বিকট
শীত এসে গেলো এই নগরে। উত্তুরে বাতাসে উত্তপ্ত এই শহরের শরীরটা জুড়োচ্ছে আর আমরা, শহরবাসীরা, এতদিন ধরে অনবরত অনলবর্ষণ করে আসা সূর্যটাকে শাপশাপান্ত করতে করতে ক্লান্ত হবার পর একটু জিরোবার অবকাশ পাচ্ছি। নাতিশীতোষ্ণ এই অঞ্চলের গতানুগতিক ঋতুবৈচিত্রের নিয়মানুযায়ী সূর্যটাকে বেশ কদিন নিরুদ্দেশ থাকতে দেখা যাবে, এ আমরা জানি, তাই অযথাই সূর্যের প্রতি নিজেদের তীরস্কারকে দায়ী ভেবে অপরাধবোধে ভুগিনা। তবে কিছু স্নায়ুরোগী এবং বৈকল্যচিত্তের মানুষের কথা আলাদা। তারা সূর্যের সম্ভাব্য তীরোধানকে ঋতুচক্র আর নিজেদের ভাগ্যচক্রের সাথে মিলিয়ে আতঙ্কের কঙ্কাল দেখে সবখানে।
শীত আমাদের শরীরে যেসব চিহ্ন রাখতে শুরু করে তাতে তারা নিজেদের জীবনীশক্তি এবং স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে।
হালকা কুয়াশায় মিষ্টিরোদে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে হাঁটছিলাম, তখন এরকম একজনের সাথে দেখা হয়ে গেল আমার।
"আমরা সূর্যটাকে গালমন্দ করে তাড়িয়ে দিয়েছি, এর ফল ভালো হবেনা। "
"আহহা! আবার শুরু করলেন!"
"বাতাসে আদ্রতা নেই, চারিদিকে কি ভীষণ শুস্কতা! দেখুন, আমার ঠোঁট ফেটে গেছে"
"এটা খুবই স্বাভাবিক, শীতকালে ওরকম হয়ই। এখন আমাকে আর বিরক্ত না করে কাজে যান"
সে অনিশ্চিত ভঙ্গিমায় চলে যায়।
তাকে মোটেও আশ্বস্ত মনে হয়না। সে টলোমলো পায়ে হাঁটতে হাঁটতে মিশে যায় অন্যান্য স্নায়ুবিকল মানুষদের ভীড়ে।
শীতের কারণে রাস্তায় লোকজন কম। আজকে কুয়াশা বেড়েই চলেছে সময়ের সাথে সাথে। রোদ এসে গোমড়ামুখ করে বসে থাকে কুয়াশার ভারি দরজার সামনে।
জানি, সূর্য আসবেই যথাসময়ে, তাই আমি শীতের এই ঝটিকা সফরকে স্বাগতম জানাই মনে মনে।
আমার সামনে একটা সবুজ পাতা ঝরে পড়ে। আমি উবু হয়ে তুলে নেই ওটাকে। অবশ্য সবুজের কিয়দংশই অবশিষ্ট আছে তার মাঝে। বিবর্ণ সবুজ! পাতা ঝরার মৌসুমে বিষাদের সুর বেজে ওঠে যেন কোথাও সঙ্গোপনে।
আমার মন কেমন কেমন করে ওঠে। আমি কর্মস্থলে যাবার পরিকল্পনা বাদ দিয়ে নিকটস্থ একটা পার্কে গিয়ে বসি। বেঞ্চের আশেপাশের পাতার স্তুপে মিশিয়ে দিই আমার সংগৃহীত পাতাটি।
যাও! এখন আর তুমি একা নও! মিশে যাও...মিশে যাও বিবর্ণদের দলে যেমনটা আমরা হয়ে গেছি এই শীতে। বিবর্ণ আর ফ্যাকাশে।
শীতটা বেড়ে চলেছে। ঘন কুয়াশার একরোখামির সাথে যুঝতে না পেরে বিদায় নিয়েছে সুর্যটা।
"আমি আগেই বলেছিলাম" শীতে কাঁপতে কাঁপতে বলে ওঠে সেই দূর্বলস্নায়ু ব্যক্তিটি। "সূর্য চলে যাবে, আর আসবেনা"
"কি বাজে বকছেন এসব! এই দেখুন না, আবহাওয়ার পূর্বাভাসে কি লেখা আছে!"
