আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ফাস্টফুড কালচার - ৩

Real knowledge is the knowledge about "The Real", or at least, that which leads to "The Real" - rest is just conjecture!

এর আগের পর্বটায় আমরা কথা বলছিলাম “ফাস্টফুড কালচারের” সমস্য নিয়ে। সাধারণ যুক্তিতে মনে হতে পারে যে, আমার উপার্জন যদি হালাল হয় - আর যে মাংস দিয়ে বার্গার বা সসেজ বানানো হচ্ছে, তা যদি হালাল হয়ে থাকে - তাহলে সমস্যাটা কোথায়? আমরা প্রথম সমস্যাটা নিয় গত সংখ্যায় আলোচনা করেছি! আসুন আমরা একে একে বাকী সমস্যাগুলো সমস্যাগুলো ভেবে দেখি: ২)এরপর আসছে “ফাস্টফুড কালচারের” অর্থনৈতিক দিকটা। প্রাথমিক ভাবে একটা দরিদ্র দেশে যখন আট-ঘাট বেঁধে ‘ফাস্টফুড কালচার’ চালু হয় - তখনকার সময়টায় বানিয়ারা আঁচ করতে পারে যে, ঐ দেশে “গরীবের ঘোড়ারোগের” অবকাশ রয়েছে। যে করেই হোক, মানুষের হাতে - নাগরিক মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষের হাতে কিছু বাড়তি পয়সা এসেছে বা আসছে (আমাদের দেশে যেমনটা গার্মেন্টস শিল্পের কল্যাণে এসেছিল)। ফাস্টফুডকে তখন ‘জাতে ওঠার’ প্রতীক হিসেবে প্রতিফলিত করা হয়।

‘ফাস্টফুড’ যে আসলে ‘জাঙ্ক-ফুড’ - খাদ্যের গুণ ও মান বা পুষ্টির নিরিখে উন্নত বিশ্বে বা চিকিৎসকদের খাতায় তা যে অত্যন্ত নিম্নমানের খাবার বলে বিবেচিত - এসব কারো ভাববার অবকাশই থাকে না। উড়ু– উড়ু– একটা “কি হনু রে!!” ভাবের বশবর্তী হয়ে, সঠিক মূল্যের ৩ গুণ দিয়েও কিছু একটা খাওয়াকে, অনেকেই অত্যন্ত বাহাদুরীর একটা কাজ মনে করে। স্পষ্ট মনে করতে পারি, ঢাকায় যখন কতিপয় দোকানে, প্রথম, কোমল পানীয়ের ঝর্ণার প্রচলন হলো - তখন শুধু আধুনিকতার অনুভূতি লাভ করতে, উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েরা যে দামে এক গ্লাস কোমল পানীয় পান করেছে - ১ লিটারের বোতল কিনলে, সেই দামে হয়তো তা থেকে ৩ গ্লাস কোমল পানীয়ের ভাগ পাওয়া যেত। একই ভাবে বাড়ীতে ডাল-ভাত রান্না করলে খাবারের জন্য মাথা পিছু ব্যয় যা হতো, ‘ফাস্টফুড’ দিয়ে দিনের যে কোন meal সমাধা করলে, স্বাভাবিক ভাবেই খরচটা অনেক বেশী হবে। এখানে ভাববার বিষয় হচ্ছে এই যে, প্রাথমিক ভাবে দুনিয়ার সব বিচারেই যে কোমল পানীয়কে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এক বাহুল্য বলে চিহ্নিত করা হবে, সেই কোমল পানীয় তিনগুণ দাম দিয়ে কিনে খাবার জন্য যে বাড়তি অর্থের প্রয়োজন, সেই বাড়তি অর্থ আসবে কোথা থেকে? অথবা পরিবারের সদস্যদের যে কোন একটা meal বাইরে খাবার জন্য ঐ পরিবারের অর্থায়নের উপর যে বাড়তি চাপ আসবে - সেই বাড়তি অর্থ আসবে কোথা থেকে? আপনি যদি সত্যিই বিশ্লেষণ করতে পারতেন, তাহলে হয়তো দেখতেন যে, এই বাড়তি টাকার যোগান দিতে গিয়েই - যার ঘুষ না খেয়ে জীবন চলছিল, তার হয়তো ঘুষ খেতে হবে - বা, যে গৃহিনীর চাকুরী না করে চলছিল, তার হয়তো চাকুরী করাটা প্রয়োজন হয়ে দাঁড়াবে - অথবা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ ক্লাসের যে মেয়ের অধ্যয়ন, কোন অভাববোধ ছাড়া অত্যন্ত নিরবচ্ছিন ভাবে চলছিল; হঠাৎই বন্ধুদের সাথে বেইলী রোডে নতুন খোলা সুইস স্ন্যাক্সের দোকানে আড্ডা মারতে যেতে না পারার গ্লানি ও হীনমন্যতা কাটিয়ে উঠতে না পেরে, বাড়তি কিছু আয়ের জন্য সে হয়তো তার ব্যবসায়ী কাজিনের কোরীয় কায়েন্টদের “সঙ্গ” দিতে রাজি হয়ে গেল।

