পূর্ব প্রকাশিতের পর‘
এক মহিলা ফোন করেছেন উনার ছেলেকে। ছেলে থাকে আমেরিকায়। উনি আবার দীর্ঘদিন ওখানে থাকার সুবাদে আঁকা-বাঁকা পথে চলাফেরা করে এইড্স্ বাধিয়েছেন।
তো ছেলেটির মা ছেলেকে ফোন করে বলছেন, ‘বাবা, শুনলাম তোর এইড্স্ হয়েছে? আল্লাহর কাছে দো’আ করছি। এছাড়া আর তো কিছু করারও নেই।
তুইও আল্লাহ আল্লাহ কর। আর বাবা, দয়া করে দেশে আসিস না। নিরীহ গ্রামবাসীকে মেরে ফেলা ঠিক হবে না। ’
ছেলে বললো, ‘কী বলছো মা? গ্রামবাসীকে মেরে ফেলার কথা আসছে কেন? আর আমি বাড়ি আসলে তাদের সমস্যা কোথায়? আমি আমার মত করে থাকবো। আলাদা থালা-বাসন ব্যবহার করবো।
জানো মা, হাঁচি, কাঁশি বা একই বাথরুম ব্যবহার করলেও এইড্স্ ছড়ায় না। তোমাদেরও কিচ্ছু হবে না মা। মা, তুমি অযথাই চিন্তা করছো। বেকার চিন্তা করে মাথা নষ্ট করো না তো। আমি আগামী মাসেই আসছি।
শেষ ক’টা দিন আমি আমার মায়ের মুখ দেখে দেখেই মরতে চাই। ’
মা বললেন, ‘দোহাই বাপ। এই কাজটি করিস না। ’
‘ কেন মা?’
‘ কারণ তুই বাড়ি আসলে আমাদের কাজের মেয়েটারও এইড্স হবে। কাজের মেয়ের হলে তোর বাবার হবে।
তোর বাবার হলে তো আমারও হবে। আমার হলে তোর ছোট চাচার হবে। তোর ছোট চাচার হলে তোর ছোট চাচিরও হবে। আর তোর ছোট চাচির একবার হয়ে গেলে পুরো গ্রামবাসীরই হবে। সারা গ্রামের মানুষ মারা যাবে।
একটু কষ্ট কর বাবা। এতগুলো নিরীহ, নিরপরাধ ভাল মানুষকে মারা কি ঠিক হবে?
’
জিসান বললো, ‘কম্পাস। তুই কি আজকাল এমন উদ্ভট উদ্ভট গল্প তৈরি করার পেছনেই সময় ব্যয় করছিস না কি?’
কম্পাস বললো, ‘জিসান, গল্পটা বানানো হলেও গল্পের মোটিভ কিন্তু কাল্পনিক নয়, ভিত্তি আছে। আমি এর দাগ নং, খতিয়ান নং, মৌজা নং সহ বলে দিতে পারবো। শুনবি?’
‘ তার কোনো দরকার নেই।
তার’চে বরং আজ আমি উঠি। ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে থাকলেও ভাল। বসে বসে উদ্ভট কথা-বার্তা শুনার কোনো মানে হয় না। তুই থাক্ তোর উদ্ভাবনি চিন্তা-ভাবনা নিয়ে। তবে আমার ছোট্ট একটা অনুরোধ, যাই কিছু ভাবিস, একটু শালিন যেন হয়।
মজা করতে গিয়ে শালিনতার সীমানা ডিঙানো উচিৎ না। তুই কবি-সাহিত্যিক না। তুই হুমায়ূন আজাদ, সৈয়দ শামছুল হক বা নির্মলেন্দু গুণ না যে, আপাত দৃষ্টিতে অশ্লীল কিছু লিখলেও সেটাকে ‘সাহিত্যের শিল্প’ বলে চালিয়ে দেয়া যাবে। ’
কম্পাস বললো, ‘আচ্ছা ঠিক আছে। তোর পরামর্শ আমার মনে থাকবে।
আর তুই যখন কবি-সাহিত্যিক প্রসঙ্গটা উঠালিই, তাহলে এ সংক্রান্ত একটা মজার চুটকীও শুনে যা। ভাল লাগবে। ’
জিসান তাকালো কম্পাসের দিকে। কম্পাস বললো,
‘ সম্ভবত ১৯৬৭/৬৮ সালের ঘটনা। বাংলাদেশ তখনো স্বাধীন হয় নি।
