রাজনৈতিক সংকটের কারণে ঢাকার কূটনীতিকদের দূতিয়ালি আসন্ন। নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়ে সমঝোতা না হওয়ায় এটি হতে যাচ্ছে বলে মনে করছেন বাংলাদেশের সাবেক কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, কূটনীতিকদের দূতিয়ালি দেশের জন্য ভালো কিছু নয়। রাজনীতিবিদদের দৈন্যতার কারণেই কূটনীতিকরা এমন কাজে জড়িয়ে পড়ছেন বা জড়ানোর সুযোগ পাচ্ছেন। যদিও পাশের দেশ ভারতে কূটনীতিকরা রাজনীতি নিয়ে কোনো কথা বললে তখনই তাকে পত্রপাঠ বিদায় করে দেওয়া হয়।
জানা যায়, এক বছর ধরেই নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে সমঝোতার জন্য দৌড়ঝাঁপ করছেন বাংলাদেশে দায়িত্ব পালনরত বিদেশি কূটনীতিকরা। সংলাপের আহ্বান জানিয়ে বক্তৃতা, বিবৃতি দিয়েছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডবি্লউ মোজেনা, ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট গিবসন, কানাডার হাইকমিশনার হিদার ক্রুডেন, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের প্রতিনিধি দলের প্রধান উইলিয়াম হানা, ভারতীয় হাইকমিশনার পঙ্কজ শরণসহ কয়েকজন কূটনীতিক। তাদের মধ্যে পঙ্কজ শরণ ছাড়া বাকি সবাই বিভিন্ন বিষয় নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা জানিয়েই চলেছেন নিয়মিত। এরই মধ্যে ঢাকার কূটনৈতিক কোরের ডিনের নেতৃত্বে মুসলিম দেশগুলোর প্রতিনিধিরা সংলাপের একটি উদ্যোগও নিয়েছিলেন। এই দলটি বিরোধীদলীয় নেতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেও সংলাপ ইস্যুতে সাক্ষাৎ পাননি প্রধানমন্ত্রীর।
দূতিয়ালির বিষয়ে তখন সরকারের স্পষ্ট আপত্তিতে রীতিমতো ভেস্তে যায় সেই উদ্যোগ। যদিও মুসলিম একটি দেশের কূটনীতিক গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনের কাছে দাবি করেন, তাদের সেই প্রচেষ্টা এখনো অব্যাহত আছে। এ ছাড়া ঢাকা এসেছিলেন জাতিসংঘের রাজনীতিবিষয়ক সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো। সব দলের সঙ্গে আলোচনা, দৌড়ঝাঁপ করে সমঝোতার চেষ্টা চালান। তার পক্ষ থেকে কিছু ফর্মুলার প্রস্তাব থাকলেও হয়নি সমঝোতা।
সরকারের সঙ্গে কিছু বিষয়ে সরাসরি টানাপড়েন থাকায় প্রথম দিকে রাষ্ট্রদূত মোজেনা সংলাপ ইস্যুতে আহ্বান ও আলোচনার মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেন, নিজে সমঝোতার কোনো উদ্যোগ নেননি। রাজনৈতিক প্রায় সব বিষয়েই দেখভালের দায়িত্ব দেওয়া হয় তার ডেপুটি মিশনপ্রধান জন ড্যানি লুইসকে। অবশ্য পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মোজেনা এখন সরাসরি ভূমিকা নিয়েছেন। খোলাখুলি জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র যে কোনো ধরনের মধ্যস্থতায় রাজি। সর্বশেষ বিরোধীদলীয় নেতার সঙ্গে একটি রূপরেখা নিয়ে তার আলোচনাও হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর এক উপদেষ্টার সঙ্গে এ নিয়ে দেনদরবার চলার বিষয়টিও কূটনীতিকপাড়ায় আলোচনায় আছে। এ ছাড়া জামায়াতের সঙ্গে আরেকটি ব্যর্থ সংলাপেও জড়িয়ে আছে প্রভাবশালী এক কূটনীতিকের বাসভবন ও সরকারের এক উপদেষ্টার নাম। তবে কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, ২০০৫ সালের টুয়েসডে গ্রুপ এবং ২০০৭ সালের কফি গ্রুপের মতো এবার নির্বাচনের বিষয় বিশেষ ভূমিকা রাখতে যাচ্ছে ঢাকার ১৩ প্রভাবশালী কূটনীতিকের ফ্রেন্ডস গ্রুপ। গত মের শুরুতে গঠন করা এই গ্রুপে আছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত মোজেনা, ব্রিটিশ হাইকমিশনার গিবসন, ইইউ প্রতিনিধি দলের প্রধান ইউলিয়াম হানা, জার্মানির রাষ্ট্রদূত আলব্রেখট কনজে, কানাডার হাইকমিশনার হিদার ক্রুডেন, জাপানের রাষ্ট্রদূত শিরোশিমা, ইতালির রাষ্ট্রদূত গিয়োর্জিয়ো গুগলিয়েলমিনো, স্পেনের রাষ্ট্রদূত লুইস তেজাদা চেকন, সুইডেনের রাষ্ট্রদূত এনেলি লিন্ডা কেনি, নরওয়ের রাষ্ট্রদূত রাগনে বার্থ লান্ড, নেদারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত জারবেন জং, ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত মিখাইল ট্রিনিকুইর ও অস্ট্রেলিয়ার হাইকমিশনার গ্রেগ উইলকক। প্রভাবশালীদের মধ্যে এই গ্রুপে নেই চীনের রাষ্ট্রদূত লি জুন ও ভারতের হাইকমিশনার পঙ্কজ শরণ।
