আমি বিদ্রোহী
অর্পিত সম্পত্তি আইন মানবাধিকার লঙ্ঘন
রিবেল মনোয়ার
মুজিবনগরের জীবন দাস(৬৫) চার সদস্যের পরিবার নিয়ে এখন পথে বসেছেন। এমনটা হবার কথা ছিল না। একটি অবস্থা সম্পন্ন পরিবারে যা যা থাকা প্রয়োজন সবই ছিল তাদের। ৫০-এর দশকে তাদের জমিজমার পরিমাণ ছিল ১৩৫৫ শতাংশ। ১৯৭৩ সালে তার বাবার কাছে একটি লিগ্যাল নোটিশ আসে।
তাতে বলা হয়, তাদের ১১৫৫ ডেসিমেল সম্পত্তি অর্পিত আইনের আওতাই চলে গেছে।
১৯৭৪ সালে জীবন দাসের বাবা মারা যান। তার বাবার এক বন্ধু ওই সম্পত্তি উদ্ধারে চেষ্টা করছিলেন। হঠাৎ একদিন তার ওপর হামলা হয়। ভয়ে তিনি দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যান।
তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১২ বছর। তার পরিবারও জীবন বাঁচাতে সম্পত্তির আশা ছেড়ে দেয়। এরপর থেকে পরিবারটির অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে। এক সময় আরও কিছু সম্পত্তি বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয় তারা।
শুধু জীবন দাসই নয়, এ রকম বহু মানুষ বহু হিন্দু-মুসলিম পরিবার আছে যারা ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের সময় শত্র“ সম্পত্তি আইন নামে যে আইনটি হয়েছিল তার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এটি অর্পিত সম্পত্তি আইন নামে এখনো বহাল রয়েছে।
অর্পিত সম্পত্তি আইন নিয়ে ২০০০ সালে চজওচ ঞৎঁংঃ পরিচালিত গবেষণায় বলা হয়, মোট দশ লাখ হিন্দু পরিবার অর্পিত সম্পত্তি আইনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে ভুমিচ্যুতির পরিমাণ একুশ লাখ একর। ওই সময়ের বাজার মূল্য হিসেবে এক লাখ ৪৫ হাজার একশ বায়ান্ন কোটি টাকা।
২০০৬ সালের ২৮ জুলাই বাংলাদেশ আইন ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক ইনস্টিটিউট আয়োজিত আলোচনা সভার অর্পিত সম্পত্তি আইনের ক্ষতির মূল পরিমানও করণীয় সম্পর্কে বলা হয়, অর্পিত সম্পত্তি আইনের ফলে সৃষ্ট মনুষ্য দুর্দশা, বঞ্চনা, জোরপূর্বক পারিবারিক বন্ধন বিচ্যুতি ভয়ভীতির কারণে নির্ঘুমরাত কাটানো, মানসিক, শারীরিক যন্ত্রণা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট, স্বাধীনতাহীন এসব ক্ষতির আর্থিক মূল্যায়ন নির্ধারণ করা কোনো অর্থনীতিবিদ, পরিসংখ্যানবিদ বা হিসাববিশারদের পক্ষে সম্ভব নয়।
১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের সময় আইনটি করা হয়। এতে বলা হয়, যুদ্ধচলাকালীন কোনো পাকিস্তানি নাগরিক সাময়িকভাবে ভারতে অবস্থানকালে পাকিস্তানের ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প কারখানা পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করবে পাকিস্তান সরকার। একজন তত্ত্বাবধায়ক সেটা দেখাশুনা করবেন। পরবর্তী ওই পাকিস্তানি নাগরিক ফেরত আসলে সরকার লাভ লোকসানসহ তার প্রতিষ্ঠান ফিরিয়ে দেবে।
পাক-ভারত যুদ্ধের স্থায়ীত্ব ছিল মাত্র ১৭ দিন সে হিসেব এর মেয়াদও হওয়ার কথা সতেরো দিন।
কিন্তু পাকিস্তান সরকার এ আইনের আওতায় সম্পত্তি অধিগ্রহণ চললো ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত। এ আইনের পাশাপাশি নতুন একটা সার্কুলারের মাধ্যমে বলা হলো, কোনো মুসলমান এ আইনের আওতায় পড়বে না। অথচ আইনটিতে এধরনের কিছুই ছিল না। এরপর বাড়িঘর জায়গা জমি সবকিছু এর আওতায় নিয়ে আসা হলো। ১৯৭৬ সালে আইনটি বাতিল করে আবার বলা হলো শত্র“ সম্পত্তি হিসেবে নেয়ার মতো এখনো অনেক সম্পত্তি রয়েছে।
এরপর বিভিন্ন সময়ে আইনটি সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। অনেকবার আইনটি বাতিলের পদক্ষেপ নেয়া হলেও শেষ পর্যন্ত তা বহাল থাকে।
সর্বশেষ ২০০১ সালের অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যার্পন আইন নামে একটি আইন করা হয়। তাতে বলা হয় অর্পিত সম্পত্তিগুলো সরকারিভাবে লিজ দেয়া হবে। সে সময় ব্যাপক দুর্নীতিরও অভিযোগ ওঠে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যার্পন আইনের মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে। এতে আসল মালিকরা তাদের সম্পত্তি ফেরত পাচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত ও আর্থিক প্রভাব খাটিয়ে সম্পত্তি দখল করা হচ্ছে। আবার হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণের কথা বলে আসল মালিকদের ঠকিয়ে জনসাধারণের সহায়তা নেবার চেষ্টা চলে। সমস্যার সমাধানের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া- প্রয়োজন।
এ লক্ষ্যে প্রত্যার্পন আইনের ফাঁকগুলো শুধরিয়ে প্রকৃত মালিকদের হাতে তাদের সম্পত্তি তুলে দেয়া উচিত। এ সমস্যা সমাধানের জন্য নতুন নতুন যেসব আইন হচ্ছে সেগুলোও প্রকৃতপক্ষে কোনো সমাধান দিতে পারছে না। ফলে সমস্যা দিন প্রকট আকার ধারণ করছে। এতে নতুন নতুন আরো স্বার্থগোষ্ঠী তৈরি হচ্ছে এবং তাদেরকে ইজারার নামে আইনগত স্বীকৃতি দেয়া হচ্ছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।