এই গল্পের অন্য পিঠের কাহিনী একাধারে করুণ ও হাস্যকর। যারা এসব ‘ফাস্টফুড’ জয়েন্ট বা আউটলেটগুলো খোলে, তারা তাদের ধূর্ততা ও ক্রূর বুদ্ধিবলে জানে যে, তাদের যে target group - অর্থাৎ কোন জনসংখ্যার নির্বোধ ও চিন্তাশক্তি লোপ পাওয়া সেই অংশ; যারা কিনা তাদের মানসে লালিত "উন্নত জীবনের ইমেজধারী প্রভুদের" মত হবার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টায় ব্যস্ত সেই target group-কে ঠিক কি ভাষায় সুড়সুড়ি দিলে, তারা কোন নির্দিষ্ট ‘ফাস্টফুড’-এর প্রতি আসক্ত হবে বা কোন নির্দিষ্ট ‘ফাস্টফুড জয়েন্টে’ খাবার জন্য মরিয়া হয়ে উঠবে এবং সে সব জায়গায় খেয়ে এবং পরবর্তীতে অন্যের কাছে সেই ‘খাওয়ার’ গল্প করে “কি হনু রে!” ভেবে পুলকিত বোধ করবে। ঘটনাটা আমি স্পষ্ট মনে করতে পারি, যদিও অনেক ক'টা বছর আগের কথা - এলিফেন্ট রোডের তথাকথিত একটা অভিজাত/আধুনিক রেঁস্তোরাকে কেমন জোড়াতালি একটা ‘ফাস্টফুড’-এর দোকানের রূপ দেয়া হয়েছিল। মেরিন একাডেমী থেকে ছুটিতে এলে, বুয়েটে পড়া আমার এক বন্ধু আমাকে ঐ দোকানে নিয়ে গিয়েছিল আপ্যায়ন করতে। একটি বার্গারের মূল্য (তখনকার বাজারে) ৫০টাকা শুনে আমি যখন সম্বিত ফিরে পাবার চেষ্টা করছি, তখন ঐ বন্ধু “ফ্রেশ লাইম” নামক পানীয় অর্ডার করলো - পরিবেশন করা হলে আমার কাছে তা অতি সাধারণ (বরফশীতল) লেবুর সরবত বলে মনে হলো - যার দাম ছিল (তখনকার বাজারে) ২০টাকা।

