আজ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৩৮তম শাহাদাতবার্ষিকী। ১৯৭৫ সালের এই দিনে তাঁকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে সপরিবারে সেনা কর্মকর্তাদের একটি দল গভীর ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে নির্মমভাবে হত্যা করে। প্রতিবছর এই দিনটিতে জাতি বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করে, কিন্তু এই হত্যাকাণ্ডের জন্য কাদের গাফিলতি বা ব্যর্থতা দায়ী ছিল, তা কদাচিৎ আলোচিত হয়। সাধারণত বলা হয়, এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের প্রত্যক্ষ মদদ ছিল; কিন্তু কোনো ষড়যন্ত্রই সফল হয় না, যদি না তাতে ভেতরের কারও গাফিলতি বা ব্যর্থতা থাকে। এই গাফিলতি বা ব্যর্থতা থাকলেই বহিঃশত্রু তার সুযোগ গ্রহণ করে অথবা ভেতরের অন্দরমহলের মানুষজনকে কাজে লাগিয়ে তাদের ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করে।
প্রথমত, বঙ্গবন্ধু গণমানুষের নেতা ছিলেন, যে কারণে তিনি আজীবন গণমানুষের সঙ্গে থাকতে চেয়েছেন। তাঁকে একাধিকবার বহুজন বলেছেন, নিরাপত্তার খাতিরে তাঁর উচিত সরকারি গণভবনে উঠে যাওয়া। তিনি উত্তরে তাঁদের বলতেন, গণভবনে চলে গেলে সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব সৃষ্টি হবে, যা তিনি প্রত্যাশা করেন না। অনেকটা এ কারণেই তিনি তাঁর ব্যক্তিগত নিরাপত্তার বিষয়টাকে তেমন গুরুত্ব দিতেন না। তাঁর ধারণা ছিল, তাঁকে বাংলার মানুষ এতই ভালোবাসে যে তারা তাঁর ক্ষতি করবে না।
এটি একধরনের অতি আত্মবিশ্বাস, যা কখনো কখনো কাল হয়ে দাঁড়াতে পারে, যেটি বঙ্গবন্ধুর বেলায় হয়েছিল।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতীয় সেনাবাহিনীর স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের অধিনায়ক মেজর জেনারেল সুজান সিং উবান পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে অপারেশনের দায়িত্বে ছিলেন। তাঁর মূল লক্ষ্য ছিল, এই অঞ্চলে পাকিস্তান সরকারের মদদে যে মিজো সশস্ত্র বাহিনী দীর্ঘদিন ধরে পূর্ব ভারতে অন্তর্ঘাতমূলক আক্রমণ চালাচ্ছিল, তাদের সেখান থেকে উৎখাত করা। মুজিব বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গেও তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার কয়েক দিন পর উবান পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেছিলেন, কিন্তু সে সময় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে উবানের তেমন আলাপ-আলোচনা হয়নি।
কিছুদিন পর উবান দিল্লি ফিরে গিয়েছিলেন। এর কয়েক মাস পর বঙ্গবন্ধু ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে এক তারবার্তা পাঠিয়ে উবানের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতের অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন। সেই আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে উবান ঢাকায় এসেছিলেন। এই আমন্ত্রণের মূল উদ্দেশ্য ছিল, বঙ্গবন্ধু এমন একটা বাহিনী গঠন করতে চান, যা মুক্তিবাহিনী ও মুজিব বাহিনীর দেশপ্রেমিক যুবকদের নিয়ে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাসহ দেশ গঠনে তাঁকে সাহায্য করতে পারবেন। বঙ্গবন্ধু এ ব্যাপারে জেনারেল উবানের সঙ্গে আলোচনা করেন।
পরবর্তীকালে জন্ম হয় জাতীয় রক্ষীবাহিনী। উবান তাঁর এসব অভিজ্ঞতা বিবৃত করেছেন মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে প্রণীত গ্রন্থ ফ্যান্টম্স্ অব চিটাগং-এ।
দ্বিতীয়বার বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতের বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন ‘এবারও আমি লক্ষ করলাম, তাঁর বাসায় কোনো নিরাপত্তাব্যবস্থা নেই। সব রকমের মানুষ সময়-অসময়ে যখন-তখন এসে প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎকার চাইত। তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসা লোকদের কোনো বাছবিচার নেই।
