আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একজন জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ ও পরাশক্তির প্রভুরা



একজন জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ ও পরাশক্তির প্রভুরা ফকির ইলিয়াস =============================== বিশ্বের শ্রেষ্ঠ পরাশক্তির জন্য বিষয়গুলো ছিল খুবই বিব্রতকর। এমনটি যে ঘটতে পারে সে অনুমান ছিল পেন্টাগনের আইটি বিশেষজ্ঞদের। সেটাই হয়েছে। উইকিলিকস নামের হ্যাকিং ওয়েবসাইট অনেক গোপন নথি ফাঁস করে দিয়েছে। না, এসব অস্বীকার করার উপায় বিশ্বনর্তকদের নেই।

‘বিশ্বনর্তক’ শব্দটি এ জন্য বললাম, যারা বিশ্বকে নাচাতে গিয়ে, বিশ্বের গণমানুষের ভাগ্য নিয়ে খেলতে গিয়ে নিজেরাই নাচছেন। ‘যুদ্ধ নয় শান্তি চাই’- এমন বাণী যে আসলেই ফাঁকা বুলি তা প্রমাণ করেই এখন গোটা পশ্চিমা বিশ্বের টার্গেট জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ। শেষ পর্যন্ত তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ব্রিটেনে তাকে গ্রেপ্তার করার পর, তার জামিন নামঞ্জুর করা হয়েছে। পাঠানো হয়েছে কারাগারে।

তার পক্ষে দাঁড়িয়েছে গোটা বিশ্বের বিবেকবান সমাজ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশিষ্ট চিন্তক, লেখক এবং সমাজ বিশ্লেষক অধ্যাপক নোয়াম চমস্কি বলেছেন, পরাশক্তিরা নিজের চামড়া ঢাকতেই এখন উদুর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপাতে চাইছেন। জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের পক্ষে দাঁড়িয়েছে তার জন্মভূমি অস্ট্রেলিয়াও। তারা বলছে মিথ্যা অজুহাতে এমন নিপীড়ন, নির্যাতন বরদাশত করা হবে না। জুলিয়ানের নিরাপত্তা দিতে হবে।

‘উইকিলিকস’ যে গোপন নথিগুলো প্রকাশ করতে পেরেছে, সেগুলো কি মিথ্যা? না, সে কথা কেউ বলছে না। বলতে পারছে না। বলার কোনো সাহসও নেই। তাই জুলিয়ানের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। তিনি সুইডেনে ‘নারীকে যৌন হয়রানি’ করেছেন।

লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে উইকিলিকস ডকুমেন্টসগুলো প্রকাশের পরপরই হুমকি-ধমকি দিয়ে এর হোস্টিং ডোমেইন বন্ধ করে দেয়া হয়। কিন্তু উইকিলিকস আবার সচল হয়ে ওঠে মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই। তাই পরাশক্তির বিধাতারা বেকাবু হয়ে উঠেপড়ে লেগে যান জুলিয়ানের বিরুদ্ধে। উইকিলিকস যে প্রমাণাদি বিশ্ব সমক্ষে উপস্থাপন করতে পেরেছে, তা প্রমাণ করছে বিশ্বের কিছু কিছু রাজনীতিবিদরা কতোটা হিপোক্র্যাট। তারা কতোটা ভণ্ড হয়ে মানুষের জানমাল নিয়ে খেলা করছেন।

এখানে যে কথাটা বলে নেয়া দরকার, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পতনের পর আমেরিকানরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল যে তারা বিশ্বকে কূটনৈতিক কূটচালের মাধ্যমেই শাসন করবে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে দেয়ার পর তৎকালীন রোনাল্ড রিগ্যান প্রশাসনের দাপট গোটা বিশ্বে বহুমাত্রিকভাবে বেড়ে যায়। যা পরবর্তী সময়ে জর্জ বুশ সিনিয়রের গালফ ওয়ার (ইরাক-কুয়েত যুদ্ধ) এবং জর্জ বুশ জুনিয়রের আফগান, ইরাক যুদ্ধের মাধ্যমে একটি অধ্যায়ের সমাপ্তির পথে রয়েছে। সেপ্টেম্বর এগারোর ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম বিশ্বকে আরো অশান্তি, অস্থির করে তোলে। সেই অস্থিরতা এবং চরম অর্থনৈতিক মন্দা নিয়েই খোঁড়া পায়ে চলছে পরাশক্তিদের আয়োজিত তথাকথিত ‘বিশ্ব শান্তি প্রকল্প।