আমি ভাবছিলাম নিতান্ত মধ্যবিত্ত পটভূমির আমার ঐ বন্ধুর মা, চাইলেই তখনকার সময়ে বেশী হলে বড়জোর ১ টাকা খরচ করে, তাকে এক গ্লাস লেবুর সরবত করে দিতে পারতেন। তাহলে দেখুন কিভাবে মধ্যবিত্ত কোন তরুণকে “কি হনু রে!” বোধ দিয়ে, কোন দ্রব্যের ২০ গুণ দাম হাতিয়ে নেয়া যায়!! ঐ ‘ফাস্টফুড’-এর দোকানের একমাত্র যে বিশেষত্ব আমার মনে আছে তা হলো পরিবেশটা খুব অন্ধকার ছিল - টেবিলে টেবিলে মোম জ্বালিয়ে দেয়া হতো। তাতে আমি যা বুঝি, অপরিচ্ছন্ন আসবাবপত্র সহ খাবার পরিবেশনের নানাবিধ দোষও ঢাকা পড়তো - কিন্তু সেজন্য ক্রেতার বাড়তি পয়সা গোনার তো কোন কারণ দেখি না। এটা বলতে গেলে “ফাস্টফুড কালচারের” সূচনার দিকের কথা। এখন তো অবস্থা আরো করুণ !! যে কোন নাজাসাতের উপরও ‘মিকি মাউস’ বা ‘স্পাইডারম্যান’-এর একটা প্রতিকৃতি সম্বলিত মোড়ক লাগিয়ে বাজারে ছাড়লে তা হয়তো মুহূর্তেই বিক্রী হয়ে যাবে।

যারা এসব “ফাস্টফুড” বাজারজাত করে, তারা জানে যে, এসব খাবারের অধিকাংশই কি সাংঘাতিক রকম অপূর্ণ খাবার এবং খাদ্যপ্রাণ বিবর্জিত - আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন যে, তাদের ছেলেমেয়েদের তারা কখনো এসব ‘জাঙ্ক-ফুড’ খেতে দেয় না, বরং নিজ সন্তানদের তারা শাক-শব্জী সমেত whole meal খেতে বলবে - শুধু তাই নয়, সম্ভবত কেবল organic (সার ছাড়া ফলানো) শাক-শব্জীই খেতে বলবে। অনেকটা - (আমার আর একটা লেখায় আমি এর আগে যেমন বলেছিলাম) কলম্বিয়ার অনেক ড্রাগ লর্ডের ছেলেমেয়েরা যেমন ড্রাগ নেয়া তো দূরে থাক, ধূমপান পর্যন্ত করে না বরং দেখা যাবে হয়তো তারা হার্ভার্ড বা এম,আই,টি থেকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত - তেমন ব্যাপার। ৩) ইংরেজীতে একটা কথা আছে, "you are what you eat" - একথার উপর ভিত্তি করেই দেখবেন মানুষের চরিত্র বিশ্লেষণের পেশায় যারা নিয়োজিত, তারা আপনাকে জিজ্ঞেস করবেন, আপনি কোন ধরনের মাংস খেতে পছন্দ করেন - চিকেন, ল্যাম্ব না বীফ। সাধারণভাবে দেখা যায় যে, আপনি যদি চিকেন পছন্দ করেন, তা হলে বেশী শারীরিক পরিশ্রমের কাজগুলোতে আপনার স্বভাবগত অনীহা থাকবে। আবার আপনি যদি বীফ বা গরুর মাংস বেশী পছন্দ করেন, তাহলে এটা সম্ভাব্য যে, আপনি শরীরী কাজগুলোতে অন্যদের তুলনায় স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন।

