I realized it doesn't really matter whether I exist or not.
প্রথম পর্ব
অনুগ্রহ করে আগে প্রথম পর্ব পড়ুন তারপর এই পর্বটি পড়ুন। এই গল্পটি রোমান্স ও থ্রিলের সমন্বয়ে রচিত। যারা এজাতীয় গল্প পড়তে পছন্দ করেন তারা মিস করবেন না যেন। আর হ্যাঁ, প্রথম পর্ব থেকে শুরু করুন।
===============================================
১.
নকশীকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আমিও বাসায় পৌঁছলাম।
ভয়াবহ একটা চিন্তা মাথায় ঢুকে গেল। প্রথমে যা কল্পনাও করতে পারিনি তাই ঘটলো। নকশী এখন একজন ভ্যাম্পায়ার! তবে আশার কথা হচ্ছে এই যে, ও পুরোমাত্রায় ভ্যাম্পায়ার নয়। ভ্যাম্পায়ার বলতে আমরা যা বুঝি তা হচ্ছে আশ্চর্য এক প্রাণী যা সাধারণত মানুষের স্বাভাবিক রূপ বদলে পরিণত হয় এবং এদের দাঁত বিশেষ করে শ্বদন্তগুলো বড় বড় হয়ে যায় এবং এরা মানুষের রক্ত খেতে পছন্দ করে। এদের কাজই মানুষের রক্ত চোষা।
রক্ত পান করা। ভ্যাম্পায়ার বাস্তবেই আছে কি না তা নিয়ে রয়েছে হাজারো মত। কেউ কেউ বলেন, ভ্যাম্পায়ার নামে সত্যিই একটা প্রাণী পৃথিবীর মাটিতে বাস করে। কিংবা করতো। এই শ্রেণীর গবেষকদের মতে ভ্যাম্পায়ার অনেকটা ডাইনোসরের মত।
ডাইনোসর যেমন বিলুপ্ত একটি প্রাণী, তেমনি ভ্যাম্পায়ারও বিলুপ্ত কোন জন্তু।
অন্যদিকে আরেকদল গবেষক মনে করেন, ভ্যাম্পায়ারের বাহ্যিক রূপটা অবাস্তব। কিন্তু ভ্যাম্পায়ারের ধারণাটা অবাস্তব নয়। অর্থাৎ, কিছু কিছু মানুষ নিজেদেরকে ভ্যাম্পায়ার মনে করে। তারা অপরের রক্ত পান করতে শুরু করে।
বিষয়টা ঘটে সাধারণত চাঁদনী রাতে। যখন মেঘের আড়াল থেকে চাঁদ বেরিয়ে আসে, ঠিক তখনই তাদের রক্তপিপাসা চাঙ্গা হয়ে উঠে। নিজেদের সত্ত্বার কথা ভুলে গিয়ে রক্তের নেশায় উন্মক্ত হয়ে উঠে তারা। তবে তখন তাদের শরীরে কোন পরিবর্তন আসে না বা শ্বদন্তও বড় হয়ে যায় না।
ভ্যাম্পায়ার নিয়ে রয়েছে এমন হাজারো ধারণা।
তবে আশ্চর্যজনক হলো এই যে, পৃথিবীতে সহস্রাধিক গল্প উপন্যাস, ছবি, কল্পকাহিনী, নাটক ইত্যাদি রচিত হয়েছে এই ভ্যাম্পায়ারের ধারণাকে ঘিরে। ব্যাকগ্রাউন্ড বা ঘটনার মাত্রা ভিন্ন হলেও সবার মূল কনসেপ্ট অনেকটা একই রকম। একটা প্রাণী থাকবে, যা চাঁদ রাতে রক্ত পিপাসায় উন্মত্ত হয়ে উঠবে। সামনে যাকেই পাবে তারই রক্ত পান করা শুরু করবে ইত্যাদি ইত্যাদি। ঠিক যেভাবে ডাউনোসরের গল্পগুলো রচিত হয়।
গডজিলা আর জুরাসিক পার্কের কাহিনীগুলোর মধ্যে খুব একটা তফাৎ নেই। এদের সেট ভিন্ন, ডিরেক্টর ভিন্ন, দেশ ভিন্ন ও ব্যাকগ্রাউন্ড ভিন্ন। মূল ধারণা একই।
