বিকট
সুসজ্জিত কামরার শীতাতপ নিয়ন্ত্রনকারী যন্ত্রের শীতল বাতাসেও লোকটা ঘামছিলো। তাকে নিরীক্ষণকারী রাশভারি এবং ক্ষমতাবান ব্যক্তিটি তার দিকে খানিকটা তাচ্ছ্যিল্যের দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো। তার ঘর্মাক্ত এবং উৎকন্ঠিত মুখের দিকে তাকিয়ে সে রতিক্রিয়ার আনন্দ পাচ্ছিলো। বেশ খানিকক্ষণ এরকম যুগপৎ আনন্দ এবং উৎকন্ঠার মুহুর্ত কাটানোর পরে ক্ষমতাবান ব্যক্তিটি ঘর্মাক্ত জনকে আরক্ত করার জন্যে বিশেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে শীতল স্বরে বলে,
" আপনার কি আমাদের কোম্পানির ওয়ার্কিং স্ট্যান্ডার্ড সম্পর্কে কোন ধারণা আছে?
" জ্বী স্যার আছে"
"তাহলে আমাকে বলুন এতদিন ধরে এখানে কাজ করার পরেও এই সাইট ম্যাপটাতে এত হিবিজিবি করেছেন কেন? এটা কি আপনার "যেমন ইচ্ছে লেখা কবিতার খাতা"?
ঘর্মাক্ত ব্যক্তিটি পূর্বে কবিতা লেখার পাপ করেছিলো এটা জানা থাকার ফলে ক্ষমতাশীল ব্যক্তিটি যুৎসই একটা খোঁচা দিতে পারে।
"স্যার, আমি এখনই ঠিক করে আনছি" লোকটার গা থেকে দরদর করে ঘাম নিঃসৃত হতে থাকে।
কিন্তু তাতে সুসজ্জিত কামরার দামী ডেস্কের বাহারী কলমদানী, দূর্লভ পেইন্টিং, বিদেশী ম্যাগাজিন কোনকিছুই ভেসে যায়না, সিক্ত হয়না। সস্তা ভীতু ঘামের শক্তি আর কতটুকু!
"এক ঘন্টার মধ্যে আমি সব নিট এ্যান্ড ক্লিন দেখতে চাই" আদেশ দিয়ে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে তাকে বিদেয় করে দেয় আরামদায়ক আসনে বসা ক্ষমতাধর। এই ধামকিটা লোকটার অনর্গল ঘাম নিঃসরণে প্রভাবকের ভূমিকা রাখে। সে মখমলে কার্পেটে ঘামের চিহ্ন রেখে প্রস্থান করে।
এক ঘন্টা পর।
"স্যার দেখুনতো এখন ঠিক আছে কিনা?"
"হুমম, মাচ বেটার। তখনকার রুঢ় আচরণের জন্যে দুঃখিত। আজকে সন্ধ্যায় শহরের নতুন পাঁচতারা হোটেলটায় একটা পার্টি আছে আমাদের, যাবেন নাকি?"
ঘর্মাক্ত ব্যক্তিটির না বলার সাহস হয়না। সে আরো ঘামতে থাকে। তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝতে পারে যে ওটা শুধুমাত্র বলার জন্যেই বলা ছিলো।
"আমাকে এখন উঠতে হচ্ছে, পার্টির সময় হয়ে এলো বলে। আপনার তো আজ আর কোন কাজ নেই। বাসায় চলে যেতে পারেন"
ঘর্মাক্ত ব্যক্তিটি দ্বিধায় পড়ে যায়, সে অপমানিত হবে, নাকি স্বস্তির শ্বাস ফেলবে। অবশ্য এই জটিল পরিস্থিতি থেকে সে সহজেই মুক্তি পায়। চোখের সামনে যখন দেখে যে তার উর্ধতন কর্মকর্তাটিও ঘামতে শুরু করেছে।
টেলিফোন।
"জ্বী...জ্বী স্যার..স্যার আসলে ব্যাপারটা হয়েছে কি...না স্যার এরকম হবেনা আর..."
প্রতাপশালী ব্যক্তিটির শরীর থেকে ঘামের বন্যা বয়ে যায়। সুনামির মত। এই ঘরে টেকাই দায় এখন। এ এক প্রবল ঘামোচ্ছাস! শক্তিশালী ঘামের স্রোত।
তবে এই ঘামই তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে বলে প্রথমিক্ত ঘর্মাক্ত ব্যক্তিটি কিছুক্ষণ ঘামকেলি করে নেয় সেখানে। দ্বিধাণ্বিত সে ব্যক্তিটি সারাদিনের ক্লান্তিশেষে বেশ প্রশান্তি অনুভব করে।
কর্মস্থল থেকে বেরুনোর সময় এলোমেলো সাইট ম্যাপ করা, তিরস্কৃত, ঘর্মাক্ত ব্যক্তিটি নিজের নাম খুঁজে পায়। একটি প্রাচীন মফঃস্বলী নাম। মোকসেদ।
মোকসেদ হাঁটতে থাকে বাসের উদ্দেশ্যে। ভীড় আর গরমে সে আবার ঘর্মাক্ত হয়ে ওঠে। একটু বিশ্রাম নেবার উদ্দেশ্যে একটি জাঁকজমকপূর্ণ বিপনীবিতানের ভেতরে গিয়ে ঢোকে। প্রথমেই চোখ পড়ে একটি সাবানের দোকানের দিকে। থরে থরে বিদেশী সাবান সাজানো রয়েছে।
"দেখুন স্যার, কোনটা পছন্দ হয়। আপনি তো ভীষণ ঘামেন, এই বিশেষ সাবানগুলো আপনাকে দেবে ঘাম এবং জীবাণু থেকে সুরক্ষা"
মৃদু হাসে মোকসেদ।
" না ঘামলে খাবো কি! ঘাম শুকিয়ে গেলে তো ঘাস খেয়ে থাকতে হবে। হাহা!"
