারী... অইসব আর কি। এই আপাতদৃষ্টিতে হাস্যকর ব্যাপারগুলোতে লজিকের সাপোর্ট আছে কিনা-সেটা কখনো খোঁজে দেখেনি মুসকান।
দেখার দরকার মনে করে নি। তার দরকার মনখারাপ ভাব দূর করা। সে লক্ষ্য করেছে ওখানে অইসব হাবিজাবি করলে সত্যিই তার মন ভাল হয়ে যায়।
তবে আজ মুসকানের মন একটু বেশি খারাপ। জ্বর মাপার যন্ত্র আছে।
রোগীকে হা করিয়ে যন্ত্রটি মুখে ঢুকিয়ে দিয়ে কয়েক সেকেন্ড পর সেটা বের করে এনে বলে দেয়া যায় জ্বর কত? এক’শ এক নাকি এক’শ দুই। মনের অবস্থা পরিমাপ করার জন্যও থার্মোমিটার টাইপের কোনো যন্ত্র থাকলে ভাল হতো। মন খারাপ ভাবের প্রকৃত অবস্থা সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়া যেত।
যদি ধরে নেয়া হয় মন খারাপের সর্বোচ্চ স্তর বিশ, তাহলে আজ মুসকানের মনখারাপের সূচকটি ঘুরোঘুরি করছে সতের/আঠারোর আশেপাশে। মুসকানের উচিৎ দীর্ঘ সময়ের জন্য শান্তি ঘরে ঢুকে যাওয়া, অথচ বিচিত্র কোনো কারণে আজ তার ওখানে ঢুকতে ইচ্ছে করছে না।
সে চাইছে এই মনখারাপ ভাবটি কিছুক্ষণ পুষে রাখতে। এই অবস্থায় সে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নিয়ে ভাবতে চায়।
সে জানে মানসিক বিপর্যয়ের এই অবস্থায় সুন্দর করে কিছু ভাবা যাবে না, লজিক এলোমেলো হয়ে যাবে, তবুও।
অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছে সে। ইডেন কলেজ।
ক্লাশ নাইন থেকে নিয়ে এ পর্যন্ত অনুমান একশ’টি ছেলে তার সাথে ভাব জমাতে চেষ্টা করেছে। তার সাথে দু’টি কথা বলার জন্য উদগ্রিব হয়ে থেকেছে। অথচ সে কাউকেই পাত্তা দেয়নি। দুই কারণে,
এক.
তার কাছে প্রেম মানে এক ধরণের ন্যাঁকামো। অযথা আবেগের জন্ম দেয়া, মাঝে কিছুদিন ক্লাশ ফাঁকি দিয়ে বাদাম খেয়ে বেড়ানো, বাবার পকেট থেকে টাকা সরিয়ে টাকাগুলো মোবাইলের পেটে ঢুকিয়ে অনেক রাত, সারা রাত অর্থহীন কথা বলা।
তারপর হয় ছ্যাক্ খেয়ে বাকী জীবন মুখটাকে বাংলা ৫ এর মতো ভোতা বানিয়ে ভাব ধরে থাকা, নয়ত বিয়ে করে ঝগড়া-ঝাটিকে স্থায়ীভাবে জীবনের অংশ করে নেয়া। কী দরকার!
দুই.
এ পর্যন্ত তেমন কাউকে তার চোখেও পড়ে নি।
অথচ আজ বান্ধবী ঝুমু’র জন্মদিনের পার্টিতে কম্পাসের সাথে প্রথম দেখা হলো তার। দেখা হওয়া মানে দূর থেকে দেখা। কম্পাসের প্রতি নজর পড়তেই চোখ আটকে গেল তার।
‘ প্রথম দেখায় প্রেম’ বলে অতি সস্তা একটা কথা বাংলা সিনেমায় চালু আছে। ব্যাপারটা ঠিক তা না। প্রেম ব্যাপারটি নিয়েই তার এক ধরণের অ্যালার্জি আছে। অতএব প্রথম দেখায় প্রেমে পড়ে যাওয়ার ঘটনাটি তার ক্ষেত্রে অন্তত ঘটবার কথা না। অথচ আজ বিচিত্র কোনো কারণে সম্পূর্ণ ভিন্ন রকমের অনুভূতির জন্ম হল মুসকানের মনে।
এই অনুভূতির কোনো নাম নেই।
এটাকে প্রেম বলা যাচ্ছে না কারণ, মনের সাথে মনের ভাবের আদান-প্রদান হওয়ার আগ পর্যন্ত সেটাকে প্রেম বলা যায় না। আর একতরফা হলে সেটাকে মোহ বলা যেতে পারে, আবেগ বলা যেতে পারে, বাহ্যিক সৌন্দর্য বা আচার-আচরণের প্রতি গভীর টান বলা যেতে পারে, এমন কি পাগলামীও বলা যেতে পারে। তবে কোনো অবস্থাতেই প্রেম বলা যাবে না।
তাহলে এই অবস্থার কী নাম দেবে সে?
