আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্পটা একটু ধৈর্য্য ধরে শুনুন। হয়তো আপনার ভাই,বোন বা সন্তানের জীবনে তাহলে এমন পরিনতি ঠেকানো যাবে।

Don't be like the hand that crushes the flower, but be like the crushed flower which leaves the fragrance in that hand ...

এবার ঈদ এর সময় কয়েকটা কারনে এমনিতেই আমার মনটা অনেক খারাপ ছিল, তবু চেষ্টা করছিলাম স্বাভাবিক থেকে সবার সাথে মজা করে ঈদ উদযাপন করতে। সবসময়ই ঈদ এ আমার খুব কাছের বন্ধুদের সাথে অন্তত ফোন এ যোগাযোগ হয়। এবার আমি রাগ করে নিজথেকে আর লিপির সাথে যোগাযোগ করিনি। বিশেষ করে ঈদের ও তার পরের দিন ওর কথা মনেও পড়েছে কয়েকবার। ওর বাসার সামনে দিয়ে আরেক ফ্রেন্ডের বাসায় যাওয়ার সময় ভাবছিলাম যে একবার ওর বাসায়ও যাবো কিনা? কিন্তু ও এবার ফোন ও করলো না আমাকে, এই ভেবে বিরক্ত হয়ে তখন সেই চিন্তা বাদ দিয়েছি।

তখন জানতাম না যে, ঐ মুহূর্তে ও কবরে ঘুমিয়ে ছিল। ঈদের পর দিন ভোর ৪টায় মারা গিয়েছে ও। ওকে আমি চিনি প্রায় এক যুগ ধরে। আমার এখন আল্লাহর রহমতে অনেক ভালো বন্ধু, কিন্তু জীবনের খুব কষ্টকর একটা সময়ে ওর সহমর্মিতা না পেলে আমার জীবনটা হয়তো অন্য রকম হত। আমি সবসময়ই ঘরকুনো স্বভাবের মেয়ে।

এমন কি গল্প বা আড্ডা দেয়ার নেশা তো দূরের কথা- কোন কিছু নিয়ে মনে আনন্দ বা কষ্ট লাগলে যে তা অন্যের সাথে শেয়ার করলে অনেক ভালো লাগে, এতটুকুও কখনও বুঝতাম না। আমরা ঢাকায় থাকি। লিপিরা আমাদের বাসার খুব কাছেই থাকতো। মাঝেমধ্যে বিকালে আমরা একসাথে ছাদে কথা বলতাম। আমার তখন সামনে এস এস সি পরীক্ষা।

আমার কিছু কাছের আত্মীয়এর জীবনে তখন কিছু অ্যাক্সিডেন্ট ঘটেছিলো। আমার ছোট চাচাতো ভাই মারা গিয়েছিলো। আমরা যে বিল্ডিং এ থাকতাম, সেখানে মোটামুটি প্রতিটি পরিবারই সবাই সবার খোজখবর নিত। কিছু দিন পর, সেখানে দু পরিবারের দূজন ব্যক্তির মৃত্যু ঘটে। পর পর ঘটে যাওয়া এসব ঘটনা অনেক বড় মানুষগুলোকেও কিছুটা মুষড়ে ফেলেছিল।

তাছাড়া, যখন কোন পরীক্ষার প্রেসার থাকে, তখন মানুষের মন মানসিকতা এমনিতেই দূর্বল হয়ে যায়, এ ব্যাপারটা আমি পরবর্তিতে আরো অনেকের মধ্যেও দেখেছি। যাইহোক, সবকিছু মিলিয়ে আমি খুবই ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। মানসিকভাবে খুবই বিপর্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। বাসার সবাই আমাকে নিয়ে টেনশানে পড়ে গেল। আম্মু বল্লো, এভাবে মন খারাপ করে সারাক্ষন বাসায় বসে থেকে এসব চিন্তা ভাবনা না করে যেন লিপিদের বাসায় যেয়ে ওর সাথে গল্প করি।

একদিন আমাদের বাসায় এসে আমার এ অবস্থার কথা শুনে লিপি আন্তরিক ভাবে আমাকে ওদের বাসায় যেতে বললো। এরপর থেকে আমি প্রতিদিন ওর সাথে আমার মনের যত ভয়, যত দূর্ভাবনার কথা শেয়ার করতে লাগলাম। ও মনোযোগ দিয়ে শুনতো। একবার আমাকে বললো, পৃথিবীতে এসমস্ত ঘটনা খুবই স্বাভাবিক, আমাদের এগুলো স্বাভাবিকভাবেই নিতে হবে। আমিও আল্লাহর অশেষ রহমতে ধীরে ধীরে সহজ স্বাভাবিক হলাম।