এই প্রসঙ্গে এতগুলো কথা এজন্য বল্লাম যে, আপনি যা খাবেন তার যে একটা সরাসরি ছাপ পড়বে আপনার চরিত্রের উপর - সে কথাটা বুঝাতে। “ফাস্টফুড” খেতে গিয়ে আপনি যদিওবা একটা প্রাথমিক বাছাই করতে পারেন - চিকেন, মাটন না বীফের তৈরী খাদ্য খাবেন - কিন্তু সত্যিকার অর্থে আপনি ঐ খাদ্যের উৎপত্তি, মান বা উপাদানসমূহ সম্বন্ধে একদমই নিশ্চিত হতে পারবেন না। পাঠক হয়তো জেনে থাকবেন যে বেকিং-এ (জিলাটিন, মনো গ্লিসারাইড, ডাই গ্লিসারাইড, এনিমেল শর্টেনিং), রান্নার সামগ্রীতে(তেলে, মার্জারিনে বা চর্বিতে মিশ্রিত অবস্থায়), এপিটাইজার/সস ইত্যাদিতে (জিলাটিন, ওয়াইন ভিনেগার), ফ্রোজেন পিজার পনিরে (রেনেট, জিলাটিন, মনো গ্লিসারাইড, ডাই গ্লিসারাইড, এনিমেল শর্টেনিং), আইসক্রীমে (জিলাটিন, মনো ও ডাই গ্লিসারাইড, স্টেরেট) ও চকোলেটে (মনো ও ডাই গ্লিসারাইড, জিলাটিন, চর্বি) এমন অনেক উপাদান রয়েছে যেগুলোর উৎস শূকর হবার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। সন্দেহজনক উপাদানগুলির সব ক’টির উৎস যে কেবলই শূকর, এমন কোন কথা নেই - যেমন গ্লিসারাইড উদ্ভিজও হতে পারে, আবার সিনথেটিকও হতে পারে - কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, সাধারণত শূকর উৎসের উপাদানগুলো আবার তুলনামূলকভাবে সস্তাও। সুতরাং ‘ফাস্টফুড’ মুখে তোলার আগে, আপনার জানার অনেক কিছু রয়েছে, কিন্তু আপনি কি মনে করেন যে, আপনার পক্ষে সেসব জানা সম্ভব? যে দেশের মানুষ, ঐতিহ্যগতভাবে ঈদের সাথে সম্পৃক্ত সিমাই বা লাচ্ছা সিমাই, শূকরের চর্বি দ্বারা ভাজা জেনেও অকুন্ঠভাবে বাজারজাত করতে পারে, সে দেশের মানুষ ১০ গুণ মুনাফা অর্জনকারী কোন দ্রব্যের উপাদানের কোন ত্রুটি সম্বন্ধে সাধারণভাবে (বিশেষ ব্যতিক্রমের কথা বলছি না আমরা) আপনাকে অবহিত করবে বলে আপনার মনে হয়? তাহলে দেখুন হারাম তো বটেই - "you are what you eat" নিয়ম মতে আপনার চরিত্রে শূকরসুলভ বৈশিষ্ট্য যোগ হবার যথেষ্ট আশংকা রয়েছে! এ তো গেল একটা দিক।

এবার আরেকটা দিকে আসি। ‘ফাস্টফুডে’ যে সব মাংস ব্যবহার করা হয়, সেগুলো সাধারণত ফার্ম থেকে আসে - আর বিশ্বজুড়ে ব্যবসায়িক কারণে profit maximization করতে গিয়ে গরু-ছাগল বা মুরগীর ফার্মে এসব প্রাণীকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে মোটা করার কাজে Growth Hormone ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এই Growth Hormone মূলত প্রাণীজ স্ত্রী-হরমোন। বেশী হারে খাদ্যের সাথে এই হরমোন গ্রহণের ফলে, মানুষের শরীরে বেশ কিছু পরিবর্তন ঘটে। আমার সহকর্মী সিঙ্গাপুরী এক ক্যাপ্টেনের বোনের ছেলে, আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন একটি “ভাজা-মুরগী” চেইনের খাবারের প্রতি ছেলেবেলা থেকে অত্যন্ত আসক্ত ছিল।

