আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মুক্তিযোদ্ধা আরও এক মহিয়সী নারীর গল্প

পাপ কখনও পিছু ছাড়ে না আজ হোক কাল হোক সে মূল্য নিতে আসবেই ।

শওকত আরা, রাজশাহী রাজশাহী শহরের পশ্চিমে রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ সড়কের পাশেই হাড়ুপুর গ্রাম। পদ্মা নদীর তীরঘেঁষা এই ছোট গ্রামেই আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। একাত্তরের অগি্নঝরা দিনগুলোতে দেশব্যাপী আন্দোলনে রাজশাহীর ছাত্র-জনতাও সক্রিয় হয়ে ওঠে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরাও সর্বাত্মক প্রতিরোধের প্রস্তুতি শুরু করে।

আমি তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যায়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী। চারদিকে থমথমে পরিস্থিতি। ২৫ মার্চ কালরাতে ঢাকার সঙ্গে রাজশাহী পুলিশ লাইন, ইপিআর ক্যাম্প, আনসার ক্যাম্পের স্বাধীনতাকামী বাঙালি সৈনিকরা বিদ্রোহ করে। পাকিস্তানি সেনারা পুলিশ লাইনে চালাল নির্মম হত্যাযজ্ঞ। শহীদ হলেন বিপুল সংখ্যায় পুলিশ বাহিনীর বাঙালি সদস্য।

রাজশাহীতেও তখন স্বাধীনতা যুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে। ছাত্র-জনতা ঘুরে দাঁড়িয়েছে পাকিস্তানি বাহিনীর দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে। ২৬ মার্চের মধ্যে হানাদাররা রাজশাহী কব্জা করে ফেলে। আমাদের হাড়ুপুর গ্রামের পাশেই ছোট গ্রাম কাঁঠালবাড়িয়া। ২৭ মার্চ কাঁঠালবাড়িয়া গ্রামের একটি নিমগাছের নিচে দাঁড়িয়ে আমি দেখছিলাম পাকিস্তানি বাহিনী কাঁঠালবাড়িয়া মোড়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে আসা বাসগুলি থামিয়ে তল্লাশি করছে।

নারী-পুরুষকে আলাদা করে নারীদের তুলে নিচ্ছে তাদের সাঁজোয়া গাড়িতে। আর পুরুষদের সারিবদ্ধভাবে গাড়িতে তুলে নির্যাতন চালাচ্ছে_এই দৃশ্য দেখে আমার মনে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে। নিরীহ বাঙালির ওপর এই নির্যাতন সহ্য করার মতো ছিল না। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে না গিয়ে আমার নিজের গ্রাম হাড়ুপুরে ফিরে গেলাম। তখন পাকিস্তানি সেনা ও তাদের সহযোগীরা আমাদের গ্রামের দিকেও ধাবমান।

আমি গ্রামে ফিরে লোকজনকে খবর দিলাম, পাকিস্তানি বাহিনী হাড়ুপুরে প্রবেশ করবে। তখন গ্রামবাসীর মধ্যে আতঙ্ক আরো বেড়ে গেল। এই খবর পেয়ে আমার ভাই জিল্লার রহমান, ফুফাতো ভাই সাইদুর রহমান কালুসহ গ্রামের আরো কয়েক যুবক হাতের কাছে যা পেলেন তাই নিয়ে গ্রামের প্রবেশপথে গলির মধ্যে অবস্থান নিলেন। তখন তো আমাদের কাছে কোনো হাতিয়ারও নেই। আমার ফুফু ফুলবানু ভাই আব্দুস সালামসহ আরো কয়েকজনকে একটি ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে একখানা লাঠি নিয়ে ঘরের দরজায় বসে পড়লেন।