এ কথা তুলতেই তিনি বললেন, “আমি জাতির জনক। দিন বা রাতে কোনো সময়েই তো আমি আমার দরজা বন্ধ করে দিতে পারি না। ” তার পরও আমি (উবান) তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিলাম, তিনি নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জাতির প্রতি দায়বদ্ধ। আমার মনে হয়, জনপ্রিয় গণতান্ত্রিক নেতারা ঝুঁকি নিয়ে থাকেন, কিন্তু মুজিব যত দূর পর্যন্ত গিয়েছিলেন, তত দূর খুব কমসংখ্যকই গিয়েছেন। ’ সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ আর সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবি বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু একে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।
শেষ দিকে বঙ্গবন্ধুকে চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছিল ষড়যন্ত্রকারীরা এবং তিনি অনেকটা বৃত্তবন্দী হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর সরলতা, উদারতা আর মহানুভবতার সুযোগে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সংস্রবহীন কর্মকর্তারা ঢুকে গিয়েছিলেন নিরাপত্তাবলয়ে। রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত নিরাপত্তার দায়িত্ব থাকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হাতে। ১৯৭৫ সালে স্বরাষ্ট্রসচিব আবদুর রহিম একাত্তরে পূর্ব পাকিস্তান স্পেশাল ফোর্সের পরিচালক ছিলেন। ১৯৭৫ সালে পুলিশের আইজি তছলিম উদ্দিন একাত্তরে পাকিস্তান পুলিশের আইজি ছিলেন।
রাষ্ট্রপতির মিলিটারি সেক্রেটারি ব্রিগেডিয়ার মাশরুল হক ও ব্যক্তিগত নিরাপত্তা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জামিল ছিলেন পাকিস্তান প্রত্যাগত সেনা কর্মকর্তা (তবে ব্রিগেডিয়ার জামিলই বঙ্গবন্ধুকে বাঁচাতে গিয়ে নিজে জীবন দেন)। রাষ্ট্রপতির ভিজিলেন্স টিমের প্রধান ডিআইজি এ বি এস সফদার একাত্তরে পাকিস্তান গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান ছিলেন। রাষ্ট্রপতির তিনজন এডিসি ক্যাপ্টেন শরীফ আজিজ, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মোশাররফ ও লেফটেন্যান্ট গোলাম রব্বানী—সবাই পাকিস্তানফেরত। সামরিক গোয়েন্দা বিভাগ ডিজিএফআই-প্রধান ব্রিগেডিয়ার আবদুর রউফ পাকিস্তান থেকে ফিরে আসা সেনা কর্মকর্তা। স্পেশাল ব্রাঞ্চের প্রধান ই এ চৌধুরী একাত্তরে ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা এনএসআইয়ের তিনজন ডেপুটি ডিরেক্টর এম এন হুদা, মুসা মিয়া চৌধুরী এবং এ কে এম মোসলেমউদ্দিন একাত্তর সালে পাকিস্তান সরকারের চাকরি করেছেন। পাকিস্তান প্রত্যাগত কর্মকর্তারাই যে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, সে সম্পর্কে তেমন তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে কেউ কেউ এই ষড়যন্ত্র সম্পর্কে অবহিত ছিলেন, সে কথা নিশ্চিত করে বলা যায়।
এটা ঠিক, পাকিস্তান প্রত্যাগতদের ঢালাওভাবে সেনাবাহিনী বা অন্যান্য চাকরিতে আত্তীকরণ ভুল ছিল। প্রয়োজন ছিল একটি বাছাই বা স্ক্রিনিং কমিটির মাধ্যমে এই কাজটি করা।
বাংলাদেশে যেসব সেনা কর্মকর্তা বা সেপাই যুদ্ধবন্দী হিসেবে পাকিস্তানে ফিরে গিয়েছিলেন, স্বল্পসংখ্যক কর্মকর্তা ছাড়া সবাইকে সেখানে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে তাঁর অসামান্য উদারতার জন্য চরম মূল্য দিতে হয়েছে। শাসকদের কখনো কখনো কঠোর হতে হয়।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পটভূমি হিসেবে প্রায়ই খাদ্যমূল্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষ আর একদলীয় শাসন বাকশালের ধুয়ো তোলা হয়। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অর্থনীতিবিদ ড. নুরুল ইসলাম বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের উপপ্রধান ছিলেন।
