হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে নিহত ব্যক্তির সংখ্যা নিয়ে ‘অধিকার’ যদি অতিরঞ্জিত ও বানোয়াট প্রতিবেদন করে থাকে, তাহলে তার বিচার অবশ্যই হতে হবে। কিন্তু হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে কতজন মারা গিয়েছিল, তা নিয়ে জনমনে সন্দেহ-সংশয় মুছে যায়নি। কারণ, সরকার নির্দিষ্টভাবে কোনো তথ্য প্রকাশ করেনি।
অধিকার বলেছিল গত ৫ মে শাপলা চত্বরের দুর্যোগের রাতে ৬১ ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। গতকাল অধিকারে ফোন করেছিলাম বিকেল পাঁচটায়।
সিনিয়র রিসার্চার তাসকিন ফাহমিনা জানালেন, তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে ১০ জুলাই তাঁদের কাছে চিঠি আসে। এতে ৬১ জনের নাম-ঠিকানা চাওয়া হয়। তাঁরা ১৭ জুলাই উত্তর দিয়েছেন। অধিকার বলেছে, ভিকটিমদের স্বজনদের নিরাপত্তার প্রশ্ন আছে। তাই তারা একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারকের নেতৃত্বে একটি স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠনের সুপারিশ করে এবং অঙ্গীকার করে যে ওই কমিশনের কাছেই তারা ৬১ জনের বিষয়ে পূর্ণ তথ্য প্রকাশ করবে।
বিডিনিউজটোয়েন্টিফোর গতকাল আদিলুর রহমান খানের গ্রেপ্তারের খবর দিতে গিয়ে বলেছে, অজ্ঞাতনামা ‘কতিপয় মানবাধিকারকর্মী’ তাদের বলেছে, আদিলুর রহমান খান বিদেশি সংস্থার কাছে নিহত ব্যক্তির সংখ্যা দুই হাজার ৫০০ উল্লেখ করে পত্র দিয়েছেন। এ পর্যন্ত আমরা এই দাবির কোনো ভিত্তি পাইনি। এমনকি কোনো সরকারি মুখপাত্রও এই দাবি করেননি।
আজকের লেখায় আমরা কেবল একজন ‘সন্দেহভাজন’ মানবাধিকারকর্মীকে কী করে রাষ্ট্র আইনের হাতে সোপর্দ করে, সেই প্রক্রিয়াটির দিকে নজর দেব। এই প্রক্রিয়া অনভিপ্রেত ও নিন্দনীয়।
সরকারের অভিযোগের সত্যতা নাকচ না করেও আমরা বলব, আমরা এই সমাজ তৈরি করতে চাই কি না, যেখানে একজন সুপরিচিত মানবাধিকারকর্মী, যাঁর সাধুতা নিয়ে কারও মনে প্রশ্ন থাকলেও, তাঁকে আমরা কাঠগড়ায় তুলতে পুলিশ রেখে ডিবি লাগাব কেন। ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ব কেন। কেন গুলশান থানার পুলিশ ওয়ারেন্ট নিয়ে স্বাভাবিক গ্রেপ্তার করে থানা থেকেই তাঁকে জামিন দেবে না। কেন আমরা একজন অভিযুক্তের বিষয়ে ১০ দিনের মধ্যে চূড়ান্ত অভিযোগপত্র পাওয়ার চিন্তাই করতে পারব না। কেন ১০ দিন লাগবে রিমান্ডে।
বিচারবিমুখ থেকে রাষ্ট্র কেন রিমান্ড-উন্মুখ হবে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের পর রিমান্ড ও কারাবাস দিয়ে বিচারবহির্ভূত শাস্তিই হয়ে উঠেছে রাষ্ট্রের নিবর্তন ও নিপীড়নমূলক হাতিয়ার। কেন কারও অপরাধের বিচারের সময় তাঁর রাজনৈতিক পরিচয় বা বিশ্বাস বা সরকারের শত্রু না মিত্র, সেই যোগসূত্র খোঁজা হবে। একটি খবর এখন বলেছে, জামায়াতের সঙ্গে তাঁর ‘লিংক’ আছে। এ ধরনের অনির্দিষ্ট তথ্য দিয়ে অভিযুক্তের প্রতিকূলে সরকারিযন্ত্রের বিদ্বেষপ্রসূত মনোভাবের অনুকূলে একটি পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়, যাতে ‘আমাদের’ লোকের মাথার চাঁদিতে আরামবোধ জাগে এই ভেবে যে ‘একটু বাড়াবাড়ি’ হলে ক্ষতি কী, সে তো ‘তাদের লোক’।
মিডিয়া জেনে বা না জেনে অনেক সময় ক্ষমতাসীনদের দ্বারা আইনের এহেন অপব্যবহারকে কুর্নিশ করে থাকে। এর বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার বিষয়ে নাগরিক সমাজের মধ্যে কোনো উদ্বেগ দেখি না। বরং ‘আমরা’ এবং ‘তারা’র দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার বেআইনি তৎপরতাকে প্রশ্রয় দেওয়ার চেষ্টা চলে। নিজের ঘাড়ের ওপর এসে না পড়া পর্যন্ত আমরা আইনের শাসন মানতে চাই না।