পাকিস্তানি বাহিনী গ্রামে ঢুকে আমার চাচা ভাসানী ন্যাপ নেতা গোলাম রাব্বানী, আমানুল্লাহ, ড. শহীদুল্লাহ আজিজ, লেলিনসহ আরো কয়েকজনকে ধরে গ্রামের মধ্যে লাইন করল। আমিন নামের একজনকে জোর করে সঙ্গে নিয়ে আওয়ামী লীগ সমর্থক নেতাদের ধরতে গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে তল্লাশি শুরু করল। প্রথমে তারা আমাদের বাড়িতে। আমার ফুফু তখন ঘরের দরজায় লাঠি হাতে পাহারায়। এক পাকিস্তানি সেনা ঘর দেখিয়ে তাঁকে প্রশ্ন করল, 'আন্দার মে কৌন হে?' ফুফু উত্তর দিলেন 'জেনানা (নারী) হে।

' পাকিস্তানি সেনারা আটকদের লাইনে দাঁড় করিয়ে নির্যাতন শুরু করল। তখন গ্রামের মধ্যে চরম আতঙ্ক। যে যেদিকে পারছে গ্রাম ছেড়ে পালাচ্ছে। চারদিকে তুমুল গোলাগুলির আওয়াজ। সন্ধ্যার আগে আগে পাকিস্তানি বাহিনীর যুদ্ধবিমান থেকে গোলাবর্ষণ করল হাড়ুপুর গ্রামের ওপর।

আর তো গ্রামে বসে থাকা যায় না। সিদ্ধান্ত নিলাম যুদ্ধে যাব। কিছু তো একটা করতে হবে দেশের জন্য। ওই দিনই সকলের সঙ্গে হাড়ুপুর গ্রাম ছেড়ে দারুশার উদ্দেশে পা বাড়ালাম। সঙ্গী হলো বান্ধবী মিনা ও তার মেয়ে বাণী।

রাতের একসময় আমরা গিয়ে পেঁৗছালাম দারুশার এক বাড়িতে। এই গ্রামটি তখনো পাকিস্তানি বাহিনীমুক্ত থাকলেও শহর থেকে থেমে থেকে গুলির শব্দ আসছিল। কয়েক দিন পর সেখানে সাক্ষাৎ পেলাম কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার। যুদ্ধের জন্য প্রশিক্ষণ নেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করায় তাঁরা আমাকে প্রশিক্ষণ দিলেন। সিদ্ধান্ত নিলাম যেকোনো উপায়েই হোক যুদ্ধে মাঠে থাকব।

তখনো শহরে গোপন অবস্থান নিয়ে ছাত্র-জনতা পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রতিরোধ করে চলেছে। চারদিকে সর্বাত্মক প্রতিরোধ যুদ্ধ চলছে। এপ্রিলের প্রথম দিকে একদিন দারুশা থেকে শহরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। আমার বান্ধবী কামরুন্নাহার বীণার ভাই রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্র মোনায়েম মঞ্জুর মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছেন আগেই। শহরের শেখপাড়ায় তাঁদের বাসা।

তিনি শহরে অবস্থানকারী মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে সক্রিয় যোগাযোগ রেখে অস্ত্র ও রশদ সরবরাহের কাজ করছিলেন। এক দিন তিনি প্রস্তাব দিলেন, আমরা শহরের বাইরে থেকে গ্রেনেডসহ ব্যাগে বা হাতে বহন করা যায়_এমন অস্ত্রশস্ত্র শহরে অবস্থানকারী মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পেঁৗছাতে পারব কি না। আমি সানন্দে রাজি হয়ে যাই। এরই মধ্যে আমি গ্রেনেড ছোড়ার কৌশলও শিখে নিয়েছি। রাইফেল চালানোও শিখে ফেলেছি গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সালামের কাছ থেকে।

তাঁর নির্দেশ মতো কয়েক দিন পরেই ট্রেনে করে আমি আমার ফুফাতো বোন হাসমত আরা হাসিকে সঙ্গে নিয়ে চলে গেলাম গোদাগাড়ীর চবি্বশনগরে। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অস্ত্রশস্ত্র তখন এসব মুক্ত এলাকাতেই জড়ো করা হতো। আর সেগুলো কৌশলে শহরের মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পেঁৗছে দেওয়া হতো। আমিও এই অস্ত্র সরবরাহের কাজে নিয়োজিত হলাম। ধরা পড়লে কী হবে, সেটি তখন আমার চিন্তার মধ্যে আসেনি।