বয়ঃসন্ধির আশেপাশে কোন এক সময় তার বক্ষদেশ স্ফীত হতে শুরু করলে তাকে সেজন্য ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হয়। ডাক্তারের মতে ঐ “ভাজা-মুরগী” চেইনের মুরগী-বাহিত Growth Hormone তার বক্ষের স্ফীতির জন্য দায়ী। পাঠক হয়তো জেনে থাকবেন যে, আজকাল পশ্চিমা দেশের মেয়েদের, শিশু মস্তিষ্কসম্পন্ন ৯/১০ বছরের শরীরে যুবতীর যৌবন, রীতিমত একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে - এই সমস্যা বা সে সব দেশে বর্ধিত হারে সমকামী প্রবণতার জন্য মাংস ও দুগ্ধজাতদ্রব্য বাহিত Growth Hormone-কে একটা কারণ হিসেবে চিহ্নিত করে থাকেন চিকিৎসকরা। অন্য যে কোন শিল্প-সামগ্রীর মতই ‘খাদ্যদ্রব্য’ এখন হচ্ছে একটা শিল্প-সামগ্রী। অন্য শিল্প-সামগ্রীর মতই খাদ্যদ্রব্যও তাই যত কম খরচে, যত বেশী উৎপাদন করা যায় এবং যত বেশী লাভে তা বিক্রী করা যায়, সে ব্যাপারে খাদ্যশিল্পের বিশাল বহুজাতিক কোম্পানীগুলো সদা তৎপর ও সজাগ দৃষ্টিসম্পন্ন।

বলা বাহুল্য যে, এসব দ্রব্যাদি উৎপাদন-স্থলে প্রচুর পরিমাণে উৎপাদিত হয়ে থাকে এবং আজকের ‘বিশ্বায়নের’ এই যুগে এটা ধরেই নেয়া হয় যে, এসব দ্রব্যাদি সেখানেই যাবে যেখানে এসবের বাজার রয়েছে। আজ তাই ব্রাজিলের একটা ডেইরি বা পোল্ট্রি ফার্মে ‘উৎপাদিত’ মাংস বা ‘মাংসজাত’ খাদ্যদ্রব্য যেমন ‘সসেজ’, ‘নাগেট’ বা বার্গারের ‘প্যাটি’ - হয়তো দেখা যাবে সৌদী আরবে বাজারজাত হচ্ছে; ঠিক যেমন ভারতের বা বার্মার মৎস্য খামারে উৎপাদিত রুই বা পাঙ্গাস মাছ আজ বাংলাদেশে বাজারজাত হচ্ছে। উৎপাদন-প্রান্তে profit maximize করার প্রচেষ্টার কাছে, বিক্রয়-প্রান্তের ক্রেতাদের ইচ্ছা/অনিচ্ছার ব্যাপারটা অত্যন্ত গৌণ হয়ে দাঁড়ায় - যা বড়জোর কাগজে কলমে আনুষ্ঠানিকতার গুরুত্ব পেতে পারে। গতবছর ইন্টারনেটের মাধ্যমে প্রাপ্ত একটা খবরে বলা হয়েছিল যে, ২০০০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে যে সব হালাল গো-মাংস বাজারজাত করা হয়েছিল, তার ৭৫% এসেছিল pork fed cows অর্থাৎ, খাদ্য হিসেবে যাদের শূকরের মাংস দিয়ে প্রতিপালন করা হয়েছিল, সেসব গরুর উৎস থেকে । আমাদের দেশে বাইরে থেকে যে সব দানবাকৃতি রুই, পাঙ্গাস বা মাগুর আসে, সেগুলোকে কিভাবে প্রতিপালন করা হয়, তা আমি নতুন করে বলে স্পর্শকাতর ও সংবেদনশীল পাঠকদের বিবমিষার উদ্রেক করতে চাই না।

