হিন্দু না ওরা মুসলিম ঐ জিজ্ঞাসে কোনজন, কান্ডারি বলো ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মা'র
আল-আন্দালুসের শুরুর দিকের দার্শনিক/বিজ্ঞানীরা গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা এবং রসায়নে যথেষ্ট সফলতা দেখালেও খাটি দর্শন চর্চায় ছিলেন অনেক পিছিয়ে। মোটামুটি আট শতক থেকেই পাশ্চাত্যের মুসলিম দুনিয়ায় অনেক জ্ঞানী গুনি মনীষির আবির্ভাব ঘটলেও সিনা-ফারাবি-রাজি মানের কোন মহামনিষির আবির্ভাবের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে ১১ শতক পর্যন্ত।
ইবনে বাজা
পরিচয় ও কর্মযজ্ঞঃ আন্দালুসিয়ান ত্রিমুর্তির প্রথম ব্যক্তি হিসাবে পরিচিত ইবনে বাজা জন্মগ্রহণ করেন আনুমানিক ১০৮৫ সালে, জারাগোসায়। তাঁর পুরো নাম আবুবকর মোহামদ বিন আল-শায়েখ। তিনি ছিলেন একাধারে জ্যোতির্বিদ, সঙ্গীতজ্ঞ, পদার্থবিজ্ঞানী, চিকিৎসক, উদ্ভিদ বিজ্ঞনী, কবি এবং দার্শনিক।
জারাগোসাতেই তিনি পড়াশোনা করেন এবং নিজের জ্ঞান গরিমার স্বীকৃতি স্বরূপ এক পর্যায়ে জারাগোসার তৎকালিন গভর্নর আবু বকরএর উজীর পদ লাভ করেন। খুব অল্প বয়সেই তিনি পাণ্ডিত্য এবং রাজনৈতিক উচ্চ পদ এই দুইই লাভ করতে সক্ষম হন। মুসলিম স্পেনে তখন চলছিল আল মোরাভিদ শাসনামল। ইবনে বাজা তার জীবনের একটা বড় সময়ই কাটিয়েছেন রাজনীতি আর বৈষয়িক বিষয় নিয়ে, এদিক থেকে তিনি ছিলেন তার পূর্বজদের চেয়ে একেবারেই আলাদা। সঙ্গীত, কবিতা, মদ আর রাজ অনুগ্রহ মিলিয়ে ত্যাগের বদলে ভোগের জীবন জাপনেই তিনি অভ্যস্ত ছিলেন বেশি, বিশেষ করে আবু বকর উযির থাকাকালিন অবস্থায়।
অথচ বৈষয়িক উচ্চাভিলাস সত্ত্বেও নিষ্ঠার সাথে তিনি দর্শন ও বিজ্ঞানে যে অবদান রেখে গিয়েছিলেন তা গড়ে দিয়ে গিয়েছিল ইবনে তুফায়েল আর ইবনে রুশদ এর ভবিষ্যতের কর্মকান্ডের ভিত্তি। তার সবচেয়ে কট্টর সমালোচকও তাকে অভিহিত করেছেন সময়ের সবচেয়ে প্রতিভাধর ব্যক্তি হিসাবে। তবে তাঁর অকালমৃত্যুতে তাঁর প্রতিভার সর্বোচ্চ বিকাশ এবং পরিণতি ব্যাহত করেছে। মৃত্যুকালিন সময়ে তাঁর বহু গুরুত্বপূর্ণ পুস্তকই ছিল অসম্পূর্ণ। ১১১৮ সালে খ্রিষ্টানদের কাছে জারাগোসার মুসলিম সরকারের পতন ঘটলে শুরু হয় ইবনে বাজার খারাপ সময়।
১১১৮ থেকে ১১৩৬ পর্যন্ত সময়কালে ইবনে বাজার জীবন সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায় না। তবে এই সময়কালের শুরুর দিকটায় তিনি একাধিক আলমোরাভিদ শাসকের দরবারে অবস্থান লাভের চেষ্টা করেন। কিন্তু তাঁর সমসাময়িক বেশ কয়েকজন প্রতিদ্বন্দ্বী এবং শত্রু তাঁর রচনার মৌল ইসলামের সাথে অসামাঞ্জস্যপূর্ণ অংশগুলোকে টার্গেট করে তাকে ধর্মবিরোধী, ইসলাম বিরোধী এহেন নানা অভিযোগে অভিযুক্ত করেন। এসময় তিনি বেশ কয়েকবার কারাবরণ করেন। ১১৩৬ সালে তিনি সেভিলে বসবাস করছিলেন বলে জানা যায়।
