আমার কিন্তু স্বপ্ন দেখতে আজও ভাল লাগে ।
এক
শহরের সুবিশাল অভিজাত একটা সুপারস্টোরের সামনে গাড়ি পার্ক করলাম ।
সারি সারি র্যাকে সাজানো দেশি-বিদেশি জিনিস পত্রের আকর্ষণীয় পশরা, বাহির থেকেই দৃষ্টিগোচর হয় । সূই থেকে বারবিডল, কাঠবাদাম থেকে ফ্রোজেন মিট- সংসারে প্রয়োজনীয় সব জিনিসের বিপুল সমাহার । পছন্দ করে বাস্কেটে রাখা আর দাম মিটিয়ে গাড়ি করে নিয়ে আসা- আপনার ব্যস্ত জীবনে এতটুকু স্বস্তি দিতে এদের চেষ্টার কোন অন্ত নেই ।
তবু হাল ফ্যাশনের সুপারস্টোর আমাকে টানে না । বাঙ্গালীর চিরায়ত স্বভাব মতই টিপে টিপে দরদাম না করে জিনিস কিনে তৃপ্তি পাই না । ব্যস্ততা আর আলসেমীর মাঝেও নিয়মিত বাজার করা তাই অভ্যেস হয়ে গিয়েছে । আজ একটা বিশেষ ব্র্যান্ডের সয়াসসের খোঁজে এখানে আসতে হয়েছে ।
সুপারস্টোরের ভিতরে সুবিশাল ভান্ডার থেকে পছন্দের ব্র্যান্ড খোঁজে বেড়াচ্ছি ।
হঠাৎ পাশে এক ভদ্রলোকের দিকে দৃষ্টি পড়ল । স্মার্ট সুবেশি একজন মানুষ গভীর মনোযোগ দিয়ে র্যাকের জিনিসপত্র দেখছেন । উনাকে দেখে একটা পরিচিত অবয়ব চোখে ভাসছে, কিন্তু মেলাতে পারছিনা । বিব্রত হওয়ার শন্কা আছে, তবু আস্তে করে বললাম, 'স্লামালিকুম ফারুক ভাই' । সালাম পেয়ে তিনি আমার দিকে দৃষ্টি ফেরালেন ।
কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে চোখেমুখে আনন্দ ফুটিয়ে প্রায় চিৎকার করে বললেন, 'আরে সবুজ নাহ'!
হ্যান্ডশেক করতে এগিয়ে যেতেই ফারুক ভাই পরম আন্তরিকতায় জড়িয়ে ধরলেন । প্রায় বছর বিশেক পর দেখা । ফারুক ভাই আমার চার ইয়ার সিনিয়র, ইউনিতে আমরা হলমেট ছিলাম । এক সাথে টেবিল টেনিস খেলতাম । তিনি খুব আন্তরিক আর কেয়ারিং মনোভাবের ছিলেন ।
ফোরহ্যান্ড স্ম্যাশ আর বিচিত্র সব স্ক্র্যু শট উনার কাছ থেকেই শিখেছিলাম । আলাপে জানলাম তিনি বিভাগীয় পর্যায়ের একজন উর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা । বছর দুয়েক ধরে এই শহরে আছেন । আলাপচারিতা শেষে জানালেন সন্ধ্যার পর তিনি স্টেশন ক্লাবে থাকেন, অবসরে যেন দেখা করি ।
দুই
কোর্ট এলাকার নিরাপত্তা বেস্টনির ভেতর শহরের সবচেয়ে পুরাতন আর অভিজাত ক্লাব এটা ।
ব্রিটিশ আমলে রেল স্টেশন হওয়ার পর এই ক্লাবের গোড়াপত্তন । মুলত উর্ধতন সরকারি কর্মকর্তা আর শহরের রয়্যাল শ্রেনীর মানুষদের মিলিত আড্ডার জায়গা । ক্লাবের ওয়েটিং রুমে গিয়ে ফারুক ভাইকে কল দিতেই তিনি গার্ড কে ফোনে বলে দিলেন । গার্ড আমাকে ক্লাবের ভিতরে নিয়ে চললো ।