এছাড়া দেশে বা বিদেশে ‘ফাস্টফুডে’ ব্যবহৃত মাংসের যোগানদাতা পশুগুলির জবাই করার প্রক্রিয়া যদি শুদ্ধ বলে ধরেও নিই, তবুও কিমা, প্যাটি, সসেজ ইত্যাদি যখন বানানো হয় তখন একটা পশুর কি নেয়া হয় আর কি বাদ দেয়া হয় - সেটা রীতিমত গবেষণা ও investigative journalism-এর বিষয়। আমাদের দেশে, এই ঢাকা শহরেই জ্যান্ত মুরগীর বাজারে বিক্রীর অপেক্ষায় থাকাকালীন সময়ে, যে সব মুরগী মরে যায় - সেগুলো যে সন্তর্পণে ‘চালু’ বা ‘গণ’ হোটেলগুলোর মেন্যুতে স্থান পায় - এমন কথা শুনে আসছি একযুগেরও বেশী সময় আগে থেকেই, যখন সত্যিকার অর্থে - আজকের দিনের নাজুক ব্রয়লার মুরগীর মত খাদ্য-শিল্পের অস্তিত্ব ছিল না। এবার আসুন খাদ্যশিল্প সংরক্ষণের দিকটাতে। বহু বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের কোন টিভি চ্যানেলে দেখা একটা মজার বিজ্ঞাপন বেশ মনে করতে পারি। কোন এক বার্গার কোম্পানী তার নিজের বার্গারের গুণাগুণ বর্ণনার আগে, সাধারণভাবে বাজারে যে সব বীফ বার্গার পাওয়া যায় সেগুলার বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করছিল।

একজন লোক একটি চাকতি সদৃশ জিনিস দেখিয়ে বলছিল যে, ওটা হচ্ছে বাজারে প্রচলিত বার্গারে ব্যবহৃত একটা মাংসের ‘প্যাটি’ - প্রথমে সে তা দেয়ালে ছুঁড়ে দেখালো যে তা অক্ষত ও অখন্ডই রয়ে গেল - অর্থাৎ, তা কি রকম শক্ত! তারপর সেটাকে দিয়ে দুটো দল ‘আইস্-হকি’ খেললো এবং খেলা শেষেও দেখা গেলো মাংসের ঐ চাকতিখানি অক্ষত ও অখন্ড রয়ে গেছে - তখন লোকটি বললো যে, তাদের বার্গার ঐ ধরনের পাথরসম ‘প্যাটি’ দিয়ে তৈরী নয় বরং ‘তাজা’ বীফের তৈরী ইত্যাদি ইত্যাদি। পাঠকের অবগতির জন্য বলছি: উৎপাদিত খাদ্য সংরণ, সুস্বাদুকরণ ও এর শোভাবর্ধনে এমন সব রাসায়নিক দ্রব্যাদি ও এমন সব পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়ে থাকে, যেগুলো মানবদেহের ও স্বাস্থ্যের জন্য মোটেই সহনীয় বা হিতকর নয়। (চিনি বা লবণের মত কিছু প্রাকৃতিক সংরক্ষণকারী পদার্থ ছাড়া) preservative বলতে যে সব রাসায়নিক দ্রব্যাদিকে বোঝায়, তার অধিকাংশই আমাদের জন্য ক্ষতিকর । স্বাদ বা গন্ধ আকর্ষণীয় করে তোলার জন্যও এমন অনেক রাসায়নিক দ্রব্যাদি ব্যবহার করা হয়, যেগুলো আমাদের জন্য মারাত্মক মাত্রায় ক্ষতিকর - বহুল ব্যবহৃত Mono Sodium Glutamate হচ্ছে এধরনের একটি উপাদান। আর খাদ্যে ব্যবহৃত কৃত্রিম রং যে খারাপ - তা সচেতন পাঠক মাত্রই জেনে থাকবেন।