এই সেভিলেই ১১৩৮ সালে তাকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়, হত্যাকান্ডের জন্য দায়ী করা হয় সেই সময়ের একজন বিখ্যাত চিকিৎসক ইবনে জোহরকে।
অকালমৃত্যুর শিকার হলেও এই স্বল্প সময়েও তিনি ইকিৎসাবিজ্ঞান, জ্যামিতি, জ্যোতির্বিদ্যা, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, আল-কেমি ও দর্শন বিষয়ক বেশকিছু গ্রন্থ রচনা করেন। জ্যোতির্বিদ্যায় তিনি টলেমির বেশ কিছু ধারণার সমালোচনা করে ইবনে তুফায়েল এবং আল বিতরুজির ভবিষ্যত গবেষনার পথ সুগম করেন। আল বিতরুজি টলেমির সৌরজগতের ভূকেন্দ্রিক মডেলের সমালোচনা করেন যার মাল মশলা তিনি পেয়েছিলেন ইবনে বাজা’র কাছে। আর বিতরুজির সমালোচনা কোপার্নিকাসের সৌরকেন্দ্রিক মতামতকে অনুপ্রাণিত করে।
পদার্থবিদ্যায় বাজা অনেক দিক থেকেই ছিলেন গ্যালিলিও গ্যালিলি এবং আইজ্যাক নিউটনের পূর্বজ। গ্যালিলিওর গতিবিদ্যায় বাজার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে বাজা এবং গ্যালিলিও দুজনের গতির সংজ্ঞাই হুবোহু এক। নিউটনের গতিবিদ্যার তৃতীয় সূত্রের সবচেয়ে পুরাতন বর্ণনা খুঁজে পাওয়া যায় বাজা’র রচনায়। নিউটন অবশ্য প্রভাবিত হয়েছিলেন লাইবেনিজের মতবাদের মাধ্যমে আর সেইক্ষেত্রে লাইবেনিজের উপর ইবনে বাজার প্রভাব থাকতে পারে।
তবে গতিবিদ্যার এই ক্রমন্নোতির ইতিহাস খুঁজতে গেলে আমাদের একেবারে গোড়ায় এরিস্টটল পর্যন্ত পৌছতে হবে। তার সঙ্গীত বিষয়ক রচনা মধ্যযুগে ইউরোপে বিখ্যাত ছিল। এছাড়া যুতিবিদ্যা বিষয়ে কয়েকটি, আত্মা সম্পর্কে একটি, সক্রিয় বুদ্ধির সংগে মানুষের বুদ্ধির মিলন সপর্কে একটি এবং “নিঃসঙ্গের আচরণ ও বিদায়পত্র” নামক একটি গ্রন্থসহ দর্শন বিষয়ক বেশ কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেন। এর বাইরে তিনি পদার্থবিদ্যা, আবহাওয়বিদ্যা, প্রাণিবিদ্যা এবং এরিস্টটলের রচনাবলীর উপর বেশকিছু ভাষ্য রচনা করেন।
তবে তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত গ্রন্থের নাম “কিতাব আল নাবাত (বাংলাঃ উদ্ভিদ বিষয়ক পুস্তক)”।
এই গ্রন্থ মধ্যযুগীয় ইউরোপে উদ্ভিদ বিদ্যার উপরে সবচেয়ে প্রামাণ্য এবং জনপ্রিয় পুস্তক হিসাবে স্বীকৃত ছিল। এই পুস্তকে তিনি উদ্ভিদের লিংগ নির্ধারণ করেন।