এই গ্রুপের প্রথম দুই বৈঠকে ভারতের হাইকমিশনার ও চীনের রাষ্ট্রদূত উপস্থিত থাকলেও শেষ পর্যন্ত আঞ্চলিক কৌশলগত কারণে তারা গ্রুপে যোগ দেননি। গ্রুপের মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন কানাডার হাইকমিশনার হিদার ক্রুডেন ও জার্মানের রাষ্ট্রদূত আলব্রেখট কনজে।
কূটনীতিকদের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড ও অতীত ইতিহাসের কথা বিবেচনায় রেখে পরিস্থিতি সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে অবিশ্বাস ও আস্থাহীনতা বিদেশিদের নাক গলানোর সুযোগ করে দেয়। তবে সামনেই জাতীয় নির্বাচন। সহিংসতার হাত থেকে দেশকে রক্ষা করতে বিদেশি মধ্যস্থতায় ভালো কোনো ফল আসতেও পারে।
এটি নতুন কিছু নয়। আমরা এর আগেও এমনটি দেখেছি।
সাবেক কূটনীতিক ফারুক চৌধুরী বলেন, আন্তর্জাতিক মহলের এই বিষয়টি যে আমাদের রাজনীতির অন্ধকারে আলোকবর্তিকা আনবে, তা মনে করি না। বরং দেশের একজন নাগরিক হিসেবে আমি লজ্জিত ও দুঃখিত। আমি অন্ধকার দেখছি।
এত বছর পরও বহিরাগতদের উপদেশ ও নির্দেশনা শুনতে হচ্ছে। এটি আমাদের সার্বভৌমত্বহানিকর বলে মনে করি। তবে কোনো উপায়ও দেখছি না_ উল্লেখ করে এই সাবেক পররাষ্ট্র সচিব বলেন, দুই দল যে অবস্থানে রয়েছে তা থেকে মুক্তিরও পথ দেখছি না। অথচ পাকিস্তানের নতুন প্রজন্ম কী চমৎকারভাবে নির্বাচন পদ্ধতিতে আমাদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাল। আমাদের ইতিবাচক রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার ঝুলি রয়েছে।
সেখান থেকে একটা উপায় বের করে কেন সমাধান করতে পারব না? অথচ সমাধান আমাদেরই করতে হবে এবং যে কোনো নির্বাচন সর্বজনগ্রহণযোগ্য হতে হবে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আরেক সাবেক উপদেষ্টা, সাবেক কূটনীতিক সি এম শফি সামি বলেন, সংলাপই সমঝোতার সবচেয়ে বড় উপায়। খোলা মনে খোলামেলা আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে পারস্পরিক সন্দেহ-অবিশ্বাস দূর করে শুধু নির্বাচন নয়, জাতীয় স্বার্থে আরও অনেক বড় ইস্যুতেও ভালো পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব। রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছা থাকলে সমঝোতা অসম্ভব নয়। সদিচ্ছা থাকলে আলাপ-আলোচনায় বসার জন্য পূর্বশর্ত বা মধ্যস্থতার প্রয়োজন হয় না।
তিনি বলেন, এর আগে এ ধরনের সংকট নিরসনে ১৯৯৫ সালে স্যার নিনিয়ান স্টিফেন এসেছিলেন জাতিসংঘের দূত হিসেবে। দেশের বাইরে থেকে দূত এসে দুই দলের মধ্যে সংলাপ করে গেছেন। সে সংলাপ সফল হয়নি। তিনি বলেন, সফল ও ফলপ্রসূ সংলাপের জন্য দুই দলের আন্তরিকতা যথেষ্ট। দেশের কল্যাণ ও গণতন্ত্র দুই বড় রাজনৈতিক দলের ওপরই নির্ভর করে।
এ কারণে কোনো পক্ষের কিংবা কোনো দূতের মধ্যস্থতা, দূতিয়ালি নয়; রাজনৈতিক দলগুলোর নিজ দায়িত্বেই সংলাপে বসা উচিত। দক্ষিণ আফ্রিকায় যদি সংলাপের মাধ্যমে তিন শতাব্দী ধরে চলমান সংকট নিরসন হতে পারে; আমাদের দেশে রাজনৈতিক দলগুলো কেন নিজেরা বসে আলাপ-আলোচনা করে দেশের কল্যাণে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না?
সাবেক রাষ্ট্রদূত আশফাকুর রহমান বলেন, ওয়ান-ইলেভেনে কূটনীতিকরা যেভাবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করেছিলেন বর্তমান প্রেক্ষাপটে তা সম্ভব নয়। বর্তমানে অবস্থা অনেক বদলে গেছে। এ ছাড়া সরকারও এখন অনেক সজাগ। বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের বাংলাদেশ সম্পর্কে অনেক উদ্বেগ রয়েছে।
কারণ তাদের বিনিয়োগ আছে আমাদের দেশে। তবে তাদের যদি কোনো বক্তব্য থাকে, মিডিয়ায় না দিয়ে, তা নিয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করতে পারে। সরকারের পক্ষ থেকেও অনেকবার বলা হয়েছে, বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে কূটনীতিকদের বলার কিছু নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. আমেনা মহসীনের মতে, রাজনৈতিক ব্যর্থতার কারণেই এখন বাইরের শক্তিগুলো এসে আমাদের এখানে হস্তক্ষেপ করছে। এটা কাম্য ছিল না।
কিন্তু এ ছাড়া আমাদের কাছে আর কোনো উপায়ও নেই। কারণ সংকট নিরসনে, দুই দলকে সংলাপে বসাতে, আমরা সুশীল সমাজ চিৎকার করতে করতে শেষ হয়ে গেলাম। কিন্তু তাদের বোধোদয় হয়নি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।