"আগামী কদিন ঘন কুয়াশায় আবৃত থাকবে শহর। সূর্যের দেখা নাও মিলতে পারে..."
আমি তাকে খবরের কাগজ পাঠ করে শোনাই।
সে তার ফাটা ঠোঁট দিয়ে কষ্ট করে হাসে।
"আবহাওয়ার অফিসের লোকজনতো হিসেব করে সূত্র কষে বলেই দিতে পারে, কিন্তু ওদের কাছে সূর্য থাকা বা না থাকায় কি আসে যায়?"
"হু, তাও তো ঠিক!" আমি কম্পিত কন্ঠ জবাব দিই। শীত বেড়ে চলেছে। তার ধূসর হিমেল চাদর দিয়ে জড়িয়ে ধরছে আমাকে। এমতাবস্থায় এই উদভ্রান্ত লোকটির নেতিবাচক কথাবার্তা আমার স্নায়ুর ওপরে যথেষ্ঠ চাপ ফেলে।
তাই আমি সরে আসি ওখান থেকে।
ঠোঁট ফাটতে শুরু করেছে আমারও। মুখে একটা বিশ্রী খসখসে ভাব। চুলকানোর সাথে সাথে সাদা চর্মাংশ উঠে আসছে। অবশ্য এসবের প্রতিকারের জন্যে ঘরে প্রচুর পরিমাণে প্রসাধনী মজুদ করে রেখেছি আগে থেকেই।
এখন যা দরকার, তা হল, ভালো শীতের কাপড়। মোটা শীতের কাপড়। আজ এতটা শীত পড়বে বুঝিনি, তাই হালকা কাপড় গায়ে দিয়েই বেড়িয়েছিলাম। কিন্তু এখন যা অবস্থা দাঁড়িয়েছে, তাতে অসুখ বাঁধাতে না চাইলে ফুটপাত থেকে হলেও কিছু কাপড় কিনে নেয়াই শ্রেয়। রাস্তায় এসময় পসরা বসায় ফেরীঅলারা।
রঙচঙে শীতের কাপড়ের। কিন্তু আজ কাউকেই দেখতে পাচ্ছিনা। শহরের মানুষজন বেশিরভাগই কর্মবিমুখ আর অলস। একটু ছুতো পেলেই ফাঁকি দেবে। রাগে গজগজ করতে করতে ভাবি আমি।
কুয়াশার পুরু চাদর সরিয়ে আমি দেখতে পাই দুজন বিক্রেতা বসে আছে শীতবস্ত্র সাজিয়ে। একজনের কাছে বহুবর্ণ পোষাক, নানা রকম এবং প্রচুর পরিমাণে, টুপি, সোয়েটার, দস্তানা, জ্যাকেট ইত্যাদি। আরেকজনের কাছে শুধু কিছু পাতলা চাদর আর কাঁথা। এই লোকটা বড় অভাবে, নিতান্তই দায়ে পড়ে পথে নেমেছে, বুঝতে পারি। কারণ এরকম পাতলা কাপড় এই শীতে মোটেও বিকোবেনা।
"কি কি লাগবে স্যার বলেন?"
আমি অন্য বিক্রেতাটির সাথে দর কষাকষি করতে শুরু করি, এবং বেশ কিছু শীতবস্ত্র কিনে ফেলি। চলে যাওয়ার সময় অপর বিক্রেতাটির দিকে তাকিয়ে মায়া হয় আমার। বেচারা গরীব মানুষ! ওর কাছ থেকে একটা চাদর কিনে নিয়ে যাই, বেচারার উপকার হবে কিছুটা, ভাবি আমি।
"এই, কত করে তোমার চাদর আর কাঁথাগুলো?" সুধোই আমি।
"যার তার কাছে বেচিনা" উদ্ধত অবজ্ঞা প্রকাশ পায় তার কন্ঠে।
হয়তোবা তুমি করে বলায় রাগ করেছে, হয়তোবা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া মধ্যবিত্ত ঘরের কোন ছেলে সে, যার কাঁধে হঠাৎ সংসারের জোয়াল এসে চেপেছে। এদের আত্মাভিমান বেশি হয়। আমি পরিস্থিতি বিবেচনা করে চটে না গিয়ে ভাববাচ্যে কথা চালিয়ে যাই,
"কেন, কি হয়েছে?"