যাই হোক, এসব বিষয় নিয়ে আমারও প্রচুর আগ্রহ আছে। প্রচুর বই ঘাঁটাঘাঁটি করেছি ভ্যাম্পায়ার বিষয়ক।
এখনো ডক্টর জেকিল ও মিস্টার হাইড নামক বিখ্যাত সেই গল্পটি পড়তে পারিনি তবে পড়ার অপেক্ষায় আছি। বইটি বাংলায়ও অনূদিত হয়েছে। হাতে পাওয়ামাত্রই পড়তে হবে।
ভ্যাম্পায়ার নিয়ে অতি আগ্রহ থাকলেও নিজে কখনো ভাবিনি যে সত্যিকারের জীবনে ভ্যাম্পায়ারসুলভ মন-মানসিকতার কারো সাথে পরিচিত হয়ে যাবো। শুধু পরিচিত তো নয়, একেবারে বেড়াজালে।
আমি একটি ভ্যাম্পায়ার দ্বারা আক্রান্ত! ভাবতেই গা শিরশির করে উঠে। মনে হচ্ছিল এই মেয়েটার কাছ থেকে বাকি জীবন দূরে থাকতে হবে। কিন্তু এ কথা ভাবতেই ওর সহজ সরল মনের কথা মনে পড়ে। চোখের সামনে ভেসে উঠে ওর সুন্দর নির্মল মায়াভরা হাসি। নিষ্পাপ মেয়েটির তো কোন দোষ নেই।
কোন এক তান্ত্রিকই তো তাকে এই ভয়াবহ বিপদে ফেলে দিয়েছে। ও বাকি জীবনে আর উদ্ধার পাবে কিনা তার কোন নিশ্চয়তা নেই। একবার ভাবলাম, বাদ দেই। ওকে নিয়ে চিন্তা করার জন্য ওর পরিবার আছে। পরমুহুর্তেই আবার মনে হলো সেদিন রাতে বাসের সেই মুহুর্তটির কথা, যখন নকশী কোনরূপ দ্বিধাদ্বন্দ ছাড়া আমার হাত ধরে বলেছিলঃ আমরা আজ থেকে বন্ধু, কেমন! তখন আবার মনে হলো বন্ধু হিসেবে আমার দায়িত্ব কতটুকু।
অনেক চিন্তাভাবনা করে ঠিক করলাম নকশীদের বাসায় যাতায়াত রাখবো। তবে ওর কাছ থেকে নিরাপদে থাকতে হবে। শুনেছি ভ্যাম্পায়াররা নাকি একবার যার দিকে নজর দেয়, তাকে শেষ করে তবে ছাড়ে। এরপরও আমার নকশীর কাছে যেতে ইচ্ছে করলো। ভরসা রাখলাম আল্লাহর উপর।
যত বিপদই আসুক, সাহায্য করার জন্য তিনি সর্বদা প্রস্তুত থাকেন।
কিছুদিন পর। নকশীর বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। তার আগে শিহাব ভাইয়াকে ফোন করে জেনে নিলাম ওনারা বাসায় আছেন কিনা। শিহাব ভাই খুব আন্তরিকতার সাথে বাসায় যেতে বললেন।
বাসে করে ওর বাসার কাছের স্টেশনে নেমে রিকশা নিলাম। মনে পড়লো মারুফের কথা। ওকে পরে বুঝিয়েছিলাম ব্যাপারটা কী ঘটেছিল। ও বিষয়টা বুঝতে পেরেছে এবং বন্ধুদের কাছে চেপে গেছে। ওর প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ করলাম।
অন্য কেউ হলে ব্যাপারটা এতো সহজে চেপে যেত না। প্রচার করেই ছাড়তো। মারুফ বলে রক্ষা।
এরই মধ্যে বাসায় পৌঁছে গেলাম। দেখলাম শিহাব ভাই গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে।
রিকশা থেকে নেমে বললামঃ আরে ভাইয়া, আপনি নিচে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?
