আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একজন শাহীন মল্লিকঃ পরিশ্রমই সাফল্যের চাবিকাঠি।

সব কিছুর মধ্যেই সুন্দর খুঁজে পেতে চেষ্টা করি............

একজন শাহীন মল্লিকঃ পরিশ্রমই সাফল্যের চাবিকাঠি। ছেলে বেলায় পড়েছিলাম-“পরিশ্রমই জীবনে সাফল্য বয়ে আনে”। বাক্যটাকে আমি মনে প্রানে বিশ্বাস করি। শুধু পরিশ্রম করে সাফল্য পেয়েছেন-এমন একজন যুবকের কথা আপনাদের সাথে শেয়ার করছি। হয়ত এই বিষয়টা জেনে অনেকেই অনুপ্রানিত হবো আমাদের জীবন চলার পথে।

কেউ নিজ প্রচেস্টায় কিছু অর্জন/সাফল্য করতে পারলে-তা অন্যরা জেনে যেমন খুশী হন এবং নিজের ভিতরেও আত্মবিশ্বাস খুঁজে পেতে পারেন আর আমিও তেমন সফল লোকদের কথা বলে নিজে একধরনের সুখ অনুভব করি। শাহিন মল্লিক ঢাকার বিক্রমপুরের ছেলে। বিক্রমপুরের অনেক মানুষ ভাগ্যান্বেষণে জাপান, ইতালী সহ বিভিন্ন দেশেগিয়ে আর্থীক সাফল্য পেয়েছেন। যা দেখে ওখানকার বেশীরভাগ তরুণদের মনেই বিদেশে পাড়ি জমানোর একটা প্রবনতা কাজ করে এবং প্রচুর টাকা ব্যয় করে বিদেশে পাড়ি জমায়। কেউ সফল হয় কিন্তু বেশীরভাগই ব্যর্থ হয়।

বিদেশে গিয়ে প্রতিষ্ঠিত হবার জন্য শাহিন মল্লিকেরও সেই পরিকল্পনার ব্যত্যয় ঘটেনি। ওরা স্থায়ী ভাবে বিক্রমপুরের বাসিন্দা হলেও স্বপরিবারে বাস করতো পুরনো ঢাকার ইসলামপুর। বাবা কাপড়ের ব্যবসা করতেন। শাহিনের কয়েক বন্ধু ইতালী/জাপানে গিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শাহিনেরও বিদেশ যাবার জন্য পড়ায় মন বসেনা।

শাহিন মল্লিকের প্রবল ইচ্ছা-জাপান/ইতালী যাবে। এইস এস সি পাশ করেই ড্রাইভিং শিখেছে। ছেলের ইচ্ছা পুরন করতে বাবা তার কাপড়ের দোকান বিক্রি করে প্রায় ৮ লক্ষ টাকা এবং ফসলী জমি বিক্রি করে ২ লক্ষ মোট দশ লক্ষ টাকা শাহিনের হাতে তুলে দেন। ১৯৯৮ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হিসাব বিজ্ঞানে অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্র থাকাকালীণ ভাগ্যান্যেষনে আরো ছয় বন্ধুর সাথে “গলাকাটা পাসপোর্ট” নিয়ে দালালের হাতধরে জাপান যাবার জন্য পাড়ি জমায়। হংকং গিয়ে ধরা খায়।

দালাল ওদের হোটেলে রেখে সাথে থাকা টাকা-পয়শা নিয়ে পাল্টি মারে। কয়েক মাস পর অনেক কস্টে পাঁচ বন্ধু দেশে ফিরে আসে। শাহিন মল্লিকের বাবা যখন জানতে পারেন-ছেলে দালালের হাতে সব খুইয়েছে-বাবা হার্টফেইল করে মারা যায়। শাহিনের মা অন্য ৪ সন্তানদের নিয়ে বিক্রমপুর গ্রামের বাড়ি ফিয়ে যায়। সব শোনে, সব জানে শাহিন মল্লিক, কিন্তু দেশে ফেরার টাকা নেই।

