লিখতে ভাল লাগে, লিখে আনন্দ পাই, তাই লিখি। নতুন কিছু তৈরির আনন্দ পাই। কল্পনার আনন্দ।
আমি অসম্ভব স্মৃতিশক্তিসম্পন্ন একটা ছেলে। আমার বয়স খুবই কম হলেও শুনে আশ্চর্য হতে পারেন, আমার সামনে এক ঘণ্টা ধরে কেউ বক্তৃতা দিয়ে গেলে সেটা আমি দু’দিন পরও হুবহু লিখে দিতে পারবো।
আমি বলে দিতে পারবো আপনি ঠিক এক সপ্তাহ আগে কী পোশাক পরে আমার সামনে এসেছিলেন কিংবা আমি কী দিয়ে লাঞ্চ করেছিলাম। অর্থাৎ আমি কিছুই ভুলে যাই না।
স্কুলে আমি সব বিষয়ে সেরা, বিশেষ করে অংক। কোন অঙ্ক করতে আমার দু’মিনিটের বেশী সময় লাগে না, যত কঠিনই হোক। উঁচু ক্লাসের অংক বই শেষ করে ফেলেছি, অনেকদিন হয়ে গেল।
অনেকেই আমার কাছে ফাঁকিবাজি করে দশ-বিশটা অঙ্ক করিয়ে নিয়ে টিচারদের কাছে বাহবা নিতে চেয়েছে, কিন্তু করার ধরণ দেখে টিচারেরা ঠিকই বুঝে ফেলেছেন যে ওগুলো আমার করে দেয়া, আর আচ্ছামত বকুনি দিয়েছেন!
কিছুদিন আগে আইকিউ পরিমাপের একটা পরীক্ষা দিয়েছি, তাতে আমার যা স্কোর, সেটা দেখে যে কারো আক্কেলগুড়ুম হয়ে যাবে। আমার বয়সী গড়পড়তা একটা ছেলে কিংবা মেয়ে আমার ধারে-কাছে নেই।
প্রথম প্রথম সবাই খুব আশ্চর্য হতো। বিস্ময়বালক সন্তান নিয়ে আমার বাবা-মাও খুশি। কানাঘুষা শোনা যাচ্ছে, আমাকে কিছুদিন বাদে “গিফটেড চাইল্ড” – দের ইস্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়া হবে।
এখানে সাধারণ ছেলেপুলেদের সাথে আমার পড়াশোনা করাটা নাকি ঠিক নয়।
সবকিছু যখন প্রায় ঠিকঠাক, তখুনি অঘটনটা ঘটলো। আর সেটা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের অঘটন।
এক সকালে পড়তে বসেই দেখি, কিছুতেই অঙ্ক মেলাতে পারছি না। অনেকবার কাটাকুটি করলাম, নতুন করে শুরু করলাম, উঁহু, কোন লাভ হল না।
ভয়ে আমার হাত-পা পেটের ভেতর ঢুকে যাবার দশা হল, এই মামুলী অংক পারছি না কেন? অথচ বাইনোমিয়াল থিওরেমের একটা ব্যাপারও তো কাল রাতে এক বড়ভাইকে বুঝিয়ে দিয়ে এসেছি! সামনে যে পরীক্ষা। এখন কী হবে?
নাক কুঁচকে মনে করার চেষ্টা করলাম, রাত্তিরে ঠিক কী নিয়ে বড়ভাইয়ের সাথে বাৎচিত করছিলাম। এমনিতে দেড় লাইনের উত্তরটা ঠিক ঠিক মনে পড়ার কথা, কিন্তু শুধু প্রথম টার্মটা বহু কষ্টে মনে করতে পারলাম, বাকীটা ঝাপসা ঠেকতে লাগলো।
আজব ব্যাপার! তবে কি ... ...
