আমার আমি......
শিস দিতে দিতে আয়নার সামনে দাঁড়ায় রিওন, চুলটা একটু ঠিক করে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে । আজ সে মনের কথা বলে দেবে সাফিনকে প্রতিদিনের অপেক্ষা আর ভাল লাগে না । শাহীন আর রানাকেও থাকতে বলেছে মোড়ে, একটা হিন্দি গানের কলি আওড়াতে আওড়াতে দরজার দিকে এগিয়ে যায় রিওন ।
- কিরে কই যাস এই ভর দুপুরে
- ধুর !! তুমি জানো যে প্রতিদিন এই সময়েই আমি বের হয় । শুধু শুধু প্যাচাল পাড়ো ক্যান ? মেজাজটাই খারাপ করে দেও ।
মায়ের কথার প্রতিউত্তরে ঝেঝিয়ে উঠে রিওন দরজা খুলে বেরিয়ে যায়, জানে ও এখন তার মা একা একা অনেক্ষন বকাবকি করবে । বিরক্ত লাগে এইসব ।
- দোস্ত তোমার জানু তো এইমাত্র চলে গেল ।
রিওন মোড়ে আসতেই তার বন্ধু শাহীন জানাল উচ্চস্বরে সিফানের চলে যাওয়ার কথা ।
- ধুর ! মার ঘ্যানঘ্যানানি-প্যানপ্যানানি প্রতিদিন ভাল্লাগেনা, হের জন্যই খালি লেট হয়
কিছুটা বিরক্তিমিশ্রিত কন্ঠে উত্তর দেই রিওন ।
- আরে রাগিস না , এখনো তোমার সুখপাখি আসে নাই । আজ কি কইতে পারবা, না প্রতিদিনের মত ঠ্যাং কাপাবা ?
রানা টিপ্পনি কাটে রিওনকে আগের দিনের কথা মনে করিয়ে দিয়ে ।
- ধুর সেদিন তো কইয়াই দিতাম, হে হের মারে লইয়া আইব এইডা কেডা জানত ।
কিছুটা শ্লেষের সাথেই উত্তর দেয় রিওন ।
সাফিনের এই রাস্তা দিয়ে যেতে মোটেও ভাল লাগেনা বরং ভয় লাগে কারন কয়েকজন ছেলের তার উদ্দেশ্যে করা কথার বাণের জন্য ।
যেটা শুধু এই মোড়েই সীমাবদ্ধ নেই, মাঝে মাঝে তাদেরকে তার স্কুলের সামনেও দেখেছে ও, আর জর্জরিত হয়েছে অশ্লীল কথা শুনে যা ও জানাতে পারেনি কাউকেই । জানাতে গেলেই শুনতে হয়েছে এক হাতে তালি বাজে না'র মত প্রবাদ । মাঝে মাঝে যে রেহায় পায়না তা না, তার আম্মু সাথে থাকলে তাকে সবকিছু থেকেই রেহায় দিয়ে দেয় যেন সবাই । তাই কাউকেই কোনকিছু বিশ্বাস করাতে পারে না ও । যে ভয়ে ভয়ে পার হচ্ছিল সাফিন মোড়টা তা পিছু ছাড়ে না, কিছু না বোঝার আগেই দেখতে পায় কয়েকজন ছেলে ঘিরে ধরেছে তার রিকসাকে ।
- আস্লামু আলাইকুম আপু থুক্কু ভাবী !! ভাল আছেন ?
- ওই ফাজলামি করিস না । আপু আপ্নেরে একটা কথা কওনের লাইগা আপ্নের রিকসা থামায়ছি, কথা শেষ হয়লেই রিকসা ছেড়ে দিব চলে যায়েন । না না আমাদের ভয় পাওয়ার কিচ্ছু নাই, এই পাড়ায়ই আমাদের বাড়ি । চেনেন না আমাগো ?
- ওই তোরে না চিনলেও চলব । আপু আপনি রিওনরে তো চেনেন, হেরে চিনলেই অইব ।
হে আপ্নেরে কিছু কইবার চায় । ঐ কস না ক্যান ?
রিওনের গলা বুক শুকিয়ে আসে, ওর মত সাহস এই পাড়ায় কারো নেই তবু এই মেয়েকে দেখলে তার হার্টবিট কেন জানি এম্নিতেই বেড়ে যায় ।
- না মানে, ইয়ে , মানে বলতে চাচ্ছিলাম যে
বলে রিওন একবার চারপাশে চোখ বুলিয়ে নেয়, ওর বন্ধুদের তাচ্ছ্যিল্লের হাসি দেখে সাহস সঞ্চার করে বলেই ফেলে
- আপনাকে আমার খুব পছন্দ, আপনার মোবাইল নাম্বারটা একটু দেওয়া যাবে !