আজ ওর মৃত্যুটাও আমি স্বাভাবিক ভাবে নিয়েছি। শুধু প্রার্থনা করি, হে আল্লাহ – লিপির কবরের আজাব মাফ করে ও কে বেহেস্ত দান কোরো। খুবই সহজ সাধারন এই মেয়েটিকে হারানোর কষ্টটা এভাবেই লাঘব করতে চেষ্টা করি। ১৮ই নভেম্বর,২০১০-ভোর ৪টা…… ওর মৃত্যুর জন্য নির্ধারিত সময়। কত মানুষ সড়ক দূর্ঘটনায় মারা যায়, কত মেয়েরা বখাটেদের হাতে অথবা প্রেমিকের হাতে খুন হয়।

মানুষের কাজই নির্ধারন করে যে তার মৃত্যুটা কেমন হবে। ও মারা গেলো হঠাৎ প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে। অসুখটা ওর অনেকদিন ধরেই, কিন্তু পড়াশোনার চাপে এটার দিকে নজর দেয়নি ও। যেমন করেই হোক, পড়াশনার প্রতিযোগিতায় যে ও কে টিকে থাকতেই হবে। এক মুহূর্ত কি অন্য কোন দিকে খেয়াল করার সময় আছে? কিন্তু কেন ও এতটাই বেপরোয়া হয়ে পড়তে চাইতো যে নিজ়ের রোগের ট্রীটমেন্ট টাও ঠিকমত করলো না? গল্পটা একটু ধৈর্য্য ধরে শুনুন।

হয়তো আপনার ভাই,বোন বা সন্তানের জীবনে তাহলে এমন পরিনতি ঠেকানো যাবে। [/s] ইন্টারমিডিয়েট এর পর মেডিকেল এ পড়বে, এ আশায় লিপি ভর্তি হল প্রাইমেট কোচিং সেন্টারে। খুব বেশি মেধাবি ও ছিল না, কিন্তু চেষ্টা করতো ১০০%। পরিবারের সবাই, আত্মীয়স্বজন- তাই ছোটবেলা থেকেই ও কে ভাল ছাত্রী হিসাবে জানে। কিন্তু ভর্তি যূদ্ধে জয়ী হতে হলে একই সাথে একজনকে হতে হয় মেধাবী, পরিশ্রমী, বুদ্ধিমান, ভাগ্যবান এবং অনেক ক্ষেত্রে বিত্তশালী ও অসৎ।

কারন মেডিকেলের প্রশ্নপত্র অনেক সময় অনেকেই কিনে নিতে পারে, একথা কারো অজানা নয়। ও ওর সাধ্যমত চেষ্টা করতে লাগলো, কিন্তু ভুল পথে। যে ভুলটা স্বনামধন্য কোচিং সেন্টারএর অনেক ছাত্রছাত্রী ই না বুঝে করে ফেলে। কারন, সবচেয়ে ভালো ভালো কোচিং সেন্টার গুলো তাদের মান বজায় রাখার প্রতিযোগিতার তোড়ে অযথাই অনেক কঠিন মডেল টেস্ট নিতে থাকে। তাদের ক্লাশ লেকচার শুনলে তাদের জ্ঞ্যান ভান্ডারের পরিচয় পেয়ে দূর্বল ছাত্রছাত্রীরা হতাশ হয়ে পড়ে।

কারন এত কম সময়ে এতকিছু তখন তারা কিভাবে আয়ত্ত্ব করবে? যদিও মূল পরীক্ষাতে কিন্তু এত বেশি কঠিন বা প্যাচানো প্রশ্নের সংখ্যা সাধারনত খুব বেশি থাকে না। কিন্তু কোচিং সেন্টার কে অনুসরন করতে যেয়ে তুলনামূলক দূর্বল ছাত্রছাত্রীরা মূল বইকে আর আয়ত্ত্ব করার সুযোগ পায় না। ফলে কঠিন অনেক কিছু শিখলেও দেখা যায়, বই এর সহজ জিনিস গুলো তারা পারছে না। ফলাফলটা হল যে, প্রথমবার লিপি মেডিকেল এ চান্স পেলো না। অথচ বন্ধুবান্ধব্দের সবাই কোথাও না কোথাও চান্স পেয়ে গিয়েছে, অনেকে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি তে ভর্তি হয়েছে।

