আকাশটা ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে
রাত গভীর থেকে গভীর হচ্ছে। তবু ঘুম আসছে না ক্যাপ্টেন হাসিবের। কারণ কমান্ডিং অফিসার তাকে এক নতুন দায়িত্ব দিয়েছেন। নিজের পরিকল্পনায় দমন করতে হবে এক দল ভয়ংকর সন্ত্রাসীকে। বেশ কিছুদিন ধরে সন্ত্রাসী গ্রুপটি চাইল্লাতলী বাজারে আস্তানা গেড়েছে।
লোকালয়ে প্রকাশ্যে অস্ত্র হাতে ঘুরছে। চাঁদাবাজি করছে, ছিনিয়ে নিচ্ছে কৃষকের গোহালের গরু কিংবা জমির ফসল। এলাকার ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সব কিছুই চলছে এই সন্ত্রাসীদের ইশারায়। সাধারণ মানুষের জীবন বিষিয়ে তুলেছে এসন্ত্রাসীরা। কয়েকদিন আগে বাড়ির পাশের পাহাড় থেকে গরু আনতে গিয়ে নিখুঁজ হয়েছিল রাবেয়া আক্তার নামে এক মধ্যবয়সী নারী।
দুইদিন পর ছড়ার পাশে পাওয়া গেছে তার ক্ষত-বিক্ষত উলঙ্গ লাশ। হতভাগ্য রাবেয়ার স্বামী তার নাবালক তিন সন্তানসহ ক্যান্টনমেন্টে এসেছিল। কমান্ডিং অফিসার তাকে কোন শান্তনা বাক্য শুনাতে পারেননি। শুধু ছল ছল চোখে বলেছিলেন,
আমি চাকুরী করি। আমার অনেক সীমাবদ্ধতা আছে।
তারপরও যতটুকু সম্ভব, আমি চেষ্টা করব।
এরপরই কমান্ডিং অফিসার এ সন্ত্রাসী গ্রুপটি দমনের জন্য পর পর দুটি সেনা টিমকে পাঠিয়ে ছিলেন। কিন্তু, সেনা সদস্যরা চাইল্লাতলী গিয়ে আর সন্ত্রাসীদের নাগাল পায়নি। তাই তৃতীয় বারের মত অপারেশন পরিচালনার জন্য সিদ্ধান্ত হয়েছে। আর সেই অপারেশন পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ক্যাপ্টেন হাসিবকে।
এ ভয়ংকর গ্রুপটিকে দমনের জন্য তাকে সময় দেয়া হয়েছে এক সপ্তাহ। কিন্তু রাত পোহালেই অপারেশন পরিকল্পনা জমা দিতে হবে। তাই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এই তরুণ অফিসার রাতে না ঘুমিয়ে পায়চারি করছেন। পায়চারি করতে করতেই ভাবছেন, গোয়েন্দা রিপোর্ট অনুযায়ী সন্ত্রাসীগ্রুপটির কাছে স্টেনগান, একে-ফরটি সেভেনের মত মারাত্মক অস্ত্র রয়েছে। সন্মুখ যুদ্ধে এসব অস্ত্র খুবই কার্যকরী।
আবার অপারেশন এলাকাটির সব পথ-ঘাট সম্পর্কেও সন্ত্রাসীদের ভালভাবে ধারণা রয়েছে। তাছাড়া তাকে অপারেশন পরিচালনা করতে হবে বাজারে। তাও আবার হাটবারে। কেননা সেদিনই সন্ত্রাসীদের সংখ্যা বেশি থাকে। অর্থাৎ বাজারে প্রচুর লোকসমাগমের মধ্যেই তাকে অপারেশন পরিচালনা করতে হবে।
