নাম শুনেই যার প্রেমে পড়ি
রাত দুইটা। শীতের কুয়াশার চাদরে শালবনের চারিদিক নিস্তব্ধ। শালবন। হ্যাঁ, চলেশ রিছিল-গিদিতা রেমা-পীরেন স্নাল-সেন্টু নকরেক-বিহেন নকরেক-অধীর দফোদের শালবন! না, লালমাটির শালবন যাদের রক্তে আরো লাল হয়েছিল তাদের নিয়ে কোন কথা বলার সময় এখন না। এই রাষ্ট্রের নানান আয়োজন-প্রয়োজনে প্রিয়াঙ্কা সিমসাং-মিন্টু চাম্বুগং-রীতা চাম্বুগং-মেরি চাম্বুগং-উৎস নকরেক-রাত্রি নকরেকদের বাবা কিংবা লিপু রেমা-পাপড়ি রেমাদের মায়ের বুকের উষ্ণতা থেকে চিরতরে বঞ্চিত হবার দু:খ নিয়েও কথা বলা বেমানান।
সীতা নকরেক, আগাথা চাম্বুগং, জলনী দালবৎদের বুকের গহীনে জমে থাকা কষ্টের কথাও ভাবতে চাচ্ছে না মন। উৎপল নকরেক, শিশিলিয়া স্নাল, প্রতাপ জাম্বিলদের জীবনে ঘটে যাওয়া সেই দু:সহ স্মৃতির কথাও মানাবে না। এখন সময় যে রোমান্টিসিজমের! জ্যোৎস্নার আলোরা শিশির ভেজা শালপাতা চুঁইয়ে চুঁইয়ে লুটোপুটি খাচ্ছে চারিধারে। এমন রাতের কথা চিন্তা করেইতো প্রয়াত জন থুছিন রিছিল লিখেছিলেন- হাই সারি রিনামা / দুখ্রো সুয়ে রুনামা / ফাংসি রুরু জাজংনামা নকমা ওয়ানগালেঙানা...(ভাবানুবাদ: এসো সখি এসো / ময়ূর নাচছে দেখো / নকমা বাড়ির ওয়ানগালাতে / হাত ধরে নাচব মোরা চাঁদের আলোতে...)। কবি হলে নির্ঘাত একখান কবিতা উপহার দিয়ে ধন্য করতাম পাঠকদেরকে (!)।
প্রেমিক হলে প্রেমের কথা শুনাতে শুনাতে প্রেমিকাকে অস্থির বানিয়ে ফেলতাম নিশ্চিত (!)। ২৫ মাইল এলাকায় টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ রোডে পাশে এক বন্ধ দোকানের বারান্দায় বসে বসে লক্ষী পূণির্মার বাঁধভাঙা জ্যোৎস্নার আলোয় স্টার সিগারেট ফুঁকছি। এই রাতের বেলা দুই আঙুলের ফাঁকে এইটা যে ধরে রাখতে পেরেছি তাও অনেকটা মোবাইল ফোনের কল্যাণে। ভাত খাওয়া শেষে সঞ্জয়ের ভাতিজার দোকানের সামনে আমরা যখন এলাম কিছুক্ষণ বসে গল্প করার ধান্দায় তখনই টের পেলাম দোকানের ভেতর ভাতিজা সজাগ আছে। ২৯ পয়সা/মিনিটের সুবিধায় প্রেমিকার সাথে প্রেম করছে।
না, ভাইস্তার প্রেমালাপ আমার প্রেম করতে না পারার অজানা হাহাকারকে উসকে দেয়নি, বরং সিগারেট পাওয়া যাচ্ছে এমন নিশ্চিন্ত আশাটাকেই যেন অন্যরকম কিছু মনে হচ্ছে। এমন জ্যোৎস্নারাত! প্রেমালাপ! আমি একটু রয়েসয়ে করারই পক্ষপাতি ছিলাম কিন্তু সঞ্জয়ের চিল্লাচিল্লিতে সে বেচারা পিছনদিকের দরজা খুলে আমাদের সিগারেট চালান দিল। কিছুক্ষণ পরে সেও আড্ডাতে যোগ দিল। বেশ মজার মানুষ। জানাল মোবাইলের কল্যাণে এতক্ষণ দোকানের ভেতর শুয়ে শুয়েই তার প্রেমিকাকে পূর্ণিমার চাঁদের রূপ বর্ণনা করছিল।
সে তার প্রেম সম্পর্কিত বিভিন্ন মজার গল্প শুনাতে লাগল আমাদের। ভরাট চাঁদের পানে তাকিয়ে তাকিয়ে আমরাও বেশ তাল দিয়ে চলেছি। বেশ কিছুক্ষণ এভাবে চলল। বন্ধু সঞ্জয় চাম্বুগং অনেকটা হুট করেই জানিয়েছিল বৃহস্পতিবার (২৫ অক্টোবর,২০০৭) যেন মধুপুর চলে আসি,সবকিছু সে ঠিকঠাক করে রেখেছে। তার কথা মতই গত সন্ধ্যায় পৌঁছেছি এখানে।