এমনি। এসো ঘরে এসো।
শিহাব ভাইয়ার সাথে ঘরে ঢুকলাম। ড্রয়িং রুমে আন্টি অর্থাৎ নকশীর মা বসে আছেন। সালাম দিলাম।
উনি আমাকে দেখে কেমন আছি জিজ্ঞেস করলেন। আরো বেশ কিছুক্ষণ কথা হলো উনার সাথে। তারপর উনি নিজ থেকেই বললেন, নকশীর শরীরটা ভালো না। ডাক্তার দেখিয়েছিলাম। ডাক্তার অসুখটা ঠিক ধরতে পারলেন না।
পরামর্শ দিলেন রক্ত পরীক্ষা করানোর। কিন্তু আমরা রক্ত পরীক্ষা করাতে চাচ্ছি না। ডাক্তাররা রক্তে আবার কি না কি খুঁজে পান কে জানে। পরে দেখা যাবে প্রেসের লোকেরা পিছনে লাগবে। গিনিপিগের মতো ওকে নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হবে।
আমি এসব চাইনা। পারিবারিক কোন চিকিৎসকও পরিচিত নেই যাকে বলে গোপনে পরীক্ষাটা করাবো।
আমি বললাম, তা ঠিক আছে। কিন্তু এভাবে পড়ে থাকলে তো ওর শরীর আরো খারাপ হবে। অবস্থা যদি খারাপ হয়ে যায়? একটা পর্যায়ে তো ডাক্তারকে অবশ্যই দেখাতে হবে।
তখন কী করবেন?
আন্টিকে চিন্তিত দেখালো। বললেনঃ এই বিষয়ে আলাপ করতেই আমার বড় ভাইয়ের বাসায় যাচ্ছি। বাসা খুব একটা দূরে না অবশ্য। কিন্তু নকশীকে একা রেখে যেতে সাহস পাচ্ছি না।
আমি বললামঃ কেন, শিহাব ভাইয়া আছে না?
আন্টি বললেনঃ আমি গেলে শিহাবকেও আমার সাথে যেতে হবে।
আমি একা সব কথা বুঝিয়ে বলতেও পারবো না আর আমাকে যা পরামর্শ দেয়া হবে সেটা বুঝতেও পারবো না।
আমি বললামঃ তাহলে পাশের বাসার কাউকে ঘরে রেখে যান।
আন্টি চুপ করে রইলেন। এই কয়েকদিনেই তার চেহারায় দুশ্চিন্তার ছাপ পড়ে গেছে। আগে তো এমনিতেই দুশ্চিন্তায় ছিলেন, মেয়ের ভ্যাম্পায়ার হয়ে যাবার খবর শুনে তো স্বাস্থ্যই ভেঙে পড়েছে বেচারীর।
বললামঃ সবচেয়ে ভালো হতো নকশীকে নিয়ে যেতে পারলে। সেটা কী সম্ভব?
