আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ফাস্টফুড কালচার -১

Real knowledge is the knowledge about "The Real", or at least, that which leads to "The Real" - rest is just conjecture!

[লেখাটি পুরানো, আগে প্রিন্ট মিডিয়াতে প্রকাশিত হয়েছে] “এক ছিল টোনা আর এক ছিল টুনি। টোনা কহিল টুনি পিঠা তৈরী কর.....” আজ আমরা যারা মধ্যবয়স্ক বা প্রৌঢ়, তারা প্রায় সবাই হয়তো এই গল্পটা জানি। আজ যারা তরুণ বা নবীন, তাদের অনেকেই হয়তো এই গল্পটা জানবেন না - কারণ, তাদের বাবা-মায়েরা হয়তো বা তাদের “সিনড্রেলা” বা “স্নো হোয়াইট এন্ড সেভেন ডোয়ার্ফস্” সমেত পাঠক্রমে শিক্ষিত করেছেন। বিশ্বের একমাত্র পরাশক্তি ও নব্য-ফেরাউন-রাজ্য - মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জীবনধারাকে, কুর’আনিক জীবনধারার চেয়ে পবিত্রতর জ্ঞান করে, চলনে-বলনে বা আচারে-আচরণে তাদের মত হয়ে যাবার একান্ত বাসনা চরিতার্থ করার প্রতিযোগিতায় আমরা যেভাবে দ্রুত আত্মনিয়োগ করে চলেছি, তাতে অচিরেই ঐ গল্প বা ঐ ধরনের আরো যে সব গল্প, বিদ্যাশিক্ষার কর্মকান্ডে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল - সেগুলোর যে বিলুপ্তি ঘটবে, অথবা, সেগুলো যে পুনর্লিখিত হবে, তা এক প্রকার নিশ্চিত। আমি কোন এক অলস প্রহরে একদিন ভাবছিলাম, উপর্যুক্ত গল্পটির তখন কি চেহারা দাঁড়াবে।

আমার মনে হলো বুঝি এমন কিছু একটা দাঁড়াতে পারে: এক ছিল টোনা। পড়ন্ত বয়সে উপনীত হইলেও, এখনো তাহার ঘর বাঁধা হইয়া উঠে নাই। বহু টুনির শয্যাসঙ্গী হইলেও, কাহাকেও সে নিজের সঙ্গে একত্রে ঘর বাঁধার ব্যাপারে রাজি করাইতে পারে নাই। এমন নয় যে তাহার কোন অক্ষমতা বা অপর্যাপ্ততা রহিয়াছে। কিন্তু কেবল একজন সঙ্গীর সাথে জুটি বাঁধা বা ঘর বাঁধার ব্যাপারটা সেকেলে হইয়া যাওয়ায়, টুনিকুলের কেহ এখন আর ঘর বাঁধিয়া নিজেকে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধিয়া ফেলিতে চাহে না।

যৌন বাসনা চরিতার্থ করিবার জন্য বা সন্তান উৎপাদনের জন্য, ঘর বাঁধাটা বাহুল্য হইয়া যাওয়ায়, টুনিগণ এখন আর কিছুতেই বিবাহের বন্ধনের বাড়তি ঝামেলায় নিজেদের আবদ্ধ করিতে চায় না। আমাদের গল্পের টোনা শুনিয়াছে যে, তাহার দাদিমা নাকি রোজ তাহার দাদার জন্য খাবার রান্না করিতেন এবং দাদা কর্মস্থল হইতে ফিরিবার সময় হইলে, তাহার পথ চাহিয়া বসিয়া থাকিতেন। শীতের মৌসুমে দাদা বাজার হইতে গুড় ও চাউলের গুঁড়ি আনিয়া দিলে, দাদিমা নিজের হাতে তাহাকে পিঠা বানাইয়া খাওয়াইয়াছেন। আমাদের টোনার মা চাকুরিজীবী ছিলেন। মৌলিক প্রয়োজনে নয়, বরং নিজেদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য ও বিবিধ চিত্তাকর্ষক ‘জিনিস’ ক্রয় করিবার সামর্থ লাভ করার অভিলাষে তিনি প্রথম চাকুরী গ্রহণ করেন।

আমাদের এই গল্পের টোনা বেশ মনে করিতে পারে যে, সে বড় হইবার পূর্বেই কিভাবে তাহাদের গৃহে রান্নাবান্নার পাট একপ্রকার চুকিয়াই গিয়াছিল। রাত্রির খাবার ছাড়া, বাকী সব বেলার খাবারই, পরিবারের সবাই যে যার মত বাহিরে সমাধা করিয়া লইত। দিনের শেষে কর্মস্থল হইতে বাবা ও মা উভয়েই পরিশ্রান্ত হইয়া ফিরিয়া আসিলে, রাত্রির খাবার কে রান্না করিবেন এবং কি রান্না করা হইবে, ইহা লইয়া প্রায়ই বচসা বাঁধিয়া যাইতো এবং গৃহের শান্তি বিনষ্ট ও বিঘ্নিত হইবার উপক্রম হইতো। শীতের মৌসুমে, কোন সন্ধ্যায়, কদাচিৎ বাবার কখনো পিঠা খাওয়ার সাধ জাগিলে, “টুনি, তাড়াতাড়ি সাজগোজ সারিয়া লও, আর সঙ্গে কিছু বাড়তি টাকা লইও - সকলে মিলিয়া আজ ‘পিঠা হাটে’ পিঠা খাইবো। ” - এই বলিয়া তিনি সকলকে লইয়া বাহিরে যাইবার আয়োজন করিতেন।

