মানুষ ৩ রকম, ১। আগুনে পুড়ে যায়, ২। আগুনে গলে যায়, ৩। আগুনে ঋদ্ধ হয়
কিছুদিন ধরে ভিকারুননিসায় ভর্তি পদ্ধতি পরিবর্তন নিয়ে মাঠ ঘাট খুব উত্তপ্ত। নিজের উত্তাপে উত্তপ্ত ঢাকার মানুষের আসলে তাতে কিছু যায় আসে না।
খবরের ফেরীওয়ালারা গরম গরম খবর দেয় আমরা কিছুক্ষন তা নিয়ে উত্তপ্ত থাকি যদি সেটা আমাদের সম্পর্কিত খবর হয়। কিছুক্ষন ঝড়বাদল চলে তারপর নশ্বর পৃথিবীর আর সব কিছুর মত সেটাও ফুরিয়ে যায়।
রাস্তা-ঘাটে আমি ইদানিং আমি বার বার কথাটা শুনছি, কিন্তু আমি এখন হচ্ছি সেই ছোট পাখি যার আপনার বাসা আগে বুনতে হবে। গত সপ্তাহ পর্যন্ত হাতে শাইনপুকুর সিরামিকসের এ্যানুয়াল বিজনেস রিপোর্ট নিয়ে ঘুড়তাম এ সপ্তাহে সেটা এ্যানালাইসিস করে জমা দিয়েছি এখন ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের poverty analysis papers নিয়ে ঘুড়ি। আমি সব শুনি তারপর নিজেকে বলি "এখন না কব কথা আনিয়াছি তৃণলতা আপনার বাসা আগে বুনি"
কিন্তু ভিকারুননিসা শব্দটার সাথে যে আমার অনেক কিছু জড়িয়ে আছে।
আমার আকাশি নীল ফ্রকটা, আমার ন্যাড়া মাথাটা, আমার প্রথম দাঁত পরা, একে একে সব দাঁত পরা, প্রথম সেলোয়ার কামিজ পরা, প্রথম শাড়িও পরাও, প্রথম স্টেজে উঠা, সব!
আজকের বলাকাবেশী আমার প্রথম উড়ার আকাশের নাম ভিকারুননিসা! আমার সত্ত্বার সবচেয়ে বড় অংশের নাম ভিকারুননিসা।
২২ বছর জীবনের ১২ বছর আমি ভিকারুননিসার বেইলী রোড ক্যাম্পাসে কাটিয়েছি। তাই যখন কেউ ভিকারুননিসা শব্দটা উচ্চারণ করে তখন আমি একটু কেঁপে উঠি, কিছুটা উত্তেজনায় কিছুটা আবেগে। কিন্তু যখন কেউ ভিকারুননিসায় ভর্তি পরীক্ষা দিবে শুনি তখন আমি আতংকে ভীষনভাবে কেঁপে উঠি। আমার সেই ছোট্ট মেয়েটার কথা মনে পরে যায় যাকে কোনদিন সকালে ডাকতে হত না, নিজ গরজে সে ভোর পাঁচটায় উঠে পড়তে বসত।
বড় বোনের ফ্লাক্সের পিপড়ার সাথেও সে হিংসা করত "পিপড়ারে তুইও ভিকারুননিসায় যেতে পারিস? হায়! আমার কবে এই ভাগ্য হবে?"
