আমি পার্থিব বাস্তবতায় অস্থির, অপার্থিব স্বপ্নপায়ী কেউ একজন . . .
টিয়েপাখির বুলি "মানুষ মেরুদণ্ডী প্রানী"-টা শুধু প্রাইমারী সাধারণ বিজ্ঞান বইতেই পাওয়া যায়। সত্যিকার "মেরুদণ্ড" জিনিসটা খুব কম মানুষের মাঝেই আছে। মানুষ ওটা লুকিয়ে রাখে কারন দেখাতে গেলেই অমেরুদণ্ডীদের লাঠির ঘায়ে ওটা খোঁয়াতে না হয়। সমাজের বড়-সড় মানুষের ওটার ভয় একটু বেশি থাকে। কারন তাদেরটা অধিকাংশ-ই নড়বড়ে হয়ে থাকে।
তো যাই হোক, প্রসঙ্গে আসি।
ইতোমধ্যই সবাই একজন অদ্ভুত ধরনের উৎসর্গিত শিক্ষকের মেরুদণ্ড প্রদর্শন এবং তার ফলে তার মৃত্যুর খবর শুনেছেন। প্রথম পাতায় আসা খুন-ডাকাতির খবরগুলো আমাদের কাছে ডালভাত হয়ে গেছে। তবে এই খবরটা বেশ অন্য একটা কারনে চোখে পড়ে গেল আর প্রতিদিন খবরটার আপডেটের জন্য খবর দেখা বা পেপার ঘাঁটা হয়েছে। অনেক সময় অনেককে দেখেছি নিজের ঘর বাঁচাতে বা স্বার্থ বাঁচাতে অন্যায় সহ্য করতে।
একাত্তুরের শান্তি বাহিনীতে যোগ দেয়া একজনের ভাষ্যে, তিনি যা করেছেন তা ছেলেমেয়ে কে বাঁচানোর জন্যই করেছেন। সেখানে একটা মফস্বলের একজন সাধারণ মানুষ তার স্বার্থ ভুলে শুধুমাত্র আদর্শ শিক্ষক সত্ত্বায় জ্বলে উঠে প্রতিবাদ করেছিলেন বখাটেদের ইভটিজিং-এর। তার ঘরে একটা ছোট্ট মেয়ে ছিল, তার স্ত্রী ছিল কিংবা একজন মা ছিল। কিন্তু সে অন্যায়ের কাছে নিজের বিবেক বলী না দিয়ে পুরো দেখকে একটা শিক্ষা দিয়ে গেছেন। সেই একদিনে একটা সাধারন মানুষ আকাশ ছোঁয়া সম্মান পেয়েছেন।
নিজের জীবনটা রাখতে পারেন নি তিনি; কারন তার পাশে আর একটাও "মিজানুর রহমান"-ও ছিলেন না। বাকি অমানুষগুলো তাকে যেমন-তেমন ভাবে তার সাহস দেখানোর শাস্তিটুকু দিয়ে গেছে। আর বাকি অবলা জীবগুলো ছিল হত্যাকান্ডের দর্শক। নানাভাবে হয়ে আসা নানা ধরনের ইভটিজিং পেপারে আসেও না, আসলেও সবাই ওটা পাশ কাটিয়ে যান। মেয়েগলোর পক্ষে কখনো কোন মেয়ে তো দূরে থাক কোন পুরুষ-ও কস্মিনকালে কন্ঠ তোলে নি।
একজন শিক্ষক তার জীবন দিয়ে দেখিয়ে গেলেন কিভাবে দায়িত্ব পালন করতে হয়। আমি অবাক হয়ে দেখেছি পেপারের খবরগুলো! শিক্ষকের মৃত্যুর পর তার ছাত্রীরা প্রতিবাদী হয়ে পথে নেমেছে। শিক্ষকের বিচারের সাথে নিজেদের নিরাপত্তা চেয়েছে। মিজানুর নিজের আগুনটুকু ওদের ভেতর কিছুটা হলেও দিয়ে গেছেন। মেয়েগুলোর মধ্য রাগ এসেছে।
আমার আশেপাশেই অনেক আক্রান্ত মেয়েকে তাদের পরিবার বলেছে চেপে যেতে। যা হয়েছে তা তাদের সম্মানহানি করার জন্য যথেষ্ট। এখানে বলেছিলাম কিছু ঘটনা। এ পোস্ট-টা দেয়ার পর আমি অবাক হয়ে আবিষ্কার করেছি যে আমাদের দেশে কতো মেয়ে ইভটিজিং-এর শিকার। খুব দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে অনেক মেয়েই এটাকে মেনে নিয়ে অদ্ভুত ট্রমায় আছে।