তবে হেফাজতের ৫ মের মেয়াদোত্তীর্ণ সমাবেশটি বলপ্রয়োগে ছত্রভঙ্গ করতে গিয়ে হতাহতের বিষয়ে নির্দিষ্ট তথ্য দিতে সরকারের সরাসরি অস্বীকৃতি এবং বিরোধী দলের দায়িত্বহীন ও প্রমাণবিহীন অতিরঞ্জন পুরো বিষয়টিকে ধোঁয়াটে করে রেখেছে।
আমাদের হয়তো কোনো একদিন কোনো বিদেশি কর্তৃপক্ষের বরাতে নতুন তথ্য শুনতে হতে পারে। আমাদের কথিত স্বাধীন গণমাধ্যম ও সংসদ মতিঝিলের সেই দুর্যোগের রাতের প্রকৃত সত্য উন্মোচনে এখন পর্যন্ত অপারগ কিংবা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। মৃতের সংখ্যা শত শত থেকে শুরু করে ৫০-এর নিচে যেকোনো সংখ্যার কথা বাতাসে ভাসছে। এ রকম একটা প্রেক্ষাপটেই খবর বেরোল যে অধিকার সম্পাদক আদিলুর রহমান খান ওরফে শুভ্র, যিনি একসময় সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হওয়ার যোগ্যতাসম্পন্ন প্রজাতন্ত্রের একটি পদে (সাবেক ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল) বহাল ছিলেন, তিনি দৃশ্যত রাষ্ট্রের কাছে রাতারাতি বিপজ্জনক ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। তাই রাত ১০টায় ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চ পাজেরো গাড়ি নিয়ে সদলবলে তাঁর বাসভবনের সামনে থেকে ছোঁ মেরে তাঁকে তুলে এনেছে।
ভাগ্যিস তারা তাঁকে ঈদের দিনটিতেই ছিনিয়ে আনতে যায়নি!
বিএনপি আমলে প্রণীত ২০০৬ সালের তথ্যপ্রযুক্তি আইনের কালো ৫৭ ধারাটির সম্ভাব্য অপব্যবহার নিয়ে এর আগে এই কলামে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলাম। কিন্তু নতুন সরকার গঠন করতে বুকের শিনা টান হতে থাকা বিএনপি আমাদের এ বিষয়ে যথারীতি আশ্বস্ত না করেই থাকছে। আদিলুর রহমান খানের বিরুদ্ধে সরকারের আস্তিনের নিচে আরও কোনো মামলা থাকলে অবাক হব না। তবে আমরা আপাতত তাঁর নাটকীয় গ্রেপ্তার থেকে ১০ দিনের রিমান্ড চাওয়া পর্যন্ত প্রক্রিয়াটির শুদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন না তুলে পারি না। প্রতীয়মান হচ্ছে যে পুরো প্রক্রিয়াটি অস্বচ্ছ এবং অনেকটাই এখতিয়ারবহির্ভূত।
পরোয়ানা ছাড়া গ্রেপ্তার, গুলশান থানায় দায়ের করা মামলার বিবরণ অভিযুক্তকে জানতে না দেওয়া, এমনকি আদালতকক্ষে তাঁর আইনজীবী ও পরিবারের সদস্যদের তাঁর কাছে ঘেঁষতে না দেওয়ার বিষয়ে অধিকার অভিযোগ তুলেছে। এসব সত্য হলে এটা স্পষ্ট যে, রিমোট কন্ট্রোলে চলুক আর নাই চলুক, সরকারিযন্ত্র বেপরোয়া, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বর্ণিত ‘মানবাধিকার হরণ’ ঠেকাতে আরেক হরণের অভিযোগ যাতে উঠতে না পারে, সে জন্য সতর্ক হওয়া দূরে থাকুক, যেন কোনো কিছুতেই তাদের কুছ পরোয়া নেই। এতে সন্দেহের অবকাশ কম যে, আদিলুর রহমান খানের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণে রাষ্ট্রযন্ত্র নির্মোহ থাকছে না বরং তার প্রেজুডিশ বা বিরাগের প্রকাশ ঘটছে। দীর্ঘকাল ধরে মানবাধিকারের সঙ্গে যুক্ত থাকা একজন আইনজীবীকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করে ‘শিক্ষা’ দেওয়া হয়েছে। রাজনীতির পাজেরো কালচারের সঙ্গে এই পাজেরো গ্রেপ্তারের একটা মিল আছে।
কোনো গণতান্ত্রিক দেশ এ রকম ধারার গ্রেপ্তারকে বাহবা দিতে পারে না। এক দশক ধরে এই রুগ্ণ ধারা ক্রমশ জেঁকে বসেছে। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের নামে ১০ দিনের রিমান্ড চাওয়া হয়েছে। সরকারিযন্ত্রের এই অন্যায্য আকাঙ্ক্ষার মধ্যেই আইনের নিরপেক্ষ প্রয়োগের পরিবর্তে প্রতিশোধপরায়ণ মনোভাবের ইঙ্গিত মিলছে। রিমান্ড মানেই কোনো না-কোনো মাত্রায় নির্যাতন।