আমরা বাস করি পূর্ব পাকিস্তানে। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর তখন মোনায়েম খান। এই ভদ্রলোকের আবার জ্ঞান-বুদ্ধি ছিল ভয়াবহ।
ঢাকায় বাংলা একাডেমীর উদ্যোগে কবি-সাহিত্যিকদের এক সভায় তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। তখন পাকিস্তানে রবীন্দ্র সঙ্গীত রাষ্ট্রীয়ভাবে নিষিদ্ধ।
কবি-সাহিত্যিকরা একে একে তাদের সাহিত্য কর্ম তুলে ধরলেন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে মোনায়েম খান কিছুটা অসন্তোষ প্রকাশ করে আফসোসের সুরে বললেন,
“ আপনারা সবাই কবিতা, গল্প উপন্যাস লিখছেন, আপনাদের নিয়ে কত আশা ছিল আমাদের। কিন্তু আপনারা আমাদেরকে নিরাশ করলেন। ”
উপস্থিত কবি-সাহিত্যিকরা পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগলেন। মোনায়েম খান বললেন, “কী করছেন আপনারা? এত লেখালেখি করছেন, অথচ আপনারা কেউ এখন পর্যন্ত একটি রবীন্দ্র সঙ্গীতও লিখতে পারলেন না?”
উপস্থিত সকলে মুখ টিপে হাসতে লাগলেন।
জিসানেরও হাসি পেয়ে গেলো। সে হাসতে হাসতেই বললো, ‘আচ্ছা কম্পাস, গল্পটা কি তুই এই মাত্র জন্ম দিলি?’
কম্পাস বললো, ‘না জিসান, এটা গল্প না। এটা সত্যি ঘটনা। মোনায়েম খানকে ঘিরে আরো অনেক মজার মজার কথা আছে। আরেকটা শুন্।
একবার ঢাকাস্থ জাপান দূতাবাসে জাপানের জাতীয় দিবস উপলক্ষে এক বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। গভর্ণর হিসেবে মোনায়েম খানকেও আমন্ত্রণ জানানো হলো। তখন পূর্ব পাকিস্তানে জাপানের হাই কমিশনারের নাম ছিল মিষ্টার তাকাসিকো (Mr. Takasiko)।
অনুষ্ঠানে খাদ্য হিসেবে পরিবেশন করা হলো জাপানের অত্যন্ত প্রসিদ্ধ ও জনপ্রিয় খাদ্য সুকিপাকি (Sukipaki))। খাবারটি মোনায়েম খানের কাছে খুব সু-স্বাদু লাগলো।
অনুষ্ঠান শেষে ফিরে আসার সময় তিনি মিষ্টার তাকাসিকোকে বললেন-
‘মিষ্টার সুকিপাকি, ইওর তাকাসিকো ইজ ভেরি টেষ্টফুল!’
মিঃ তাকসিকো বিব্রত ভঙ্গিতে হাসতে লাগলেন। বললেন, ‘ইয়েস স্যার। থ্যাংক য়্যূ স্যার, এজ য়্যূ প্লিজ স্যার। ’
জিসান বললো, ‘আচ্ছা কম্পাস, জীবনটা কী তুই এভাবেই পার করে দিবি? হাসি-ঠাট্টার মধ্যদিয়ে?’
কম্পাস বললো, ‘সেটা করতে পারলে তো মন্দ হত না। ’
জিসান বললো, ‘খোদা হাফেজ।
’
‘ খোদা হাফেজ মানে? তোর না আমার সাথে আজ দুপুরে খাওয়ার কথা?’
জিসান বললো, ‘এতক্ষণ যা খাইয়েছিস, সেগুলোই হজম করতে পারছি না। আগে এগুলো তো হজম করতে দে। গুড বাই’
কম্পাস বললো, ‘গুড মর্নিং। ’
যেতে যেতে ফিরে দাঁড়ালো জিসান। হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো, ‘বেলা ১২টা একুশ মিনিটে গুড মর্নিং হয় কী করে রে?’
