চরম দুর্নীতিবাজ বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার এখন মন্ত্রী, উপদেষ্টা, সচিবসহ বিভিন্ন সরকারি কর্মচারীদের জন্য শত শত কোটি টাকা খরচ করে বিলাসবহুল গাড়ি কেনার এক মহোত্সবে মত্ত হয়েছে। এদের এই ক্রিমিনাল ব্যাপার দেখে অবাক হতে হয়। কিন্তু এতে আসলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এরা নিজেদের নিম্ন চরিত্রের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণভাবেই জনগণের পকেট মেরে ও জনগণকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নিজেদের জন্য এই ব্যবস্থা করছে।
২৩ নভেম্বর দৈনিক কালের কণ্ঠে প্রকাশিত একটি রিপোর্টে দেখা যায় যে, অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে এসব গাড়ি কেনার অনুমোদন প্রদানের সিদ্ধান্ত মন্ত্রিসভায় গৃহীত হয়েছে।
গাড়িগুলো কেনা হবে সরকারের প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের মাধ্যমে।
শুধু এই খাতে নয় অনেক খাতেই সরকারি গাড়ি কেনার এই ব্যবস্থা হচ্ছে। তার মধ্যে কয়েকটির দৃষ্টান্ত এখানে উল্লেখ করা হলো। ‘‘সফরকারী ভিআইপিদের জন্য ‘প্রটোকল কার’ সম্পর্কে উপরোক্ত রিপোর্টে বলা হয়, সফরকারী ভিআইপিদের প্রটোকল দেয়ার সঙ্গে প্রতিটি জেলায় একটি করে ‘প্রটোকল কার’ কেনা হচ্ছে। স্বাধীনতার পর এই প্রথম প্রটোকলের জন্য আলাদা গাড়ি কেনার উদ্যোগ নেয়া হলো।
বিলাসবহুল এসব গাড়ি কেনার জন্য সরকারের ব্যয় হবে প্রায় ৩০ কোটি টাকা। কোন ভিআইপি কখন কোথায় সফরে যাবেন, তার ঠিক না থাকলেও এসব গাড়ি অপেক্ষায় থাকবে তাদের প্রটোকল দেয়ার জন্য। তাই এই ‘অনিশ্চিত প্রটোকলের’ অজুহাতে এসব গাড়ির মাধ্যমে জেলা পর্যায়ে কর্মরত আমলারা নিজেদের আরাম-আয়েশ নিশ্চিত করবেন বলে মন্তব্য করছেন সংশ্লিষ্টরা। ”
এতদিন পর্যন্ত এসব তথাকথিত ভিআইপি অর্থাত্ মন্ত্রী, উপদেষ্টা, সচিব ইত্যাদি জেলায় সফরে গেলে সেখানে যে সব গাড়ি আছে সেগুলোই ব্যবহার করা হতো। কারণ, এসব গাড়ির সংখ্যাও কম নয়।
তাছাড়া এ গাড়িগুলোও সাধারণ গাড়ির থেকে বিলাসবহুল। কিন্তু এটা সত্ত্বেও ‘প্রটোকলের’ নামে এখন প্রত্যেক জেলায় উচ্চ মূল্যের গাড়ি কেনার ব্যবস্থা হচ্ছে। এগুলোর একেকটির দাম বাহান্ন লাখ থেকে এক কোটির কাছাকাছি। অনেক জেলায় বছরে হয়তো দুই-একবার এ ধরনের ভিআইপি’র সফর হয়। কোনো বছরে হয়ই না।
কিন্তু তার জন্য যে গাড়ির ব্যবস্থা হচ্ছে সেগুলো জেলা প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিরাই ব্যবহার করবে। তাদের পরিবারের লোক ও আত্মীয়-স্বজনরাও চড়বে এসব গাড়িতে।
দেশের সাতটি বিভাগের কমিশনারদের জন্য এবং অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকদের জন্য গাড়ি কেনা হচ্ছে। এ বিষয়ে কালের কণ্ঠ রিপোর্টটিতে বলা হয়েছে, “নবগঠিত রংপুরসহ সাত বিভাগীয় কমিশনারের জন্য ১০টি ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের জন্য আরও ৭৬টি গাড়ি কেনার প্রক্রিয়া প্রায় চূড়ান্ত করা হয়েছে। এভাবে মোট ১৫০টি গাড়ি কেনায় সরকারের ব্যয় ধরা হয়েছে ৭০ কোটি টাকা।
”
এর অর্থ দাঁড়াল, ‘প্রটোকলের’ সঙ্গে এবং বিভাগীয় কমিশনার ও অতিরিক্ত জেলা কমিশনারদের জন্য ১১৪টি গাড়ি কেনা বাবদ সরকারের ব্যয় হবে ১০০ কোটি টাকা।
