আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিপন্ন গণতন্ত্র

চারিদিকে দেখো চাহি হৃদয় প্রসারি

• ভারতের সবচেয়ে খনি সমৃদ্ধ অথচ সবচেয়ে দরিদ্র এলাকা, ছত্তিশগড় ঝাড়খণ্ড ওড়িশা পশ্চিমবঙ্গ অন্ধ্রপ্রদেশের আদিবাসী অধ্যুষিত বিস্তৃত ভূখণ্ড এখন সংবাদের শিরোনামে। কারণ এখানে চলছে অপারেশন গ্রীন হান্ট। এই মিলিটারি অপারেশনের মূল লক্ষ্য হিসেবে সরকারের তরফ থেকে অবশ্য বারবার বলা হচ্ছে “দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার প্রধান বিপদ” মাওবাদের কথা, তবু এটা স্পষ্ট যে এটা আদিবাসীদের বিরুদ্ধে সরকার পরিচালিত একটি যুদ্ধ, যার মূল লক্ষ্য এই এলাকার আকরিক-খনিসম্পদকে সরকারের নিয়ন্ত্রক একচেটিয়া পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দেওয়া। একচেটিয়া কর্পোরেট ও সরকারের মধ্যকার লুন্ঠনদলিল মউচুক্তিগুলিকে কার্যকরী করা। • দীর্ঘলালিত কাঠামোগত বঞ্চনার বিরুদ্ধে আদিবাসীদের বিক্ষোভের ইতিহাস বেশ পু্রোনোই।

উপনিবেশের যুগ থেকে আদিবাসীদের তাদের বেঁচে থাকার অধিকারটুকুকে কেবল বজায় রাখতে গিয়ে মরণপণ লড়তে হয়েছে। ’৪৭ পরবর্তী স্বাধীন গণতান্ত্রিক ভারত সরকারের নীতি ও শাসনপদ্ধতিও বারবার আঘাত করেছে আদিবাসীদের। বিভিন্ন বাঁধ খনিস্থাপন প্রভৃতি ‘উন্নয়নমূলক’ কাজে তাদের বারবার উচ্ছেদ হতে হয়েছে। উন্নয়নের সামান্যতম সুফল দূরে থাক, এমনকী ক্ষতিপূরণের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় তাদের বেশির ভাগই বাসভূমি জীবিকা জীবন থেকে হারিয়ে গেছে। সরকার নিজের জানানো তথ্যেই বলেছে পুনর্বাসন দেওয়া যায়নি এমন আদিবাসীর সংখ্যা ১কোটি ৪৪ লক্ষ, যদিও বাস্তবে সংখ্যাটা অনেক অনেক বেশি, আর সেটা প্রতিদিন বাড়ছে।

বঞ্চনার বোধ তাদের মধ্যে সঙ্গতভাবেই থেকে গেছিল। এর সাথেই সাম্প্রতিক বছরগুলিতে নিওলিবারাল শাসননীতির দুনিয়ায় শুরু হয়েছে শোষণ অত্যাচারের এক নতুন অধ্যায়। বর্তমান পর্বে এটা খনি-আকরিক দখলকে কেন্দ্র করে চূড়ান্ত রূপ গ্রহণ করেছে। আমরা জানি ছত্তিশগড় ঝাড়খণ্ড অন্ধ্রপ্রদেশ হল দেশের মধ্যে কয়লা লোহা বক্সাইটের সবচেয়ে বড় ভাণ্ডার। একসময়ে কেবলমাত্র সরকারের হাতে থাকা মাইনিং এর অধিকার কয়েকবছর আগে আইন করে দিয়ে দেওয়া হয়েছে দেশি বিদেশি পুঁজিপতিদের।

তারও পরে খনিক্ষেত্রে একশো শতাংশ প্রবেশাধিকার পেয়েছে বিদেশি একচেটিয়া পুঁজি। এরা দেশের সম্পদ নিংড়ে নেওয়া বিশাল অংকের মুনাফার স্বার্থে ঝাঁপিয়ে পড়েছে খনি অঞ্চলগুলিতে। লাভের বিশাল পরিমাণ লোভ তাদের গুমখুন গণহত্যাসহ যে কোনো কাজে মরিয়া করে তুলেছে। • কতটা লাভ থাকে প্রাইভেট কম্পানীগুলোর মাইনিং এর ক্ষেত্রে ? কর্ণাটকের ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক লোকায়ুক্ত রিপোর্ট জানাচ্ছে প্রাইভেট কম্পানীগুলো এক টন লোহা উত্তোলনে নিজেরা ৫০০০ টাকা পেলে সরকার রয়্যালটি বাবাদ পায় ২৭ টাকা। বক্সাইট ও অ্যালমুনিয়াম এর ক্ষেত্রে অবস্থাটা আরো করুণ।

