আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একজন মুক্তিযোদ্ধার হাতধরে আমার হাঁটতে শেখা

সম্পাদনা করি আমিরাত-বাংলা মাসিক মুকুল। ভালবাসি মা, মাটি ও মানুষকে..

মা-বাবার বড় সন্তান আমি। তাই আদুরে দুলাল ছিলাম আর এখনো সেই ভালবাসার পরিমাণ কমেনি বলে আমার ভাই-বোনদের সাথে মিষ্টিযুদ্ধ হয়। ছোটবেলায় আম্মু আমাকে কিচ্ছা শুনিয়ে ঘুম পাড়াতেন। একদিনের কিচ্ছার বিষয় ছিল মুক্তিযুদ্ধ।

আম্মু সেই যুদ্ধের সময় ছিলেন একজন ক্লাস টুতে পড়–য়া। তাই সব ঘটনা মনে না থাকলেও চতুর্দিকে মুক্তিকামী মানুষের মিছিল আর পাক বাহিনীর অত্যাচারে নিরীহ মানুষের লুকিয়ে থাকার ঘটনা আম্মুর মনে হয়েছিল বলে ওইদিন ঢুকরে কেঁদে ওঠলেন। তারপরেও আমাকে শুনালেন মুক্তিযুদ্ধের গল্প। আমি যখন ক্লাস ফাইভ এ পড়ি। তখন বৃত্তি পরীক্ষার জন্য প্রচুর শ্রম দিতে হয়েছে।

বাংলা পড়তে গিয়ে স্মরণীয়-বরণীয় যাঁরা অধ্যায়ে জানতে পারলাম একাত্তুরের ১৪ ডিসেম্বর দেশকে বিবেকহারা করতে যে মহাপুরুষদের হত্যা করা হয়েছিল। আর তাঁদেরই একজন ড. গোবিন্দ চন্দ্র (জিসি) দেব। আর উনার পিতৃভিটা সিলেট জেলার বিয়ানীবাজারের লাউতা গ্রামে। পাঠ্যবইতে আমাদের উপজেলার একটা গ্রামের নাম দেখে আন্দোলিত হলাম। কারণ লাউতায় আমার নানাবাড়িও।

ওইদিন বাড়ি ফেরে আম্মুর কাছে বায়না ধরলাম নানাবাড়ি যেতে ড. জিসি দেব এর পিতৃভিটা দেখব। এ ব্যপারে আম্মু আমাকে আস্বস্ত করেছিলেন কিন্তু নানাবাড়ি যেতে ওই বাড়িটি দেখিয়েছিলেন আব্বু। আব্বুর সাথে উত্তেজনা আর আশা সেই সাথে বুকের ধুক ধুকানি নিয়ে উঠলাম লাউতা প্রাথমিক বিদল্যালয়ের টিলাতে। আমরা যখন গিয়েছিলাম তখন পশ্চিমাকাশে সূর্যিমামা হেলান দিতে যাচ্ছিল। দেখলাম একদল বালক ওই বিদ্যালয় মাঠে ফুটবল খেলতে ছিল।

আরেকটি রাখাল ছেলে একটি ইটের স্মম্ভের উপর বসে আসে। আব্বু পাশে গিয়ে ছেলেটিকে নামতে বল্লেন আর মানা করলেন এখানে না বসতে কারণ এটা একজন বিখ্যাত লোকের স্মৃতিসৌধ। আমি দেখতে পেলাম ”শহীদ দার্শনিক ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব স্মৃতিসৌধ” এই লেখাটি পড়ার পরই আমি আরো চমকে উঠলাম। নিজে নিজেজে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল। আরো উত্তেজিত ছিলাম এই ভেবে স্কুলে গিয়ে সহপাঠীদের বলবো আমি এই জিসিদেব এর বাড়ি দেখেছি।

আর এটা আমার নানাবাড়ির পাশেই। জিসিদেব বাড়ি দর্শন শেষেই নানাবাড়িতে গেলাম । গিয়ে দেখি নানাবাড়িতে আমাদের বড়খালারাও এসেছেন। তাই সারারাত আনন্দ আর হাসির রেখা ছিল আমার আ¤ম্মু-খালাদের চোখ-মুখে। আম্মু আমাকে ঘুমিয়ে যেতে বল্লে আমি মুক্তিযোদ্ধা দেখব বায়না ধরে বসলাম।