দুতলা ক্লাবের নিচতলায় একদিকে ক্যান্টিন আর বার, অন্যদিকে কনভেনশন সেন্টার ।
দুতলায় রিডিং রুম, জিমনেসিয়াম আর ইনডোর প্লে রুম । ইনডোর প্লে রুমে বেশ হইচই, টেবিল টেনিস আর ক্যারাম খেলা ঘিরে । শেষ রুমটা বেশ বড়, শুনশান । একদিকে কয়েকজন নিবিষ্ট মনে দাবা খেলে যাচ্ছে, অন্য দিকে তাস খেলার আয়োজন ।
কয়েকটা টেবিলে গোল হয়ে বসে তাস খেলা হচ্ছে ।
একটা টেবিল থেকে ফারুক ভাই উঠে এসে আমাকে রিসিভ করেন । প্লেয়ারদের পাশে একটা চেয়ার টেনে দিলে আমি বসে তাদের খেলা দেখতে থাকি ।
তিন
ইউনি লাইফে প্রচুর তাস খেলেছি । কানা শামীম ভাই আর আমি মিলে হলের ইনডোর কম্পিটিশনে একবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম, ইন্টারন্যাশনাল ব্রীজে । কিন্তু এখানে খেলা হয় কন্ট্রাক্ট ব্রীজ ।
ফারুক ভাই জানালেন, বড় বড় ক্লাব আর বিদেশি দূতাবাসের আড্ডা এই কন্ট্রাক্ট ব্রীজ কে ঘিরেই আবর্তিত হয় ।
ফারুক ভাইয়ের সুবাদে প্রতি সন্ধ্যায় ক্লাবে যাই । উনার পার্টনার হতে বেশি দিন লাগেনি । খেলাটার ধরণ ইন্টারন্যাশনাল ব্রীজের মতই । পার্থক্য হল কল এ ।
অকশন ব্রীজে (ইন্টারন্যাশনাল) যত কমে কল পাওয়া যায় তত ভাল, কিন্তু কন্ট্রাক্টে যত কল উঠবে তত বেশি পয়েন্ট । ফাইভ, সিক্স এমনকি সেভেন লেভেল পর্যন্ত কল উঠে যায় । কন্ট্রাক্ট ব্রীজ হল ফেক কল আর ট্রিক্সের খেলা ।
যেমন, আমার হাতে ছোটবড় দুটো স্যুট সহ বিশ পয়েন্ট আছে । আমি কল দিলাম ওয়ান নোটার্ম ।
ডানের বিপক্ষ প্লেয়ার একটা লম্বা স্যুট নিয়ে টু স্পেড । আমার পার্টনার একটা স্যুট সহ বেশ কিছু পয়েন্টস নিয়ে থ্রী হার্টস সাপোর্ট দিল । বাম পাশের বিপক্ষ প্লেয়ার পাস দিবার পর আমার কল ফোর ক্লাবস ।
খেলার মজাটাই এখানে, আমার ফোর ক্লাবস ডাকাটা কিন্তু ক্লাবসের স্যুট ছাড়াই । এটাকে বলে আসকিং কল, অর্থাৎ আমি জানতে চাচ্ছি পার্টনারের হাতে কয়টা টেক্কা আছে ।
পার্টনারের হাতে একটা টেক্কা থাকলে ডাকবে ফোর ডাইস, দুটোয় ফোর হার্টস, তিনটায় ফোর স্পেড আর চারটায় ফোর নোটার্ম । টেক্কার হিসাব নেয়ার পর কিং এর হিসাব নিতে কল দিব ফাইব ক্লাবস, এমনকি কুইনের হিসাবও নেয়া যায় সিক্স ক্লাব কল করে । এইভাবে পার্টনারের হাতের সব কার্ডের হিসাব বের করে ডিসিশন কল দেয়া হয় ।
চার
বিভাগীয় কমিশনার আর চেম্বার অব কমার্সের যৌথ উদ্যোগে ক্লাবে একটা ইনডোর গেমসের আয়োজন হয়েছে । সারা রাত ধরে গেমস চলবে ।