কিন্তু এখানে যে ব্যয় ধরা হয়েছে খরচ হবে তার থেকেও বেশি। কারণ, আগে বিভাগীয় কমিশনারদের জন্য যে গাড়ি বরাদ্দ করা হয়েছিল তার দাম ছিল প্রতিটি ৪৬ লাখ ৩৭ হাজার টাকা। এগুলোর দাম বেড়ে এখন দাঁড়িয়েছে ৬২ লাখ টাকা। কমিশনারদের গাড়ির বাবদ ও অতিরিক্ত টাকা বরাদ্দের জন্য সংস্থাপন মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানানো হয়েছে এবং সেই বরাদ্দের চিঠি এখন অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে রয়েছে।
এছাড়া ভিশন ২০২১ বাস্তবায়ন করার জন্য জেলা পর্যায়ে নতুন করে এডিসি পদ সৃষ্টির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তাদের জন্যও নতুন গাড়ি কেনার চিন্তা হচ্ছে।
এসব ক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার যে, বর্তমানে ওপরে উল্লিখিত কর্মরত অফিসারদের জন্য গাড়ির ব্যবস্থা আছে এবং একেকজনের জন্য অনেক ক্ষেত্রে বরাদ্দ গাড়ি অথবা অন্যভাবে ব্যবহৃত গাড়ির সংখ্যা একাধিক। তা সত্ত্বেও তাদের জন্য এখন নতুন গাড়ি কেনার ব্যবস্থা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ঘুষ দেয়ার ব্যাপার ছাড়া আর কি? এভাবে এদের ঘুষ দিয়ে প্রশাসনকে নিজেদের দলের অনুগত রাখার জন্যই সরকারিভাবে এখন গাড়ি কেনার জন্য ব্যস্তভাবে ব্যয় বরাদ্দ হচ্ছে।
উপজেলা চেয়ারম্যানদের প্রত্যেকের জন্যই গাড়ি বরাদ্দ আছে।
তারা এসব গাড়ি নিয়মিত ব্যবহার করতে থাকেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের জন্য একইভাবে সরকার নতুন গাড়ি কিনছে। এ প্রসঙ্গে একই পত্রিকায় অন্য একটি রিপোর্টে বলা হয়, উপজেলা চেয়ারম্যানদের জন্য আরও ২১১টি গাড়ি কিনবে সরকার। এজন্য সব মিলিয়ে ব্যয় হবে ৮৭ কোটি ৫৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা। প্রতিটি গাড়ির দাম পড়বে ৪১ লাখ ৫০ হাজার টাকা।
বছরখানেক আগে এই একই পাঁজেরো জিপ গাড়ি প্রতি খরচ হয়েছিল ৩২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। অর্থাত্ এক বছরের ব্যবধানে একটি গাড়ি কিনতে সরকারকে অতিরিক্ত ৯ লাখ টাকা খরচ করতে হচ্ছে। গত সোমবার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সভাপতিত্বে সরকারী ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে উপজেলা পরিষদের জন্য আরও ২১১টি জিপ গাড়ি কেনা সংক্রান্ত প্রস্তাবের অনুমোদন দেয়া হয়েছে বলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের যুগ্ম-সচিব নূরুল করিম সাংবাদিকদের জানিয়েছেন। ”
লুণ্ঠনজীবী শাসক শ্রেণীর শাসনে লুটপাট এখন কোন্ পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে তার একটি প্রামাণ্যচিত্র আলোচ্য রিপোর্টটির মধ্যে দেয়া তথ্য থেকে স্পষ্টভাবেই পাওয়া যাচ্ছে। এই পরিস্থিতির একটা ভয়ানক দিক হচ্ছে দুর্নীতির আতঙ্কজনক বিস্তার।
এ ক্ষেত্রে পরিস্থিতি বিশেষভাবে আতঙ্কজনক ও ভয়াবহ এ কারণে যে, দুর্নীতির এই বিস্তার ঘটাচ্ছে সরকারের শীর্ষস্থানীয় লোকজন—প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, পরগাছা জাতীয় উপদেষ্টা এবং উচ্চ পর্যায়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তারা। সমাজে আজ যেভাবে সব ধরনের দুর্নীতির বিস্তার ঘটেছে, রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি তার শেকড় বিস্তার করেছে এর মূল কারণ ১৯৭২ সাল থেকেই সরকারি পর্যায়ে ও সরকারের লোকজনদের দ্বারা ঘটতে থাকা দুর্নীতি। ১৯৭২ সালে সরাসরি লুটপাট দিয়ে শুরু হলেও ক্রমেই তা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। লুটপাট এখন বাংলাদেশে এক সুসংগঠিত ব্যাপার। বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই যে, বছরের পর বছর ধরে ৩০ লাখ মানুষের জীবনের বিনিময়ে অর্জিত এই বাংলাদেশ বিশ্বের দুর্নীতিপরায়ণ দেশের মধ্যে শীর্ষস্থান অধিকার করে আছে।