আন্টি মাথা নাড়লেন। ওর অবস্থা খুবই খারাপ। হাঁটাহাঁটি করতে পারে অবশ্য। কিন্তু এই অবস্থায় ওকে বাইরে নিয়ে যেতে ভরসা পাচ্ছিনা।
আমি চুপ করে রইলাম। কী বলব খুঁজে পেলাম না।
শিহাব ভাইয়া বললেন, এসো নকশীর রুমে। বলে উঠে ভিতরের দিকে গেলেন। পিছন পিছন আমিও গেলাম।
ফিটফাট বাড়িটা সামান্য ক’দিনেই অগোছালো হয়ে গেছে। যে পরিবারের সদস্যের এত করুণ অবস্থা, সেই পরিবারের আসবাবপত্রের অবস্থা এমন থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক।
ভিতরের দিকে নকশীর বেডরুম। কাঁথা গায়ে দিয়ে শুয়ে আছে সে। ভিতরে যাবার পর চোখ খুললো।
শিহাব ভাই বসতে বললো। কিন্তু আমি বসার কিছু খুঁজে পেলাম না। বেডরুম বলেই বোধহয় বসার জন্য কোন চেয়ার বা সোফা রাখা হয়নি। শিহাব ভাই খাটে বসতে বললেন। ছোট একটা খাট।
একটু ইতস্তত করে বসলাম নকশীর গা ঘেষে। শিহাব ভাই দাঁড়িয়ে রইলেন। আমি বললামঃ বসুন না ভাইয়া। অবশ্য নিজেই বুঝলাম না কোথায় বসবেন তিনি।
“তোমরা কথা বল” বলে ড্রয়িং রুমে চলে গেলেন তিনি।
নকশী এতক্ষণ কিছু বলেনি। আমি এবার ওকে ভালো করে দেখার সুযোগ পেলাম। সত্যি খুব খারাপ লাগলো ওকে দেখে। একেবারে বিধ্বস্ত একটা চেহারা দেখলাম। নকশীও কেমন যেন বিধ্বস্ত মুখে উজ্জ্বল দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল।
চোখের পাতা খুলতে পারছে না ঠিকমত। আধবোজা চোখেই আমার দিকে তাকিয়ে ছোট্ট করে হাসলো। কাঁপা কাঁপা গলায় বললোঃ অবশেষে আমাকে মনে পড়লো। আমি তো ভয়ই পেয়েছিলাম যে তুমি আর কোন যোগাযোগ রাখবে না বুঝি। যাই হোক, কেমন আছো তুমি?
২.
ফেরার সময় মনটা প্রচন্ড খারাপ হয়ে গেল।
নিজের উপরই রাগ লাগলো নকশীর সাথে কখনো যোগাযোগ রাখবো না এমন সিদ্ধান্ত নেয়ায়। ঠিক করলাম, যে কোন উপায়ে হোক, নকশীর পাশে সবসময় থাকতে হবে। এটি ওর বন্ধুত্বের দাবি। নিষ্পাপ, সরল মনের আশা। এই দাবিকে প্রত্যাখ্যান করার কোন অধিকার আমার নেই।
নকশীর বাসা থেকে ফেরার সময় আন্টির সাথে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলেছিলাম। তিনি বলেছেন, কোন সিদ্ধান্ত নিলে আমাকে ফোন করে জানাবেন। আমিও দিনরাত চিন্তা করলাম কী করা যায়। কিন্তু কোন সল্যুশন বের করা সম্ভব হয়নি। কোন সত্যিকারের কবিরাজও চিনি না যে তাকে খবর দিয়ে আনাবো।
তাই আন্টির ফোনের অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না।
একদিন সকালে ফোন করলো আন্টি। মুখ ধুয়ে নাস্তা খেতে বসবো এমন সময় ফোন বেজে উঠলো। কাছে গিয়ে দেখলাম আন্টিদের বাসার নাম্বার। রিসিভ করে সালাম দিলাম।
কিন্তু কোন উত্তর পেলাম না। তার বদলে একটা প্রশ্নের সম্মুখীন হলামঃ কেমন আছো সুমন?
হঠাৎ করে চিনতে না পারলেও বুঝতে পারলাম কণ্ঠস্বরটা নকশীর। অবাক হলাম। বললামঃ আরে নকশী! কেমন আছো তুমি? শরীর ভালো হয়েছে?
না খুব একটা উন্নতি হয়নি। অবনতিও বোধহয় হয়নি।
ঠিক বুঝতে পারছি না।
হুমম। ওষুধ খাচ্ছো ঠিকমত? নাকি ফাঁকিবাজি করছো?
মিষ্টি একটা হাসির আওয়াজ ভেসে এলো ফোনে। হাসিটা যান্ত্রিকভাবে আসলেও মনে হলো আমার সামনেই কেউ যেন হেসে উঠলো। নকশী বললোঃ ওষুধ মা তিনবেলা সামনে বসে খাইয়ে যান।
ফাঁকিবাজি করবো কীভাবে?