অনেকেই লটারী পদ্ধতি নিয়ে অনেকে কথা বলছে। কিছু আন্দোলনের পদচারনাও হচ্ছে, কিছু কর্মসূচির হাক-ডাকও শোনা যাচ্ছে। সবার মতমত দেবার অধিকার আছে। আমি সবার মূল্যবান মতামতের প্রতি সন্মান দেখিয়ে একটা তথ্য দেই, লটারী পদ্ধতিটা কিন্তু ভিকারুননিসায় আগেই ছিল ১৯৯২ সালে সেটা বন্ধ হয়ে যায়, তখন থেকে এই লিখিত পদ্ধতি শুরু হয়। এর আগে একটা ভাইভা হত এবং কিছু হাতের লেখা দেখা হত, স্কুলের ছাত্রীরা পরীক্ষার্থীদের গল্প শুনাত, গান শুনাত।
বড় আপুদের নিয়ে একটা আনন্দঘন পরিবেশে পরীক্ষা নেয়া হত।
তখনকার ভিকারুননিসার ছাত্রীরা স্কুল প্রাঙ্গন পরিস্কার করা থেকে সব রকম কাজ করত। নাচে গানে খেলায় বিতর্কে লেখাপড়ায় সব ক্ষেত্রে ভিকারুননিসা অপ্রতিদ্বন্দি ছিল। সবখানে ভিকারুননিসার জয়জয়কার ছিল।
আমার বড় বোন '৯০ ব্যাচে ভিকারুননিসায় ভর্তি হয়।
১৯৯০ সালে ছিল ভিকারুননিসার স্বর্ণবর্ষ, সেবছর এস এস সি তে ভিকারুননিসার সাফল্য সব বছরকে ছাড়িয়ে যায়। আমি '৯৫এর ব্যাচে ভিকারুননিসায় ভর্তি হই। তখনও অবশ্য কিছু গৌরব অবশিষ্ট ছিল। এখনকার মেয়েদের শিক্ষা পরিস্থিতি খুবই আশঙ্কাজনক। আমার নিজের ছোটবোন ক্লাস ৭ এ পড়ে।
আমার বড়বোন এবং আমার সাথে ওর লেখাপড়া এবং মূল্যবোধ সবকিছুর দূরত্ব অনেক বেশি। আমার অবজার্ভেশন বলে, এখনকার ভিকারুননিসা আসলে অনেক বেশি নামে চলে, গতবছরের রেজাল্টও তার প্রমান!
ইউনিভার্সিটি ভর্তি পরীক্ষার সময়ও দেখা যাচ্ছে মেয়েদের ঠিকানা শেষ পর্যন্ত বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে! যেখানে সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে নাম না জানা স্কুল কলেজ থেকে শিক্ষার্থীরা উঠে আসছে! সমাপনী পরীক্ষাগুলোতেও নামকরা স্কুলগুলির থেকে তাদের ফলাফল ভাল!
এ থেকে ২টা জিনিশ প্রমান হয়,
এক, লটারী পদ্ধতি বলে যেটাকে আখ্যা দেয়া হচ্ছে সে পদ্ধতিতে ভর্তি হওয়া ভিকারুননিসার মেয়েদের পরবর্তি জীবনে সাফল্যের মাত্রাটা বেশি। তাদের অর্জিত বড় বড় ট্রফিগুলো এখনও আমাদের প্রিন্সিপালের রুমে শোভা বাড়ায়।
দুই, স্কুলের নামে শিক্ষার্থী নামী নয় বরং শিক্ষার্থীর গুনেই স্কুলের সুনাম। আমি ভাল বলেই না সবাই ভিকারুননিসা কে ভাল বলে।
আমি যদি ফার্নিচার টাইপ হতাম তাহলে কি কেউ বলত ভিকারুননিসা হেন তেন? আমাদের সাথের সব মেয়েই কি খুব স্মার্ট? মোটেও না অনেক মেয়ে আছে খুব আনস্মার্ট (চেহারার কথা বলি নাই, কাজের কথা বলেছি)
আমার এক কাজিনের মেয়ে ৮ বছর বয়সে ভিকারুননিসায় ক্লাস ওয়ানে পড়ছে। আমার এক চাচাতো বোনও তাই। না ওরা ক্লাস ১ আরও একবার পড়ে নাই। ক্লাস ২টে পড়ার তো প্রশ্নই আসে না! ওরা বনসাই'র মত ২ বছর আল্লাহ'র দুনিয়ার সব ভর্তি কোচিং এ কোচিং করেছে।
আমি যখন ওদের সাথে কথা বলি আমার তখন ওদের মানুষ মনে হয় না।
শিশু তো নাই। ওরা দুনিয়ার রূঢ় বাস্তবতাটা আমার চেয়েও ভাল জানে, এমনকি প্রথমবার চান্স না পাবার পর চতুর রাজনীতিবীদের মত "স্থূল কারচুপি হয়েছে, ভিকারুননিসায় সব ডোনেশনের কারবার" জাতীয় মন্তব্যও করেছে।
পরের বার আমি আমার চাচাতোবোনকে জিজ্ঞেস করলাম "তুই এবার চান্স পেয়েছিস কি কারচুপির মাধ্যমে?" সে অম্লান বদনে জবাব দিয়েছিল " কিভাবে চান্স পেয়েছি জানি না তবে এবারও চান্স না পেলে আত্মহত্যা করতাম, এই মুখ আর দেখাতাম না" এই মেয়ে ২০০২ সালের দোসরা জানুয়ারিতে জন্ম নিয়েছে, হিসাব মতে ওর বয়স ঠিক ৮ বছর!!!!!