আমি আর ফারুক ভাই যথারীতি কন্ট্রাক্ট ব্রীজে নাম দিলাম । কয়েক রাউন্ড গেম জিতে ফাইনালে উঠে গেলাম । ফাইনালে আমাদের প্রতিদ্বন্ধি চেম্বার সভাপতি ইয়াজদানি সাহেব আর পুলিশের ডিসি-নর্থ এর জুটি ।
ইয়াজদানি সাহেব শহরে একজন সজ্জন মানুষ হিসাবে সুপরিচিত । অনেক বছর আগে উনাদের পরিবার পাটনা থেকে এই শহরে এসে বসবাস শুরু করেন ।
তিন পুরুষের তেজারতি সাফল্যের ধারাবাহিকতায় তিনি আজ শহরের সবচেয়ে বড় শিল্পপতি, প্রথম শ্রেনীর ঠিকাদার এবং একজন ফিলানথ্রপিস্ট । শহরে নিজের নামে, বাপ-দাদার নামে প্রচুর দাতব্য প্রতিষ্টান তিনি গড়ে দিয়েছেন ।
এতদিন ইয়াজদানি সাহেবকে দুর থেকে দেখলেও কথা বলার কখনো সুযোগ হয়নি । আজকে কন্ট্রাক্ট ব্রীজে ফাইনাল খেলার সুবাদে উনার কাছে বসতে পারলাম । প্রথমেই তিনি মজার মজার কথা বলে একটা অন্তরঙ্গ আড্ডার পরিবেশ তৈরি করে দিলেন ।
ডিসি-নর্থ গম্ভীর মানুষ, সম্প্রতি তিনি এ শহরে বদলি হয়ে এসেছেন ।
প্রথম চার ড্রিলেই দুটি গেম করে রাবার সহ প্রচুর পয়েন্ট আদায় করে নিল প্রতিপক্ষ । আমি একটু নার্ভাস ফিল করছিলাম । পরের ড্রিলে আমি কল পেয়েও পার্টনারকে খেলতে দিয়ে ডামি থেকে গেলাম । ফারুক ভাই ঠান্ডা মাথায় খেলে গেম আদায় করে নিলেন ।
নিজেরা গেম পাবার পর আমার আত্মবিশ্বাস ফিরতে লাগল ।
আমাদের একটা গেম থাকায় প্রতিপক্ষ 'ভালনারেবল' পজিশন থেকে কল দিচ্ছিল । আমার হাতে ভাল পয়েন্ট থাকার পরও পাস দিয়ে যাচ্ছিলাম । কিন্তু ফারুক ভাই একাই কল দিয়ে দিয়ে প্রতিপক্ষের কল সিক্সে নিয়ে গেল, আর আমি ডাবল দিই । ঐ ড্রিল থেকে হাজার খানেক পয়েন্ট নিয়ে এসেছি ।
ড্রিলে অপ্রত্যাশিত বড় একটা শর্ট খেয়ে ইয়াজদানি সাহেবের চেহারা দেখার মত হয়ে গেল । নাগিনা সিনেমার অমরেশপুরির মত চোখ বড় করে তিনি পার্টনারের দিকে অগ্নিদৃষ্টি বর্ষণ করলেন, আর ডিসি-নর্থ সাহেব মাথা নিচু করে কার্ডে শাপল দিতে থাকলেন ।
পরের ড্রিলগুলোতে প্রতিপক্ষ খুব ভালো খেলার চেষ্টা করে । কিন্তু রাতটা ছিল আমাদের, আমি হাতে প্রচুর ভাল কার্ডের সাপোর্ট পাচ্ছিলাম । আর ফারুক ভাই দুর্দান্ত খেলে যায়, বিশেষকরে তার ট্রিক্সগুলো ছিল অসাধারণ ।
সতের ড্রিলের খেলায় শেষ অবধি আমরাই জয়ী হলাম ।
পাঁচ
কম্পিটিশন গেমসে বিজয়ী হবার পর ইয়াজদানি সাহেব আমাদের সাথেই খেলেন । প্রায়ই তার পার্টনার বদল হয়, কোনদিন ডিসি-নর্থ সাহবে আবার কোনদিন নির্বাহি প্রকৌশলী সওজ । বর্ণাঢ্য চরিত্রের ইয়াজদানি সাহেবের প্রতি আমি এক ধরনের টান অনুভব করতে থাকি ।