ওহ। গুড! তারমানে ওষুধপত্র খাওয়া হচ্ছে ঠিকমত। তাহলে শরীরের উন্নতি আশা করা যায়।
হ্যাঁ, তা যায়। শোন, মা কথা বলবেন তোমার সাথে।
ফোনটা আন্টির হাতে দেয়া হলো।
আন্টি কুশল বিনিময়ের পর জানালেন, আগামীকাল তিনি আর শিহাব ভাইয়া তাদের গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছেন। যাবেন আর আসবেন। সাথে করে কোন একজন বিখ্যাত হুজুরকে নাকি নিয়ে আসবেন। তার নাকি সাফল্যের কোন অভাব নেই।
তাই তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাকেই ঘরে আনবেন। তিনি বললেনঃ আমাদের গ্রাম খুব একটা দূরে না। যাবো আর আসবো। খুব ভোরে রওনা হবো। আসতে হয়তো সন্ধ্যা হবে।
আমি বললামঃ যাক, এতোদিনে একটা পথ পাওয়া গেল। কিন্তু নকশী? ও একা থাকবে?
আন্টি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। বললেনঃ এই বিষয়টাই আলাপ করতে ফোন করেছি। তুমি আমার ছেলের মতো। তোমাকে যদি একটা অনুরোধ করি, রাখবে?
অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম।
বললামঃ আন্টি কী বলেন এসব। আপনি এভাবে কেন বলছেন। বলুন আমাকে কী করতে হবে। সম্ভব হলে তো অবশ্যই করবো। করবো না কেন!
আন্টি বললেনঃ আমরা মোটামুটি বারো ঘন্টা ঘরের বাইরে থাকছি।
অর্থাৎ, বাড়িতে যেতে আর ফিরে আসতে সর্বোচ্চ বারো ঘন্টা লাগতে পারে। এই বারো ঘন্টা নকশীকে একা ঘরে রাখা সম্ভব না। আশেপাশের মানুষের কথা বলেছিলে তুমি, কিন্তু আমি আশেপাশের কারো প্রতি ততটা ভরসা রাখতে পারছি না। তাছাড়া অ্যাপার্টমেন্ট তো, মালিকরা কেউ থাকেন না। সব ভাড়াটিয়া।
ওদের উপর ভরসা করাও যায় না। তো আমি চাচ্ছিলাম যে, এই সময়টা তুমি যদি বাসায় এসে থাকো, তাহলে আমাদের খুব উপকার হয়।
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামলেন তিনি। অপেক্ষা করলেন আমি কিছু বলি কি না শোনার জন্য। আমি চুপ করে রইলাম।
তিনি বললেনঃ তোমাকে আমি আর শিহাব খুব বিশ্বাস করি। আমি জানি আমাদের ঘর সামাল দেবার জন্য তুমি খুবই ছোট এবং আমি তোমাকে আমার ঘর সামাল দেবার জন্য কখনো বলবও না। নকশীর পুরোটা ব্যাপার তুমি জানো। অন্য কেউ ব্যাপারটা এখনো জানে না। বাইরের লোক ঘরে রাখলে তারা হয়তোবা জেনে যাবে।
তাই আমি আশা করছি তুমি ঘরে থাকবে। শুধু নকশীর দিকে খেয়াল রাখবে। ব্যস। পারবে?
