.
ফোনে ভেসে ওঠা নাম্বারটা দেখেই ভ্রু কুচকে ওঠে মিরপুর থানার ওসি মাহবুব হোসেনের। রাস্তার মোড়ে টানান ‘ পুলিশ আপনার বন্ধু- বিপদে ম্মরণ করুন ‘ এই বিল বোর্ড থেকে নিয়েছে বোধ হয়। প্রকাশ্যে টানানো থাকলেও সাধারণত কেউ ফোন করতে সাহস করে না। কিন্তু সকাল থেকে এই ছোকড়া আট-দশ বার ফোন দিয়েছে। বার বার একই কথা বলছে।
ফোন ধরে তিনি বুঝলেন, এবারও একই কথা।
‘একদম গরিব লোক ছিল স্যার। দিনমুজুরি করে চলতো । পার্টি ক্ষমতায় স্যার। তারপরও যদি কোন নেতা না আসে স্যার মানুষ কি বলবে বলেন ! এমপি আমাদের ফোন ধরে না স্যার।
আপনি বলেন স্যার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যেতে পারে। এলাকাবাসী খুব উত্তেজিত। স্যার আপনি চলে আসেন। এমপি সাহেবকে জানান যে এলাকাবাসীর দাবী তিনি এসে যাতে বাচ্চাগুলোর দায়িত্ব নিয়েছেন এই ঘোষনা দেন। ’
‘আপনার নাম কি ?‘
যুবকের কথার তুবড়ি থামিয়ে প্রশ্ন করেন মাহবুব হোসেন।
‘স্যার আমি এই এলাকার স্যার। স্যার আপনি বিরক্ত হবেন না দয়া করে। ’
‘ আচ্ছা , আপনি ফোন ছাড়ুন। ’
‘স্যার , গরমে স্যার, লাশ ফুলে উঠছে স্যার । মারা গেছে কাল রাতে।
এখন চারটা বাজে। জানাজা হবে এমপি সাহেব আসলে স্যার। আমরা লাইন দিয়ে দাড়িয়ে আছি স্যার। ’
‘আপনারা চেষ্টা করুন। আপনি বুঝতে পারছেন না, বিষয়টা আমার এক্তিয়ারের বাইরে।
খুন খারাবি হলে একটা কথা ছিল। ’
ও প্রান্তে আর কথা বাড়ানোর সুযোগ না দিয়ে লাইন কেটে দিয়ে বেসিনে মুখ ধুয়ে চেয়ারে বসে কলিং বেল টিপেন।
প্রায় মুহুর্তের মধ্যেই পাশের রুম থেকে এসে উদয় হন ডিউটি অফিসার।
‘ শোনো সবুজ, এমপি সাহেবের পিএসকে আর ফোন দিয়েছ ? কি বলেন তিনি ? এমপি সাহেব আসবেন ? না আসলে ফোর্স পাঠিয়ে লাশ দাফন করতে তাগদি দাও ওদের। রাজি না হলে পোষ্ট মর্টেমের ভয় দেখাও।
’
‘জি স্যার। এখুনি ব্যবস্থা করছি। পি এস সাহেব জানিয়েছেন স্যারের স্বাস্থটা একটু খারাপ। ভাল বোধ করলে আসবেন। ‘
‘আচ্ছা, বুঝতে পারছি।
তুমি ফোর্স পাঠাও। ’
ফোনটা আবার বেজে ঊঠলে মেজাজটা চরমে ঊঠে যায় অসির। কিন্তু, ধমক দেয়ার আগেই কথা শুরু করে দিয়েছে যুবকটি।
‘স্যার আপনি এমপি সাহেবকে জানান লোকজন রাস্তা বন্ধ করে দেবে। গাড়ি চলবে না।
তাকে তাড়াতাড়ি আসতে বলেন স্যার। এলাকার বদনাম হয়ে যাবে স্যার। এমপি সাহেব অপমান হবেন। ’
ওসি কোন কথা বলার আগেই ফোনের লাইন কেটে যায়।
‘ ওখানে ঝামেলা হবে সবুজ দ্রুত ফোর্স পাঠাও।
’
আবারও ফোন বেজে উঠলে এবার আর নিজের উপর নিয়ন্ত্রন রাখা মুস্কিল হলো ওসি মাহবুব হোসেনের।
‘স্যার বাচ্চাগুলোর কান্নায় আল্লার আরস কাইপ্পা উঠছে স্যার। ওরা খাটের পাশে গড়াগড়ি করছে। কেউ চোখে পানি রাখতে পারছে না স্যার। আপনি শোনেন স্যার ... একটু লাইনে থাকেন স্যার ... ’
ওসি ছেলেটিকে থামানোর চেষ্টা করেন।
কিন্তু সে ফোন কান থেকে সরিয়ে হাতে নিয়ে হাঁটছে মনে হয়। অষ্পষ্ট তার তাড়াহুড়া ভরা কণ্ঠ শোনা যায়। এই সরেন সরেন... । লোক জনের উত্তেজিত কণ্ঠও ভেসে আসে কানে। স্যার শুনেন...