দেশের জন্য কিছু করছি, এটাই ছিল বড় কথা। আমরা চবি্বশনগর থেকে বেশকিছু গ্রেনেড নিয়ে ট্রেনে করে শহরে নামলাম। তখন পথে পথে পাকিস্তানি বাহিনীর ট্যাঙ্ক ও সৈন্যরা টহল দিচ্ছে। পরিচিত এক রিকশায় চড়ে গ্রেনেডগুলো পেঁৗছে দিলাম শেখপাড়ায় মোনায়েম মঞ্জুরের বাসায়। এভাবেই আমরা দিনের পর দিন চবি্বশনগর, কাকনহাট থেকে অস্ত্র, গোলাবারুদ, গ্রেনেড নিয়ে শহরে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পেঁৗছে দিতে থাকলাম।

জুলাইয়ের মাঝামাঝি এক দিন মুক্তিযোদ্ধা মোস্তাফিজুর রহমান গামা ও আল-মুনসুরের আনা গ্রেনেড ভর্তি একটি ট্রাঙ্ক পেঁৗছে দিলাম রাজশাহী বেতারের শিল্পী দেওয়ান আব্দুল খালেকের তালাইমারীর বাসায়। আমরা শহরে চলাফেরার সময় গ্রামের পরিচিত রিকশাওয়ালা মুনসুরের রিকশায় যাতায়াত করতাম। তিনি শহরের অগিগলি ভালো চিনতেন। দেশের প্রতি তাঁর মমত্ববোধ ছিল অপরিসীম। অক্টোবরের শুরুতে ৭ নম্বর সেক্টরের ৪ নম্বর সাব-সেক্টরের কমান্ডার মেজর গিয়াস রাজশাহীতে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে নির্দেশ পাঠালেন, শহরের ঘোড়ামারায় কুঞ্জমৈত্রের বাড়িতে স্থাপিত রাজাকার ক্যাম্প, বোয়ালিয়া থানার পাশের মোসলেমের বাড়ির আল-বদর ক্যাম্প, অলকার মোড়ের টেলিফোন এঙ্চেঞ্জ, বিদ্যুৎ সরবরাহ কেন্দ্রসহ বিশেষ বিশেষ স্থাপনায় গেরিলা হামলা পরিচালনার।

মুক্তিযোদ্ধারা এই নিয়ে পরিকল্পনা ও যোগাযোগ শুরু করলেন। এখানকার বুয়েটের ছাত্র মুক্তিযোদ্ধা বাবর আলী তখন শহরের বিভিন্ন স্থানে অপারেশনের দায়িত্বে। তিনি আমার সঙ্গে কথা বললেন এই অপারেশনের বিস্তারিত নিয়ে। আমরা পরামর্শ করলাম সিটি কলেজের শিক্ষক আব্দুল মোমিনের সঙ্গে। পরে কথা বললাম পাবলিক লাইব্রেরির সেক্রেটারি মোহা. এহিয়া ও লাইব্রেরিয়ান রেজাউল আহমেদ এবং পিওন মজিবুরের সঙ্গে।

সিদ্ধান্ত হলো অস্ত্রভর্তি একটি ট্রাঙ্ক আমরা পরের দিন পেঁৗছে দেব ঘোড়ামারার পাবলিক লাইব্রেরিতে। সিদ্ধান্ত মোতাবেক ৭ অক্টোবর ভোরে মুক্তিযোদ্ধা বাবর আলী আর আমি চারটি ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী মাইন, বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক, কয়েকটি এসএমজি, গ্রেনেড ও গুলির ম্যাগাজিন ভর্তি ট্রাঙ্কটি নিয়ে কোর্ট এলাকা থেকে একটি রিকশা করে রওয়ানা দিলাম মধ্য শহরের ঘোড়ামারার উদ্দেশে। অস্ত্রগুলো পাঠানো হয়েছে মুক্তাঞ্চল বরেন্দ্র এলাকা থেকে। বুক আমাদের দুরু দুরু করছে। চারদিকে পাকিস্তানি সেনারা টহল দিচ্ছে শহরে।