তাই পরিকল্পনা নিখুঁত না হলে সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার আশঙ্কা আছে।
তাছাড়া অপারেশন এলাকা থেকে প্রায় পাঁচকিলোমিটার পানি পথের দুরত্বও একটা বড় সমস্যা। আগের দু’টি অভিযান নিয়েই তাকে ভাবতে হচ্ছে। কারণ পর পর দু’টি অভিযানের কারণে সন্ত্রাসীগ্রুপটি অধিক সতর্ক হয়ে যাওয়াটাও স্বাভাবিক। তাই অধিক সতর্ক হয়ে ভাবতে হচ্ছে ক্যাপ্টেন হাসিবকে।
শান্তি চুক্তির পর শান্তিবাহিনী অস্ত্র জমা দিয়েছে। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি আসেনি। বন্ধ হয়নি অস্ত্রবাজি, চলছে চাঁদাবাজিও। এর মধ্যে আবার যুক্ত হয়েছে নতুন উৎপাত, চুক্তির পক্ষ-বিপক্ষের নামে এক ঘৃণ্য লড়াই। চাঁদা আদায় এবং এলাকার আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দু’দলের বন্ধুক যুদ্ধ নিত্যনৈমেত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
খুনাখুনির ঘটনাও ঘটছে অহরহ। এ ভয়ানক পরিস্থির মধ্যে পাহাড় থেকে বেশকিছু সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার করায় সমস্যা আরো প্রকট হয়েছে। সেনা প্রত্যাহার হওয়া এলাকাগুলো চুক্তির পক্ষ-বিপক্ষ সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। চাইল্লাতলী এমনই এক নতুন অভয়ারণ্য।
কাপ্তাই লেকের পূর্ব পাড়ে উঁচু পাহাড়ের পাদদেশে এ এলাকাটির অবস্থান।
ঘন ও গভীর জঙ্গলে ঢাকা পাহাড় এবং লেকের তীরে চাইল্লাতলীর মানুষজন এতদিন শান্তিপূর্ণভাবেই বাস করছিল। কিন্তু এলাকার নিরাপত্তাদানকারী ক্যাম্পটি প্রত্যাহারের পর থেকেই শান্তি চলে গেছে তাদের। নিরাপত্তার অভাবে রাতে ঘুমাতে পারছে না কেউ। অনেকে রাত জেগে পাহারা দিচ্ছে। তারপরও শেষ রক্ষা হলো না।
প্রথমে চিঠি দিয়ে এবং পরে সরাসরি চাঁদা দাবী করেছে পাহাড়ী সন্ত্রাসীরা। পাহাড়ী-বাঙালি বাদ যাচ্ছে না কেউ। যার অবস্থা যত ভাল তার চাঁদার পরিমাণও তত বেশি। কোন উপায় নেই, শেষ পর্যন্ত নিয়মিত চাঁদা দিয়েই একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে চাচ্ছে এলাকাবাসী। কিন্তু দিনে দিনে সন্ত্রাসীদের সাহস এবং চাহিদা দু’টোই বেড়ে গেল।
এক সময় তারা প্রকাশ্যেই অস্ত্র নিয়ে ঘুরতে শুরু করে। চাইল্লাতলী বাজারে গিয়ে টোল আদায়ের মতই চাঁদা তোলে। প্রতিবাদ তো দূরের কথা, সামান্য এদিক সেদিক হলেই নাজেহাল হতে হচ্ছে সন্ত্রাসীদের হাতে। বাজারে আসা ক্রেতা-বিক্রেতা সবাইকে চাঁদা দিতে হচ্ছে। বাদ যাচ্ছে না বাইরে থেকে আসা ব্যবসায়ীরাও।