কম্পাস সেই চিরচেনা বিচিত্র হাসি দিয়ে বললো, ‘আমাদের জীবনটা অনন্ত জীবনের একটা সংক্ষিপ্ত ভূমিকা।
পৃথিবীতে ১০০ বছর বেঁচে থাকা মানে লক্ষ-কোটি বছরের অসীম জীবনের একটি ভোরের এক ভগ্লাংশ সময় অতিক্রম করা। কিয়ামতের এক দিনের দৈর্ঘ্য হবে পৃথিবীর হিসেবে ৫০ হাজার বছরের সমান। সেই অনুপাতে এই পৃথিবতে কেউ যদি ১০০ বছর বেঁচে থাকে, তাহলে অই একদিনের তুলনায় এই এক’শ বছর হবে ২ মিনিট ৪৫ সেকেন্ড মাত্র। অংকটা দাড়াবে-
পৃথিবীর ১০০ বছর = পরকালের ২ মিনিট ৪৫ সেকেন্ড।
সে তুলনায় আমার তো বলা উচিৎ ছিল, ‘সু প্রভাতাংশ।
’
জিসান আর কোনো কথা না বলেই বেরিয়ে গেলো। আরো কিছুক্ষণ থাকলে ফিলোসোফি ঝাড়তে ঝাড়তে কম্পাস তার মাথা ধরিয়ে দেবে।
জিসান বেরিয়ে যাবার পর কম্পাস আবারো ভাবতে থাকে মোবাইল ফোন নিয়ে।
কম্পাস ভাবে, নতুন প্রজন্মের যখন লেখাপড়া করে মানুষ হবার কথা, সে সময় কোন্ আক্কেলে মা-বাবা তাদের হাতে মোবাইল ফোন তুলে দিচ্ছেন! আর মোবাইল অপারেটরগুলোও কী উদ্দেশ্যে নিশি রাতে কলরেট দিচ্ছে কমিয়ে বা ফ্রি করে। কম্পাসের সন্দেহ হয় কোনো গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে এদেশের কিশোর কিশোরীগুলোকে মেধাশূন্য ও ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে কি না? সে মনে করে, মোবাইল ফোন ব্যবহারের ক্ষেত্রে একটি নীতিমালা প্রণীত হওয়া দরকার।
তা না হলে নতুন প্রজন্মটির বড় বেশি ক্ষতি হয়ে যাবে।
কম্পাসের মোবাইল ভাবনার জগতে এসে হানা দিল মুসকানের মোবাইল। অর্থাৎ মুসকানের ফোন। প্রথমে নাম্বার চিনতে পারেনি সে। মুসকানের নাম্বারটি সেভ করে রাখার কোনো দরকার মনে করে নি।
কম্পাস রিং রিসিভ করে স্বভাবসূলভ ভঙ্গিতে বললো-
‘ ইয়েস। ’
ওপাশ থেকে মুসকান বললো, ‘কেমন আছেন?’
‘ আপনি কে?’
‘চিনতে পারেন নি আমাকে?’
‘ স্যরি। ’
‘ গলাটা কি পরিচিত পরিচিতও মনে হচ্ছে না?’
‘ আরে! এত প্যাচাচ্ছেন কেন। সোজা করে পরিচয়টা দিয়ে দিলেই তো হয়। ’
‘ মুসকান।
’
‘ মুসকান?’
‘ হুঁ। আশা করি চিনতে পেরেছেন?’
‘ আপনার না আমাকে আর কখনো ফোন না করার কথা ছিল। ’
‘ দেখুন মিষ্টার, আপনি আমাকে ফোন না করার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। আমি আপনার অনুরোধটা রাখতে পারিনি। সবকাজ তো আর সবাইকে দিয়ে হয় না।
কী বলেন?’
কম্পাস বিরক্তির সাথে বললো-
‘ দেখুন, আপনি আমাকে যেমন ভাবছেন, আমি তেমন ছেলে না। প্লিজ অন্য কোথাও ট্রাই করুন। ’
মুসকান বললো-
‘আপনার কি রবীন্দ্রনাথের অই লাইনটির ব্যাখ্যা জানা আছে?’
‘ এখানে রবীন্দ্রনাথ আসছেন কেন?’
‘ আহ্ হা, বলুন না?’
‘ কোন্ লাইন?’
‘ অই যে, ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে’।
‘ আমি জানি না। জানার কোনো আগ্রহও নেই।
আপাতত যা জানতে আমার খুববেশি আগ্রহ, তা হল আপনার মূল পরিকল্পনাটা কি?’
