ব্যস্ত নগরীর ফুটপাত দিয়ে আনমনা ভঙ্গিতে হাটছে কম্পাস। চাকরীর জন্য ইন্টারভ্যু দিতে গিয়েছিল একটি মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানীতে। ইন্টারভ্যু বোর্ডের কর্মকর্তাদের কথাবার্তার ধরণ থেকে সে মোটামুটি স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পেরেছে যে, এদের প্রায় সকলের মাথাই বেশ কিছুটা আউলা।
প্রথমেই তাকে প্রশ্ন করা হলো-
‘ আপনার নাম তো কম্পাস। তাহলে আপনি দক্ষিণমুখি হয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছেন কেন? আপনার তো উত্তরমুখি হয়ে থাকার কথা।
এক কাজ করুন, আপনার সমস্যা হলে আপনি আমাদেরকে পেছন ফিরেই বসুন। সমস্যা নেই। ভাল কথা, আপনি তো মুসলমান। তা নামাজ পড়েন কোন্ দিকে? মুখ কি পশ্চিম দিকে রাখতে পারেন? নাকি মাঝে-মধ্যে চুম্বকের টানে উত্তর দিকেও এসে যায়?’
কম্পাস বিব্রত ভক্তিতে তাকিয়েছিল তাদের দিকে। বুঝাই যাচ্ছে এটা প্রশ্ন নয়।
মজা করা। কম্পাস দেখলো পাশের জন তরকারিতে আরেকটু লবণ দিলেন। বললেন, ‘আচ্ছা কম্পাস সাহেব, বলুন দেখি কম্পাসের কাটা সব সময় উত্তরমুখি হয়ে থাকে কেন?’
প্রশ্নটি শুনে কম্পাসের মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। সে এখানে তার নামকরণের কারণ ও স্বার্থকতা শীর্ষক কোনো প্রবন্ধ রচনা করতে আসে নি। তাছাড়া কম্পাসের কাটা কেন উত্তরমুখি হয়ে থাকে, এটা তার চাকরীর আনুসাঙ্গিক বিষয় না।
সে জানে পৃথিবীর উত্তর দিকে চুম্বক লোহার পাহাড় অবস্থিত। আর কম্পাস নামক দিকদর্শন যন্ত্রের ছোট্ট কাটার মাথায় চুম্বক লাগানো থাকে বলে সেই কাটাটি সবসময় উত্তরমুখি হয়ে থাকে। কিন্তু বলতে ইচ্ছে করলো না। ওরা প্রশ্নটা জানার জন্য করে নি। করেছে মজা করার জন্য।
প্রশ্নকর্তা আবার বললেন, ‘কী হলো মিষ্টার কম্পাস? কথা বলছেন না কেন?’
‘ আমি জানি না স্যার। ’
গর্বের হাসি ফুটলো প্রশ্নকর্তার মুখে। তিনি বললেন, ‘পৃথিবীর উত্তরপ্রান্তে চুম্বক পাহাড় থাকায় এটা হয়। আচ্ছা কম্পাস সাহেব, আপনার কি অই পাহাড়টি দেখতে ইচ্ছে করে না?’
অসহায় শিশুদের মত তাকালো কম্পাস।
প্রশ্নকর্তারা একটু সদয় হলেন।
এ নিয়ে আর কথা বললেন না। শুধু বললেন, ‘দেখুন, এখানে আমরা যারাই চাকরী করি, তারা সবাই বিনাপ্রশ্নে মালিকের আনুগত্য করি। আপনাকেও সেটা করতে লাগবে। আপনি কি সেটা পারবেন?’
কম্পাস এবারো অসহায়ের মত তাকালো তাদের দিকে। এ জাতীয় প্রশ্নের জবাব কেমন করে দিতে হয়, সেটা তার জানা নেই।
প্রশ্নকর্তারা আবার বললেন-
‘ দেখুন, আপনার যদি ব্যক্তিত্ব নামক কোনো রোগ থাকে, তাহলে এই রোগ না সারানো পর্যন্ত এখানে চাকরী করতে পারবেন না। আমরা আমাদের বিবেকবুদ্ধি বাসায় রেখে আসি। আপনাকেও সেটা করতে হবে। পারবেন আমাদের মত কুকুর স্বভাবী হতে?’