হঠাৎই মাথায় এক হাজার ওয়াটের একটা বাতি দুম করে জ্বলে উঠলো। আমি ঘরময় ডিগবাজি দিতে শুরু করলাম আর বিচিত্র আওয়াজে চিৎকার করতে শুরু করলাম।
আমার বাবা-মায়ের ছুটে আসতে সময় লাগলো না। আমার কাণ্ড দেখে তাঁদের চক্ষু চড়কগাছ। সুবোধ-শিষ্ট তাঁদের ছেলে, যে নাকের ওপর ভারী চশমাটা চাপিয়ে দিনরাত মুখ গুঁজে অঙ্ক করে আর জটিল সব থিওরেম প্রমাণ করে, সে কিনা ঠিক বাঁদরের মতোই ডিগবাজি দিয়ে যাচ্ছে!
অবশেষে যখন তাঁরা আমাকে ধরে-বেঁধে থামালেন, তখন আমি হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম, মা, আমার অসুখ সেরে গেছে! আমি এখন স্বাভাবিক একটা ছেলে!
অসুখ? হ্যাঁ, এই অসম্ভব প্রতিভা আমার জন্য একটা অসুখই ছিল। “বিস্ময়বালক” খেতাবটা আমার জন্য গর্ব ছিল না, বরং বুকের ভেতর একটা ভার হয়ে চেপে বসে থাকতো।
আমি কোনদিন আমারই সহপাঠী আব্রাহাম আর নেইলের মতো কাদায় গড়াগড়ি করে ফুটবল খেলতে পারি নি।
কোনদিন কারো সাথে একটু হেসে কথা বলতে পারি নি। কেউ আমাকে কোনদিন জিজ্ঞেস করে নি, তুমি কেমন আছ? দেখা হলেই সবাই শুধু আমাকে একরাশ সমস্যা ধরিয়ে দিত; বলতো, এগুলো একটু করে দাও না! কেউ আমাকে ডেকে পাশে বসায় নি, আমার জন্য আলাদা সীট বরাদ্দ ছিল। আমাকে নিয়ে গল্প করতো সবাই, কিন্তু যখন আমার দিকে তাকাত, সেটা বন্ধুত্বপূর্ণ দৃষ্টি বলে মনে হতো না; মনে হত, ওরা চিড়িয়াখানার কোন সুদর্শন প্রাণীর দিকে তাকিয়ে আছে, যাকে দেখা যায়, যার প্রশংসা করা যায়; কিন্তু ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না, বন্ধুত্ব করা যায় না। প্রবলেম সলভ করতে করতে বইয়ের পাতার মতোই খসখসে হয়ে উঠেছিলাম আমি, বাইরে এবং ভেতরে।
অথচ আজ? আজকের সকালটা একেবারে আলাদা।
এখন সবাই আমাকে নিজেদের একজন বলেই মনে করবে। আব্রাহাম আর নেইল আমার সাথে টিফিন শেয়ার করবে, আমাকে সত্যিকারের বন্ধু ভাববে। আমি ফুটবল খেলতে বেরুলে কেউ বাঁকা চোখে তাকাবে না। গাণিতিক কোন জটিল সমস্যা নিয়ে কেউ আমার কাছে আসবে না, বরং জিজ্ঞেস করবে আমি কেমন আছি। আমাকে আর গিফটেড চাইল্ডদের স্কুলে যেতে হবে না, সাধারণদের মধ্যে থেকেই বড় হবো।
শীঘ্রই স্কুল পাশ করবো, আর কে জানে, একদিন হয়তো কোন মেয়ে আমাকে ভালোও বাসবে!
একেবারে সাধারণ হয়ে থাকা, সাধারণদের মতোই হাসতে আর কাঁদতে পারা যে কি ভীষণ আনন্দের, তা এই গিফটেড চাইল্ডরাই শুধু বোঝে, যখন সে আর গিফটেড চাইল্ড থাকে না। যারা সাধারণ, তারা তো কখনোই বোঝে না যে তারা কত সৌভাগ্যবান।
মানুষ কিছু পেলে আনন্দ পায়, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ঈশ্বরের কি আশ্চর্য লীলা দেখুন তো, আমার আনন্দ হচ্ছে হারিয়ে। যে ক্ষমতা হাতে পেলে যে কেউ বর্তে যেত, সে ক্ষমতাটাই চলে গিয়ে আমাকে একেবারে নির্ভার-নিশ্চিন্ত করে দিয়েছে।
(১৬ আগস্ট, ২০১৩)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।