আমি ভার্সিটিতে ভর্তি হবার আগে অল্প হাতে গোনা কিছু গাছ ছাড়া কোন গাছ চিনতাম না। রুই, ইলিশ আর চিংড়ি ছাড়া কোন মাছ চিনতাম না। ভিকারুননিসায় ভর্তি হবার আগ পর্যন্ত আমার শৈশব বলে কিছু ছিল না।
ভার্সিটিতেও এসব শিখার কারণ হচ্ছে আমার পড়ার একটা বড় অংশ কৃষি। ইঞ্জিনিয়ারিং বা পিউর বি বি এ পড়লে হয়তো আমি এসব কোনদিনও শিখতাম না!
ভিকারুননিসা আমাকে অনেক দিয়েছে অনেক কিছু! আমি যেখানে যাই সবার মাঝে আমাকে আলাদা করে দেখা যায়। সবাই জানে মেয়েটা ভিকারুননিসা থেকে পাশ করার কারনে এত স্মার্ট এক্টিভ। এর অনেকটাই ভিকারুননিসার দান। আমাদের টিচারদের মমতা ছিল দেখার মত, আপারা আমাদের কোনদিন ছাত্রী বলে ডাকতেন না, ভিকারুননিসায় ছাত্রী শব্দটাই নেই।
সবাইকে মেয়ে বলা হয়। লক্ষ্য করলে দেখবেন টিচাররা কখনও সাক্ষাতকার দিলে, "আমাদের মেয়েরা" এভাবে কথা বলেন।
আমার নিজের বড় বোন ভিকারুননিসায় পড়ত। শান্ত চুপচাপ ছিল, কিছুটা দূর্বল চিত্তেরও, রেজাল্টও তত ভাল করত না। ক্লাসে নাইনে সাইন্স পেল না।
ক্লাসে কেউ ওকে গোনায়ই ধরত না। সেই মেয়ে ক্লাস ৯ এ প্লেসে এসে পরল পুরা নিজের চেষ্টায়। এস এস সি তে আর্টস থেকে ৮০৫ নম্বর পেয়ে পাশ করে। ক্লাস নাইনের ঘটনা, মহসিন তালুকদার নামক একজন তথা কথিত শিক্ষক আছেন ভিকারুননিসায়। তিনি আপুকে অংকে সর্বোচ্চ মার্ক্স পাবার অপরাধে যা ইচ্ছা তা বলে বকাবকি করেন তার মধ্যে এমন কথাও ছিল যে আপু নকল করে এত মার্কস পেয়েছে।
ক্লাসে এইট পর্যন্ত যে মেয়ে অংকে ৬০ তুলতে পারে নি তখন জনৈক মহসিন তালুকদারের টনক নড়ে নি যে একটি মেয়ে হোঁচট খাচ্ছে, যখন সে দাড়াতে শিখল তখনও তাকে সাধুবাদ জানানোর বদলে তাকে তিরস্কার করেছে। (*পাঠক এমন মনে করার কোন অবকাশ নেই যে ভিকারুননিসার সব টিচার এমন, এটা একটা এক্সট্রিম সিচুয়েশন বললাম, তবে আপুর সাথে অনেক টিচারের ব্যাবহারই এমন ছিল যারা আমাকেই মাথায় তুলে রাখতেন।