এদিকে আত্মীয়স্বজন রা বলছে, “এতো পড়েও কেন তুমি চান্স পেলা না? অমুক তো ঠিক ই অমূক জায়গায় চান্স পেয়েছে, তুমি পেলা না কেন?” চরমভাবে হতাশাগ্রস্ত হয়ে এবার ও নিজেই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে গেলো। [sb]“সবাই পারে, আমি কেন পারি না? আমি কি কোনদিন পারবো?আমার তাহলে কী হবে?” ওর ভেতরের এই সব প্রশ্নের কোন উত্তর ওর কোন আত্মীয়স্বজন কি দিয়েছিলো? আমি নিজে তখন ব্যস্ত হয়ে গিয়েছি আমার নতুন ইউনিভার্সিটির চাপের বেড়াজালে। হোস্টেল এ উঠে যাওয়ায় ওর সাথে দেখা করার সুযোগটাও চলে গেল আমার। শুধু একদিন এতটুকু আশ্ব্যস্ত করতে পেরেছিলাম যে, আরেকবার চেষ্টা করে দেখো…. এবার আর কোচিং এর অন্ধ অনুসরন করার দরকার নাই। ও পরের বছর আবার চেষ্টা শুরু করলো।

আল্লাহর রহমতে শেষপর্যন্ত ও চিটাগং ডেন্টাল মেডিকেল এ ভর্তি হতে পারলো। ঈদের সময় আমরা আবার একে অন্যের বাসায় আসার সু্যোগ পেতাম। বছরে একবার বা দুইবার দেখা করতাম, আর মনের যত দুঃখ আছে তা নিয়ে কথা বলতাম। আমাদের সমাজে বাবা মায়েরা সন্তান কে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখে- তার সন্তান কে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হতেই হবে। কিন্তু তার সন্তানের ক্ষমতা কতটুকু, সে ব্যপারে সঠিক ধারনা কয়জনের থাকে? মান সম্মত ভাবে ডাক্তারি বা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গেলে একজন শিক্ষার্থীকে যে কী সংগ্রাম করতে হয় সেই ধারনাও হয়তো অনেক পরিবারের নাই।

অনেক সন্তানেরাই বাবা মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে, সমাজে মাথা ঊঁচু করে দাড়াতে যে কোন মূল্যে সেই সংগ্রামে টিকে থাকতে চেষ্টা করে। কিন্তু তা তে সফল হওয়ার জন্য তার পরিবারের সদস্যদের থেকে প্রয়োজনীয় মানসিক ও আর্থিক সাপোর্ট কতজনের ভাগ্যে কতটুকু জোটে? বাংলাদেশের কয়টি পরিবার যথেষ্ট স্বচ্ছল ও সচেতন?এমন অবস্থার ভেতর দিয়ে বেরিয়ে আসা ডাক্তাররা তাই রোগ ধরতে পারে না, ইঞ্জিনিয়াররা যে বাড়ি বানায় তা ভেঙ্গে পড়ে। এসব কথা বলতাম না, বলছি কারন- অন্য আরো অনেকের মতই এসব কারনে ও কম কষ্ট পায় নি মারা যাওয়ার আগে। হয়তো তূলনামূলক দূর্বল ই ছিল ও, হয়তো ততটা পরিশ্রমও করতে পারে নি। একবার একটা পরীক্ষায় খারাপ করলো।

বাসায় কাঊকে বলেনি। শুনলে মন খারাপ করবে, কষ্ট পাবে বাবা মা- তাই। কিন্তু [sb]“এরপর আরো অনেক খাটতে হবে, আর কতবার পিছিয়ে পড়বো?”-এ চিন্তাটাই হয়তো বধ্যমূল হয়ে গেলো ওর ভেতর। খাটতে শুরুও করেছিল। এরপর একদিন শুনলাম, ভাইরাস জ্বর, খুব ই খারাপ অবস্থা।

ঢাকাতে ট্রীটমেন্ট শেষ না করেই চিটাগং চলে গেল, ক্লাশ শুরু হয়ে গিয়েছিল বলে। তারপর শুনলাম ও হঠাত খুব ই অসুস্থ, continuously মাথা ব্যথা, বমি, জ্বর। এটা এবছরের শুরুর দিকের ঘটনা। আমি ওর বাসায় গেলাম। গিয়ে দেখি ও বিছানায় পড়া।