কিন্তু তার সাথে খেলতে বসায় সমস্যাও আছে ।
কেউ না কেউ দেখা করতে আসে, খেলা বন্ধ রেখে তিনি তাদের সঙ্গে কথা বলেন । আমি অবাক হলাম, শহরের ডাকসাইটে রাজনৈতিক নেতা শরফুল সাহেব ইয়াজদানিকে খুব মেনে চলেন । মিনিস্টার ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করায় উনার অনুপস্থিতিতে শরফুল সাহেব সব কিছু দেখাশোনা করেন । মিনিস্টার সাহবের ডানহাত শরফুল শহরের ভবিষ্যত মেয়র প্রার্থী ।
আমার অবাক হওয়ার ব্যাপারটা লক্ষ্য করে ফারুক ভাই জানান, মিনিস্টারের ডানহাত আসলে ইয়াজদানি সাহেব ।
পর্দার আড়ালে থেকে তিনিই সবকিছুতে কলকাঠি নাড়েন । শরফুল সাহেব খেলার পুতুল । খেলাটা আরো ভালভাবে জমানোর জন্য ইয়াজদানি নাকি মাঠে নতুন পুতুল নামিয়েছেন । যুবনেতা ইসমাইল এখন শহরের রাজনীতিতে শরফুলের প্রতিদ্বন্ধি । রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রন-টেন্ডার সবকিছুতেই শরফুল এখন কোনঠাসা ।
ইয়াজদানি সাহেব শরফুলকে বলে দিয়েছেন, ইসমাইলের সাথে মিলে মিশে চলতে ।
মিলে মিশে চলার মাশুল শরফুল ভালই দিচ্ছে । টেন্ডার-টোল ইতিমধ্যে ইসমাইল দখল নিয়ে নিয়েছে । ইয়াজদানির অজান্তে শরফুল ব্যাপারটা মিনিস্টারের কানেও তুলেছিল, কিন্তু পাত্তা পায় নি । ইসমাইল এখন মিনিস্টারেরও প্রিয়পাত্র ।
একদিন খেলার মাঝখানে একটা ফোন পেয়ে ইয়াজদানি সাহেব বিরস বদনে ক্লাব ত্যাগ করেন । ফারুক ভাই ডিসি-নর্থের সাথে আলাপ করে যা জেনেছিলেন সেটা ছিল ভয়াবহ । দল ক্ষমতায় আসার পর শরফুলের হাত দিয়ে সব ইনকাম আসত ইয়াজদানির হাতে, সেখান থেকে মিনিস্টার । ইয়াজদানি ভাবলেন, সবকিছু ক্রমশ শরফুলের একক হাতে চলে যাওয়ায় যেকোন সময় সে নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যেতে পারে । এই আশঙ্কায় তিনি মাঠে নামান উদীয়মান যুবনেতা ইসমাইলকে ।
কিন্তু ইসমাইল এখন ফ্রাঙ্কেনস্টাইন হয়ে সবকিছু একাই গিলে খাওয়া শুরু করেছে । মিনিস্টার সাহেবের সাথে নাকি সে আলাদা রফাও করে ফেলেছে ।
অনিয়মিত হলেও ইয়াজদানি সাহেব ক্লাবে আসেন । তিনি চান না, তার রাজত্ব হারানোর ব্যাপারটা প্রচার পাক । প্রশাসন-পুলিশের সাথে তিনি সখ্যতা বজায় রেখে যাচ্ছেন ।