নিজের রসিকতায় নিজেই উচ্চঃস্বরে হেসে ওঠে মোকসেদ। সেলসম্যান এহেন দার্শনিক কথাবার্তায় বিরক্ত হয়ে অন্যান্য খরিদ্দারের দিকে মন দেয়।
মোকসেদ ঘুরতে থাকে বিশাল এ বিতানে। ঘুরতে ঘুরতে শরীরচর্চা বিষয়ক একটি ক্লাবের সামনে এসে দাঁড়ায়। নানারকম উন্নত সরঞ্জাম দিয়ে সমাজের উচ্চস্তরের ছেলেরা ঘাম ঝরাতে ব্যস্ত। একটু কথা বলে কেমন হয় তাদের সাথে? এগিয়ে যায় মোকসেদ।
নীল শর্টস পরা এক সুঠাম দেহের অধিকারী, যে প্রাণপনে ডাম্বেল ভাঁজছিলো, তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করে,
"ঘাম ঝরানোর জন্যে এত কায়দা কানুন? দেখুন না আমি এমনিতেই কত ঘামি!"
"পুওর ইউ! আপনার মত মানুষদের তো দেখিই! ক্রমাগত ঘেমেই চলেছেন।
অফিসের বসের কাছে বকা খেয়ে ঘামেন, ভীড় বাসে বাঁদুড়ঝোলা হয়ে ঘামেন। ইনক্রমিন্টের চিন্তায় নির্ঘুম রাতে বিছানা ঘেমে ভেজান। সস্তা এবং নিম্নমানের ঘামাতুর আপনি। আমার অতসবের বালাই নেই। শরীর ঠিক রাখার জন্যে ঘামছি।
বাসায় গিয়ে ঘুমোবো আর ডিমপোচ খাবো। আপনি কয়টা ডিম খান দিনে?"
মোকসেদের শরীর শীতল হয়ে আসে। তার ঘাম শুকিয়ে যেতে থাকে। এতদিনের ঘর্মাবস্থ্যার বিপর্যয়ে সে বিচলিত হয়। তার শরীর শীতল হতে থাকে।
ঘাম নেই হয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পরে যদি আর না থাকে তখন? সে দৌড়ে একটি ফাস্টফুড দোকানের কাছে যায়।
"ঘামের জুস হবে? প্যাক করে নিয়ে যাবো"
"হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। একটু বসুন। "
তারা মোকসেদের শরীর চেপে ধরে থাকে আর বিশেষ একধরনের যন্ত্র দিয়ে ঘাম চিপে বের করে।
"এইতো হয়ে গেছে, নিন!"
"কত টাকা দিতে হবে"
"আসলে এটা আমাদের এক স্পেশাল অফার। টাকা দিতে হবেনা। আমরা সচরাচর টাকাই নিয়ে থাকি, তবে ইদানিং আপনার মত মানুষদের ঘাম সংগ্রহ করাটা এক বাতিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। আপনাকে যে এক লিটার ঘাম দেয়া হল, ও থেকে সামান্য কিছু আমাদের দিলেই খুশী হব। আমরা ঘামখেকো"
মোকসেদের যদিও ইচ্ছে হচ্ছিলোনা তার কষ্টার্জিত ঘাম ওদের দিতে।
এর চেয়ে টাকা দিলেই ভালো হত। তবে সে আর তর্কাতর্কিতে গেলোনা। বিপনীবিতানটা অশ্লীল আর ঠান্ডা হয়ে উঠছে। এখানে আর থাকা উচিৎ না।
মোকসেদ আবারও মিশে গেল রাস্তায়।
ভীড়ে। ঘরে ফেরার সময় হয়ে এসেছে। এসময় বাস পাওয়াটা বেশ ঝক্কির। রীতিমত বিপদজনকও। তবে তার সাদামাঠা নন এ্যাডভেঞ্চারাস জীবনে এটাকেই সে বেছে নিয়েছে বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে।
বাসের পাদানিতে কোনরকমে এক পা রেখে আর এক হাত দিয়ে হাতল ধরে রেখে ঝুলন্ত অবস্থায় চলতে চলতে সে ঘামবিষয়ক জটিলতা ভুলে যায়। বাসের মধ্যে এরকম আরো ঘর্মাক্ত মানুষ থাকার ফলে সে বেশ একটা একাত্মতাও অনুভব করে। আশেপাশের খিস্তিখেউর, মহিলা আসন বিষয়ক বচসা, ভাড়া নিয়ে তর্কাতর্কি ,এসব তাকে প্রশান্ত এবং ফুরফুরে করে তোলে। তবে পকেটে রাখা ঘামের বোতলটা ঠিকমত আছে কিনা বারবার পরখ করে দেখে। এটা না থাকলে বিপদে পড়তে হবে।