প্রতিবাদী না হয়ে নিজের মেয়েটাকেও বিশাল একটা ভুল শেকলে বেঁধে বড় করছেন। কেন তারা রেগে উঠেন না, মেয়েগুলোর ভেতরে নিজেদের রাগটা শক্তিতে বদলে দেন না?! আমি ভিকারুননিসার এক মেয়েকে ইভটিজিং-এর শিকার হতে দেখেছি যখন আমি ক্লাস সিক্সে পড়ি। মেয়েটার হাত একটা ছেলে ধরতে গেলে মেয়েটা তার কেডস দুটা খুলে ঐ ছেলের দিকে ছুঁড়তে ছুঁড়তে অমানুষিকভাবে চিৎকার করতে থাকে। সবাই যখন চমকে মেয়েটার দিকে তাকায় তখন ছেলেটা পালিয়ে গেছে। মেয়েটা তখন-ও চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলে যাচ্ছে যে কিভাবে ছেলেটা তাকে প্রতিদিন উত্যক্ত করে।
হতবাক মানুষেরা কেউ এগিয়ে যায় নি। ও কান্না থামিয়ে বিহ্বল-অস্থির চোখে ভীড়ের মাঝে "একজন মিজানুর রহমান" খুঁজে খুঁজে অসহায় ভাবে মাথা নিচু করে ঘরে ফিরে গেছে। একটা মানুষ-ও মেয়েটার অপমান বা ভয়ানক কষ্টটা বোঝে নি বা বোঝার চেষ্টাই করে নি।
সত্যিকার সেই মানুষটা এ ধরনের মেয়েগুলোর হয়ে প্রতিবাদ করায় বিষয়টা অভুতপূর্ব একটা ছবি দাঁড়া করায়। আমরা কয়েকদিন পেপার দেখবো… তার পরিবারকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দেয়া সান্ত্বনা শুনবো, "ক্ষতিপূরণ"-এর অঙ্ক জানবো।
বখাটেগুলোকে রিমান্ডে নেয়ার খবর পাবো কিন্তু তাদের জামিনের খবর পাবো না। তারপর একসময় ভুলে যাবো। বখাটেগুলো মেয়েগুলোর সম্মান অস্তিত্ব আগের মতোই কুঁড়ে কুঁড়ে খাবে। মা-বাবারা এসে তর্জনী জড়ো করে মেয়েগুলোকে ঘরবন্দী করবেন। সমাজের জুজুরা মেয়েটার ছিন্ন-ভিন্ন চরিত্রের দিকে কটাক্ষ করে বিশাল বিনোদন করবেন।
মেয়েগুলো ধুঁকে ধুঁকে বাঁচবে যেমন তারা আগেও বেঁচে ছিল। শুধু নাটোরের কিছু মেয়ের মনে জ্বলজ্বল করবে একটা নাম। যে নামটা তাদের মুখ না গুঁজে সাহসী সবার জন্য নিজের জীবনটা দিয়ে গেছেন। প্রতিবাদ শিখিয়ে দিয়ে গেছেন। অন্যদের মতো তাদের বিকিয়ে যেতে দেন নি।
হয়তো মেয়েগুলোর শিশুগুলো মিজানুরের আদর্শে বড় হবে। হয়তো বাংলাদেশের একটা কোণে বেঁচে উঠবেন আরো দশটা মিজানুর! হয়তো কিছু ছেলের মনেও মিজানুরের আদর্শ নাড়া দিয়ে যাবে!
আমরা মেয়েরা এমন নপুংসক-আবৃত দেশে থেকেও কতো অবান্তর চিন্তা করি দেখুন তো!
সব মেয়ের কথা জানি না তবে আমি আমার মেয়েটাকে বা ছেলেটাকে এই মানুষটার আদর্শ দিবোই। আমি এখনের নোংরা পৃথিবীতে নোংরা মনের অমানুষের ভীরে একজন মানুষ হিসেবে মিজানুর রহমান-কে দেখে চমকে গিয়েছি। তাঁর জন্য আমার সবটুকু শ্রদ্ধা উৎসর্গ করেছি। তাঁর আত্মা অনেক অনেক খাঁটি দোয়া আর আশীর্বাদে ঘুমিয়ে থাকুক শান্তিতে!