ইতিমধ্যে খবর এল, শরফুলের ক্যাডার বাহিনীর একটা বড় অংশ ইসমাইলের সাথে যোগ দিয়েছে । যুবনেতা ইসমাইল আয়োজিত সম্বর্ধনা সভায় মিনিস্টার সাহেব উপস্থিত হয়েছেন । মাননীয় মিনিস্টার এই প্রথমবার শহরে এসেও ইয়াজদানি সাহেবের সাথে কোন পরামর্শ করার প্রয়োজন বোধ করেন নি ।
ছয়
কিছুদিন ধরে ইয়াজদানি সাহেবকে ক্লাবে দেখা যাচ্ছে না । উনার রাজনৈতিক কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকা হয়ে গেছে ভেবে আমাদের আলোচনার গতি নতুন নতুন বিষয়ে মোড় নিয়েছে ।
আর এই অবস্থায় সাময়িক বিরতি কাটিয়ে তিনি আবার আমাদের মাঝে ফিরে এলেন । কিন্তু উনার অভিব্যক্তিতে কোন পরিবর্তন চোখে পড়ছে না, রাজ্যপাট হারানোর কোন চিহ্ন বা বেদনাও দৃশ্যমান নয় । শুধু বদল হয়েছে পার্টনার ।
ডিসি-নর্থ সাহেব বা নির্বাহি প্রকৌশলী কেউই ইদানিং ক্লাবে আসছেন না । ইয়াজদানি সাহেবের খেলার পার্টনার এখন অবসরপ্রাপ্ত পোস্টমাস্টার জেনারেল আব্দুল হাই সাহেব ।
তিনি এই শহরেরই মানুষ । এক সময় বাংলাদেশে ডাকবিভাগের দোর্দন্ড প্রতাপ ছিল, আর কৌশলী পরামর্শদাতা হিসাবে স্থানীয় রাজনীতিবিদদের কাছে হাই সাহেবের ছিল বিশেষ গুরুত্ব । সময়ের প্রয়োজনে ডাকবিভাগ গুরুত্বহীন হয়ে পড়ার সাথে সাথে বুড়িয়ে যাওয়া হাই সাহেবের কথাও সবাই এক সময় ভুলে গিয়েছিল । কিন্তু তাকে একজন মানুষ ভুলেন নি, ইয়াজদানি সাহেব । এই দুঃসময়ে ঘাগু ইয়াজদানি নির্ভর করেছেন এই অভিজ্ঞ প্রাক্তন খেলোয়ারের উপর ।
ব্রীজ খেলার বিরতিতে হাই সাহেব স্থানীয় একটি পত্রিকা মেলে ধরলেন । প্রথম পাতায় ঝকঝকে ছাপা ছবি, শহরে মিনিস্টার সাহেবের উন্নয়ন কাজের উদ্বোধন । মিনিস্টার সাহেবের পেছনে হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে আছে ইসমাইল আর শরফুল । সবার মুখই হাসি হাসি । হাসি হাসি ইয়াজদানি আর হাই সাহেবের মুখও ।
ফারুক ভাই তার অনুমান জানিয়ে দিলেন, শরফুলকে ইসমাইলের সাথে ভিড়িয়ে দেয়ার চালটা ইয়াজদানি সাহেবের ।
ক্লাবে একদিন সবাই খেলায় ব্যস্ত । সেখানে ঘুরতে এলেন প্রেসক্লাবের সভাপতি, দুজন সাংবাদিক সাথে নিয়ে । সবার সাথে হাত মিলিয়ে খোশ গল্প করে শেষে এলেন আমাদের টেবিলে । আমাদের সাথে সৌজন্যমুলক টুকটাক কথা বলে নিচে নেমে গেলেন ।
কিছুক্ষন পর হাই সাহেবকে সাথে নিয়ে ইয়াজদানিও নিচে নামলেন । ফারুক ভাইয়ের অনুসন্ধানী চোখ আন্দাজ করে নিল, নিচতলার বারে এখন হুইস্কির চুমুকে চুমুকে জটিল ব্লু-প্রিন্ট আঁকা হচ্ছে । মুখে বললেন, 'লোকাল পেপারে একটু চোখ রেখ' !