এবার সে হাসে। নির্মল, সুন্দর হাসি, আমাদের মত শুস্ক আর রুক্ষ নয় তার ত্বক। লাবণ্যময় একটা চেহারা।
"হাহা! কিনেবেন? কিনে কি লাভ যদি ব্যবহার করতে না পারেন? খামোখা পয়সা খরচ। তবে দেখতে পারেন"
বলে সে তার বিক্রয়সামগ্রীগুলো বিছিয়ে দেয়, শিশিরভেজা তাজা ঘাসে।
আমি বাছতে শুরু করি। অদ্ভুত! একটা পুরোনো গন্ধ, একটা ভীষণ পরিচিত পুরোনো গন্ধ...এই কাঁথাটা...এতো আমার মায়ের তৈরী করা, যা আমি হারিয়ে ফেলেছি অনেক আগেই। আমি তড়িঘড়ি করে হাতড়াতে শুরু করি অন্যান্য শীতবস্ত্রগুলো, আরো কিছু পাবার আশায়।
করতে গিয়ে সব এলোমেলো করে ফেলি।
"বলেছিনা, এগুলো যার তার কাছে বিক্রীর জন্যে না! যে সে ইচ্ছে করলেই এগুলো কিনতে পারেনা"
সে টান দিয়ে চাদর আর কাঁথাগুলো গুছিয়ে নিয়ে হারিয়ে যায় কুয়াশার মাঝে।
জগদ্দল পাথরের মত দাঁড়িয়ে থাকি আমি। এতসব শীতবস্ত্র চাপিয়েও বিন্দুমাত্র উষ্ণতা অনুভব করিনা। একটুও ওম পাইনা থরথর করে কাঁপতে থাকি।
আবহাওয়াটা ভালো না। আমিও স্নায়ুবৈকল্যে ভোগা শীতগ্রস্থদের মত অস্বাভাবিক আতঙ্ক অনুভব করি। বাসায় ফিরতে হবে। সেখানে হয়তোবা এই ভৌতিক শীতের আগ্রাসন থেকে রেহাই পাওয়া যাবে।
আমি ছুটতে থাকি।
আমার সাথে ছুটতে থাকে সেইসব শীতগ্রস্থ মানুষেরা। তাদের ভয়ার্ত চিৎকার চেচামেচিতে এক বীভৎস পরিবেশের সৃষ্টি হয়।
"আমি আগেই বলেছিলাম, সময়টা ভালোনা" ঠোঁট থেকে গড়িয়ে পরা রক্ত চাটতে চাটতে ওদের একজন বলে।
ওদের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে আমার ভয় করে। তাই ইচ্ছে করে পা হড়কে পড়ে যাই।
এতে তারা আরো ভয় পেয়ে জোরে দৌড়ুতে শুরু করে।
আমার হাঁটুর কাছে ছিলে যায়। শীতকালে কাঁটাছেড়ার যন্ত্রণা দীর্ঘস্থায়ী হয়। আমি পা চেপে বসে থাকি। প্রার্থনা করতে থাকি যেন এই ভয়াবহ শীতকাল দ্রুত কেটে যায়।
সূর্য একদিন উঠবে জানি, জানি শীতকাল ঋতুবৈচিত্রের অংশ বৈ কিছু নয়। এটা চিরস্থায়ী না। কিন্তু আমার লদ্ধজ্ঞান আজকে ভীষণ নড়বড়ে অবস্থায় আছে অবিশ্বাস আর ভয়ের আক্রমণে।
অবিশ্বাস আর ভয় আর সন্দেহ নিয়েই তো এভাবে বাঁচি আমরা প্রতিনিয়ত। কখনও বুকে নিয়ে, কখনও মেকি হাসিতে, কখনও পাশবালিশের মত লেপটে ধরে।
এই শীতকাল, এই কুয়াশা এবার যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো তা।
