১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার প্রতিবাদে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব সীমান্ত এলাকায় শুরু হয় প্রতিরোধযুদ্ধ। সারা দেশে কারফিউ আর সেনা-তৎপরতার মুখে যখন টুঁ শব্দটি করার উপায় ছিল না, তখন একদল দামাল যোদ্ধা গর্জে ওঠে অস্ত্র হাতে। অস্ত্র হাতে 'জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু' স্লোগানে কাঁপিয়ে তোলে তারা সীমান্তবর্তী জনপদ।
একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাদের পরাস্ত করে যেসব বীর মুক্তিযোদ্ধা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাদের অনেকে। মাত্র চার বছরের ব্যবধানে পঁচাত্তরেই দেশি বাহিনীর বুলেটের টার্গেটে পরিণত হন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। প্রতিরোধযুদ্ধের মূল নেতৃত্বে থাকা কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম জানান, ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৭ পর্যন্ত চলমান ওই প্রতিরোধ-সংগ্রামে শাহাদাত বরণ করেন ১০৪ জন বীরযোদ্ধা। বঙ্গবন্ধুকে ভালোবেসে তার হত্যার প্রতিবাদে চট্টগ্রামের মৌলভী সৈয়দ, গাইবান্ধার মুন্না, দুলাল দে বিপ্লব, বগুড়ার সারিয়াকান্দির আবদুল খালেক খসরু, সাখাওয়াত হোসেন মান্নান, সৈয়দ নুরুল ইসলাম, আলী আজম আলমগীর, নজিবর রহমান নিহার, রেজাউল করিম, ফনেস সাংমা, অ্যালসিন মারাক, সুধীন মারাকরা অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছেন নিজের জীবন। প্রতিরোধযুদ্ধে অংশ নেওয়া জাতীয় মুক্তিবাহিনী '৭৫ গবেষণা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান যুগল হাশমী জানান, ৮৩ জন শহীদ প্রতিরোধযোদ্ধার নাম তাদের কাছে রয়েছে। তবে বাংলাদেশ প্রতিদিনের অনুসন্ধানে সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে পঁচাত্তরের প্রতিরোধযুদ্ধে শাহাদাত বরণকারী ৯১ জন বীর যোদ্ধার নাম-ঠিকানা। প্রতিরোধযুদ্ধে গুলিবিদ্ধসহ তিন শতাধিক আহতের তালিকা রয়েছে।
প্রতিরোধযুদ্ধে আহত হন কয়েকশ বীর যোদ্ধা। গুলিবিদ্ধ শাহ মুস্তাইন বিল্লাহ, ফারুক আহমদ, মো. আবদুল্লাহ বীরপ্রতীক, গৌরাঙ্গ চন্দ্র পাল, ইসাহাক মারাক, মার্তুস সাংমা, অতুল সাংমা, জিতেন্দ্র ভৌমিক, সুকুমার চন্দ্র, শেখর হাগিদক, কমান্ডার আবদুল হক, কমান্ডার দুলাল চন্দ্র সাহা, সত্যেন চন্দ্র, প্রমোদ, অমল চন্দ্র, বাবুল হক, বিজন মৃ, বিজয় রিছিল, শেলেসটিন রুগা, সাধন পালদের খোঁজও নেয়নি কেউ। পরবর্তী সময়ে ভারতীয় বিএসএফ কর্তৃক আটক ও পুশব্যাক হয়ে আসা অনেক যোদ্ধা-কমান্ডারের খোঁজ পাওয়া যায়নি। আবার কয়েকশ যোদ্ধার ঠাঁই হয় সরকারি পুনর্বাসন কেন্দ্রের বন্দীশালায়। কেউ কেউ নিরুদ্দেশ হয়ে যান আসাম-মেঘালয়ের ভেতর। যারা আহত অবস্থায় বেঁচে আছেন, তাদের জীবন কাটছে ধুঁকে ধুঁকে। কিন্তু এসব প্রতিরোধযোদ্ধার বিষয়ে দলীয় বা সরকারিভাবে উদ্যোগ নেওয়া হয়নি কোনো। এ ছাড়া জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদস্বরূপ সশস্ত্র সংগ্রামের অপরাধে বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত অবস্থায় কারাগারে বন্দী থাকতে হয় আরও অন্তত ৮১ জনকে। ১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় প্রতিবাদী যুবকেরা দলে দলে সমবেত হন ভারতের আসাম ও মেঘালয় সীমান্তঘেঁষা গারো পাহাড় ও দুর্গম বনাঞ্চলে। তাদের প্রতিবাদ-প্রতিরোধ শুধুই প্রতীকী মেজাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। ময়মনসিংহ, শেরপুর, নেত্রকোনা জেলা সীমান্তের বিশাল এলাকাজুড়ে নিজেদের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় সমর্থ হন প্রতিরোধযোদ্ধারা। সশস্ত্র আক্রমণের মাধ্যমে সীমান্তবর্তী পাঁচটি বিডিআর ক্যাম্প ও দুটি থানা দখল করে তা নিজেরাই পরিচালনা করতে থাকেন তারা। সম্মুখযুদ্ধে তারা অবতীর্ণ হন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সঙ্গেও। প্রশিক্ষিত সেনাদলের হেলিকপ্টার, গানশিপ আর সাঁজোয়া বহরের বিপরীতে এমএমজি, মর্টার, এসএলআর নিয়ে লড়াই চালান তারা। একবার সেনাবাহিনী হটেছে তো অন্যবার পিছিয়ে গেছেন প্রতিরোধযোদ্ধারা। যুদ্ধকালে শুধু দুর্গাপুর-কলমাকান্দা সীমান্তবর্তী জনপদে অন্তত নয়জন প্রতিরোধযোদ্ধা এবং পাঁচজন বিডিআর-পুলিশ নিহত হন। গুলিবিদ্ধ হন উভয় পক্ষের শতাধিক ব্যক্তি। ক্রসফায়ারে মারা যান তিন সাধারণ গ্রামবাসী। পাবনার নিশ্চিন্তপুরে যমুনার দুর্গম চরাঞ্চলে প্রতিরোধযোদ্ধাদের সঙ্গে সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার-যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ১৯৭৫ সালের ১২ অক্টোবর প্রতিরোধযোদ্ধারা ওই চরে অবস্থান করছে মর্মে খবর পেয়ে সেনাবাহিনীর কয়েকটি দল হেলিকপ্টার ও জলপথ ঘিরে ব্যাপক গোলাগুলি শুরু করে। প্রতিরোধযোদ্ধাদের পাল্টা প্রতিরোধে বেশ কিছু সেনাসদস্য নিহত হলে হেলিকপ্টার-দল পিছু হটে। এ সময় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়ে জলপথে যাওয়া সেনাদলটিও দ্রুত পিছু হটে টাঙ্গাইলের দিকে। দুই দিনের এ ভয়াবহ তাণ্ডবে শহীদ হন প্রতিরোধযুদ্ধের অন্যতম এক কমান্ডার বগুড়ার আবদুল খালেক খসরুসহ অন্তত চারজন। এ সময় মৃতদেহ দাফন করা সম্ভব হয়নি বলে খসরুসহ শহীদ যোদ্ধাদের মৃতদেহ ভাসিয়ে দেওয়া হয় যমুনার স্রোতে। এভাবে প্রায় ২২ মাস যুদ্ধ চালিয়ে প্রতিরোধযোদ্ধারা টিকে থাকেন বীরত্বের সঙ্গে। একদিকে আন্তর্জাতিক সাহায্য ও সমর্থনের অভাব, অন্যদিকে জাতীয় পর্যায়ের নেতাদের সম্পৃক্ততাহীনতার মুখে প্রতিরোধযুদ্ধ থেমে যায় অসমাপ্ত অবস্থায়। অনুসন্ধানে দেখা যায়, প্রতিরোধযুদ্ধ ১৯৭৫ সালের নভেম্বরে শুরু হয়ে স্থায়ী হয় ১৯৭৭ সালের জুলাই পর্যন্ত। তবে প্রতিরোধযুদ্ধের সেক্টর হেডকোয়ার্টার ও সাব-সেক্টরগুলোয় অবস্থান নেওয়া যোদ্ধাদের শেষ দলটি অস্ত্র ত্যাগ করেন ১৯৭৮ সালের এপ্রিল মাসে।