মুসকান কম্পাসের কথাকে এড়িয়ে গিয়ে বললো, ‘আচ্ছা আপনার কি মনে হচ্ছে না রবি ঠাকুর এখানে ভুল করেছেন? চাবি ভেঙে নিয়ে যাবে কিভাবে? বলা তো উচিৎ ছিল-ভেঙে মোর ঘরের তালা...’
কম্পাস বললো, ‘দেখুন, তালাচাবি নিয়ে আমি আপনার সাথে কথা বলতে আগ্রহবোধ করছি না। রবীন্দ্রনাথ নিশ্চয় মনের মধ্যে কোনো ভাব নিয়ে এটা লিখেছিলেন। সবচে’ ভাল হত সরাসরি তাঁকে প্রশ্নটা করতে পারলে। সেটা তো আর সম্ভব না। অবশ্য পুরো কবিতাটা সামনে থাকলেও হয়ত কিছু একটা আন্দাজ করা যেত।
যা হোক, এ নিয়ে আমি আপনার সাথে কথা বলতে চাই না। ’
‘ তাহলে কী নিয়ে কথা বলতে চান?’
‘ কিছু নিয়েই না। দয়া করে কি ফোনটা রাখবেন?’
‘ না, কারণ আমার কথা এখনো শেষ হয় নি। ’
‘ তাহলে প্লিজ দুই মিনিটে শেষ করুন। ’
মুসকান বললো, ‘আচ্ছা কম্পাস সাহেব, আপনি আমাকে কেমন মেয়ে ভাবছেন?’
‘ সত্যি করে বলবো?’
‘ হ্যাঁ, সত্যিই বলবেন।
মিথ্যা বলার দরকার কী?’
‘ আসলে আমি আপনাকে নিয়েই ভাবি নি। ভাবার দরকারও মনে করি নি। ’
‘ এত অহংকার কিন্তু ঠিক না। ’
‘ এটা অহংকার না। আর আপনি এটাকে অহংকার ভাবলেও ক্ষতি নেই।
আপনার কথা কি শেষ হয়েছে? শেষ হয়ে থাকলে আমি রাখবো। ’
‘ এত তাড়াহুড়া করছেন কেন? আমার সাথে কথা বলে কি আরাম পাচ্ছেন না? আমি যদি আপনাকে বলি, ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি...’
ওপাশ থেকে লাইন ডিসকানেক্ট হয়ে গেল। ফোন কাটার আগে কম্পাস যে কুৎসিত শব্দটি ব্যবহার করলো, সেটা সাধারণত টানবাজারের বিশেষ কিছু মেয়েদের বেলায় বলা হয়।
এরপর কেটে গেছে অনেক দিন। মুসকানের কানে বারবার ভেসে এসেছে অই কুৎসিত শব্দটি।
তার উচিৎ কম্পাস শব্দটিও জীবনে আর মুখে না আনা। যে ছেলে কোনো কিছু না বুঝে কোনো মেয়ে সম্বন্ধে এমন বাজে মন্তব্য করতে পারে, সেই ছেলের রুচি এবং কমনসেন্স নিয়ে প্রশ্ন উঠাই স্বাভাবিক।
কিন্তু মুসকান কম্পাস নামটিকে তার মন থেকে বাদ দিতে পারলো না। তার মনে হলো, সে যদি চুপ করে থাকে, তাহলে অই ছেলের দেয়া গালিটি যে তার প্রাপ্য ছিল না, সে যে অই টাইপের মেয়ে না, এই সত্যটি মাটির নিচে চাপা পড়ে থাকবে। অন্তত এই পৃথিবীর একজন মানুষ তো তাকে খারাপ মেয়ে ভেবেছে।
কেন ভাববে?
সে ঠিক করলো, এমন পরিবেশ তৈরি করবে, যাতে করে লজ্জায় লাল হয়ে কৃতজ্ঞতায় হাত জোড় করার মত করে কম্পাস এসে দাঁড়ায় তার সামনে। সে জানে না ঘটনাটি কখন এবং কিভাবে ঘটবে। তবে ঘটবেই, এই বিশ্বাস নিয়েই কাটতে থাকে মুসকানের সময়
চলবে...
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।