বস্তুতপক্ষে তিনিই আমাদের পরিকল্পনা কমিশনের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি তাঁর গ্রন্থ মেকিং অব অ্যা নেশন: বাংলাদেশ-এ লিখেছেন, ১৯৭৪ সালে চালের উৎপাদন ১৯৭৩ সালের চেয়ে বেশি হয়েছিল। তবে সেই বছর জুলাই-আগস্ট মাসের ভয়াবহ বন্যায় দেশের তখনকার একমাত্র বৈদেশিক অর্থ উপার্জনকারী ফসল পাটের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম জ্যামিতিক হারে বাড়ার কারণে দেশে সব ধরনের আমদানি করা পণ্যের দামও এ সময় অস্বাভাবিকভাবে বাড়ে। বন্যার কারণে আমন চাষও বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
এ সময় একটি জাতীয় দৈনিক এই মর্মে নিয়মিত সংবাদ প্রকাশ করে যে দেশে ভয়াবহ খাদ্যঘাটতি আসন্ন এবং প্রচুর পরিমাণে চাল চোরাই পথে ভারতে পাচার হয়ে যাচ্ছে। এই সংবাদে মজুতদারেরা দারুণ উৎসাহী হন এবং বাজার থেকে রাতারাতি সব চাল উধাও করে দিয়ে দেশে এক চরম কৃত্রিম খাদ্যসংকট সৃষ্টি করেন।
ড. নুরুল ইসলাম লিখেছেন, এই সময় চোরাচালান নিবৃত্ত করার দায়িত্বে নিয়োজিত সেনাবাহিনীর তৎকালীন উপপ্রধান জিয়াউর রহমান তাঁর সঙ্গে একদিন তাঁর দপ্তরে সাক্ষাৎ করেন এবং জানান, মাসে ৫ থেকে ১০ লাখ টন চাল ভারতে পাচার হয়ে যাচ্ছে। ড. নুরুল ইসলাম জিয়াউর রহমানের কাছে জানতে চান, কীভাবে এত বিশাল পরিমাণের চাল চোরাচালান হওয়া সম্ভব? তখন জিয়াউর রহমান তাঁর কোনো উত্তর দিতে না পারলেও অনেকটা ক্ষুব্ধ হয়ে ফিরে যান। বঙ্গবন্ধু জিয়াকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন এবং উপসেনাপ্রধান পদটি তাঁর জন্যই তিনি সৃষ্টি করেছিলেন।
১৯৭৫ সালের মার্চ মাসে কর্নেল ফারুকুর রহমান জিয়ার সঙ্গে দেখা করে তাঁকে তাঁদের সরকার পরিবর্তনের পরিকল্পনা বিষয়ে অবহিত করেন বলে আমরা জেনেছি। জিয়া উত্তরে জানান, তিনি একজন সিনিয়র কর্মকর্তা হিসেবে এর সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন না। তবে তাঁরা তাঁদের পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হতে পারেন। কর্নেল ফারুক পরবর্তীকালে প্রখ্যাত সাংবাদিক এন্থনি ম্যাসকারেনহাসের সঙ্গে লন্ডনে এক টিভি সাক্ষাৎকারে তা স্বীকার করেছেন। সে ক্ষেত্রে জিয়ার দায়িত্ব ছিল এই তথ্য বঙ্গবন্ধু বা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জানানো।
বঙ্গবন্ধুর অন্দরমহলে জিয়ার নিয়মিত যাতায়াত ছিল। জিয়া তাঁর ওপর অর্পিত একটি পবিত্র দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন।
আর ওপরে যে জাতীয় দৈনিকের কথা উল্লেখ করেছি, সেই পত্রিকাটি উত্তরবঙ্গের জনৈক অর্ধ-উন্মাদ বাসন্তীর ছেঁড়া জাল পরা ছবি ছেপে তখন চারদিকে হইচই ফেলে দেয়। বলেছে, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা এতই খারাপ যে বাংলাদেশের নারীদের এখন কাপড়ের পরিবর্তে জাল পরে থাকতে হচ্ছে। বাংলাদেশ যে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র হতে যাচ্ছে, তা প্রমাণ করার জন্য সবার আপ্রাণ চেষ্টা।
বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর সেই ফটোগ্রাফার নিজেই স্বীকার করেন, সেটি ছিল একটি সাজানো ছবি। অথচ বঙ্গবন্ধু ওই পত্রিকার সম্পাদককেও নিজের সন্তান জ্ঞান করতেন।
তাই বলতে হয়, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড একটি সম্মিলিত ব্যর্থতার ফল। এর দায়দায়িত্ব অনেককেই নিতে হবে। তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল সফিউল্লাহও তাঁর দায়িত্ব এড়াতে পারেন না।
সেনাপ্রধান হিসেবে সেনা গোয়েন্দা সংস্থা বা তাঁর অধীনে কর্মকর্তাদের সম্পর্কে তাঁর প্রত্যক্ষ ধারণা থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। সেটি তাঁর ছিল না।
তাই আজকের এই দিনটিতে প্রত্যাশা করব, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা তাঁর পরিবারের সদস্যদের নির্মম মৃত্যু যেসব কারণে হয়েছিল, সেসব বিষয় মাথায় রেখে সামনের দিকে অগ্রসর হবেন। এখনো দেশের মানুষ প্রত্যাশা করে, বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজ তাঁকে দিয়ে সমাপ্ত করা সম্ভব।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।