’ আসল কথা হচ্ছে এই যুদ্ধ থেকে পরাশক্তির প্রভুরা যে লাভবান হয়েছে এবং হচ্ছে, উইকিলিকসের প্রকাশিত বিভিন্ন ডকুমেন্টস সেই প্রমাণাদি খুব স্পষ্টভাবে করেছে। যেমন দেখা যাচ্ছে সৌদি আরবের বাদশাহ আব্দুল্লাহ যুক্তরাষ্ট্রকে বলছেন, ‘ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা যতো শিগগিরই সম্ভব গুঁড়িয়ে দাও। ’ তার ভাষায় ‘সাপের বিষফণা কেটে দেয়ার এখনই সময়। ’ খুব গভীরভাবে বিবেচনার বিষয়, সৌদি আরব মাঝে মাঝে ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুদের পক্ষে কথা বললেও প্রকৃতপক্ষে মুসলিম বিশ্বের ঐক্যবদ্ধ শক্তি সঞ্চয় হোক- সেটা চায় না। ‘শিয়া’ এবং ‘সুন্নী’ পন্থীদের স্নায়ুযুদ্ধও এখানে আরেকটি ফ্যাক্টর তো বটেই।

কারণ শিয়া অধ্যুষিত ইরান পরমাণু বোমার জনক হোক এটা সুন্নী অধ্যুষিত সৌদি আরবের জন্য শংকার কারণ তো বটেই। ঘটনা সেখানেই থেমে নেই। সৌদি আরবে পরিবারভিত্তিক রাজতন্ত্রের যে অভ্যন্তরীণ স্নায়ুযুদ্ধ চলছে, তার পৃষ্ঠপোষকতার জন্যও সৌদি রাজপরিবারে মার্কিনি সমর্থন খুবই প্রয়োজন। পিতা সৌদী বিন আব্দুল আজিজের বিভিন্ন বিবাহ সূত্রে জন্ম নেয়া যুবরাজরা ক্ষমতার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন, সে সংবাদ বিশ্ব মিডিয়ায় এখন ওপেন সিক্রেট। যে কথাটি না বললেই নয়, তা হচ্ছে উইকিলিকস কেন, এ রকম আরো একশটি ওয়েবসাইট যদি অন্যতম পরাশক্তিও তাদের প্রভুদের গোপন কিছু দলিলপত্র ফাঁস করে দেয় তবুও পরাশক্তিদের কিছু যাবে আসবে না।

এর কারণ হচ্ছে প্রত্যেকটি টার্গেটকৃত রাষ্ট্রে কিছু ‘রাষ্ট্রীয় এজেন্ট’ পরাশক্তির প্রভুরা তৈরি করেই রেখেছে। আর পাশ্চাত্যের রাষ্ট্রদূতেরা সেসব দেশে তাদের সার্বক্ষণিক স্বার্থ তো রক্ষা করেই যাচ্ছেন! মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের প্রবক্তারা মুখোশের আড়ালে কী করছেন তার খণ্ডচিত্র প্রকাশ করেছে উইকিলিকস। সত্য কথা বললেই যে রক্ত বন্যা বইয়ে দেয়া হয় এর প্রমাণ বিশ্বে অনেক। মহাত্মা গান্ধী থেকে মার্টিন লুথার কিং, আব্রাহাম লিংকন, জন এফ কেনেডি- তাদের পরিণতির কথা আমরা জানি। জানি চেগুয়েভারা, একজন চির সংগ্রামী মানুষের আখ্যানও।

পরাশক্তি ঘেরা এই সেই বিশ্ব যারা ন্যালসন ম্যান্ডেলা, অং সান সুকীকে গৃহবন্দী করায়। আবার তাদের মুক্তি দাবি করে বাহবা নেয়ারও পথ খুঁজে। সেই কণ্টকাকীর্ণ বিশ্বে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ হ্যাকার হলেও একজন নায়ক। তাকে ভিলেন বানাবার চেষ্টা, নতুন কোনো মতলবী উপাদান নয়। মুসলিম শাসকরা কিভাবে তস্করতন্ত্র লালন করেন, নার্সের অবৈধ যৌন সেবা নেন, তা ফাঁস করেছে উইকিলিকস।

বলে দিয়েছে, কীভাবে পাশ্চাত্যের দাপটশালী রাজনীতিকরা গরিব দেশগুলোতে মানবতার কবর রচনা করেন। সন্দেহ নেই ক্ষমতাবান আইটি বিশেষজ্ঞরা এখন হ্যাকারদের ধকল কিভাবে মোকাবেলা করা যায়, সে পথ অবশ্যই খুঁজবেন। কিন্তু রাজনীতিকরা সত্যিকার বিশ্ব শান্তি কিভাবে কায়েম করা যায় সে পথ খুঁজবেন না। কারণ সত্যিকার শান্তি প্রতিষ্ঠিত হলে বুর্জোয়া অস্ত্র ব্যবসায়ী, মুনাফাখোর সুদ ব্যবসায়ী মহাজনদের বাণিজ্য-পাতি শিকেয় উঠবে। তারপরও একজন জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ এর কণ্ঠরোধ করে তাকে নির্যাতন করে বিশ্বের মজলুম মানুষের প্রতিবাদের কণ্ঠ রোধ করা যাবে না।

কোনো না কোনোভাবে সত্য প্রকাশিত হবেই। জুলিয়ান যেন ন্যায়বিচার পান, সেই দাবি গোটা বিশ্বের বিবেকবান মানুষের। ------------------------------------------------------- দৈনিক ভোরের কাগজ। ঢাকা। ১৩ ডিসেম্বর ২০১০ সোমবার


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.