আমি বললামঃ আমার তো কোন সমস্যা নেই। তবে আম্মু…
আন্টি বললেনঃ তোমার আম্মু কি ঘরে আছেন? আমি বললাম হ্যাঁ।
তিনি বললেন ওনাকে একটু দাও। আমি ওনার সাথে কথা বলছি।
আমি আম্মুকে ডেকে বললাম নকশীর মা ফোন করেছেন। আম্মু ফোন ধরলে আমি অন্য রুমে চলে আসলাম। আমার রুমে এসে বসলাম।
প্রস্তাবটার ভালো দিক খারাপ দিক নিয়ে চিন্তা করতে থাকলাম। একটা সম্পূর্ণ অপরিচিত পরিবেশ। পুরো এ্যাপার্টমেন্টে কাউকেই চিনি না। শুধু নকশীকে চিনি। বাসায় আমি আর নকশী একা।
ব্যাপারটা শুনতেই কেমন যেন খটকা লাগল। আমি জানি, এখানে খটকা দূরে থাক, বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশও নেই। কিন্তু বাঙ্গালীর সন্দেহপ্রবণ মন এখানেই খুঁজে বের করে নিবে অনেক কিছু। যা কল্পনারও অতীত।
এইসব ভাবছি, এমন সময় আম্মু এলো।
বললোঃ নকশীর মা সব বলেছেন আমাকে। তোর কোন সমস্যা হবে বলে মনে হচ্ছে না। তিনি তোকে বিল্ডিংয়ের কেয়ারটেকারদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে যাবেন। সন্ধ্যা নাগাদ ওনারা এসে পড়লে তুই চলে আসিস।
আমি নিশ্চিন্ত হলাম।
৩.
ভোরের হাওয়া আসলেই অসাধারণ। যারা সকালে ঘুমায়, তারা যে প্রকৃতির কি এক উপহার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, তা আর বলে বোঝানোর মত নয়। সকালের ঠান্ডা বাতাস, সূর্যের ধীরগতিতে উদয়ন, এসবই প্রকৃতির অসাধারণ সব উপহার, অসাধারণ সব দৃশ্য। আমি নিজেও অবশ্য সকালে ঘুমিয়ে থাকি। তবে আজ নকশীদের বাসায় যেতে হচ্ছে বলে ফজরের নামাজের পর আর ঘুমানো হয়নি।
বাসে করে খালি রাস্তা পার হয়ে নকশীর বাসার দিকে যাচ্ছিলাম। মনে পড়লো, ভোর ছাড়া আর বছরের দুইটা দিন রাজধানীর এই দৃশ্য বিদ্যমান থাকে। সেই দুইটা দিন হচ্ছে ঈদের দিনগুলো। ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা। ঈদুল ফিতরে রাস্তাঘাট বেশি ফাঁকা হয়।
তখন সবচাইতে বেশি সুবিধা যেটা হয়, সেটা হচ্ছে জনসংখ্যা কমে যাবার কারণে লোডশেডিংয়ের হাত থেকে নিস্তার পাওয়া যায়। বেশ ভালো কাটে ক’টা দিন। তারপর আবার সেই পূর্বাবস্থায় ফেরৎ।
মাঝেমধ্যে মনে হয়, ঈদের ছুটিতে বাড়ি যাবার পর ঢাকায় ঢোকার সমস্ত পথ যদি কোনভাবে বন্ধ করে দেয়া যেত, তাহলে হয়তোবা রাজধানীর বিদ্যুৎ সমস্যার একটা স্থায়ী সমাধান হতো!