শহীদ হন যারা : বাংলাদেশ প্রতিদিনের অনুসন্ধানে জানা যায়, এই সশস্ত্র আন্দোলনে জীবন দেন শতাধিক যোদ্ধা। এদের ৯১ জনের নাম পাওয়া গেছে। এরা হচ্ছেন বগুড়ার আবদুুল খালেক খসরু ও নজিবুর রহমান নিহার, গাইবান্ধার ইবনে সাউদ, রেজাউল করিম, মিজানুল হক মুকুল, মোহাম্মদ আলী, আবদুর রাজ্জাক, আলী আযম আলমগীর, মো. বাবুল, মো. সোলায়মান ও আবদুর রহিম আজাদ, কুড়িগ্রামের রেজাউল করিম-২, নূরুল ইসলাম ও নূরুল আমিন, নেত্রকোনার আবদুল খালেক, রাধারমণ রায় ঝন্টু, বামুন সরকার, রজব আলী, আবুল কাশেম, হামিদুল ইসলাম, ফজর আলী, শান্তি বিকাশ সাহা পল্টু, আবদুল হেকিম, মুসলিম উদ্দিন তালুকদার ও সুব্রত, টাঙ্গাইলের সাখাওয়াত হোসেন মান্নান ও সৈয়দ নূরুল ইসলাম, চট্টগ্রামের মৌলভী সৈয়দ আহমেদ, কুমিল্লার সুশীল ভৌমিক বেলু, সুনামগঞ্জের নিরানন্দ দাশ, মতিলাল দাশ, আখলমন মাঝি, বলরাম সরকার, শেরপুরের বিপ্লব কুমার দে দুলাল, দুলাল মিয়া, মনোরঞ্জন সরকার, হাবিবুর রহমান, বীরেন্দ্র চন্দ্র পাল, কছর আলী, আলী হোসেন, শওকত আলী, মোতালেব, ধীরেন্দ্র চন্দ্র শীল, রুস্তম আলী ও মোজাম্মেল হক, জামালপুরের নজরুল ইসলাম ও আলতাফুর রহমান, ময়মনসিংহের আবদুল হামিদ, আবদুল আজিজ, সুশীল চন্দ্র দত্ত, রঞ্জিত কুমার এস, মজিবুর রহমান খান, সুবোধ চন্দ্র ধর, আলকাস উদ্দিন সরকার, দ্বীপাল চন্দ্র দাশ, জোবেদ আলী ও সিরাজুল ইসলাম। শহীদদের ২৫ জন আদিবাসী। এরা হচ্ছেন শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার রঞ্জিত সাংমা, অনন্ত বর্মণ, জয়েশ্বর বর্মণ, সপ্রু সাংমা, কাশেম সাংমা, নিরঞ্জন সাংমা, পিটারসন সাংমা, প্রাণবল্লভ বর্মণ, প্রটিন দিও, শ্রীদাম রিছিল ও চিত্তরঞ্জন ডালু, শ্রীবর্দী উপজেলার সম্রাট সাংমা, ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলার ফনেস সাংমা, তপন চাম্বুগং, অ্যালিসন মারাক, গোবিনিক মারাক, সুদর্শন মানকিন, হারু সাংমা, হযরত সাংমা, জবিনাশ তেলসী, অগাস্টিন চিছিম, সুধীন কুবি ও ডমিনিক চাম্বুগং, নেত্রকোনার কলমাকান্দা উপজেলার হেনরি সাংমা এবং ধোবাউড়া উপজেলার পংকজ আজিম।
যা বললেন বঙ্গবীর : পঁচাত্তরের প্রতিরোধযুদ্ধ প্রসঙ্গে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম বলেছেন, 'বঙ্গবন্ধু হত্যার বিরুদ্ধে সর্বাত্দক প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করলেও আওয়ামী লীগ নেতাদের পূর্ণাঙ্গ সমর্থনের অভাবে আমরা সফল হতে পারিনি। তবু চলতে থাকে সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রাম। কিন্তু ভারতে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে ইন্দিরা গান্ধীকে সরিয়ে ক্ষমতায় আসেন মোরারজি দেশাই। জিয়াউর রহমান তার সঙ্গে গভীর সম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং ভারতের সঙ্গে চুক্তি করে প্রতিরোধ-সংগ্রামীদের প্রতি দেশটির সমর্থন বন্ধের ব্যবস্থা করেন। শুধু তা-ই নয়, ওই সময় মোরারজি দেশাই সরকার অসংখ্য প্রতিরোধ-সংগ্রামীকে ধরে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেয়। শুধু আমার প্রতি বিদ্বেষপ্রসূত পঁচাত্তরে কয়েক হাজার প্রতিরোধসংগ্রামীকে করা হয় বঞ্চিত। বোধহয় আমার কারণে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিরোধ-সংগ্রামে যারা জীবন দিয়েছেন, তাদের জন্য সংসদে শোক প্রস্তাব পর্যন্ত নেওয়া যায়নি।'
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।