আর কম্পানীগুলোর এই বিপুল লাভের কড়ি ভোট সরকার বিচারক সংবাদপত্র টিভি চ্যানেল এসব কে কিনে ফেলার ক্ষেত্রে যে যথেষ্ট তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। • পাহাড় থেকে খনি – আকরিক দখলের মরীয়া চেষ্টার সামনে আদিবাসীদের বসতি জীবিকা অধিকার ইত্যাদি নেহাৎ অপ্রয়োজনীয় বিষয় হয়ে উঠেছে । একের পর এক মৌ চুক্তি হচ্ছে টাটা পস্কো এসার মিত্তল জিন্দাল বেদান্ত এর মতো কম্পানীগুলোর সঙ্গে। এরা প্রচুর মুনাফাগন্ধী যে খনিকাজ চালানোর জন্য আসছে, উচ্ছেদ তাতে একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া আর তাতে পুনর্বাসনের বিষয়টি ভীষণভাবেই অবহেলিত। এ অবস্থায় আদিবাসী প্রতিবাদ প্রতিরোধ আর বিক্ষোভ অত্যন্ত প্রত্যাশিত ঘটনা।

মৌ চুক্তির পর কোম্পানীগুলি, যারা সরকারকে পেছন থেকে নিয়ন্ত্রণ করে, আদিবাসীদের প্রতিবাদের সামনে পড়ে দাবী জানাচ্ছে ‘নিরাপত্তার’। প্রতিরোধ এড়িয়ে যাতে তারা নির্বিঘ্নে জমি দখল করতে পারে তার জন্য সরকার কখোনো রাষ্ট্রীয় বাহিনী, যেমন কোবরা গ্রে হাউণ্ড, কখোনো মদতপুষ্ট প্রাইভেট বাহিনী, যেমন সালওয়া জুদুম দিয়ে তাদের দাবী পূরণ করছে। আদিবাসীদের ওপর তীব্র আক্রমণ আর গণতান্ত্রিক অধিকারগুলির চূড়ান্ত অস্বীকারকে বৈধতা দিতেই আসছে মাওবাদী দমনের কাহিনীটি। • ঝাড়খণ্ডের উদাহরণ থেকে ব্যাপারটা বোঝা যায়। ঝাড়খণ্ড সরকার বিভিন্ন কম্পানীর সাথে মৌ স্বাক্ষর করেছেন খনি বিদ্যুৎ স্পঞ্জ আয়রন ইস্পাত শিল্প স্থাপনের জন্য।

আর সবুজ শিকার অভিযান চালানো হচ্ছে এইসব শিল্পের জন্য প্রস্তাবিত খুন্তি গুমলা বোকারো পূর্ব ও পশ্চিম সিংভূম গিরিডি চাতরা লাটেহার রামগড় হাজারিবাগ প্রভৃতি জেলাগুলোতে, যেখানে আদিবাসী মানুষ এই উন্নয়ন-উচ্ছেদের বিরোধিতা করছেন। কথাটা ছত্তিশগড় বা ওড়িষার খনিসমৃদ্ধ এলাকার জন্য একইভাবে সত্য। • সাম্প্রতিক সময়ে নিওলিবারাল অর্থনীতির প্রবল আগ্রাসী লুন্ঠন শোষণের চেহারাটা লাতিন আমেরিকা সহ পৃথিবীর নানা দেশের মতোই প্রকটভাবে এদেশেও এখন দেখা দিচ্ছে। গত কয়েকবছরে একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থে দেশজুড়ে এস ই জেড গঠনের নামে হাজার হাজার একর কৃষিজমি গ্রাস, তার প্রতিরোধকে পুলিশি সন্ত্রাসে রক্তাক্ত করার নির্মম ছবি আমরা দেখেছি। কর্পোরেটদের খনি দখলের নির্মম মরীয়া প্রয়াসকে সুরক্ষিত করতে স্বভাব লড়াকু প্রতিবাদী আদিবাসীদের ওপর সন্ত্রাস আরো বহুগুণিত হয়েছে।

রাষ্ট্রের হাতে ঘটে গেছে তার তীব্র সামরীকিকরণ, যার পোশাকী নাম অপারেশন গ্রীন হান্ট। যেখানে যত প্রতিরোধ, সবকিছুকেই দমন করা হচ্ছে মাওবাদের নামে। মাওবাদী বাহানায় গণতন্ত্রকেই নিশানা বানানোর সরকারী চেষ্টা অব্যাহত। • ভারতরাষ্ট্রের সীমিত গণতান্ত্রিক পরিসরকেও আজ বিরাট চ্যালেঞ্জের সামনে ফেলেছে অপারেশন গ্রীন হান্ট। তাকে প্রতিরোধ করার আশু প্রশ্নটি স্বাভাবিকভাবেই যে কোন গণতান্ত্রিক কাজের এক প্রধান দিক।

আর এই কাজটি ব্যাপক গণউদ্যোগের মধ্য দিয়েই সফল হতে পারে। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের ব্যাপক উদ্যোগকে পালটা হিংসা, বিচ্ছিন্ন কিছু মিলিটারি অ্যাকশন দিয়ে সমাধান করার চেষ্টাটি রাষ্ট্রকে তার স্বপক্ষে যুক্তি ও বৃহত্তর সামরিক অভিযান সমাবেশের সুযোগকেই শুধু এনে দেবে না, ব্যাপক গণভিত্তিকেও রাষ্ট্রবিরোধী গণসংগ্রাম থেকে দূরে ঠেলে দেবে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.