আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

টমাস মান-এর ব্ল্যাক সোয়ান এর অনুবাদ (২য় কিস্তি)

আমি আমার পৃথিবীর রাজা

(১ম কিস্তি) ‘তাৎপর্যময়, সত্যিই তাৎপর্যময় ! এতে কোনো সন্দেহ নেই’ রোজালি বলেন। ‘প্রফেসর জামসটেগেরও এটা খুব ভালো লাগবে। তোর এ স্টাইলটা তিনি খুব পছন্দ করেন। আসলে তার ছবি চেনার চোখ আছে। এমন ছবি বোঝার মতা সবার থাকে না।

কী নাম রেখেখিস এটার ?’ ‘সান্ধ্য বাতাসে গাছ’। ‘হ্যাঁ, এ নামটা শুনলে বিষয়বস্তু কিছুটা বোঝা যায়। ধূসর হলুদাভ পটভূমিতে ঐ কোণ আর বৃত্তগুলো কী গাছ ? আর ঐ অদ্ভুত সর্পিল রেখাগুলো বাতাস, তাই না ! মজার তো, আনা, খুব মজা লাগছে ! কিন্তু মামণি, এত সুন্দর প্রকৃতিকে তুই কী করেছিস ? এত যুক্তি দিয়ে ছবি আকার দরকার কী ? মন থেকে এবার একটা কিছু আঁকÑ জীবন্ত কিছু, ফুলের মতোÑ লাইলাক ফুলের গন্ধ ছড়াবে। এত জীবন্ত যে লোকে ঘ্রাণ নিতে চাইবে। ফুলদানির দুপাশে দুটো মানুষের ছবিও আঁকবি।

এক ভদ্রলোক এক মহিলাকে ফাইং কিস দিচ্ছেÑ এমন। আর টেবিলের ওপর ফুলদানি, ফুল ও যুগলের ছায়া ফেলতে হবে...। ’ ‘থামো তো মা ! তোমার কল্পনাশক্তি দিনকে দিন বেড়ে যাচ্ছে। কেউ এখন এমন ছবি আঁকতে পারে না। ’ ‘আনা, এভাবে না করিস না।

তোর মেধা দিয়ে এমন একটা ছবি কি তুই আঁকতে পারিস না ! মন থেকে আঁকা কোনো ছবি !’ ‘মা, তুমি আমাকে ভুল বুঝছো। আমি এমন আঁকতে পারি কিনা, সেটা কথা না। আসলে এমন ছবি কেউ আঁকতে পারে না। সময় ও শিল্প এখন এমন ছবি চায় না। ’ ‘ধ্যাত, সময় আর শিল্পের ধার ধারতে কে বলেছে ! না, আসলে এ কথা বলতে চাইনি।

জীবন ও অগ্রগতি যদি একে স্বীকৃতি দেয় তাহলে তো অনুতাপের কিছু নেই। অন্যের থেকে দূরে থাকাটাই অনুতাপের। আমি এটা বুঝতে পারছি। এও বুঝতে পারছি এমন একটা ছবি আঁকার জন্য তোর মতো জিনিয়াস দরকার। এ ছবি সরাসরি অর্থবহ না হলেও এর ভেতরে দারুণ তাৎপর্য আছে’।

আনা তার মাকে চুমু খেয়ে জড়িয়ে ধরে। হাতের ভেজা তুলিটা দূরেই রাখে। রোজালিও মেয়েকে চুমু খায়। মনে মনে তিনি খুব খুশি মেয়ে আঁকার মতো একটা ছবি খুঁজে পেয়েছে। বিমূর্ত হলেও প্রাণ থাকবে এ ছবিতে।

ফ্রলেইন ভন টুমলারের মনের গোপন দরজাটা খুলে গেল। এ ঘরে বাসা বাধে রঙিন স্বপ্ন। একদিন বিপরীত লিঙ্গের কেউ এসে সাদরে গ্রহণ করবে তাকে। তার পায়ের খুঁতকে পরোয়া করবে না সে প্রেমিক। দরজাটা আপনাতেই বন্ধ হয়ে যায় আবার।

স্বপ্নটা কুঁড়ি অবস্থাতেই ঝরে যায়। একবার বাড়ি পাল্টানোর পরপরই সে প্রেমে পড়েছিল। অবশ্য মনে মনে খুব দুঃখও পেত এ কারণে। তার প্রেমের বস্তুটা ছিল সুদর্শন এক পুরুষ, রসায়নবিদ। বিজ্ঞানকে দ্রুত টাকায় রূপ দেয়াকে জ্ঞানী লোকের কাজ মনে করত সে।

ডক্টরেট করার পর ডুসেলডর্ফের রাসায়নিক কারখানার হোমড়া-চোমড়া বনে গেল সে। তার সৌন্দর্য ও সাফল্যে পুরুষরাও হিংসা করত। আর মেয়েরা, তারা এ পাত্রের সান্নিধ্যে আসতে পাগল ছিল। বৃদ্ধা-যুবতি সবাই তার চারপাশে ঘুরঘুর করত। আনাও তাদের মতোই হতাশ বোধ করত।

তবে আত্মমর্যাদার কারণে কখনো ওই ছেলের ধারে-কাছে যায়নি সে। তো, সেই আকর্ষণীয় পাত্রের নাম ড. ব্র“নার। লোকে তাকে বাস্তববাদী ও উচ্চাকাক্সী বলেই জানে। সব সময় উপরের দিকেই তার দৃষ্টি। একবার শিল্প-সাহিত্য সমাজে ফ্রলেইন ভন টুমলারের সঙ্গে কথা হয়েছিল তার।