আমার হাঁটুর ব্যথাটা ধীরে ধীরে সংক্রামিত হতে থাকে। শীতকালে ব্যথা বেদনা বৃদ্ধি পায় জানি, কিন্তু এরকম বিতিকিচ্ছিরিভাবে ছড়িয়ে পড়বে, ভাবিনি। ব্যথাটা বাড়তে বাড়তে বুকের কাছে এসে থামে, ওখানেই জমাট বেঁধে থাকে। আমি আক্রান্ত হচ্ছি....এক্ষণি রুখে না দাঁড়ালে নির্ঘাৎ মারা পড়ব।
তাই অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়াই। বাসায় পৌঁছুতে হবে যেভাবে হোক।
শীতকালে কাটাছেড়াগুলো বড্ড যন্ত্রণা দেয়। কষ্ট হয় হাঁটতে, ভীষণ কষ্ট। কোথা থেকে সব কষ্ট এসে আমার বুকে জমা হয় কুয়াশার মত।
আমি হেঁটে চলি, কখনও ক্লান্তিতে নুয়ে পড়ি, ছেচড়ে চলি সরীসৃপের মত।
কুয়াশা কাটেনা
শীত বেড়েই চলে
আমার ক্ষতস্থানগুলো ভীষণ জ্বলতে থাকে।
বুক চেপে ধরি ব্যথায়।
আমি হেঁটে অথবা ছেঁচড়ে চলতেই থাকি, ঝরে পড়া পাতা, ফুল, আর রুক্ষ ঘাস মাড়িয়ে।
দিনের পর দিন কাটে।
আমার হাঁটার গতি স্লথ হয়ে আসে। একাকী এই শীতের শহরে একটু উষ্ণতা, একটু ওম, একটু আরামের জন্যে হাহাকার করে ওঠে শরীর আর মন।
দিন কেটে যায়।
অতিথী পাখীদের ঘরে ফেরা দেখে বুঝতে পারি, শীতকালটা শেষ হয়ে এল বলে। ঐতো সূর্য উঠছে! সূর্য উঠবে এতো জানা কথা কিন্তু শীতের সময়টায় কি ভয়েই না ছিলাম! অবিশ্বাসের ঠোক্কড়ে চেনাজানা বিষয়গুলো কিরকম নাস্তানাবুদ হয়ে গিয়েছিলো ভেবে হাসি পায়।
সূর্যের আলোয় আমার ক্ষতস্থানগুলো সারতে শুরু করে। হাঁটু থেকে শুরু করে বুকের কাটাছেড়াগুলো নিরাময় লাভ করে। এবার আমি জোর পেয়ে দৌড়ুতে শুরু করি ঘরের দিকে। বহুদিন স্নান করা হয়না, নরম বিছানায় শোয়া হয়না, দাঁড়ি গোঁফ কামানো হয়না। এই আরামদায়ক আবহাওয়াতে এসবই আয়েশ করে করব।
আমি বাসার ভেতর ঢুকি। কে যেন বেড়িয়ে যায়, কারা যেন বেড়িয়ে যায়, কি যেন নিয়ে যায়, কাকে যেন নিয়ে যায়, বুঝিনা আমি। চিনে উঠতে পারিনা কাউকে বা কিচ্ছুকে। ঘরের ভেতরে অন্ধকার। বাতিগুলো সব বিকল।
কিন্তু এয়ারকুলারটা ঠিকই চলছে বিজবিজ শব্দ করে। ভেতর থেকে বোঝার উপায় নেই যে, শীতকাল চলে গেছে। আমি আবার কাঁপতে থাকি শীতে, আমার ক্ষতস্থানগুলোতে ব্যথা করতে শুরু করে। জানালা খুলে দেই রোদের প্রত্যাশায়, কিন্তু আলো আসেনা, আমি কিচ্ছু দেখতে পাইনা, শুধু শুনতে পাই ডানা ঝাপটে চলে যাচ্ছে অতিথী পাখিগুলো
সুন্দর পাখিগুলো!
মায়াময় পাখিগুলো!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।