এই শহরে যানবাহনের আধিক্য এবং মন্থরগতির কারণে সচরাচর বড় দুর্ঘটনা ঘটেনা। ঘটলেও আক্রান্ত হয় নিরীহ পথচারী, অথবা রিকশা আরোহী। কিন্তু আজ রাস্তা অপেক্ষাকৃত ফাঁকা থাকার কারণে দিকবিদ্বীক হয়ে ছুটছে গাড়িগুলো। দুর্ঘটনার আগের মুহুর্তে মোকসেদ শুধুমাত্র একটা বিশাল ট্রাক দেখতে পেলো, তেড়ে আসছে মুখোমুখি।
রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে যাত্রীরা।
পুলিশ এবং ডাক্তারদের আগে পরিসংখ্যাবিদেরা উপস্থিত হয়েছে।
নিহত-৫
আহত- চল্লিশজনের মত।
শহরের ক্রমবর্ধমান দুর্ঘটনার গ্রাফ তৈরীতে এটা তাদের বিশেষ কাজে লাগবে।
মোকসেদক আহত হয়েছে ভীষণভাবে। গলায় কাঁচ ঢুকে গেছে।
পা টাও মচকে গেছে। আর কোথা থেকে যেন অবিরল ধারায় রক্ত পড়ছে। সে বেশ কষ্ট পেলেও এটা ভেবে খুশী হল যে সংখ্যাতত্বে তার নাম থাকবে।
অবশ্য শুধুমাত্র একজন আহত ব্যক্তি হিসেবেই। রক্তের হিসেব থাকবেনা সেখানে।
থাকবেনা ঘামের হিসাব। সে পকেটে রাখা ঘামের বতলটা নেড়েচেড়ে দেখে। নাহ, ঠিকই আছে। এখানে রক্তের চেয়ে ঘাম বেশি গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিদিন যত মানুষের শরীর থেকে রক্ত বের হয়, ঘাম বের হয় তার থেকে অনেকগুন বেশি।
সুতরাং মোকসেদ তার মহামূল্যবান ঘামের বোতলটি নিয়ে হাঁটতে হাঁটতেই বাসার দিকে রওনা হয়। রক্ত পড়ছে, পড়ুক। রক্তশূন্যতায় মরে গেলেই বা কি এসে যায়! মরে গেলে তো সব শেষই। এর চেয়ে বেঁচে থাকার মহামূল্যবান উপকরণ ঘাম'টা সংরক্ষণ করা দরকার।
তিনতলা সিঁড়ি বেয়ে উঠতে বেশ কষ্ট হয় তার।
এতক্ষণে অবশ্য রক্ত শুকিয়ে গেছে। গলায় বিঁধে থাকা কাঁচগুলো গিলে ফেলেছে। দরজা খুলে দেয় তার স্ত্রী। লাফ দিয়ে কোলে ওঠে তার ছোট্ট মেয়ে।
"বাবা, তোমাকে ক্লান্ত লাগছে কেন এত?"
"একটু লেবুর শরবত করে দেবো?" মোলায়েম কন্ঠে বলে তার স্ত্রী
আহ, ঘামের মূল্য!
"আমিতো প্রতিদিনই ক্লান্ত হয়ে আসিরে মা, তুই আজকে বুঝলি!"
মনে মনে ভাবে মোসাদ্দেক।
"লেবুর শরবত কত করে গ্লাস?" মুখ ফসকে বলতে গিয়েও নিজেকে সামলে নেয় মোসাদ্দেক।
"লেবুর শরবত দরকার নেই, আজ আমি অন্য একটা পানীয় এনেছি। ওটাই খাবো এখন"
মোসাদ্দেক তার পকেট থেকে ঘামের বোতলটা বের করে ঢকঢক করে গিলতে থাকে।
তার স্ত্রী আর মেয়ে মুগ্ধ এবং স্বপ্নালু চোখে মোসাদ্দেকের ঘামপান দেখে।
বোতলটি ছিলো স্বচ্ছ।
তার ভেতরে অনেক কিছু দেখা যায়। তাদের ভবিষ্যত, একজন সম্ভাব্য কর্পোরেট সুপারস্টার মোসাদ্দেক, বিদেশে হাওয়া বদল করতে যাওয়া... প্রভৃতি।
মোসাদ্দেক ঘামপান করে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এখনও অনেক ঘাম ঝরানো বাকি। পরে না হয় রক্ত, অশ্রু, বা বুকের জলপ্রপাত জাতীয় অন্য পানীয়গুলোর কথা ভাবা যাবে!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।