‘ কুকুর স্বভাবী?’
‘হুঁ, কুকুর স্বভাবী। তবে পুরোপুরি কুকুরস্বভাবী আমরা হতে পারি নি।
তেমন ভাগ্য নিয়ে সম্ভবত জন্মাই নি আমরা। ’
অবিশ্বাস্য ভঙ্গিতে কম্পাস তাকালো জুরি বোর্ডের সদস্যদের দিকে। দেখতে চাইলো তারা রসিকতা করার চেষ্টা করছেন কি না?
প্রশ্নকর্তা বললেন, ‘তবে যাই বলুন, একটি কাজ কিন্তু এখানে এসে জানা হয়েছে। কুকুর অত্যন্ত প্রভূভক্ত প্রাণী, জানতাম আমরা। কিন্তু এখানে এসে প্রথম জানতে পারলাম কুকুর শুধু প্রভূভক্ত প্রাণী-ই না, কুকুরের মধ্যে এমন দশটি মহৎ গুণ আছে, যেগুলো কোনো মানুষের মধ্যে চলে আসলে সে আল্লাহর ওলি হয়ে যায়।
এবারে কাজের কথায় আসি? চাকরীটা আপনাকে পেতে হলে আপনাকে যা করতে হবে, তা হলো, আপনাকে নিজে থেকেই খোঁজে বের করতে হবে কুকুরের সেই মহৎ গুণগুলো কী কী? তারপর সেগুলো ফুলস্কেপ কাগজে লিখে সাথে আপনার মন্তব্য জুড়ে দিয়ে এপ্লিকেশনের সাথে জমা দিতে হবে। ’
কম্পাস বুঝতে পারছে এই প্রতিষ্ঠানের সকলেই মোটামুটি কিছুটা মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়ে গেছেন। এখানে চাকরী করলে তাকেও এই ভাগ্য বরণ করতে হবে। তার উচিৎ নিয়োগদাতাদের বলা, কিছু মনে করবেন না স্যার, কুকুরের মত প্রভু ভক্তির এই চাকরীটা আমি করতে চাচ্ছি না। আপনাদের অতি মূল্যবান সময় নষ্ট করার জন্য দুঃখিত।
আর যদি বেয়াদবি মাপ করেন, তাহলে ছোট্ট একটি পরামর্শ দেই। সম্ভব হলে এই প্রতিষ্ঠানের জন্য পার্মানেন্ট একজন সাইকিয়াট্রিষ্ট নিয়োগ দেয়া যায় কি না বিবেচনা করে দেখবেন।
কিন্তু কথাগুলো তার বলা হয় নি। চাকরীটা তার বড়বেশি প্রয়োজন। মায়ের উইল করে রেখে যাওয়া টাকায় এ পর্যন্ত চলেছে।
সেই টাকাও ফুরিয়ে আসছে। সেই ছোটবেলা থেকেই সে বাবার অর্থ থেকে দূরে থেকেছে। এমন কি বাবার খাবারটা পর্যন্ত খায় নি।
কম্পাস সোজা পা বাড়ালো আজিজ সুপার মার্কেটের দিকে। বড় বড় লেখক-সাহিত্যিকরা ওখানে আড্ডা দেন।
তাদের কাছ থেকে কোনো হিন্টস্ পাওয়া যেতে পারে। ওখানে বড় বড় লাইব্রেরীও আছে। প্রচুর বইপত্র পাওয়া যায়। সেসব বইয়ের কোনো না কোনোটিতে নিশ্চয়ই লেখা আছে কুকুরের সেই মহৎ গুণগুলো। খোঁজে বের করতে হবে।
তবে সমস্যা হচ্ছে ঠিক কোন্ ধরণের বইতে সেটা পাওয়া যাবে বলা মুশকিল।
বেশ কয়েকটি লাইব্রেরী ঘুরাঘুরি করলো কম্পাস। সারি সারি করে সাজিয়ে রাখা বইয়ের থাকগুলোতে চোখ বোলালো। তেমন কোনো বই তার চোখে পড়লো না।
এক সেলস্ম্যান জিজ্ঞেস করেছে-
‘ এক্সকিউজ মী স্যার? কোন্ ধরণের বই খুঁজছেন বলুন?’