আমাদের রিকশাটি হড়গামের নুরু মিলের পশ্চিম দিয়ে লক্ষ্মীপুরে পেঁৗছে। লক্ষ্মীপুরের কাছে চেকপোস্টে পাকিস্তানি সেনারা আমাদের রিকশার গতিরোধ করে। তাদের প্রশ্ন ছিল, 'তুম লোগ কৌন হ্যায়, কাহা যা-রাহা?' বাবর আলী উত্তর দিল, আমার বোন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসে তাকে রাখতে যাচ্ছি। আমি সালোয়ার কামিজ পরা ছিলাম। মাথাটা ওড়না দিয়ে ঢেকে নিয়েছিলাম।

আমরা লক্ষ করছিলাম একটি মোটরসাইকেলে দুজন পাকিস্তানি গোয়েন্দা সেনা আমাদের রিকশাটি ফলো করছে শুরু থেকেই। লক্ষ্মীপুরে আমরা তাদের দেখলাম। আমাদের রিকশাটি সদর হাসপাতাল মোড়ের কাছে পেঁৗছালে দেখলাম সেই মোটরসাইকেলটি আমাদের আবারও সামনে পড়ল এবং ফলো করছে। মুখে প্রকাশ না করলেও আমরা আশঙ্কা করছিলাম, এবার বুঝি ধরা পড়তেই হবে। তখন মনে মনে আল্লাহকে ডাকছিলাম।

আমাদের রিকশাটি শেষ পর্যন্ত পাবলিক লাইব্রেরিতে গিয়ে পেঁৗছালে আমরা লাইব্রেরিয়ান রেজাউলের কাছে অস্ত্রভর্তি ট্রাঙ্কটি হস্তান্তর করলাম। আবার বাবর আলীর নির্দেশে পরদিন সেই ট্রাঙ্কটি পাবলিক লাইব্রেরি থেকে নিয়ে মহিষবাথান এলাকার এক মুক্তিযোদ্ধার বাড়িতে পেঁৗছে দিলাম। এই অস্ত্র দিয়ে মুক্তিসেনারা শহরের নির্দেশিত স্থাপনায় অপারেশন করলেন কয়েক দিন পর। এদিকে আমি যে শহরে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে অস্ত্র ও রশদ পেঁৗছে দিচ্ছি তা পাকিস্তানি সেনারা অবগত হলো। আমাকে ধরার জন্য তারা আমার গ্রামের বাড়িসহ সম্ভাব্য স্থানে অভিযান শুরু করল।

গুপ্তচর নিয়োগ করল। আমি এই খবর পেলাম মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে। শেষ পর্যন্ত অক্টোবরের শেষের দিকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাতের আঁধারে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলার শেখপাড়ায় পেঁৗছালাম। আমরা যখন পদ্মা অতিক্রম করছি তখন পাকিস্তানি বাহিনী নদীতে সার্চ লাইটের আলো ফেলছিল। ওরা আমাকে ধরার জন্য শহরের বিভিন্ন স্থানে অপারেশন শুরু করে।

ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করে আমরা রাজশাহীর বিভিন্ন প্রান্তে যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পাঠাতে থাকলাম। ১৮ ডিসেম্বর রাজশাহী শক্রমুক্ত হলে আমরা ফিরলাম গ্রামে। বিজয়ীর বেশে, স্বাধীন দেশের মাটিতে। সেই ফেরার অনুভূতি আজও আমাকে আলোড়িত করে। পরিচিতি : মুক্তিযোদ্ধা শওকত আরা খাতুনের জন্ম রাজশাহীর হাড়ুপুর গ্রামে।

বাবা মরহুম আহমেদ হোসেন পণ্ডিত ও মা পরিজান বেগমের ১১ ছেলেমেয়ের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ শওকত আরা। তিনি স্বামী ও সন্তানদের নিয়ে বসবাস করেন পাবনা শহরের রাধানগরে। স্বামী মোহাম্মদ হোসেন জামাল পিটিআই ইনস্ট্রাকটর পদের চাকরি থেকে কিছুদিন আগে অবসরে গেছেন। শওকত আরা খাতুন বর্তমানে পাবনার আতাইকুলা ডিগ্রি কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক পদে কর্মরত। তিনি মুক্তিবার্তায় তালিকাভুক্ত।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.