পশ্চিমা দেশে অনেক শিশুদের ‘হাইপার-একটিভ’ বা ‘অস্বাভাবিক রকমের চঞ্চল’ হবার জন্য ‘ফাস্টফুড’ বা ‘জাঙ্কফুডে’ ব্যবহৃত রাসায়নিক সামগ্রীকে দায়ী করা হয়। ‘হাইপার-একটিভ’ বাচ্চাদের মানবিক গুণাগুণ প্রায় ক্ষেত্রেই স্বাভাবিক ভাবে বিকশিত হয়না - বরং বেশী চঞ্চল হবার কারণে, তাদের প্রাণশক্তির অপচয় হয় এবং অন্য ক্ষেত্রে পূর্ণতা লাভ করতে তারা হয়তো ধীরগতি হয় - যেমন বাচ্চা হয়তো দেরীতে কথা বললো অথবা অমনোযোগী স্বভাবের হলো । আমি এত কথা বলছি আপনাকে শুধু এটুকু বোঝাতে যে - আপনি, আপনার দেশ বা আপনার জাতি যত বেশী ‘ফাস্টফুড কালচারে’ অভ্যস্ত হয়ে উঠবেন, নিজের খাদ্যের ব্যাপারে সঠিক তথ্য সংগ্রহে এবং তার মান নিয়ন্ত্রণে আপনার অপারগতা ততই বৃদ্ধি পাবে। আল্লাহর সৃষ্টিকে বিকৃত করতে আল্লাহ্ আমাদের নিষেধ করেছেন। আল্লাহ্ তা‘লা তাঁর সৃষ্ট প্রকৃতিকে বিকৃত করার ব্যাপারটাকে, "মানুষকে দিয়ে করানো শয়তানের ইচ্ছার কাজ বলে বর্ণনা করেছেন" (কুর'আন, ৪:১১৯)।

কিন্তু মানুষ আরো বহু কিছুর মতই খাদ্যদ্রব্যকে, নিজের লোভের যোগান দিতে যে ভাবে যথেচ্ছ পরিবর্তন করে চলেছে, সেটাকে নিঃসন্দেহে আল্লাহর সৃষ্টিকে বিকৃত করার প্রয়াস বলা যেতে পারে। যেমন, দুধের ‘খারাপ হয়ে যাওয়া’ রোধ করতে এবং তা দূরদূরান্তে বাজারজাত করতে যে ভাবে প্রক্রিয়াজাত করা হয়, তাতে দুধের মূল গুণাগুণ অনেকাংশেই নষ্ট হয়ে যায়। এটা নিঃসন্দেহে আল্লাহর সৃষ্টির বিকৃতি সাধন। একইভাবে স্ট্র-বেরী যাতে সহজেই পচে না যায় এবং স্ট্র-বেরীর ‘শেলফ্-লাইফ’ যাতে বৃদ্ধি করা যায়, সেজন্য সেগুলোকে রশ্মি দিয়ে ‘মেরে’ ফেলা হয়, তখন তারা মৃত ফলে পরিণত হয় । সুন্দর দেখানোর জন্য বা বড় আকারে প্রচুর ফলনের জন্য এখন শাক-শব্জি, ফল-মূল বা শস্য ইত্যাদিকে Genetically Modified(GM) করা হচ্ছে - অর্থাৎ ‘জিন’ পর্যায়ে পরিবর্তন সাধন করে নানা অস্বাভাবিক গুণাগুণ যোগ করা হচ্ছে।

এসব বিকৃতির পরিপূর্ণ অনিষ্টকর পরিণাম জানতে হয়তো আরো কিছু সময় লাগবে - তবে ইতোমধ্যেই সারা বিশ্বের সচেতন মানুষ এসব বিকৃতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছেন। এই তো সেদিন যুক্তরাষ্ট্রের Taco (এক প্রকার মেক্সিকান খাবার) বিক্রেতা এক স্বনামধন্য ‘ফাস্টফুড’ চেইন-শপের বিরুদ্ধে GM-ভূট্ট্রা দ্বারা প্রস্তুত খাবার খেয়ে অসুস্থ হয়েছেন বলে অভিযোগ তুলে মামলা দায়ের করলেন এক ক্রেতা। এছাড়া দেখুন যে উপায়ে, উদাহরণ স্বরূপ, ব্রয়লার মুরগী প্রতিপালন করা হয় - তা নিঃসন্দেহে আল্লাহর সৃষ্টি ‘মুরগী প্রজাতির’ প্রাকৃতিক “লাইফ-সাইকেল” বা “জীবন-চক্রের” বিকৃতি। উপরন্তু হরমোন প্রয়োগও নিঃসন্দেহে সৃষ্টির বিকৃতি। এসবই করা হয় কেবল একটা উদ্দেশ্যে - সম্ভাব্য সর্বাধিক মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে।