________________________________________________________
খবর সূত্র : প্রথম আলো
২১-১০-২০১০
ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত (ইভ টিজিং) করার প্রতিবাদ জানানোয় বখাটেদের হামলায় গুরুতর আহত কলেজশিক্ষক মিজানুর রহমানের (৩৬) চিকিৎসা এখনো চলছে।
তাঁর অবস্থা অপরিবর্তিত রয়েছে। আজ বেলা দুইটার দিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রের (আইসিইউ) সহযোগী অধ্যাপক কামরুল হুদা এ কথা জানান।
এর আগে তাঁর পর্যবেক্ষণে নিয়োজিত একদল চিকিৎসক সকাল ১০টার দিকে তাঁকে পর্যবেক্ষণ করেন। নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার লোকমানপুর কলেজের এ শিক্ষক এখন এই হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক কামরুল হুদা গতকাল প্রথম আলোকে জানিয়েছিলেন, ‘মিজানুর রহমান ক্লিনিক্যালি ডেড।
’
মিজানুর রহমানের ভাতিজা আবু হেনা মোস্তফা কামাল ঢাকায় প্রথম আলোকে জানান, মিজানুর রহমান চার দিন ধরে অচেতন। চিকিৎসকেরা তাঁদের জানিয়েছেন, তিনি ক্লিনিক্যালি ডেড। তবে এখনো মৃত ঘোষণা করা হয়নি।
লোকমানপুর কলেজ সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় দুই বখাটে যুবক আসিফ আলী ও রাজন কলেজের একাদশ শ্রেণীর কয়েকজন ছাত্রীকে উত্ত্যক্ত করত এবং অশালীন আচরণ করত। ছাত্রীরা বিষয়টি কলেজের রসায়ন বিভাগের শিক্ষক মিজানুর রহমানকে জানান।
মিজানুর রহমান ঘটনাটি অধ্যক্ষ ও ব্যবস্থাপনা কমিটিকে জানান। তিনি অভিযুক্ত ওই যুবকদের সতর্ক করে দেন।
এতে ওই যুবকেরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। ১২ অক্টোবর দুপুরে বখাটে যুবকেরা স্থানীয় কৃষ্ণা কৃষি খামারের সামনে প্রভাষক মিজানুর রহমানের ওপর মোটরসাইকেল তুলে দেয় এবং মাথা, বুক ও চোখে গুরুতর আঘাত করে।
স্থানীয় লোকজন তাঁকে উদ্ধার করে প্রথমে বাগাতিপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে, পরে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে।
অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে নেওয়া হয়।
গতকাল অর্থাৎ ২৬শে অক্টোবর তাঁর জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
শেষ আপডেট :
শিক্ষক মিজানুর রহমান হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া আসামি আসিফ হোসেনকে তিন দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। আজ মঙ্গলবার সকালে মুখ্য বিচারিক হাকিম মজিবুর রহমান পুলিশের রিমান্ড আবেদন মঞ্জুর করেন এবং তাঁর জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করেন।
আদালত সূত্র জানায়, পুলিশ আসিফকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আজ সাত দিনের রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন জানায়।
পরে শুনানি শেষে আদালত তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। শুনানিকালে আসামি পক্ষের আইনজীবী লোকমান হোসেন জামিনের আবেদন করে রিমান্ডের বিরোধিতা করেন।
তিনি আদালতকে জানান, আসামি আসিফ অসুস্থ। রিমান্ড আবেদন মঞ্জুর করা হলে আসামির প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে।
সরকার পক্ষ থেকে কোর্ট ইন্সপেক্টর (সিআই) জাহাঙ্গীর আলম ও মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) আবদুর রহিম আদালতকে জানান, অভিযুক্ত ব্যক্তিরা নিহত হওয়া কলেজ শিক্ষকের ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করেছিলেন।
এ ব্যাপারে ওই শিক্ষক প্রতিবাদ করলে আসামিরা পূর্বপরিকল্পিতভাবে তাঁকে হত্যা করেন। রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা না হলে তদন্ত অসম্পূর্ণ থাকবে। বিচারক তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে জিজ্ঞাসাবাদের সময় পুলিশকে আসামির স্বাস্থ্য সম্পর্কে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার নির্দেশ দেন।
এদিকে তদন্ত কর্মকর্তা আগে দায়ের করা ‘হত্যা চেষ্টা’ মামলাটি হত্যা মামলায় রূপান্তরিত করার আবেদন জানিয়ে আদালতে আবেদন করেন। মামলাটি এখন থেকে হত্যা মামলা হিসেবে পরিচালিত হবে।
এদিকে মামলার অন্য আসামি রাজনকে গ্রেপ্তার করতে পুলিশ গতকাল সোমবার রাতে কয়েকটি স্থানে অভিযান চালিয়েছে।
_____________________________________________________________________________
মাঝে মাঝে স্বপ্নদৃশ্যের মতো মনে হয়, যদি এই আসামীগুলোকে ফাঁসি দিয়ে মেরে ফেলা যেতো! শুধু একবার! তাহলে মেয়েগুলোকে যেমনতেমন ভাবে অপমান করার আগে একবার ভেবে দেখতো অমানুষগুলো!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।