কম্পাস বলেছে, ‘না, তেমন বিশেষ কোনো বই না।
এমনি এমনিই চোখ বোলাচ্ছি। পছন্দের কোনো বই পেলে বলবো। ’
এছাড়া আর কী-ই-বা বলার ছিল তার। সে তো আর সেলস্ম্যানকে বলতে পারে না- কুকুরের মহৎ গুণাবলীর ব্যাখ্যা লিখা আছে যে বইতে, সেই বইটি আমাকে দেন তো?
পকেট থেকে মোবাইল ফোনটি বের করলো কম্পাস। খালাতো বোন ঝুমু’র সাথে কথা বলা দরকার।
অপ্রয়োজনীয় বিষয়াবলীতে তার পান্ডিত্ব অসাধারণ। কম্পাসের ধারণা গুরুত্বহীন সাবজেক্টের ‘নলেজ এনসাইক্লোপিডিয়া’ হিসেবে ঝুমুকে পদক দেয়ার ব্যাপারটি বিবেচনা করা যেতে পারে।
‘ হ্যালো ঝুমু?’
‘ কম্পাস ভাইয়া? স্লামালিকুম। ’
‘ কিরে। আজ বড় ভদ্র হয়ে গেলি? একেবারে আস্তো সালাম।
ব্যাপার কি?’
‘ ব্যাপার কিছু না। নিশ্চয় তুমি কোনো সমস্যায় পড়েছ। সমস্যায় না পড়লে তোমার তো ঝুমুর কাছে ফোন করার কথা না। আর যেহেতু সমস্যায় আছো, সুতরাং ধরে নেয়া যায় অশান্তিতেও আছো। এজন্য প্রথমেই তোমার দরকার শান্তি।
তাই সালাম দিলাম। সালাম অর্থ তো শান্তি। আসসালামু আলাইকুম অর্থ তোমার উপর শান্তি বর্ষিত হোক। ’
কম্পাস বললো, ‘কী রে! আজকাল এই লাইনে আগ বাড়ছিস নাকি?’
‘ তুমি কোন্ লাইনের কথা বলছো?’
‘ এই তো, ধর্মীয় লাইনে। ’
‘ দেখো ভাইয়া, আমি বিশ্বাস করি লাইন সর্বমোট দুইটা।
সোজা লাইন, বাঁকা লাইন। অথবা বলতে পারো সঠিক লাইন, ভুল লাইন। আমাদের সব সময়ই কি সঠিক লাইনে থাকা উচিৎ নয়?’
‘ তুই কি সবার সাথেই এভাবে লেকচার দিস? নাকি শুধু আমার সাথে?’
‘ সবার সাথেই চেষ্টা করি, তবে পারি না। বুদ্ধিমানরা বেশি কথা সহ্য করতে চায় না। ’
‘ কী বললি? তার মানে আমি বোকা?’
‘ স্যরি ভাইয়া, মজা করলাম।
স্যরি এগেইন। ’
কম্পাস বললো, ‘আচ্ছা ঠিক আছে। বুঝলাম সালাম অর্থ শান্তি। আসসালামু আলাইকুম অর্থ-তোমার উপর শান্তি বর্ষিত হোক। কিন্তু তুই তো আসসালামু আলাইকুম বলিস নি।
বলেছিস স্লামালিকুম। আচ্ছা এই স্লামালিকুম অর্থ কি রে?’
ঝুমু চুপ হয়ে গেল। প্রশ্নটা তার জন্য একটু কঠিন হয়ে গেছে। প্রসঙ্গ পাল্টানো দরকার। সে বললো, ‘কেন ফোন করেছো বলো?’
‘ আচ্ছা ঝুমু।
কুকুর সম্বন্ধে তোর এক্সপিরিয়েন্স কেমন?’
‘ কী সম্বন্ধে?’
‘ কুকুর সম্বন্ধে। ’
‘ কুকুর সম্বন্ধে?’