সুজনের (লেখক সঞ্জীব দ্রং এর ভাতিজা) সাথে গল্প করতে করতে সন্ধ্যা সাতটার দিকে সঞ্জয়ের দেখা পেয়েছিলাম। আরো কিছুক্ষণ পর সুজনরা অন্যকাজে চলে গেলে আমাকে তুষ্ট করতে সঞ্জয় নিয়ে গেল তুষ্টি সাংমাদের বাড়ি। ছোট্ট একটা বগনা (ভাত রান্নার এলুমিনিয়ামের পাতিলে চু রান্না হলে সেই পাত্রকে এই নামে ডাকা হয় এখানে) নিয়ে আমরা বসে গেলাম। ভালই পুষিয়ে গেল আমাদের। বিশেষ করে নারায়ণগঞ্জ-মধুপুরের লম্বা(সকাল ৯.৪৫ মি.-বিকাল ৫.০০ মি) ভ্রমনক্লান্তি কাটাতে বেশ সহায়ক হলো আমার।
১৯৫০ সালের আগের সময়ে এই হাবিমার চালা জমিতে হাবাহুয়া বা জুম চাষ করা মান্দি-কোচ-বর্মণেরা তাদের সারাদিনের খাটুনির পর এভাবেই ক্লান্তিনাশক পানীয়ে জুড়িয়ে নিতেন তাদের শরীর-মনকে। নিজেদের ক্লান্তি দূর করতে করতে অক্লান্ত ঘড়ির কাটা জানান দিল সে রাত বারটার ঘরে পৌঁছে গেছে। লক্ষীপূজার প্রসাদের জন্য বের হলাম দুজনে। রাস্তায় অনেকের সাথেই দেখা হল। এতক্ষণ কই আছিলা? এত দেরি কেন? ইত্যাদি সওয়ালের সাথে সবাই জানাল প্রসাদ বিতরণ শেষ হয়ে গেছে।
পান্থিদের (যুবকদের) কেউ কেউ ঠারেঠুরে জানাল লক্ষীপূজার বিশেষ কৃত্যটির কথা। হ্যাঁ, লক্ষীপূজায় এখানকার গ্রামের যুবকেরা (খৃস্টান-হিন্দু নির্বিশেষে) বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে এই কৃত্য ইতোমধ্যই সম্পন্ন করে ফেলেছে, কেউবা করার অপেক্ষায়। অধিকাংশেরই লক্ষ্য থাকে হাঁস-মুরগীর দিকে। এতে চু এর সাথে খাজিটা বেশ ভালো জমে। যাক, সেই কৃত্যে যোগ না দিয়ে আমরা হাটতে হাটতে চলে এলাম জলছত্র পূজা মণ্ডবে।
হ্যাঁ, মাঠ ফাঁকা। মণ্ডব চত্বরে কারো কোনো আনাগোনা নেই। পূজারি শেষ মুহুর্তের গোছগাছ সেড়ে নিচ্ছিলেন। মা লক্ষী আমাদের খালি হাতে ফেরালেন না। আমাদের দেখে তাড়াতাড়ি ভেতরে থেকে কিছু প্রসাদ এনে দিলেন পূজারি।
হাতের তালুতে করে চেটেপুটে শেষ করে দিলাম নিমিষেই। লিটুকে (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া মান্দি যুবক) ফোন করে চলে এলাম শান্তি নিকেতনের সামনে। বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের ইয়ূথ কনফারেণ্স আজ রাত থেকে শুরু হয়েছে এখানে। তিনদিন চলবে। সন্ধ্যায় মধুপুর পা রেখেই জানলাম সঞ্জীব দ্রং এসেছেন।
সারাদেশ থেকে (মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ইডেন কলেজ আর ময়মনসিংহে পড়ুয়া) প্রায় ৭০ জনের মত চাকমা, মারমা, টিপরা, খাসি, সান্তাল, মান্দিসহ আদিবাসী ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে এই কনফারেন্স। পাহাড়-সমতলের আদিবাসীদের মধ্যে এক মেলবন্ধন ঘটানোই এর উদ্দেশ্য। শান্তি নিকেতনে যাওয়ার রাস্তার মুখে বসে যখন সুজনের সাথে আড্ডা মারছিলাম তখন আগত অনেকের সাথেই আলাপ হয়েছিল। যাক, শান্তি নিকেতনের সামনের রাস্তায় লিটু সহ আরো কিছু মান্দি ছেলের সাথে আরো কিছুক্ষণ গ্লাসটানা আর আড্ডা মেরে সঞ্জয়দের বাড়ি আসতে আসতে রাত দেড়টা বেজে গেল। বাড়িতে সবাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।
এমনিতেই এখানে রাত নামে তাড়াতাড়ি। রান্না ঘরে ঢুকে আমরা ভাত খেয়ে নিলাম।
শীত বেশ ভালই পড়েছে এই বন এলাকাতে। শীতের প্রকোপই মহাসড়কের পাশে আমাদের জ্যোৎস্নাময় আড্ডাটা দীর্ঘস্থায়ী হতে দেয়নি। তিনটার দিকে সঞ্জয়দের রুমে লেপের ভেতরে নিজেকে লুকিয়ে ফেললাম।
ভাতিজার মতন ২৯পয়সা/মিনিটে নয়, ০ পয়সা/ঘন্টায় ভাবতে লাগলাম কোন এক জ্যোৎস্না রাতের কথা... । (অসমাপ্ত)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।