দেশে ফিরেইবা কি করবে-দেশেতো জমি জিরেত কিছুই নেই। ৯/১০ লক্ষ টাকা খরচ করে জাপান যেতে ব্যর্থ শাহিন মল্লিক রাত কাটায়-‘যখন যেখানে যেমন’ অবস্থায়। সপ্তাহন্তেও একদিন পেটপুরে খেতে পারেনা। ধর্মভীরু শাহিন মল্লিক কপর্দক শুণ্য হয়ে জীবন বাঁচাতে একটি শুকর পালন ফার্মেহপার্ট টাইম কাজ নেয়। অবশর সময়ে হংকং যাওয়া বাংলাদেশী ব্যবসায়ী/পর্যটকদের ফুটফরমাস খাটে-সামান্য কিছু বখসিশের আশায়।

অত্যন্ত বিনয়ী শাহিন মল্লিক হংকং এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে থেকে পর্যটকদের ট্যাক্সী ক্যাব ঠিক করেদেয়, হোটেলে নিয়েযায়...ট্যাক্সি ক্যাব ড্রাইভারের নিকট থেকে কিছু কমিশন পায়, যে হোটেলে বোর্ডার নিয়েযায়-সেই হোটেল থেকে কিছু কমিশন পায় এবং পর্যটকেরাও খুশী হয়ে যাকিছু দেয়-“থ্যাকং য়্যু স্যার” বলে স্মীত হেসে নিয়ে নেয়। হংকং এয়ারপোর্টেই ওর সাথে প্রথম আমার দেখাহয়েছিল ৯৮ সনের জুন/জুলাই মাসে। অনেক বাংলাদেশী ব্যবসায়ীই ওকে টুকটাক হেল্প করে......। ১৯৯৮ ডিসেম্বর মাসে আমার সাথে ওর আবার দেখা হয় কাউলুন মসজিদে এশার নামাজ আদায় করার সময়। নামাজ শেষে আমার সাথে আমার হোটেলে চলে আসে-ডাইনিং এ খেতে খেতে শুনেছি উপরে উল্লিখিত ঘটনা।

ইতোমধ্যে শাহিন মল্লিক ইংরেজী এবং ম্যান্ডারিন/চায়নীজ বলাটা ভালই রপ্ত করে ফেলেছে! আমরা যারা নিয়মিত হংকং যাই-তেমন ব্যবসায়ীরা সকলেই শাহিন মল্লিককে চিনি/জানি এবং টুকটাক হেল্প করতে চেস্তা করি। ছোট খাট কাজ করেই হংকং-কাউলুন-কুনমিং করে কাটিয়ে দেয় বছর দেড়েক। ২০০০ সালে একদল বৃটিশ পর্যটক ওকে “গাইড” হিসেবে নিয়ে যায় কুনমিং। শাহিন কুনমিং গিয়ে দেখতে পায়-ওখানে হংকং থেকে অনেক বেশী উপার্জনের সুযোগ আছে। পর্যটক দলের সাথে ফিরে আসে হংকং।

কিছুদিন পর হংকং থেকে পাততারি গুটিয়ে চলে যায় কুনমিং। ওখানে গিয়েও পেশা হয়-বিদেশী ট্যুরিস্টদের গাইড-সেই সংগে নিজেও ট্যাক্সিক্যাব/ভ্যান পার্ট টাইম ড্রাইভ করে। “চায়না ইস্টার্ণ এয়ারলাইন্স” ঢাকা-কুনিমিং এয়ার রুট চালু করে। উদ্ববোধনী ফ্লাইট থেকে শুরু করে ৭ দিন পর্যন্ত চায়না ইস্টার্ন এয়ারলাইন্স বাংলাদেশের ২০০ জন ব্যবসায়ী, ১০০ জন সরকারী আমলা/বিশিস্টজন এবং শতাধিক মিডিয়া কর্মীদের ৩ দিন করে অনারিয়াম এয়ার টিকেট এবং থাকা খাওয়ার প্যাকেজ দিয়েছিল। আমরা কয়েক ব্যবসায়ী বন্ধুও ওই প্যাকেজ ট্যুরে অংশ নেই।