ধর্ম ও দর্শনঃ ইবনে বাজা’র দার্শনিক অবদান পাশ্চাত্যের মুসলিম দর্শন চর্চায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্পেনিয় খলিফা আল হাকাম আরব ভূখন্ড থেকে যেসব দর্শন বিষয়ক রচনা স্পেনে নিয়ে যান তার বেশিরভাগই ছিল স্পেনের পন্ডিতদের জন্য জটিল এবং দুর্বোধ্য। পরবর্তিযুগে যেই অল্প কয়েকজন মনিষীর প্রচেষ্টা এসব গ্রন্থের সহজ ভাষ্য তৈরি হয় ইবনে বাজা ছিলেন তাদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয়।
প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী ইবনে বাজা তাঁর দার্শনিক মতামতের ক্ষেত্রে আল-ফারাবির দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। তবে, অধুনা এমন ধারণাও করা হয় যে, তিনি আসলে ফারাবির দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন না, ফারাবির চিন্তার সাথে তাঁর চিন্তার মিল আছে মাত্র। ফারাবির দ্বারা প্রভাবিত হন বা না হন বেশ কিছু দিক থেকে তিনি ফারাবিকেও অতিক্রম করেন। দর্শন চর্চায় এরিস্টটলকে বোঝার ক্ষেত্রেই তিনি সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ করেন। তাঁর এরিস্টটলের ভাষ্যগুলো পড়লেই বোঝা যায় যে এরিস্টটলই ছিল তাঁর ধ্যান জ্ঞান এবং এরিস্টটলকে তিনি আয়ত্ব করেছিলেন নিষ্ঠা এবং অনুরাগের সাথে।
বাস্তব সত্ত্বা বিষয়ক আলোচনায় অবশ্য তিনি তাঁর পূর্বজদের চেয়ে ব্যাতিক্রম ছিলেন। ফারাবি-সিনা যেমন বাস্তব সত্ত্বাকে একক হিসাবে গণ্য করেছেন সেইখানে ইবনে বাজা বাস্তবসত্ত্বার ক্ষেত্রে ছিলেন বহুত্ববাদী। তার মতে জড়, আত্মা এবং বুদ্ধি এই তিনটিই বাস্তবসত্ত্বা, সেই অর্থে এই তিনটিই অনন্তকাল ধরে বিরাজমান আছে, যা ছিল পুরোপুরি মৌল ইসলাম পরিপন্থী মতবাদ। তবে এর মধ্যে জড় নিজেকে চালিত করতে পারে না, আত্মা এবং বুদ্ধি জড়কে চালিত করে। আত্মার অবস্থান বুদ্ধি আর জড়ের মাঝখানে।
আত্মা স্বয়ংচালিত কিন্তু বুদ্ধি অচালিত। বুদ্ধি বিকারহীন এবং পরিবর্তনহীন, এর আকার ও শক্তি অনন্ত শ্বাশ্বত। ইবনে বাজা’র দর্শন চিন্তায় বহুগুনাবলী বিশিষ্ট সদা সক্রিয় “আল্লাহ”র কোন অস্তিত্ব নাই, তার দর্শনের সর্বোচ্চ অবস্থানে আছে নির্গুন, পরিবর্তনহীন এবং বিকারহীন “সক্রিয় বুদ্ধি”। মানব বুদ্ধি আর সক্রিয় বুদ্ধির মধ্যে গুনগত কোন পার্থক্য নাই। জড়জগতে বিরাজমান “মানব বুদ্ধির” সাথে “সক্রিয় বুদ্ধির” মিলনকেই মুক্তি এবং সর্বোচ্চ দার্শনিক লক্ষ্য হিসাবে উল্লেখ করে ইবনে বাজা।
তার মতে এই যোগাযোগ শুধুমাত্র মুষ্টিমেয় কিছু ব্যাক্তির পক্ষেই অর্জন করা সম্ভব, আপামর মানুষের জন্য নয়।
