হেথা নয় অন্য কোথা অন্য কোনখানে
"শৈবাল দীঘিরে বলে উচ্চ করি শির
লিখে রেখো একফোটা দিলেম শিশির। "
সেই স্কুল জীবনের ভাবসম্প্রসারনটি আজও বার বার মনে পড়ে। কেননা আমরা বোধহয় ঐ শৈবালের মতই। জীবনে কারও কাছ থেকে কি পেলাম সেটা আমাদের বিবেচনায়ই আসে না। অথচ দেবার পরিমানটা সামান্য হলেও ভাবি অনেক বড় করে।
ষময়ের ব্যবধানে কবিতার ঐ দুটি লাইন আমার জীবনে আজ প্রচন্ড অর্থবহ।
বাবার আদর থেকে বঞ্চিত ছিলাম সেই শৈশব হতেই। বড় ভাই সৌদি প্রবাসী ১৯৯১ সালের ডিসেম্বর হতেই। তখন আমি দশম শ্রেনীতে পড়ি। দুই বোন, দুই ভাই আর মা মিলে আমাদের ছো্ট্ট সংসার।
বড় ভাই বাইরে থাকেন বলে তখন থেকেই সংসারের দেখাশুনা আমাকেই করতে হতো। পুরো পরিবারটাকে আমি আগলে রাখার চেষ্টা করতাম। সংসারের খরচের চাপ কমাতে তখন থেকেই বেশ টিউশনি করতাম। নিজের হাতে সংসারের পুরো টাকা থাকা সত্বেও টিউশনির টাকা দিয়েই নিজের পকেট খরচ ও অন্যান্য খরচ চালিয়ে নিতাম। মোট কথা সংসারের গার্ডিয়ান হিসেবে নিজেকে সংযত রাখতে পেরেছি সবসময়।
বড় ভাই কে নিজের হৃদয়ে বসিয়েছি ভালবাসা ও শ্রদ্ধার দেবতা হিসেবে। বাবার অবর্তমানে সংসারের পেছনে তার অবদান ছিল অসামান্য। সবসময় স্বপ্ন দেখতাম প্রতিষ্ঠিত হয়ে কত দ্রুত তার পাশে দাঁড়াবো। সময় এগিয়ে চললো। কলেজে পড়া অবস্থায় একজনের সাথে শেয়ারে ব্যবসায় নামলাম।
পরবর্তীতে তার প্রতারক মনোভাবের কারনে নিজেকে গুটিয়ে নিলাম। একবছরে কিছু অর্থ উপার্জন করলাম এবং সেই সাথে ব্যবসায় খাটানো পুঁজি এক লাখ টাকা ফেরত নিয়ে নিলাম এবং ভাইকে দিয়ে দিলাম। কম্পিউটার ডিপ্লোমা শেষ করেছিলাম ১৯৯৮ সালে। এরপর গ্রাফিক্স ডিজাইন কোর্সটাও করে নিলাম। অবশেষে ডিগ্রী পাশের পর গার্মেন্টস এক্সেসরিজ সাপ্লাইয়ার হিসেবে কাজ শুরু করলাম।
ভালই চলছিল সবকিছু। এরি মধ্যে প্রবাস জীবনে বড় ভাইয়ের কেটে গেছে দশটি বছর। এর মধ্যে ছুটিতে দেশে এসেছেন বেশ কয়েকবার। তিনি যখনই দেশে আসতেন, তখনই আমার কাছে বর্ননা করতেন তার মানসিক অবস্থার কথা। বিদেশ করতে আর ভাল লাগেনা, মরুভূমি তার জীবনটা চুষে নিয়ে যাচ্ছে, তার এই অবস্থা সংসারের বাকীরা বুঝতেই চায়না -- এসব নানা কথা সে বলতো আমাকে।
কর্তব্য ও ভালবাসার খাতিরে এবং বিবেকের দংশনে ভাইকে আর বিদেশে থাকতে দিতে মন চাইল না। এদিকে পরিবারের খরচ একা চালানোর মত আমার অবস্থানও শক্ত নয়। তাই ভাইয়ের সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলাম আমি সৌদি আরব আসবো আর তাকে দেশে পাঠিয়ে দেবো। তাকে বসে খাওয়াবো।
জীবনের সে সিদ্ধান্তই আমার কাল হল।
ভালবাসার আড়ালে লুকিয়ে থাকা বড় ভাইয়ের বিশ্বাসঘাতকতা আমি বিন্দুমাত্র টের পাইনি। অবশেষে ২০০১ সালের সেপ্টেম্বরের আনলাকি ১৩ তে আমি পা রাখলাম এই মরুভূমির দেশে। ভাইয়ে কথা ছিল কাজ ঠিক করেই আমাকে বিদেশে আনছেন। এসে দেখলাম পুরো উল্টো। নিজেই বিভিন্ন অফিসে ঘুরে ঘুরে কম্পিউটার ডিজাইনার হিসেবে কাজ যোগাড় করলাম।