চাউলের গুঁড়ি দেখিতে কি প্রকার তাহা আমাদের আজকের টোনা জানেনা। তবু, অতীত স্মৃতি রোমন্থনে, আজকের শীতকালের এই সন্ধ্যায় পিঠা খাইবার জন্য তাহার প্রাণ ব্যাকুল হইয়া উঠিল। সে মনে করিতে চেষ্টা করিল যে, যুক্তরাষ্ট্রের কেন্টাকি অঙ্গরাজ্যের লুইভিল হইতে আগত মিঃ পিটার আহমেদ প্যান, ‘প্যান-পিঠা’ নামক যে অত্যাধুনিক পিঠার দোকানখানি অতি সম্প্রতি খুলিয়া বসিয়াছেন, তাহা রাত্রিবেলা কতক্ষণ খোলা থাকে! এইসব ভাবিতে ভাবিতে অন্যমনস্কভাবে সে তাহার ক্রেডিট-কার্ডখানার জন্য হাত বাড়াইল। পিঠা খাইবার উদ্দেশ্যে গৃহ হইতে বাহির হইতে গিয়া, তাহার গৃহিণী নাই বিধায়, তাহার যাত্রাসঙ্গী হইবার মত যে কেহ নাই - এই বাস্তবতা মনে হইতে তাহার মনখানি বিষন্নতায় ছাইয়া গেল। মাননীয় পাঠক! প্রথম দৃষ্টিতে উপরের গল্পকে কল্পনাবিলাস মনে হলেও, ওরকম একটা সামাজিক অবস্থানে পৌঁছাটা আমাদের জন্য এখন কেবল সময়ের ব্যাপার।

সামাজিক দুষ্কর্মের ব্যাপারে, অনেক দিক দিয়ে আমরা ইতোমধ্যেই বিশ্ব-নিয়ন্তা কু্ফফার শ্রেষ্ঠ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে প্রতিযোগিতায় নামার যোগ্যতায় উন্নীত হয়েছি। উদাহরণ স্বরূপ, পাঠক হয়তো জেনে থাকবেন যে, বাংলাদেশের হয়ে জাতিসংঘে কর্মরত জনৈকা কূটনীতিকের ব্যবসায়ী স্বামী সবান্ধব, নিউ ইয়র্কের একটি নাইটক্লাবে ল্যাপ ড্যান্সার বার-বণিতাদের নিয়ে ফূর্তি করে ও মদ্যপান করে একরাতে প্রায় ১ লক্ষ ৩০ হাজার ডলার (বা প্রায় ৭৬ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা) ব্যয় করে সেখানকার খবরের কাগজের খবর হবার বিরল সম্মান লাভ করেছেন। যে দেশের মানুষের মাথাপিছু বাৎসরিক আয় ৪৪৪ ডলার, সে দেশের একজন নাগরিক হয়ে এমন একটা দুর্লভ সম্মানের অধিকারী হতে পারাটা নিঃসন্দেহে চাঞ্চল্যকর একটা ব্যাপার । এছাড়া হালে, এক বঙ্গ-ললনার নগ্ন দেহ-সৌন্দর্যের ছবি, সেখানকার এক পর্ণোগ্রাফিক ম্যাগাজিনে ছাপা হওয়াতে কুফফারের কাছে আমাদের দেশের গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চয়ই আরো সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে!** তাহলেই ভেবে দেখুন অচিরেই টোনা-টুনির গল্পের সমকালীন রূপ কি দাঁড়াতে পারে। যাহোক্, আমি টোনা-টুনির গল্প দিয়ে লেখাটা শুরু করেছিলাম একারণে যে, টোনা-টুনির আদি গল্পটাতে সংসার পাতার এবং সংসারের দৈনন্দিন কর্মকান্ডের একটা কথাচিত্র ছিল।

আমরা যে দিকে ধেয়ে চলেছি তাতে, ঐ কথাচিত্রে বর্ণিত সংসার ধর্ম এবং সংসার কর্ম, দুটোই হয়তো অচিরেই একদিন ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবে। একটা বিল্ডিং বা স্থাপনাকে যেমন বহুবিধ উপায়ে ভাঙ্গা যায় এবং সেই ভাঙ্গনের সূচনা যেমন দৃশ্যমান ভাবে বাইরের দিক থেকে করা যায় অথবা লোক চক্ষুর অন্তরালে যেমন সন্তর্পণে ভিতরের দিক থেকেও করা যেতে পারে - তেমনি একটা জীবন ব্যবস্থাকে বহুদিক থেকে ধ্বংস করে দেয়া যায় - কখনো বল প্রয়োগ করে বাইরে থেকে, যেমন উত্তর আমেরিকার রেড-ইন্ডিয়ানদের জীবনব্যবস্থা এবং জীবনের ধরনকে বল প্রয়োগের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছিল ‘সাদা-চামড়া’ ইউরোপীয়রা। আবার ধরুন চটকদার জীবনযাত্রার প্রলোভনের ফাঁদে পা দিয়ে কোন সভ্যতা (ভিতর থেকে নিজেই) ক্ষয় হতে হতে একদিন dominant culture-এ বিলীন হয়ে যেতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ ফিলিপিন্সের সংস্কৃতির কথা বলা যায়, যা কিনা আমেরিকান dominant culture-এ বিলীন হয়ে গেছে (দক্ষিণ ফিলিপিন্সের কিছু সেকেলে মুসলিম জনগোষ্ঠী এর ব্যতিক্রম, যে জন্য আজ তাদের চরম মূল্য দিতে হচ্ছে)। Footnote**:উভয় খবরের জন্য দেখুন - যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক থেকে প্রকাশিত “সাপ্তাহিক বাঙালী” পত্রিকার ১৩ই জুন ২০০৪ সংখ্যা (চলবে .........ইনশা'আল্লাহ্!)


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.