আম্মু আমাকে বল্লেন ঠিক আছে। এখন ঘুমিয়ে যা সকালে দেখাব। সারারাত আমার কাছে স্বপ্নময়ী ছিল। একদিকে এতো বড় একজন লোকের বাড়ি দেখেছি অপরদিকে সকালবেলা একজন মুক্তিযোদ্ধাকে দেখলেই আমার স্বপ্নপূরণ হবে। আমার স্বপ্নের রাত্রি কেটে সকাল এলো।

খাওয়া-দাওয়া শেষে আম্মুকে বল্লাম আম্মু আমার কথাটা মনে আছে। আম্মু বল্লেন হ্যা আছে, এদিকে আয়। আমি যেতেই দেখি বড়খালু কে আমার সামনে ডেকে বল্লেন উনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। আমি কেমন চমকে আছি বুঝতে পেরে খালু পকেটে থাকা মুক্তিসনদ এর ছোটকরা কপি আমাকে দেখালেন। দেখতে গিয়ে দেখলাম লিখা-বীরমুক্তিযোদ্ধা রকিব উদ্দিন।

আমার মাথা নীচে এলো। খালু আমার স্বপ্নের নায়ক ভাবতেই ভাললাগাটা আরো বেড়ে গেল। খালুর বাড়ি মৌলভীবাজারের বড়লেখায়। আর আমাদের বাড়ি সিলেটের বিয়ানীবাজার। সুনাই নামক নদীটা আমাদের ভাগ করে দিলেও একসময় বিয়ানীবাজার ও বড়লেখার কিছু অংশ নিয়ে একই থানা ছিল।

১৯৭১ এ খালু যুদ্ধ করেছেন বিয়ানীবাজারের সারপার অঞ্চলে। ঠিক তখন-ই খালু আমাকে উৎসাহ দিতে উনার ডান হাতের কনুইতে লাগা গুলির দাগ দেখালেন। আর ভয়াবহ সেই দিনের কিছু স্মৃতি রোমন্থন করলেন। আমি ভয়ে কাঁপতে থাকি। আম্মু আমাকে কোলে জড়িয়ে ধরলেন আর বল্লেন এই মুক্তিযোদ্ধার হাত ধরেই তুমি প্রথম হাঁটতে শিখেছিলে।

আমি যখন হাঁটতে শুরু করবো তখন একদিকে আব্বু অপরদিকে নাকি আমার মুক্তিযোদ্ধা খালু ছিলেন। আমি পড়ে যাচ্ছি দেখে খালু আমার হাত ধরে হাঁটা শিখিয়েছিলেন। সময়ের ধারাবাহিকতায় ড. জিসি দেব মরণোত্তর স্বাধীনতা পদক পেয়েছেন আর এলাকায়ও আমার খালু একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আলাদা খ্যাতি পেয়েছেন। কিন্তু আমার সেই বাল্যকালে এমন পরিবেশ ছিলনা। আমাদের প্রজন্মে-প্রজন্মে মুক্তিযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ছে।

এটা আনন্দের। এখন আমি খালুর সামনে বসতে গেলে খুব ভয় করে এই ভেবে আমি একজন মুক্তিযোদ্ধার সামনে কি করে বসবো। খেলাঘর আসেরের সাথে যুক্ত হলাম । আমরা গঠন করলাম পঞ্চখণ্ড খেলাঘর আসর, বিয়ানীবাজার। বিশিষ্ট শিশুসাহিত্যিক লোকমান আহম্মদ আপন ভাই হলেন সভাপতি আর সম্পাদকের ভার পড়লো আমার উপর।

আমরা মাধ্যমিক পর্যায়ের ছাত্র-ছাত্রীদের মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনাতে ”খেলাঘর স্কুলে যায়-মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনায়” প্রোগ্রাম শুরু করেছিলাম। আর প্রায় ৭টি স্কুলে গিয়ে ওইসব এলাকার সাদামনের মাটির মানুষ যারা পেশায় একজন খেটে খাওয়া মানূষ, অফিসের কেরানি। তারা যে বীর সেটা প্রমাণ করলাম। ওইসব মুক্তিযোদ্ধারা আবেগ-আপ্লুত হয়ে কেঁদেছিলেন। চোখের বারেন্দা ভাসিয়েছিলেন এই বলে-স্বাধীনের পর এতো সম্মান পাইনি।

তাদের সেই কান্নমাখা চোখ আজো কিছু রতে উৎসাহ জন্মায়। আর সেই তাগিদ থেকেই রাজাকার মুক্ত দেশ এবং আমাদের সাধারণ পেশার অসাধারণ বীরদের সম্মান জানাতে সকলের প্রতি আকুল অনুরোধ থাকলো। লেখক: সম্পাদক, মাসিক মুকুল, দুবাই, আমিরাত।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.