‘ হ্যাঁ। ’
ঝুমু ভেবে পেল না এই প্রশ্নের মানে কি। চেহারা দেখতে পারলে কিছুটা আন্দাজ করা যেত। বুঝা যেত ইয়ার্কির মোডে কথাটি বলা হচ্ছে কি না।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে মোবাইলে চেহারা দেখা যাচ্ছে না। কম্পাস আবার জিজ্ঞেস করলো-
‘ কী রে, কথা বলছিস না কেন?’
‘ কী বলবো?’
‘ অই যে বললাম, কুকুর সম্বন্ধে তোর জ্ঞান কেমন?’
‘ আচ্ছা ভাইয়া, কুকুর কি থিসিসের জন্য কোনো আদর্শ সাবজেক্ট?’
কম্পাস বললো, ‘কথাটাকে তুই অভাবে নিচ্ছিস কেন ঝুমু? আমি কুকুর বিষয়ে কিছু ইম্পরটেন্ট তথ্য জানতে চাচ্ছি। তাই তোকে জিজ্ঞেস করলাম। ’
ঝুমু বললো, ‘কী জানতে চাও?’
কম্পাস কিছুটা ইতস্তত করে বললো, ‘কুকুরের নাকি কিছু মহৎ গুণাবলি আছে। ওগুলো একটু জানতে চাই।
’
‘ কুকুরের আবার মহৎ গুণ থাকবে কীভাবে? অবশ্য ডগ হলে ভিন্ন কথা। অপরাধীকে ধরতে তাদের যোগ্যতা ও দক্ষতা অসাধারণ। আমার ধারণা পুলিশের’চে-ও বেশি। গন্ধ শুকে শুকে ক্রিমিনাল পর্যন্ত পৌছে যায়। ’
কম্পাস বললো, ‘ঝুমু, কথাটাকে তুই হালকা করে নিচ্ছিস।
আমি কিন্তু সত্যি সত্যিই জানতে চাচ্ছি। ’
‘ আমি জানি না ভাইয়া। কুকুর বিষয়ে কখনো গবেষণা করি নি। তবে...’
‘ তবে কি?’
‘ একজনকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারি। কুকুর বিষয়ে তার প্রচন্ড আগ্রহ।
ভাড়া বাসায় থেকেও সে তিনটা কুকুর পোষে। ’
‘ কে সে?’
‘ সেটা তোমার জানা দরকার নেই। আমি যদি জানতে পারি, তোমাকে জানাবো। ’
কম্পাস বললো, ‘তার আর দরকার নেই। ’
‘ দরকার নেই কেন?’
‘ সেটা তোর জানারও দরকার নেই।
’
কম্পাস লাইন কেটে দিল।
বিকেল পর্যন্ত ঘুরোঘুরি করে কম্পাস বাসায় ফিরে আসলো। কুকুর বিষয়ক সমস্যা আপাতত ভুলে থাকতে হবে। খুব ক্ষিধে লেগেছে। তবে এই মুহুর্তে তার’চে-ও যা জরুরী, সেটা হচ্ছে বিশ্রাম।
বাসায় ফিরে বেশ সময় নিয়ে লম্বা একটা গোসল দিল সে। গোসলের পর শরীরটা হালকা লাগছে। সারাদিন প্রচন্ড ধকল গেছে শরীরের উপর। গোসল করায় শরীরটাতেও একটা পবিত্র পবিত্র ভাব চলে এসেছে। পেটের ক্ষিধাও বেড়েছে।
কিন্তু ভাত খেতে ইচ্ছে করছে না। এক মগ কফি খেতে পারলে ভাল হত। বুয়া চলে গেছে। এখন কফি খেতে হলে নিজেকে বানিয়ে খেতে হবে। আপাতত ক্লান্ত শরীর থেকে সাপোর্ট পাওয়া যাচ্ছে না।
বিছানায় গা এলিয়ে দিল কম্পাস। চোখ বুঝে আসছে ঘুমে। সেই সঙ্গে মাথার মাঝে এসে ঘুর ঘুর করছে কুকুর বিষয়ক জটিলতা। ঘুম এবং কুকুর, মাথার ভেতরে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই পরাজিত হয় কুকুর।
জিতে যায় ঘুম। গভীর ঘুমের কোলে ঢলে পড়ে কম্পাস।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।