বিশেষ করে সাপ্তাহিক হাটবারে তাদের অত্যাচারটা বেড়ে যায়।
অন্যান্য হাটবারের মত আজো সকাল থেকে ক্রেতা-বিক্রেতাদের ভিড় বাড়ছে। আশ-পাশের মানুষজন যেমন আসছে তেমনি আসছে দূরদুরান্ত থেকেও। ক্রেতা-বিক্রেতাদের ভিড়ে ব্যস্ত সময় পার করছে কালাধন চাকমার দলও। বাজারে বেশি মানুষ, বেশি বেচাকেনা মানেই অনেক টাকার লেনদেন।
আর অনেক টাকার লেনদেন মানেই পার্টির ভাল ইনকাম। তাই সকাল থেকেই সে তার দশজনের দলকে তিন ভাগ করে বাজারের তিনটি প্রবেশ মুখে বসিয়ে দিয়েছে। স্থল পথ দু’টির মুখে আছে দু’জন করে। আর জলপথের মুখে ছয় জনের দল নিয়ে কালাধন চাকমা নিজেই অবস্থান করছে। কারণ দূরের ব্যবসায়ীসহ বেশির ভাগ লোকজন বাজারে আসে এই পথেই।
একটার পর একটা ইঞ্জিন বোট আসছে আর যাত্রীদের সাথে আনা জিনিসপত্র দেখে চাঁদা ধার্য হচ্ছে। যাদের সাথে নগদ টাকা আছে তারা তখনই নির্ধারিত চাঁদা দিয়ে স্লিপ সংগ্রহ করছে। আর যারা দিতে পারছে না তারা বাজার শেষে দিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করছে। কেউ টু-শব্দটিও করছে না। সব কিছুই চলছে নীরবে।
তাছাড়া কিছু বলার সাহস কিংবা সুযোগও নেই তাদের। কারণ এর পরিণতি সম্পর্কে সবাই জানে।
সব কিছুই ঠিকঠাকই চলছিল, তবে হঠাৎ করেই ঘোট পাকাল এক বৃদ্ধ। এই বৃদ্ধ একটা ছাগল বিক্রি করতে এনেছে। ছাগলের জন্য একশ টাকা চাঁদা নির্ধারিত হয়েছে।
কিন্তু সে চাঁদা দিতে রাজি হচ্ছে না। কারণ হিসেবে বলছে, তার ছেলের অসুখ। তার চিকিৎসায় অনেক টাকা লাগছে। তাই নিজের শেষ সম্বল এই ছাগলটা বাজারে এনেছে। এটা বিক্রি করেও সব টাকা যোগার হবে না।
তাই সে অনুনয় করে বলছে-
বাবা, আমারে আজকের মত মাফ কইরা দেও।
কিন্তু ছেলের চিকিৎসাই হোক আর যাইহোক তাই বলে পার্টির চাঁদা দিবে না এটা কি করে সম্ভব? বৃদ্ধের স্পর্ধা দেখে কালাধন নিজেকে সামলাতে পারলো না। তাই কোন কথা না বলে সজোরে একচড় বসিয়ে দিল বুড়োর গালে। টাল সামলাতে না পেরে লুটিয়ে পড়ল বুড়ো মানুষটি। বুড়োর অসহায় অবস্থা দেখে সাহস করে এগিয়ে এলো না কেউ বরং ভয়ে দূরে সরে গেল সবাই।
এ সময় করল্যার খাঁচি নিয়ে এলো এক যুবক। সে খাঁচিটা বুড়োর পাশে নামিয়ে রেখে নিজের চাঁদা পরিশোধ করল। তারপর বলল-
দাদা, এই চাচা খুবই গরীব মানুষ। ওনারে মাফ কইরা দিলে হয় না?