আবার এই মুহুর্তে কম্পাস নামের ছেলেটি যদি তার সামনে এসে টেলিভিশনের বিজ্ঞাপনের মডেলদের মত বলে-“চলো, বিয়ে করে ফেলি।
” তাহলে সাথে সাথেই সে ‘না’ করে দেবে। বিয়ে ব্যাপারটি নিয়ে মুসকানের মনে এক ধরণের খুত্খুতে ভাব আছে। জানা নেই শুনা নেই, এমন একটি অপরিচিত ছেলের সাথে এক বিছানায় শুয়ে থাকা এবং...
ভাবতেই যেন কেমন লাগে মুসকানের। সে এই অস্বস্থিকর প্রক্রিয়ার ভেতরে দিয়ে যেতে চায় না। অবশ্য যারা ঢাক-ঢুল পিঠিয়ে বিয়ে করছে, তাদের প্রতি তার কোনো অভিযোগ নেই।
পৃথিবীর চলমান স্বাভাবিক বংশবিস্তারের ধারাকে বাঁচিয়ে রাখতে বিয়ের বিকল্প নেই। তবে তার একজনের জীবনে বিয়ে না করলে কিছু যাবে আসবে না। প্রকৃতির পরিকল্পনার মহাভারত অশুদ্ধ হয়েও যাবে না।
প্রেম এবং বিয়ে নিয়ে এই হল মুসকানের মানসিক অবস্থান। অথচ আজ তার মনে রহস্যময় বৈচিত্রের ময়ূর পেখম মেলেছে।
সে বুঝতে পারছেনা আসলে কী হচ্ছে? কেন হচ্ছে?
এমন নয় যে, কম্পাস (পরে বান্ধবীর কাছ থেকে নাম জেনেছে) ছেলেটি অপরূপ সুন্দর এবং অসাধারণ হ্যান্ডসাম। হালকা-পাতলা গড়নের শ্যামলা একটি ছেলে। তবে চেহারায় একধরণের শিশু সূলভ চাঞ্চল্য এবং সারল্য আছে। চোখ ভর্তি মায়া। তবে কম্পাসের যে দিকটি মুসকানকে আকর্ষণ করেছে, তা হলো-তার ব্যক্তিত্ব।
মানুষের ব্যক্তিত্ব ফুটে উঠে তার কথাবার্তা, চাল-চলন এবং কিছুটা পোশাক-পরিচ্ছেদে, কম্পাসের ব্যক্তিত্ব ফুটে উঠেছে তার চেহারায়। অন্তত মুসকানের তাই মনে হয়েছে।
অনুষ্ঠানের মাঝপথেই মুসকান ‘শরীর খারাপ লাগছে’ বলে বাড়ি ফিরে এসেছে। আসার সময় কৌশলে ঝুমু’র কাছ থেকে কম্পাসের সেলফোন নাম্বারটি সংগ্রহ করেছে। ব্যাপারটি সহজ হয়েছে কারণ, কম্পাস হচ্ছে ঝুমু’র আপন খালাত ভাই।
বেশ কয়েকদিন কম্পাসের মোবাইল নাম্বারটি ডিসপ্লেতে এনে মুসকান বারবার বৃদ্ধাঙ্গুলী নিয়ে গেছে সেন্ড বাটনে কিন্তু চাপ দিতে পারে নি। সে লক্ষ্য করেছে তার হাত কাঁপছে!
আজও সারাদিন চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে মুসকান। যে কারণে রাতে ঘুম হয় নি একফোটাও। তার অস্বস্থি আরো বাড়িয়ে দিয়েছে যে ব্যাপারটি, সেটি হলো, অতি সাদামাটা টাইপ এই ছেলেটির জন্য তার ভেতরে এত অগ্রহ তৈরি হওয়ার কারণ কি?
সকালে নাস্তার টেবিলে বাবা জিজ্ঞেস করেছেন-
‘ কি-রে, তোর চোখ এত লাল কেন? রাতে ঘুম হয় নি? শরীর-টরীর খারাপ না তো?’
হাসার চেষ্টা করে মুসকান জবাব দিয়েছে-
‘ না বাবা, শরীর ঠিক আছে। সামনে পরীক্ষা তো, তাই একটু বেশি রাত জেগে পড়ার কারণে হয়ত চোখ একটু লাল দেখাচ্ছে।
ও কিছু না। ’
‘ না রে, কিছু একটা তো হয়েছে। মুখটাও কেমন শুকনা শুকনা লাগছে। ’
‘ এটা সব বাবাদেরই লাগে। আর মুখতো শুকনা লাগবেই।
ঘুম থেকে উঠে দাঁত ব্রাশ করে মুখ ধোয়ার পর খুব ভাল করে টাওয়েল দিয়ে ঘসে মুখ শুকিয়ে ফেলেছি না?’
হালকা রসিকতা করে পরিবেশটাকে স্বাভাবিক করতে চেষ্টা করলে মুসকান।
সকাল ১০টায় মোবাইল ফোনটি হাতে নিয়ে ছাদে চলে গেল সে। যা হবার পরে দেখা যাবে। ফোন সে করবেই। ফোনে কী বলবে, সেটা সারারাত ধরে গুছিয়ে রেখেছে সে।
আস্তে আস্তে কম্পাসের মোবাইলের ডিজিটগুলো টিপতে শুরু করে সে-০১৭১১-০০০০০০
...চলবে
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।