কুনমিং পৌঁছেই আমার দেখা পাই আমার অত্যন্ত স্নেভাজন শাহিন মল্লিকের। ঢাকা-কুনমিং এয়ার রুট চালু হবার সাথে সাথে কুনমিং এ প্রচুর পরিমান বাংলাদেশী ব্যবসায়ী এবং ট্যুরিস্টের যাতায়ত বেড়েযায়। এয়ার সেডিউলের কারনে বেশীর ভাগ যাত্রীদের/ব্যবসায়ীদেরকেই কুনমিং যাত্রা বিরতি করতে হয়। ২০০১ সনে আমার সাথে আবার শাহিন মল্লিকের দেখা। তারপর থেকেই কুনমিং এ আমি এবং আমার পরিচিত সব ব্যবসায়ীই শাহিন মল্লিকের গেস্ট! বাংলাদেশী যাত্রীরা কুনমিং সিটিতে একজন বাংলাদেশী যিনি চায়নীজ ভাষায় দক্ষ এবং কুনমিং শহরের সবকিছু চেনে, জানে-তেমন একজন শাহিন মল্লিককে পেয়ে অনেক স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন, নির্ভরতা খুঁজে পান।

এজকন যাত্রীর ১২/১৪ ঘন্টা হোটেলে থাকার জন্য যেখানে কমপক্ষে ২০০ আর এম বি লাগে সেখানে অনেক যাত্রীই হোটেলে থাকতে ইতস্তত করতেন। শাহিন মল্লিক অনেক ট্রাঞ্জিট যাত্রীদের নিজ ক্যাবে করে নিয়ে তার নিজের ভাড়াকরা ফ্ল্যাটে রাখেন, নিজের রান্না করা খাবার খাওয়ান, আবার ফ্লাইট টাইমে এয়ারপোর্ট পৌঁছে দেয়-যাত্রী চলে যাবার সময় ট্রাঞ্জিট প্যাসেঞ্জারগন খুশী হয়ে শাহিনের হাতে ২/১শ’ আর এম বি’র একটা লাল নোট ধরিয়ে দিয়ে যায়!শাহিন মল্লিক বেজায় খুশী!লাভ ফিফটি পার্সেন্ট! এবার শাহিন এটাকেই পেশা হিসেবে নেবার সিদ্ধান্ত নেয়। শাহিনের সুহৃদ কয়েকজন ব্যবসায়ীর নিকট থেকে পাঁচ হাজার ডলার শর্ট লোন নিয়ে শাহিন ওখানে একটি অত্যাধুনিক আবাসিক ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে গেস্ট হাউজ ব্যবসা শুরু করে। সাথে বাংলাদেশী খাওয়া। মাছে ভাতে বাংগালীরা বিদেশের মাটিতে বাংলায় কথা বলতে পারা, বাংলাদেশী রান্না খাবার খেতে পাওয়ায় এবং বাংলাদেশী স্টাইলে থাকার অমন সুবন্দোবস্ত পেয়েতো সোনায় সোহাগা অবস্থা!শাহিন মল্লিকের সেবার বিষয়টা বাংলাদেশী সকল ব্যবসায়ী এবং ট্যুরিস্টদের মাঝে ছরিয়ে পরতে সময় লাগেনি।

ইতোমধ্যে শাহিন মল্লিক তার এক কাজিন সহ আরো ৩/৪ জন বাংলাদেশীকেও কুনমিং নিয়ে যায়। কিন্তু নিয়মানুযায়ী ওখানে “ট্যুরিস্ট ভিসা”য় যাওয়া বাংলাদেশীরা তিন মাসের বেশী থাকতে পারেনা। কাজও করে অবৈধ হিসেবে। তখন ওরা চলে যায় হংকং। হংকং ৩/৪ দিন থেকে আবার তিন মাসের ভিসা বাড়িয়ে নিয়ে থাকতে হয় কুনমিং/চায়না।