ছেড়া এবং ময়লা শার্ট পড়া এই যুবকের কথা শুনেই সতর্ক হয়ে গেল কালাধন। সাথে সাথেই সে হাত বাড়ালো তার স্টেন গানের দিকে।
কিন্তু ততক্ষণে দেরী হয়ে গেছে। গর্জে ওঠেছে অন্য একজনের অস্ত্র। মুহুর্তের মধ্যেই গুলি, ককটেল ফাটার শব্দ আর ধূয়ায় অন্ধকার নেমে এলো চাইল্লাতলী বাজার ঘাটে। ঘটনরা আকশ্মিকতায় সাধারণ মানুষ আতংকে দিকবিদিক ছুটতে শুরু করল। দশ মিনিট ধরে বৃষ্টির মত চলল গুলি আর পাল্টাগুলির তান্ডব।
কিন্তু প্রশিক্ষিত কমান্ডোদের সাথে পেরে ওঠা সম্ভব হয়না সন্ত্রাসীদের। শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পন করে জীবন বাঁচাল তিনসন্ত্রাসী ।
আর গুলি বন্ধ হতেই দেখা গেল মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছে কালাধনসহ অপর তিনসন্ত্রাসীর দেহ । বাকি তিনজন দু’হাত তোলে দাঁড়িয়ে আছে। এদের দু’জনের গায়েও গুলি লেগেছে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই
দলে দলে লোকজন এসে ভীড় জমাল। কিন্তু ঘটনা দেখতে এসে সবাই অবাক। কারণ ছাগল বেচতে আসা বৃদ্ধ, করল্যা নিয়ে আসা যুবক এবং তাদের বোট চালক এরা সবাই সেনা সদস্য। বোটচালকরূপী ইঞ্জিনের তেল আর কালি মাখা ময়লা পোশাক পড়া তরুণই ক্যাপ্টেন হাসিব। তার আশে পাশে আছেন আরো কয়েকজন।
তারাও পড়ে আছেন কৃষক কিংবা সাধারণ হাটুরের পোশাক। একেক জনের পোশাক একেক রকম হলেও কমন বিষয় একটাই, সবার হাতেই চকচক করছে আগ্নেয়াস্ত্র। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখানে এসে যোগ দিল আরো দু’টি দল। তারাও গ্রেফতার করে এনেছে তিন সন্ত্রাসীকে। এরা ছিল স্থল পথ দু’টির দায়িত্বে।
স্থল পথ দু’টিতে দু’জন করে চারজন সন্ত্রাসী ছিল। কিন্তু একজন পালিয়ে গেছে।
আস্তে আস্তে জানা গেল সবই। ক্যাপ্টেন হাসিব দায়িত্ব পাওয়ার পরই পুরো বিষয়টা গভীরভাবে স্টাডি করেন। সহায়তা নেন আগে পরিচালিত অভিযান দু’টির অভিজ্ঞতারও।
আর সে আলোকেই অপারেশন পরিকল্পনা জমা দেন। সেই সাথে অনুমতি প্রার্থনা করেন, অপারেশনের আগে একবার নিজে গিয়ে ঘটনাস্থল দেখে আসার। অফিসার তার পিঠ চাপড়ে অনুমতি দিয়ে বলেন-
ইয়াংম্যান, বি কেয়ারফুল।
পরিকল্পনা মত তিন দিন আগে এসে ক্যাপ্টেন হাসিব চাইল্লাতলী বাজার এবং এর আশপাশ এলাকা রেকি করেন। আর সে অনুযায়ীই দু’টি দল পাঠিয়ে দেন স্থল পথে।
আর নিজে ইঞ্জিন বোট নিয়ে আসেন জলপথে। কারণ এখানেই থাকে সন্ত্রাসীদের মূল গ্রুপটি। ছদ্মবেশ ধারণ করেছিলেন কারণ আগের অভিযান দু’টির অভিজ্ঞতা থেকে নিশ্চিত হয়েছিলেন, যে বাজার এবং বাজারে আসার পথগুলোতে সন্ত্রাসীদের ইনফর্মার থাকে। তাই ইউনিফর্ম পড়ে অভিযান করতে গেলে পূর্বের মতই নিঃষ্ফল হতে হবে। কিন্তু ব্যর্থ হতে চাননি তিনি।
তবে তার ভয় ছিল একটাই। হাটবারে প্রচুর সাধারণ মানুষ থাকে। তাই অপারেশন চলাকালে ভুল হলে তাদের ক্ষতি হওয়াটাও স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু অপারেশনের সময় সে ভয় দূর করে দিয়ে ছিল কালাধন চাকমা নিজেই। বৃদ্ধবেশী সেনা সদস্যকে চড় মারায় লোকজন ভয়ে দূরে সরে যায়।
এতেই তৈরি হয়ে যায় অভিযানের নিরাপদ পরিবেশ। আর সুযোগ বুঝেই দূরবর্তী টিম দু’টির জন্য গ্রিন সিগ্ন্যাল স্বরূপ গর্জে ওঠে ক্যাপ্টেন হাসিবের এসএমজি।
(বি.দ্র. কমান্ডো অভিযানের বিষয়বস্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের চলমান ঘটনার একটি অংশ হলেও এর স্থান, কাল এবং চরিত্রের নামগুলো কাল্পনিক। )
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।