অন্যদিকে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও জামায়াত এমনভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে, যাতে এটা মনে হওয়ার কারণ খুবই সীমিত যে তারা দেশের একটি বড় মানবাধিকার সংগঠনের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তির অন্যায্য গ্রেপ্তারকে কেবলই মানবাধিকারের প্রতি হুমকি হিসেবে গণ্য করছে। কেবল আইনি প্রক্রিয়ার বরখেলাপের কারণে তারা উদ্বিগ্ন। বরং এই আশঙ্কাই থাকবে যে সরকারের পতনের এক দফার আন্দোলন শুরু করতে গিয়ে হঠাৎ তারা একটি হাতিয়ার পেয়ে গেছে। এখন তারা এটাকে তাদের মূল মনোষ্কাম পূরণে ব্যবহার করতে চাইবে। আদিলুর রহমান খান বিএনপি আমলেই ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ছিলেন এবং তাঁকে বিরোধী শিবিরের একজন হিসেবেই দেখা হবে।
তবে আদিলুর রহমান খানের রাজনৈতিক অবস্থান বিএনপি-জামায়াতবান্ধব হিসেবে দেখা হলেও একজন সক্রিয় মানবাধিকারকর্মী হিসেবেও তিনি নিজের একটি জায়গা তৈরি করেছেন। তাঁর রিমান্ড শুনানিকালে নেদারল্যান্ডস ও সুইডিশ দূতাবাসের দুজন কর্মকর্তার উপস্থিতি তারই ইঙ্গিত দেয়।
আদিলুর রহমানকে নিজেদের লোক বিবেচনা করে বিএনপির চেয়ারপারসন ও ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব ত্বরিত বিবৃতি দিয়েছেন। কিন্তু অধিকারের যে তথ্যকে সরকার চ্যালেঞ্জ করেছে, সেই চ্যালেঞ্জ বিরোধী দলেরও করার কথা। আমরা স্বীকার করি যে স্বাধীন তদন্ত কমিশনের কাছে তথ্য প্রকাশে অধিকারের অবস্থান নাকচ করা যায় না।
কারণ, নাগরিকের নিরাপত্তাহীনতার বোধ খুবই স্পষ্ট। গুম হওয়া ব্যক্তির পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে থানা মামলা নেয় না। আবার প্রকাশ্যে নিতে চাইলেও ভয়ে অনেকে থানায় যান না। আজ পর্যন্ত একটি ক্রসফায়ারের ঘটনারও (বিএনপি আমল থেকে একই ধারা) তদন্ত প্রতিবেদন সরকার জনসমক্ষে প্রকাশ করেনি। বুকের ছাতি ফুলিয়ে বলেনি বিএনপি একটিরও তদন্ত করেনি।
এই দেখুন আমরা করেছি। ওই দেখুন বিলবোর্ডের ডিজিটাল পর্দায় সেসব তথ্য ঝকঝক করছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নূর খান বললেন, ‘সমাজে ভয় ঢুকেছে। চায়ের দোকানে-বাসে সরকারবিরোধী কোনো আলোচনা শুনি না। ভোটের আগে জরিপ করি।
ধারণা পাই সরকারি প্রার্থী জিততেও পারে। কিন্তু পরে ভোটের বাক্স খালি থাকে। রাজার বিরুদ্ধে কথা না বলতে পারার যুগে আমরা যেন ফিরছি। ’
আমরা বুঝতে পারছি, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো প্রতিবাদে সরব হবে। বেশি হবে বিএনপি।
সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি ও বিএনপি আমলের অ্যাটর্নি জেনারেল নিম্ন আদালতে আদিলুর রহমান খানের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। বিএনপি একে একটি ইস্যু করবে। কিন্তু সেই ভয়ার্ত হেফজতি রাতের সঠিক তথ্য জানতে আমাদের অসহায়ত্ব বোধ ঘুচবে না। ‘অধিকার’ জানে, এই ‘অজনপ্রিয়’ সরকার স্বাধীন তদন্ত কমিশনও করবে না। তাদেরও ৬১ জন নিহত ব্যক্তির প্রশ্নবিদ্ধ তালিকাটি প্রকাশ করতে হবে না।
কিন্তু অধিকারের মিত্র ইদানীং অতিশয় জনপ্রিয় প্রতীয়মান হওয়া বিএনপি কেন ৬১ জনের ব্যাপারে ‘স্বাধীন তদন্ত’ চালিয়ে তার রিপোর্ট প্রকাশে অনিচ্ছুক কিংবা থরহরিকম্প? অবসরপ্রাপ্ত বিচারকেরা নিশ্চয় বিএনপিকে বর্জন করেননি। কেন সবাইকে সব কাজ কেবল মসনদে গিয়েই করে দেখাতে হবে?
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।