পক্ষ বিপক্ষঃ ইবনে বাজার জীবনকালে আল-আন্দালুসের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল অস্থিতিশীল এবং উত্তপ্ত। পাশ্চাত্যের মুসলিম রাজ্যগুলোর মধ্যে যেমন ছিল অন্তর্কলহ তেমনি ছিল ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে ওঠা খ্রীষ্টান আক্রমন। এটা ছিল এমন একটা সময় যখন মুসলিম স্পেন এবং উত্তর আফ্রিকার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দীদের অন্যতম অস্ত্র হয়ে ওঠে পরস্পরের ধর্ম বিরোধীতার অভিযোগ উত্থাপন করা। আর এসব ক্ষেত্রে ইবনে বাজার মতো দার্শনিক/বিজ্ঞানীরা ছিলেন সহজ টার্গেট।
এরিষ্টটলের নিষ্ঠাবান অনুসারী হওয়া, বহুত্ববাদী বাস্তবসত্ত্বার ধারণা প্রচার ইত্যাদি কারণে অল্প বয়সেই ইবনে বাজাকে ধর্ম বিরোধীতার অভিযোগে পরতে হয়। তবে জারাগোসার গভর্নর আবু বকরের অধীনে থাকাকালীন তাকে কোন সমস্যায় পরতে হয় নাই। তার সমসাময়ীক অনেক রাজনৈতিক এবং বৌদ্ধিক প্রতিপক্ষ ছিল। তার সমকালীন শ্রেষ্ঠ জীবনিকার হিসাবে খ্যাত ফাতহ ইবনে খাকান সেসময় কালাইদআল-ইকয়ান নামক সমকালিন কবি এবং কবিতার উপর একটি বিখ্যাত গ্রন্থ রচনা করেন যাতে প্রতিভাবান কবি হওয়া সত্ত্বেও ইবনে বাজার অবমূল্যায়ন করেনএবং সেইসাথে তাকে ধর্মবিরোধী বলে অভিযুক্ত করেন। জারাগোসার পতনের পর এবং পৃষ্ঠপোষকতাহীন হওয়ার পর থেকেই তার বিরুদ্ধে বারবার ধর্মবিরোধীতার অভিযোগ ওঠে, একাধিকবার তিনি কারাগারে আটক হন, চলে একাধিক হত্যা প্রচেষ্টা।
এসবের ধারাবাহিকতাতেই ১১৩৮ খ্রীষ্টাব্দে তাকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়। অভিযুক্তদের মধ্যে প্রথমেই যার নাম আসে, তিনি তৎকালিন বিখ্যাত চিকিৎসক ইবনে জোহর। নিজের গুরুত্বপূর্ণ বহুকাজ অসম্পূর্ণ রেখেই অকালে মৃত্যুবরণ করেন মুসলিম পাশ্চাত্যের ত্রিমূর্তীর প্রথমজন।
তবে নিজের ক্ষুদ্র জীবনেও ইবনে বাজা লাভ করেছিলেন জারাগোজার গভর্নর আবু বকরএর ঘনিষ্ট বন্ধুত্ব। সমসাময়িক শিষ্যদের মধ্যেও তাঁর ছিল গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব।
তাঁর শিষ্যদের মধ্যে আল ইমাম এবং ইবনে তুফায়েল পরবর্তি প্রজন্মে জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চায় নেতৃত্ব দেন। ভবিষ্যত প্রজন্মের মধ্যে ইবনে রুশদ, মায়মোনিডস, আল বিতরুজি, থমাস একুইনাস, গ্যালিলিও গ্যালিলি এবং আরো অনেকেই বিভিন্ন ভাবে ঋণী ছিলেন ইবনে বাজার কাছে।
পরবর্তি পর্বে থাকবে ইবনে বাজার শিষ্য এবং ইবনে রুশদের শিক্ষক ইবনে তুফায়লের জীবন এবং কর্ম নিয়ে আলোচনা থাকবে। মূলত ইবনে রুশদের মৃত্যুর সাথে সাথেই শেষ হয়ে যায় মুসলিম জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার স্বর্ণযুগ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।