ফারুক ভাইয়ের আন্দাজ যে ভুল ছিল না, তা দুদিন পরেই বোঝা গেল । স্থানীয় পত্রিকায় ইসমাইলের দখলবাজি-চাঁদাবাজি নিয়ে বিশাল প্রতিবেদন এসেছে । সকালেই ইসমাইল খবর পেয়ে যায়, তার লোকজন হকারের কাছ থেকে সব পত্রিকা ছিনিয়ে নিয়ে পুড়িয়ে দেয় ।
রাত্রে তার ক্যাডার বাহিনী ঐ পত্রিকা অফিসে হামলা করে । অফিস ভাংচুরের পাশাপাশি কর্মরত কয়েকজন সাংবাদিককে মারধর করা হয় । রাতেই পুরো শহরে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে । সাংবাদিক ইউনিয়ন ঘটনার প্রতিবাদের পরেরদিন মানববন্ধন আহবান করে । মানববন্ধন না করতে ইসমাইলের ক্যাডাররা কড়া হুমকী দিয়ে যায় ।
খবরটা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে । স্থানীয় পত্রিকার পাশাপাশি জাতীয় পত্রিকাগুলোও ফলাও করে এই খবর ছাপে এবং 'মিনিস্টারের ছত্রছায়ায় ইসমাইলের চাঁদাবাজি-দখলবাজি' নিয়ে সিরিজ রিপোর্ট করে ।
সাত
ড্রিল শুরু করব, কিন্তু ইয়াজদানি সাহেব এখনো এসে পৌছান নি । ফারুক ভাই কার্ডে অনবরত শাপল দিয়ে যাচ্ছেন, আর দুজনেই হাই সাহেবের সার্ভিস লাইফের গল্প শুনছি । হাই সাহেবের কথা শুনতে ভালই লাগছে ।
পাকি পিরিয়ডে পাঞ্জাবী আর বিহারী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ট্রিক্স করে তিনি কিভাবে ডাকবিভাগে বুক ফুলিয়ে চাকরি করতেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় একজন বেলুচ মেজরের সহায়তায় কিভাবে তার প্রাণ রক্ষা হয়েছিল- ইত্যাদি ইত্যাদি । এমন সময় ইয়াজদানি সাহেব ক্লাবে এসে পৌছলেন ।
এমনিতে সব সময় ইয়াজদানি সাহেব ফতুয়া-পাজামা পড়েন । ফতুয়ার উপর একটা সুন্দর কাশ্মিরি শাল ভাঁজ করা থাকে । আজকে উনি স্যুট-কোট-টাই পড়ে এসেছেন ।
কোটের পকেটে একটা লাল রেশমী রুমাল ত্রিভুজ আকৃতি নিয়ে উঁকি দিচ্ছে । দীর্ঘদেহি উজ্বল ফর্সা রঙের ইয়াজদানি সাহেবকে পার্টি ড্রেস ক্লাবের সবচেয়ে আকর্ষনীয় ব্যক্তিত্বে পরিনত করেছে । সবার দৃষ্টি উনার হাসি খুশি মুখের উপর ।
ইয়াজদানি সাহেব প্রসন্ন চিত্তে কয়েক ড্রিল তাস খেলে উঠে পড়লেন । উনার কোন এক নিকটাত্মীয়ের বাসায় একটা পারিবারিক অনুষ্টানে যোগ দিবেন ।
পোস্টমাস্টার সাহেব ইয়াজদানির দিকে চোখ তুলে কন্ঠস্বর নামিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, গাড়ি এনেছ ? ইয়াজদানি মাথা নেড়ে বললেন, 'কাছেই প্রোগ্রাম রিক্সা নিয়ে যাব' বলেই প্রস্থান করেন । আমি ভাবলাম পোস্টমাস্টার সাহেবের লিফট দরকার হয়ত । উনাকে গাড়ি দিয়ে পৌছে দেয়ার কথা বলতেই নিঃশব্দে হাসলেন । 'আমি গাড়ি নিয়ে এসেছি' বলে কিছুক্ষন পর তিনিও উঠে চলে গেলেন ।
সে রাতে আমারও বাসায় কিছু জরুরি কাজ ছিল ।
তাই তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরেছি । রাত এগারটায় ফারুক ভাই ফোন দিয়ে বললেন কিছু শুনেছি কি না ! আমি বললাম কি ব্যাপারে ? তিনি ঠান্ডা গলায় বললেন, 'ইসমাইল ডেড! সামওয়ান শুট হিম ফ্রম ট্রিগার পয়েন্ট' !!
আট
শহর কয়েকদিন টালমাটাল অবস্থায় আছে । ইসমাইলকে কে খুন করতে পারে, তা কেউ ধারণা করতে পারছে না । শরফুল তার সাথে হাত মেলানোর পর প্রকাশ্যে ইসমাইলের শত্রুতা করার মত কেউ এই শহরে ছিল না । আইন শৃঙ্খলা বাহিনী, রাজনৈতিক নেতা-কর্মী এবং পুরো শহরবাসি কেউই কিছু সাসপেক্ট করতে পারছে না ।
স্থানীয়-জাতীয় পত্রিকা আর টিভি মিডিয়া এটা নিয়ে কয়েকদিন গরম নিউজ রিপোর্ট করে । তারপর আস্তে আস্তে এই ইস্যু মিইয়ে যেতে যেতে এক সময় সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে আসে ।
এর মধ্যে একটা সুসংবাদ এল । ফারুক ভাই পদোন্নতি পেয়েছেন । একটা জেলায় প্রশাসক হিসাবে খুব শীঘ্র তিনি যোগ দিবেন ।
তার ডিপার্টমেন্টের পাশাপাশি ক্লাব থেকেও একটা বিদায় সম্বর্ধনার আয়োজন করা হয়েছে । চমৎকার একটা বছর ফারুক ভাইয়ের সান্নিধ্যে কাটিয়েছি, তাই আমার মনটা ছিল খুবই খারাপ । বিদায় কালে অনেকটা আবেগাপ্লুত হয়েই একান্তে ফারুক ভাইকে বললাম, 'বস প্লীজ সে, হোয়াট এবাউট লাস্ট মিস্ট্রি' ??