এ ব্যাপারে ভাইয়ের কোন রকম সাহায্য পেলাম না। সৌদি আরব এবং মিডলইস্ট এর অন্যান্য দেশে কন্ট্রাক্ট এবং ট্রান্সফার ছাড়া কাজ করা যায় না। প্রায় সব কোম্পানিই নির্দিষ্ট কন্ট্রাক্ট পিরিয়ডে লোক নিয়োগ করে। ঐ সময়ের মধ্যে কোন শ্রমিক নিয়োগকৃত কোম্পানি ছেড়ে অন্য কোন কোম্পানীতে অনেক ভাল জব পেলেও যেতে পারে না। এখানে লেবার প্রফেশনটা একটা বড় বিষয়।
কিছু কিছু প্রফেশন ট্রান্সফারেবল নয়। তার মধ্যে একটি ভিসা প্রফেশন হল মাজরা (কৃষি)। বড় ভাই আমাকে ঐ মাজরা ভিসাতেই এনেছিলেন। ব্যাপারটা তখন আমার জানা ছিল না। অফিসে তিনমাস প্রবেশনারী পিরিয়ড শেষে যখন ট্রান্সফারের প্রশ্ন এলো, তখনই সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা খেলাম।
মাজরা ভিসার কারনে আমার ট্রান্সফার হলনা এবং চাকরী চলে গেল। মনের দিক দিয়ে পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়লাম। কারন যেখানেই চাকরী পাচ্ছি, সমস্যা ঐ একটাই। আগে ভিসা প্রফেশন চেইঞ্জ করতে হবে। অবশেষে এখানে আর এক ভাল কোম্পানীতে ক্যাশিয়ার হিসেবে চাকরী হল।
তখন ভাইকে বললাম ভিসা প্রফেশন চেইঞ্জ করে দিতে। কিন্তু জানিনা কোন কারনে তিনি সেটা করতে অপারগতা প্রকাশ করলেন। তার বিয়ের পর থেকেই কি তার এই ষড়যন্ত্রমূলক আচরন শুরু হয়েছে নাকি মনে মনে অনেক আগে থেকেই প্ল্যান করেছিলেন বুঝতে পারিনি। তিনি আরও কিছু এমন আচরন আমার সাথে করলেন যা বলতে গেলে লেখা অনেক দীর্ঘায়িত হয়ে যাবে। ভাইয়ের প্রতি আমার বিশ্বাস ভালবাসা পুরোটাই নষ্ট হয়ে গেল তার ব্যাখ্যাহীন কাজের কারনে।
এহেন আচরনের কারনে আমি তার সঙ্গ ছাড়তে বাধ্য হলাম। তিনিও হয়তো এটাই চাচ্ছিলেন। তাই একবারের জন্যেও আর কাছে ডাকলেন না। সারা জীবনের বিশ্বাস একবার ভেঙ্গে গেলে তা বোধহয় আর জোড়া লাগে না। আমি সম্পূর্ন নিস্বঃ অবস্থায় পথে নামলাম।
দীর্ঘ চারমাস অমানূষিক যন্ত্রনা বুকে নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করেছি। দিন কেটেছে অনাহারে, অর্ধাহারে। দেশে ফিরে আসবো তাতেও বিপত্তি দেখা দিল। যেহেতু আমি জানতাম না আমার স্পন্সার কে বা কোথায় (এ ব্যাপারে ভাই আমাকে কিছুই জানতে দেননি), তাই একমাত্র পথ ছিল পুলিশের কাছে ধরা দিয়ে দেশে আসতে হবে। কত দিন জেলে থাকতে হবে তাও জানি না।
এই ছিল আমার দুঃখের ইতিহাসের সার সংক্ষেপ। যেহেতু বড় ভাইয়ের পরিচালনায় আমাদের সংসার, তাই মা-বোনেরা সবাই বড় ভাইয়ের সাথ দিয়ে আমাকে পরিত্যাগ করল। আপন নিবাসেও আমার অবস্থান বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। এ প্রবাসও আজ আমার কাছে বিপন্ন নিবাস। আজও আমি নিভৃতে আমার মায়ের জন্য চোখের জল ফেলি।
জানিনা আমার মা সেটা অনুভব করেন কিনা। বোনদের জন্য আমার হৃদয় কাঁদে। বিশেষ করে ছোট বোন কে ( যে আমার বোন ও সবচেয়ে কাছের বন্ধুও ছিল) মনে পড়ে খুব বেশি। হয়তো আমার কথা তাদের মনেও পড়েনা একবারও। আপনদের স্নেহ-ভালবাসা বঞ্চিত হতে কে চায়? আমার মত দুর্ভাগ্য যেন আর কারও না হয়।
আপন মানুষের চক্রান্তে পড়ে আর কারও জীবন যেন এভাবে ধ্বংস না হয়ে যায়।
(একটি সত্য ঘটনা)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।