গাড়ি কেনার ক্ষেত্রে যে বিষয়টি বিশেষভাবে বলা দরকার তা হলো, শুধু সরকারি প্রশাসনের জন্য গাড়ি কেনার মধ্যে দুর্নীতি নিহিত নেই। তার বাইরে অন্য রকম দুর্নীতিও আছে এবং এই দুর্নীতিই বড় আকারে গাড়ি ক্রয় কর্মসূচির এক গুরুত্বপূর্ণ দিক। সরকার এসব গাড়ি কিনছে সরকারি সংস্থা প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের মাধ্যমে। এই গাড়ি ক্রয় ক্ষেত্রে সরকারের মন্ত্রী, সচিব থেকে নিয়ে অন্য অনেক ধরনের লোক ঘুষ, কমিশন ইত্যাদির মাধ্যমে যে কোটি কোটি টাকা পকেটস্থ করবে সেটাও লুটতরাজেরই দৃষ্টান্ত। শুধু তাই নয়, এভাবে দুর্নীতি ও লুটতরাজের সুযোগ যদি না থাকত তাহলে গাড়ি কেনার প্রস্তাবক ও সেই প্রস্তাব পাস করণেওয়ালারা গাড়ি কেনার ব্যাপারে এত উত্সাহিত হতো না।
এসব কথা আসলে বলাই বাহুল্য, কারণ এই সত্য জানে না, বাংলাদেশে সচেতন ব্যক্তিদের মধ্যে এমন কেউ আছে বলে মনে হয় না। বিগত বিএনপি সরকারের আমলে বিআরটিসি’র বাস কেনার সময় তত্কালীন যোগাযোগমন্ত্রী যে দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি ডলার পকেটস্থ করেছিলেন এ তথ্যও এমন কেউ নেই যার অজানা। শাসক শ্রেণীর বিভিন্ন দলভুক্ত এই লোকেরা, এসব নেতা-নেত্রীরা যে সবাই একই পদের লোক, অর্থাত্ দুর্নীতিবাজ এটা ১৯৯০ সালের আগে এবং তারপর দুই দফা করে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ভালোভাবেই দেখা গেছে।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে, সরকার এভাবে গাড়ি কেনার জন্য ব্যস্ত হয়ে ওই কর্মকে প্রায় জরুরিভাবে সম্পন্ন করার উদ্যোগ নিলেও উপরের রিপোর্টটি থেকে দেখা যায়, বিভিন্ন জেলায় কিছু কিছু সরকারি কর্মকর্তা নিজেদের নাম প্রকাশ না করার শর্তে সাংবাদিকদের কাছে বলেছেন, এই সরকারি ব্যয় সম্পূর্ণ নিষ্প্রয়োজন, কারণ যেসব গাড়ি ইতোমধ্যেই হাতে আছে সেগুলো কাজ চালিয়ে নেয়ার জন্য যথেষ্ট। এর অতিরিক্ত কোনো গাড়ির প্রয়োজন হয় না।
কয়েকজন অতি উচ্চপদস্থ সাবেক সরকারি কর্মকর্তা এবং বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিদের মতামত এ রকমই।
এ টা বিশেষভাবে বলা দরকার যে, দেশের জনগণ যখন হাজারও সমস্যায় জর্জরিত, অধিকাংশ ছাত্রের জন্য যেখানে স্কুলের ঠিকমত ব্যবস্থা নেই, লাখ লাখ রোগীর জন্য যেখানে চিকিত্সা ব্যবস্থা নেই, কোটি কোটি শিশুর পুষ্টিকর খাদ্য বলে কিছু নেই, সাধারণভাবে গরিব মানুষ আজ অখাদ্য কুখাদ্য খাচ্ছে। গরিবদের আবাসন ব্যবস্থা শোচনীয় অথবা নেই বললেই হয়, এমনকি আদালতগুলোর অবস্থাও খারাপ, তাদের কোনো উপযুক্ত ভবন নেই, সেখানে এভাবে গাড়ি কেনার জন্য শত শত কোটি টাকা খরচ করাকে ক্রিমিনাল কাজ ছাড়া অন্য কিছু বলা যায় না। সরকার এবং সমগ্র প্রশাসন কীভাবে ও কতখানি ক্রিমিনালাইজড হয়েছে অর্থাত্ এর অপরাধিকীকরণ কোন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে এসবই হলো তার দৃষ্টান্ত এবং অভ্রান্ত প্রমাণ।
সূত্র: সম্পাদকীয়, দৈনিক আমার দেশ, ২৫ নভেম্বর।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।