তাকে নিয়ে মেয়েদের উন্মাদনাকে ব্যঙ্গ করেছিল সে। সেই উন্মাদনার বাইরে আনার মতো বুদ্ধিমতি মেয়ের সঙ্গে কথা বলে ব্র“নার খুব খুশি। অন্য মেয়েদের ব্যঙ্গ করায় আনা খুব খুশি হয়েছিল। কিন্তু নিজের ভালো লাগার কথা বলে ব্র“নারের বিরক্তিতে পরিণত হতে চায়নি অন্য মেয়েদের হাত থেকে বাঁচতে আনার সঙ্গই নিরাপদ মনে হয়েছিল ব্র“নারের। ব্র“নারের প্রতি টানটা আনার তখনো ছিল।

তবে ব্র“নারের পুরুষালি আকর্ষণের কাছে নিজের দুর্বলতাকে সম্পূর্ণ করা পছন্দ হয়নি আনার। ব্র“নারের কথা ভেবেই মধুর বেদনায় দিন কাটত তার। এখনো সে ভাবে ব্র“নার কখনো মুখ ফুটে বললে সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যাবে। কিন্তু শব্দটা খুব দুষ্ট। কিছুতেই ব্র“নারের মুখ থেকে বের হতে চাইছে না।

ব্র“নারের উচ্চাকাক্সা আনার খুঁতকে ছাপিয়ে যেতে পারেনি। ভালো মানের যৌতুকও এর কাছে তুচ্ছ। শিগগির আনার কাছ থেকে সরে গিয়ে এক শিল্পপতির ধনী কন্যাকে বিয়ে করবে সে। শ্বশুরবাড়ি বোকামেই স্থায়ী হবে ব্র“নার। শ্বশুরের কেমিক্যাল কোম্পানি চালাবে।

ডুসেলডর্সের মহিলা সমাজ খুবই দুঃখ পাবে তার চলে যাওয়ায়। আনাও মুক্তি পাবে। রোজালি মেয়ের এ কষ্টের কথাটা জানেন। পরে হলেও জানতেন। মায়ের কোলে আনাই একদিন কেঁদে বলেছিল নিজের যন্ত্রণার কথা।

এক আবেগের মুহূর্তে প্রকাশ করেছিল একথা। এটা আনার কাছে পরে লজ্জাকর মনে হয়েছিল। ফ্র ভন টুমলার চালাক মহিলা না হলেও আগে থেকেই অনেক কিছু বুঝতে পারতেন। মুখরোচক ব্যাপারগুলো নয়, নারী মনের সমবেদনার কথাগুলোই তিনি বুঝতেন। নিজের গন্ডির ভেতর এমন ঘটনাগুলো খুব কমই তার নজর এড়াত।

বেখেয়াল, মৃদু হাসি, লজ্জায় রক্তিম গাল আর চোখের ঝিলিক দেখেই তিনি বুঝে ফেলেন সব। কোন মেয়েটা কোন ছেলের প্রেমে পড়েছে তাও বের করে ফেলেন অনায়াসে। সেই হিসাব থেকেই মেয়ের কাছে কথাটা পেড়েছিলেন। আনার তখনো বলার ইচ্ছা ছিল না। স্বভাবতই রোজালি বুঝে ফেলেন কোন মহিলা বিয়ের পর সুখী হয়েছে নাকি হয়নি।

কখনো এতে আনন্দ পান, কখনো দুঃখও হয় তার। প্রাথমিক পর্যায়েই গর্ভাবস্থা চোখে পড়ে তার। এতে আনন্দও পান তিনি। মজা করে বলে ওঠেন ‘কিছু হতে চলেছে’। আনা ওর ছোট ভাইয়ের খুব দেখাশোনা করেছে।

ছেলেটা তখন মাধ্যমিক স্কুলে পড়ত। ওর বাড়ির কাজ, পড়াশোনা সবই দেখত আনা। রোজালি এতে খুশি হতেন। এই সন্তুষ্টিকে একটা সংজ্ঞার্থও দিয়েছিলেন তিনি। মেয়েদের ওপর ছেলেদের নির্ভরশীলতা।

ছেলেকে নিয়ে রোজালির বিশেষ কোনো ভাবনা ছিল না। লম্বা, লাল চুলের ছেলেটা দেখতে তার মৃত বাবার মতো হয়েছে। মানবিক বিষয়ে তার জ্ঞানের পরিধি খুবই কম। কিন্তু সে স্বপ্ন দেখত বড়ো রাস্তা ও সেতু তৈরির। তার আগ্রহ ছিল ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার।

মায়ের দিক থেকে কেবল শান্ত বন্ধুভাব ও শরীরের গঠনটা পেয়েছে সে। মেয়েই রোজালির আসল বন্ধু। তবে আনার দৃষ্টিতে তাদের দুজনের আস্থার বুনিয়াদ কেবল এক দিক থেকেই। কারণ মা তার সবকিছু জানে। তার ছোট্ট মনের গোপন আবেগ, গর্বিত ও তিক্ত আত্মার কথা, তার ব্যথা বেদনা।

এসব কিছু বিবেচনা করেই সে মনে করে খোলাখোলিভাবে মায়ের জানাও তার অধিকার।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।