- আসলে সর্যি ভাইয়া আমিতো সেট ইউজ করিনা ।
আমতা আমতা করে উত্তর দেয় সাফিন ।
- তাহলে বাসার নাম্বারটা দেন ।
পাশ থেকে বলে ওঠে কেউ একজন ।
- ভাইয়া আসলে বাসার নাম্বারটা যার তার কাছে দেওয়া নিষেধ আছে ।
বলেই বৃদ্ধ রিকসাওয়ালাকে তাড়া দেয় সাফিন এগিয়ে যাওয়ার জন্য ।
- শালার মাগীর সাহস দেখছস !! কত্তবড় সাহস !! তোর মত পোলার মুখের সামনে না বলে দেয়।
রাগে ফোস ফোস করতে থাকে রানা ।
- হেই শালীরে উঠাই লইয়া আসাতো ওয়ান টু'র ব্যাপার আর হে পাট লই আমাগো লগে । এর একটা এস্পার-উস্পার করতেই অইব । তুই না করলেও আমরা করুম ।
বলে শাহীন এদিক ওদিক তাকায় সমর্থনের জন্য ।
রিওনের কাছে পৃথিবী ফাকা ফাকা লাগে ।
রাগ আর কষ্টের মিশ্র অনুভুতি তাকে অন্ধ আর উন্মাদ করে তোলে । তার ইচ্ছা করছে চিৎকার করে সমস্ত পৃথিবীকে ধ্বংস করে দিতে ।
রিওনের ভয় লাগছে অনেক ভয় । যদিও সে তার চিরচেনা যায়গায় রয়েছে তারপর ও ভয় করছে অনেক । তাকে একা রেখ শাহীন আর রানা বের হয়ছে প্রায় নয়টার দিকে এখন প্রায় বারটা বাজতে চলল তবু তাদের দেখা নাই ।
আকাশে আজ অনেক বড় চাঁদ উঠেছে, প্রায় আলোকিত করে ফেলেছে পুরো অঞ্চল । এই আলোতে পরিবেশটা আরো ভৌতিক হয়ে উঠেছে । জ্যোৎস্নার একটুকরো আলো সাফিনের মুখেও পড়েছে যা রিওনকে ভাললাগার অনুভুতির বদলে রক্ত হিম করা ভয়ের অনুভুতি দিচ্ছে । মনে হচ্ছে সাফিন হাসছে তাকে ভীত আর কাপুরুষ হিসাবে দেখে ।
ওরা বুঝতে পারেনি ঘটনা এভাবে ঘটবে ।
সাফিন যাতে চিৎকার চেঁচামেচি না করতে পারে তার জন্য ওরা সাফিনের উড়না দিয়েই সাফিনের মুখ চেপে ধরেছিল কিন্তু উড়না যে মুখের সাথে সাথে সাফিনের নাকও চেপে ধরেছিল, অতিরিক্ত উত্তেজনার কারনে কেউ বুঝইতেই পারেনি । বরং সাফিনের লাফালাফির মত নড়াচড়া তাদের কাছে বিরক্তিকর আর অসহনীয় মনে হয়েছিল যা হয়ত সে করছিল এক চিলতে মুক্ত হাওয়ার জন্য, বুক ভরে শ্বাস নেওয়ার জন্য । তাই হঠাৎ করেই যখন সাফিনের নড়াচড়া বন্ধ হয়ে তার দেহ নিথর হয়েছিল তখন তারা চিন্তার বদলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল, যা ছিল ক্ষনস্থায়ী । যখন ওরা বুঝতে পেরেছিল সাফিনের চিরমুক্তি হয়েছে তখনই কয়েকজন তার বন্ধু কেটে পড়েছিল বিভিন্ন দোহাই দিয়ে ।
- নাহ রানা, শাহীন আসেনা কেন ?
ওরা গেছে লাশ কোথায় লুকিয়ে রাখা যায় তার বন্দোবস্ত করতে ।
রিওনের এই নিস্তব্ধতা ভাল লাগছে না মোটেই ।
চমকে উঠে রিওন অস্বাভাবিক একটা শব্দে, সাফিনের ছায়া পড়েছে চাঁদের আলোয় । ছায়া যেন কিছু বলতে চায় । ভয় পায় ও অনেক ভয়, ছুটতে থাকে রিওন, সাফিনের লাশ ফেলে উর্ধশ্বাসে । তবুও যেন ছায়া তাকে ছাড়েনি, যে কিনা পিছু নিয়েছে তার ।
যদিও ছায়াটা তার নিজের মত তবুও বিশ্বাস করতে পারে না রিওন । সে ছুটতেই থাকে, ছায়ার হাত থেকে বাঁচতেই হবে তার যেকোন মুল্যে । হঠাৎ তীব্র আলোর ঝলকানিতে চোখ ধাঁধিয়ে যায় রিওনের, যে আলোর যেন কোন আদি বা অন্ত নেই ।
- ধুর !! এইসব হারামীর বাচ্চাগুলো কেন যে আমার গাড়ীর তলে আসে । অন্য কোনদিকে শালার কুত্তার বাচ্চাদের চোখ যায় না, মরতে আসে আমার গাড়ীর তলে ।
যা শালা মর, আমার তাতে কি ।
খিস্তি-খেউড় আওড়াতে আওড়াতে তার ট্রাককে এগিয়ে নিয়ে চলে মদ্যপ ট্রাক ড্রাইভার ।
চাঁদের আলোয় হাল্কা ছায়া পড়ে রাস্তায় ট্রাকের, সেইসাথে হয়ত ওই ড্রাইভারেরও যা কিনা এগিয়ে চলে বীরদর্পে ট্রাকের সাথে সাথে । যার কাছ থেকে হয়ত মুক্তি নেই কারোরই ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।