বছর নাঘুরতেই শাহিন মল্লিক অমন ৩/৪ টা গেস্ট হাউজের মালিক! মাত্র দুই বছরের মাথায়ই বাংলাদেশ থেকে শিক্ষিত ২০/২৫ বেকার যুবক এবং বাবুর্চী নিয়ে পুরোদস্তুর গেস্ট হাউজ ব্যবসায়ী। ওর ব্যবসা আরো জমেছে-বাংলাদেশ থেকে রান্না/খাওয়ার সকল উপকরণ ইম্পোর্ট করে। ওর গেস্ট হাউজের নাম “অবশর বাংলা”। চায়না-বাংলাদেশ বিশাল বানিজ্যের কারনে অজস্র বাংলাদেশী চায়না ভ্রমনে যায়। শাহিন মল্লিক সেসুযোগ কাজে লাগায়।

“চায়না ন্যাশনাল ট্যুরিজম অথরিটি”তে জয়েনভেঞ্চার ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী ক্যাটাগরীতে এনলিস্ট হয়ে চায়নীজ পার্টনার নিয়ে চায়নার বিভিন্ন সিটিতে “গেস্ট হাউজ” ব্যবসা খুলে বসে-সাথে ঘরোয়া পরিবেশে খাবার হোটেল। বর্তমানে চায়নার বিভিন্ন সিটিতে ওর প্রায় ২৫ টা গেস্ট হাউজ আছে। শুধু বাংলাদেশ থেকেই প্রায় ২৬০ জন শিক্ষিত লোকের চাকুরীর সংস্থান করছে খোদ চায়নাতে। চায়নায় বিদেশী বিনিয়োগ নিয়মে “৭৫ ভাগ শ্রমিক/কর্মচারী চায়নীজ হতে হবে”-সেই নিয়ম নাথাকলে শাহিন মল্লিক একাই অন্তত ২০০০ জন বাংলাদেশীর কর্মসংস্থান চায়নাতে করতে সক্ষম হতেন। চায়নীজ ছারাও আরো কয়েকটি দেশের তরুণ/তরুণীদের চাকুরী দিয়েছে “চায়না-বাংলা ট্যুরিজম সিন্ডিকেটস” নামক লিমিটেড কোম্পানীতে।

সেইসব গেস্ট হাউজে এখন শুধু বাংলাদেশীরাই থাকেনা-প্রায় সব দেশের ইয়াং ট্যুরিস্টদের শস্তায় থাকার অপুর্ব সুযোগ চায়না জুড়ে “অবশর বাংলা”!শুধু ট্যুরিস্ট সার্ভিসের জন্য ‘চায়না-বাংলা ট্যুরিজম সিন্ডিকেটস” মালিকানায় এখন তিন শতাধিক ছোট বড় ভেহিকেল আছে। ভাবতেই পারেন-২৫ টি গেস্ট হাউজ, তিনশতাধিক ভেহিকেলের ব্যকয়াপ সার্ভিসের জন্য কি পরিমান লজিস্টিক সাপোর্ট প্রয়োজন হয়......। শাহিন মল্লিকের ব্যবসায়ীক প্রসার সম্পর্কে খুব সংক্ষিপ্ত ভাবে উল্যেখ করছি-বর্তমানে শাহিন মল্লিকের কর্পোরেট অফিস আছে হংকং, কুনমিং, সাংহাই, বেজিং, ক্যান্টন এবং নানজিং। সবগুলো অফিসেই শাহিন পালাক্রমে অফিস করে। শাহিন মল্লিক এখন ইস্টার্ণ চায়না এয়ার লাইন্স এবং সাউদার্ণ চায়না এয়ারলাইন্স এর “প্লাটিনাম ভি আই পি প্যাসেঞ্জার”! ব্যংক অব চায়নার “গোল্ড ক্যাটাগরী” ক্লায়ান্ট! সব থেকে বিস্ময়কর সংবাদ হলো-“চায়না ন্যাশনাল ট্যুরিজম অথরিটি” ২০০৯-২০১০ অর্থবছরে টুরিজম সেক্টরে(ক্ষুদ্র বিনিয়োগ ক্যাটাগরী বিভাগে)” চায়না-বাংলা ট্যুরিজম সিন্ডিকেটস”কে পুরস্কৃত করেছে।

চায়নার মত দেশে শাহিন মল্লিকের এখন অর্থ-বিত্ত, ক্ষমতা, সম্মান বেড়েছে-তাই বলে তাঁর বিনয়, ভদ্রতা, সৌযন্যবোধ মোটেই কমেনি!

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.