আমাদের বিশ্বাসমতে আল্লাহর সৃষ্টিকে বিকৃত করার প্রচেষ্টা থেকে কখনো মঙ্গলময় কিছু আসবে না - আর তা যে সত্যি তা উপরে আলোচিত বিষয়াবলী থেকে সহজেই অনুমান করা যায়। (প্রসঙ্গত মনে পড়লো, বাংলাদেশ, স্বাধীনতার পরবর্তী কয়েক বছরের মাথায় হঠাৎ উন্নত বিশ্বে ব্যাঙের পা রপ্তানী করতে শুরু করলো। ব্যাঙ যেহেতু আমাদের দেশে খাওয়া হয় না এবং তা প্রচুর পরিমাণে পাওয়াও যেত - সুতরাং উৎসাহের ও লোভের আধিক্যে ভবিষ্যতের কথা না ভেবে এমন ভাবে ব্যাঙ নিধন শুরু হলো যে, অল্পদিনের ভিতরই সবাই বুঝলেন যে, পোকামাকড়ের আধিক্যে এক প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে যাচ্ছে। আল্লাহর সৃষ্টি, প্রাকৃতিক পরিবেশকে এখানে বিকৃত করা হচ্ছিল। ) পবিত্র কুর’আনে অন্তত চারটি আয়াতে (২:১৬৮, ৫:৮৮, ৮:৬৯, ১৬:১১৪) আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘লা খাদ্যের কথা বলতে গিয়ে حَلَالًا طَيِّبًا [“হালালান তায়্যিবান”] অর্থাৎ, lawful and good বা ‘বৈধ ও উত্তম’ খাবারের কথা বলেছেন।

এছাড়া - “আল্লাহ্ তোমাদের যে সব ‘উত্তম খাবার’ দান করেছেন তা থেকে আহার কর” - এরকম কথা বলা হয়েছে অন্তত আরো চারটি আয়াতে(২:৫৭, ২:১৭২, ৭:১৬০, ২০:৮১)। খাঁটি খাদ্যের/পানীয়ের কথা বলা হয়েছে অন্তত সাতটি আয়াতে (৫:৪, ৫:৫, ১১:৮৮,১৬:৬৬, ১৭:৭০, ৪৫:১৬, ৪৭:১৫)। উপরন্তু স্বাস্থ্যকর (wholesome) খাবার ও পানীয়ের কথা উল্লেখিত হয়েছে অন্তত আরো তিনটি (৪:১৬০, ১৬:৬৭, ৭৭:২৭) আয়াতে। এ থেকে বোঝা যায় যে, খাবার হালাল হবার বাধ্যবাধকতার সাথে সাথে তা যেন ‘উন্নত উৎসের’ ‘খাঁটি’ হয়, ‘উত্তম’ হয় এবং ‘স্বাস্থ্যকর’ হয় সে ব্যাপারেও গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। পাঠকের অবগতির জন্য আমরা নীচে, উপর্যুক্ত আয়াতসমূহের একটি আয়াত(২:১৬৮) অর্থসহ তুলে দিলাম: يَا أَيُّهَا النَّاسُ كُلُوا مِمَّا فِي الْأَرْضِ حَلَالًا طَيِّبًا وَلَا تَتَّبِعُوا خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُبِينٌ “হে মানুষ, জমিনে যে সব হালাল ও পবিত্র দ্রব্য রহিয়াছে, তাহা খাও এবং শয়তানের প্রদর্শিত পথে চলিও না; সে তো তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু ।

” (সূরা বাক্বারা, আয়াত ২:১৬৮) [চলবে......ইনশা'আল্লাহ্!]

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.