মুখ (চোয়াল), হাত, পা বেশ ফুলে গিয়েছে। মাথা ব্যথা কিছুতেই কমে না। কিন্তু এসব নিয়ে তার তেমন কোন দুঃখ নেই। ক্লাশ খুলে যাবে, তখন ওয়ার্ডে কাজ করতে হবে, সামনে পরীক্ষা……….কিভাবে এসব দিবে তাই নিয়েই হা হুতাশ! কয়েকবার বিভিন্ন টেস্ট, এম আর আই করিয়েছে। কিছুই ধরা পড়েনি।

আমি বললাম, “তুমি এসব বড় বড় ডাক্তারদের কাছে যাচ্ছো, অথচ তারা তো তোমার সমস্যার কথা ভাল ভাবে শুনছেও না। শুধু টেস্ট করলেই কি সব বোঝা যায়? চল, আমি তোমাকে নিয়ে আবার ডাক্তারের কাছে যাই। আর …….একবার পরীক্ষা গেলেও আরেকবার পরীক্ষা দেয়ার সু্যোগ আসবে। এহুলো নিয়ে ভাবা লাগবে না। ” ও বললো-“আচ্ছা দেখি”।

তার কয়েকদিন পর শুনি, ও চিটাগং এ হোস্টেলে চলে গ্যাছে। ওর মা যেতে দিতে চায় না বলে জোর করেই নিজে নিজে চলে গ্যছে। আমি ফোন দেই, পাই না। কিছুদিন পর ও নিজেই ফোন করে জানালো, ওখানে ডাক্তার দেখিয়েছে- খুব বড় কোন সমস্যা না, ঔষুধ খাচ্ছে এখন। আমি যেন দূশ্চিন্তা না করি।

কিন্তু আমি ঠিক বুঝলাম না! নিজের চোখে ওর যে অবস্থা দেখেছি, তাতে বিশ্বাস হতে চায় না যে সামান্য কোন সমস্যা ওর! এরপর মাঝে মাঝেই ফোন এ ট্রাই করতাম খোজ নেয়ার। কিন্তু হয়তো ব্যস্ততার জন্য ধরতো না। তাই বলে পরে একটু কলব্যাক করবে না আমাকে? আমি তাই রাগ করি ওর উপর। হয়তো আমাকে আর ভালো বন্ধু ভাবে না ও!!! হয়তো এখন ভালই আছে! তারপর শেষবার যখন ওর খবর শুনলাম, তখন ওর মৃত্যু সংবাদ শুনলাম। ওর বাসায় গিয়ে জানলাম, নিয়মিত ক্লাশ করেছে এতদিন ও।

[sb](কারন, আর কোন ভাবেই অন্যদের চেয়ে পিছিয়ে পড়া যাবে না, সবাই পারলে ও কেও পারতে হবে। ) মা কে ফোন করতে দেরি হয়ে যেতো নাকি প্রায় ই, ক্লাশ করা, ওয়ার্ডে যাওয়া, নামায পড়া- এসবের ফাঁকে ফোন করতে একটু তো দেরি হতেই পারে। এবার ঈদে বাসায় এসে সব কিছু ঠিকঠাক মতই করেছে। শুধু নাকি মৃতো দাদীকে দুদিন স্বপ্নে দেখেছিলো, আর সারাদিন বসে বসে কী জানি ভাবতো! ঈদের দিন সন্ধ্যা থেকেই বমি আর ডায়রিয়া শুরু হয়। ডাক্তার কে ব্যপারটা জানিয়ে ঔষুধ ও খেয়েছিল।

কিন্তু অবস্থা আরও খারাপ হতে লাগলো। মাঝরাতে মেডিকেলে নেয়ার পথেই মারা গেলো। – এতটুকুই শুধু জানি আমি। কেন ও নিজের মধ্যে রোগ পুষে রাখলো? কেন- আমার, ওর মা-বাবার, ভাই-বোনের কারো কথাই শুনলো না, নিজের অসুখটার কোন গুরুত্বই দিল না। এমনকি, আসলে ঠিক কি রোগ হয়েছিলো- তা ও অজানা থেকে গেলো।

মাঝে মাঝে মনে হয়, কেউ যেতে দিতে না চাইলেও এবারো ও জোর করে চুপি চুপি চলে গ্যাছে- ক্লাশ খুলে যাচ্ছে না?

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।