মেজাজ খারাপ করে লাইন কেটে দেন ওসি সাহেব।
ছেলেটা মাথা ধরিয়ে দিয়েছে একে বারে। অস্থির লাগছে। ইন্টরকম টিপে ডিউটি অফিসার সবুজ আনোয়ারকে রুমে আসতে বলেন।
‘কি হয়েছে বলো তো। ঘটনার খোঁজ নিয়েছো কিছু ?’
‘হ্যাঁ স্যার।
মারা গেছে হাসপাতালে। নাম রহিম মিয়া। বয়স ত্রিশ। পার্টি র মিছিল মিটিংয়ে যেত। সেরাতে আড়াইশো টাকা চুক্তিতে পার্টির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর ব্যানার লাগাচ্ছিল ।
গোল চক্করের মাঝের গাছ থেকে পরে আহত হবার পর ঢাকা মেডিক্যালে নিয়ে যায় ওদের পার্টির লোকরাই। কাল রাত তিনটা ত্রিশের দিকে মারা যায়। গোলারটেক বস্তিতে থাকতো। গ্রামের বাড়ি রাজবাড়ি। খোঁজ না পেয়ে তার স্ত্রী থানায় এসেছিলেন।
সে মারা যাওয়ার পর হাসপাতাল থেকে থানায় ফোন দিয়েছে। ভর্তির সময় সাথের লোকরা বস্তির ঠিকানা লিখে রেখেছিল। এস আই রমিজ সেহেরীর পর টহলের সময় তার পরিবারের কাছে খবর দিয়ে এসেছে। ’
ফোনটা বেজে ওঠে আবার ।
‘শোনেন স্যার... ‘
ফোন কানে ধরে স্তম্বিত হয়ে যান ওসি মাহবুব হোসেন।
‘বাবাগো আমারেও সাথে লইয়া যাও। ’ বারবার বলে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে পাঁচ-ছয় বছরের একটা শিশু। রহিমের বড় মেয়ে বোধহয়। আরো কয়েকজনের বিলাপের শব্দ কানে আসে।
মনটা ভীষন খারাপ হয়ে যায়।
ফোন বন্ধ না করেই কান থেকে নিচে নামিয়ে রাখে। কি যেন বলছে ছেলেটা এখনো। এক সময় অস্পষ্ট শব্দ বন্ধ হয়ে যায়।
‘ঠিক আছে সবুজ তুমি যাও। ‘
‘স্যার কিছুক্ষণ আগে বস্তির লোকজন রাস্তা আটকে ছিল।
আমরা পৌঁছার আগেই স্থানীয় লোকজন ওদের লাঠি সোটা নিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছে। ’
‘এরা কারা ?‘
‘পার্টির লোকই স্যার। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হতে পারে টের পেয়ে আগেই তৈরী হয়ে ছিল। আপনি চিনবেন স্যার জসিম ভাইয়ের ছেলেরা সামাল দিয়েছে। ‘
‘আচ্ছা,ঠিক আছে।
ড্রাইভারকে গাড়ি লাগাতে বলো। ’
ওসি গোলার টেক পৌঁছতে পৌঁছতে রহিম মিয়ার জানাজা শেষ হয়ে গিয়েছে। পঞ্চাশ-ষাটজন জন লোক খাটিয়া নিয়ে যাচ্ছে। পুলিশের গাড়ি আসছে দেখে কয়েকজন দৌড়ে গলিতে ঢুকে গেল। এরা রাস্তা বন্ধ করেছিল বোধ হয়।
মাহবুব হোসেন এগিয়ে জিজ্ঞেস করেন রহিমের স্ত্রী , ‘বাচ্চারা কোথায় ?‘
ভীড় থেকে এক বুড়ো জবাব দেন,‘ওরা গ্রামের বাড়ি রওনা হয়ে গেছে। ’
‘আমাকে ফোন করেছিলেন কে ?’
কেউ জবাব দেয় না। একে অপরের মুখের দিকে তাকায়। সবার মুখের দিকে তাকিয়ে এদের কেউ তাকে ফোন দেয়ার সাহস রাখে বলে মনে হলো না।
সারা দিন যে নাম্বার থেকে ফোন এসেছে তাতে ফোন দিলেও কেউ ধরে না।
এক বার ধরে এক জন জানালেন এটা গোলার টেকের একটা ফোন ফ্যাক্সের দোকান।
রচনা:০৯ /০৯ /১০ ইং
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।