ফারুক ভাই আমার কাঁধে হাত রেখে রহস্যময় হাসি দিয়ে বললেন, 'ইসমাইলের ব্যাপারে জানতে চাইছ তো! তোমাকে ট্রাস্ট করি । তোমাকে যা বলব, নিজের সেফটি'র কথা ভেবেই তা নিজের কাছে রেখো' !!
ফারুক ভাই যা বললেন তার সারমর্ম এরকম, রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ আর মিনিস্টারের ট্রাস্ট হারিয়েও ইয়াজদানির তেমন কোন ক্ষতি হয় নি । কিন্তু যেদিন অদৃশ্য মাদক সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণও ইসমাইলের হাতে চলে যায়, সেদিন ইয়াজদানির দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায় ।
পোস্ট মাস্টারের পরামর্শে তাই ইসমাইলকে সরিয়ে দেয়ার চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হয় । কিন্তু ইসমাইলকে শুট করার মত সাহসী কোন কিলার সে যোগার করতে পারেনি । আর তাছাড়া প্রফেশনাল কিলার এমনিতেই রিস্কি, ধরা পড়ে গেলে হড়হড় করে সবার নাম বলে দেয় ।
কেউ যেন সন্দেহ করতে না পারে, সেজন্য ঐদিন ইয়াজদানি তার এক নিকটাত্মীয়ের বাসায় এক প্রোগরামের আয়োজন করে । গাড়ি ব্যবহার করলে নাম্বারপ্লেট নিয়ে সমস্যা হতে পারে, তাই সে তার ছদ্মবেশি বডিগার্ডের রিক্সায় চড়ে রওয়ানা দেয় ।
একটা গোপন ড্রিল নিয়ে কথা বলার জন্য ইসমাইলের সেখানে আসার কথা ছিল । এলাকাটা ছিল ইসমাইলের ক্যাডার বাহিনীর কঠোর নিয়ন্ত্রনে, তাই নিরাপত্তা নিয়ে সে কোন শঙ্কা বোধ করেনি । কিংবা ইয়াজদানিকে নিয়ে সে হয়ত শঙ্কিত ছিল না । আর সেখানেই ইয়াজদানি পয়েন্ট বোরের সাইলেন্সর পিস্তল ইসমাইলের মাথায় ঠেকিয়ে গুলি করে । কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই ইয়াজদানি তার আত্মীয়ের বাসার প্রোগরামে এটেন্ড করে ।
পুরো ঘটনা শুনে আমি চোখ বড় বড় করে ফারুক ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছি । আমার মুখ থেকে অস্ফুট একটা শব্দ বেরুল, পুলিশ! পুলিশের তদন্ত!
ফারুক ভাই হেসে দিয়ে বললেন, 'এটাও বুঝ না! ইসমাইলের ডেড বডির কোন মুল্য নেই, মিনিস্টার-রাজনৈতিক নেতা-ক্যাডার-কর্মী কারো কাছে । তবু মিনিস্টার করুণা করে প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছেন ইসমাইলের খুনি যেই হোক, তাকে ধরে আইনের হাতে তুলে দেয়ার । আর পুলিশ নিয়ম মাফিক তদন্ত করতে গিয়ে কোন ক্লু বের করতে পারেনি । ইসমাইলের পরিবার থেকেও চাপ দেয়ার কেউ নেই ।
সো, ঘটনা এখানেই শেষ' !!
আমি কিছুই বললাম না । আমার কিছু বলারও নেই । শুধু অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম আমার কন্ট্রাক্ট ব্রীজ পার্টনারের মুখের দিকে ।
---------------সমাপ্ত----------------
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।