**মহসিন তালুকদার সম্পর্কে আমাকে কেউ শিক্ষা না দিতে আসলেই আমি খুশি হব। আমার জীবনে আমি যতগুলো নিম্ন শ্রেনীর মানুষ দেখেছিল এই পর্যন্ত সে তাদের মধ্যে সেরা। আমি স্কুলে থাকতেও তাকে কখনও সন্মান করতাম না এখন তো প্রশ্নই আসে না।
যার নিজের মেয়ের অবস্থা এমন সে অন্যের মেয়েকে নিয়ে কথা বলতে আসে কিভাবে সেটাই আমার সারা জীবনের প্রশ্ন)
আমার বোন এখন সিডনিতে থাকে। সে ঢাকা ভার্সিটি থেকে পাবলিক এ্যডমিনিশট্রেশন থেকে পাশ করেছে। সিডনি'র যতগুলো ইউনিভার্সিটিতে Phd'র জন্য আবেদন করেছে সবাই তাকে আমন্ত্রন জানিয়েছে। দুলাভাই'র MS শেষ হলেই ও শুরু করবে। আপু যখন পতিত ছিল ওকে স্কুল থেকে weak girl careটা নেয়া হত ঠিকই, কিন্তু ওর মনোবলটা তৈরি করে নি।
উলটা ভর্ষণা দিত, যেটা ওকে আরও তুচ্ছ করে দিত, সেই সব ছাপিয়ে ওর নিজের নিজেকে প্রমান করতে হয়েছে। যেখানে ভিকারুননিসার অবদান তুলনামূলক কম।
একই মায়ের ২ মেয়েকেই যদি সমানভাবে গড়ে তুলতে না পারে সেখানে স্কুল ভিকারুননিসা হোক কি না হোক তাতে কি বা আসে যায়?
শুধু শুধু কেন একটা শিশুর সোনার শৈশব নষ্ট করা? স্কুল কেন শুধু ভিকারুননিসাই হতে হবে? কেন কেউ অন্য অপসনের চিন্তা করবে না? কেন নিজের চেষ্টায় উঠে দাঁড়াবে না? ১৯৫২ সালে ভিকারুননিসাও কিন্তু খুব প্রতিষ্ঠিত স্কুল ছিল না, ভিকারুননিসা যদি উঠতে পারে অন্যরা কেন পারবে না? কেন? শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করার চেয়ে শ্রেষ্ঠত্বে তকমা লাগানো বেশি সোজা বলে? I am very sorry to say, আমি দেখতে পাচ্ছি এই শ্রেষ্ঠত্ব তাসে ঘরের মত ভেঙ্গে যাবে এত বড় জনসংখ্যার চাপ ভিকারুননিসার একার পক্ষে সামলানো কিছুতেই সম্ভব হবে না।
আমি মনে করি, কোন কিছুর উন্নতি করতে হলে সেটাকে প্রতিনিয়ত সময় উপযোগী করতে হয়, পুরাতন ধ্যান ধারণা ভেঙ্গেই তবেই সেটা সম্ভব। আশা থাকবে পরিবর্তন উন্নতির তরে হোক।
আমার বাবা-মা যেমন বুক ভরে গর্ব নিয়ে বলে আমার তিনটা মেয়েই ভিকারুননিসায় পড়েছে। প্রার্থনা করি আরও ১০০ বছর পরও যেন কোন বাবা মা'র একই গৌরব মহিমান্বিত করে ভিকারুননিসার প্রাঙ্গন।
Viqi's Rule!!!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।