নকশীর বাসায় পৌঁছলাম। শিহাব ভাইয়া আর আন্টিকে দেখলাম তৈরি হয়ে বসে আছেন।
আমি ঢোকার কিছুক্ষণ পরেই তারা অ্যাপার্টমেন্টের কেয়ারটেকারের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন। তারপর বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। আশা করলাম সারাটা দিন কোন সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে না।
দরজা লাগিয়ে পিছন দিকে তাকালাম। নকশীকে দেখলাম না।
আশ্চর্য! সোফায়ই তো বসে ছিল। ভিতরে চলে গেল কিছু না বলেই? আমি আর মাথা ঘামালাম না। ড্রয়িং রুমে বসে টিভি অন করলাম। এতো সকালে দেখার মত কিছু হয়না অবশ্য। তবে এমটিভি’তে ভালো ভালো হিন্দি গানগুলো দেয় এই সময়ে।
তাই চ্যানেল ঘুরিয়ে এমটিভিতে এসে স্থির হলাম। চোখে ঘুম ঘুম অনুভব করলাম। এতো সকালে ঘুম থেকে উঠেই অভ্যাস নেই, তার উপর এতদূরে আসলাম আবার। বাসায় সোফাতেই ঘুমিয়ে পড়ার অভ্যাস থাকলেও আরেকজনের বাসায় সেইভাবে শুতে ইচ্ছা করলো না।
প্রায় আধঘন্টা পর নকশী এলো ভিতরের রুম থেকে।
এসে বলল, কী ব্যাপার? একা একা কী করছো? ভেতরে এসে বসো।
আমি বললাম, নাহ। আমি এখানেই ঠিক আছি। ভেতরে গিয়ে কী করবো? বেটার এখানে বসে টিভি দেখি। চাইলে তুমিও দেখতে পারো।
বিরক্তিঝরা দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো আমার দিকে নকশী। হনহন করে আমার দিকে হেঁটে এসে আমার সামনে দাঁড়াল। ধমকের স্বরে বললো, গাধা কোথাকার! আমি তো হতবাক। আমার দোষটা বুঝলাম না। নকশী তারপর আমার হাত ধরে ভেতরের দিকে টেনে নিয়ে চললো।
আমি কোনরকমে রিমোট দিয়ে টিভিটা অফ করলাম।
বাসাটা মোটামুটি বড়। তিনজন মানুষের জন্য প্রয়োজনের অতিরিক্ত জায়গা আছে। প্রথম দিন ছোট মনে হলেও আসলে অনেক বড় একটি স্পেস নিয়ে তৈরি ফ্ল্যাটটা। নকশী আমাকে টেনে নিয়ে বারান্দায় বসালো।
অবশ্য শহরের বারান্দায় বসেও মজা নেই। চারিদিকে শুধু দালান আর দালান। বারান্দাটা পূর্বমুখী। তাই রোদ আসছে। অবশ্য দুপুরের দিকে এই রোদ সরে যাবে।
তখন এখানে শান্তিতে বসা যাবে। এখন এই রোদের মধ্যে আমাকে বারান্দায় আনলো কেন বুঝলাম না।
নকশী পাশে এসে বসলো। জিজ্ঞেস করলো, চা খাবে?
আমি খানিকটা ধমকের স্বরে বললাম, চা খেতে তো আসিনি।
নকশী একটু ধাক্কা খেয়ে বললো, তাহলে?
আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল।
বললামঃ রোদের মধ্যে বারান্দায় দাওয়ার করলে কেন?
হঠাৎই যেন নকশীর চোখে পড়লো যে বাইরের প্রচন্ড রোদ গায়ে এসে পড়ছে। ওহ সরি সরি! খেয়াল করিনি। এসো ভিতরে এসো।
এরপরের ঘটনা উল্লেখযোগ্য কিছু না। একটা মেয়েকে আরো অনেক কাছ থেকে চেনার সুযোগ হলো।
সারাটা দিন টিভি দেখে, টিভি গেমস খেলে আর নানা বিষয়ে কথাবার্তার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হলো। আর এতসবের মধ্য দিয়ে আমাদের মধ্যকার বন্ধুত্বটা হলো আরো অনেক অনেক গাঢ়, সুদৃঢ়। তবে খুব খারাপ লাগলো মেয়েটার জন্য। ওর জন্য কিছু করতে পারলে খুব ভালো হতো। কিন্তু ভুত বা জ্বীন এসবকে আমি অনেক ভয় করি।
তাই কিছু করা সম্ভব নয়। যা করার, এভাবেই করতে হবে। সরাসরি কিছু করতে পারবো না।
সন্ধ্যাবেলায় আন্টি আর ভাইয়া আসলো। সাথে কোন হুজুর টুজুর দেখলাম না।
জিজ্ঞেস করলাম কী হয়েছে। আন্টি বললেনঃ না তেমন কিছু না। এই বলে ভিতরের রুমে চলে গেলেন। শিহাব ভাইয়ার চোখেমুখেও দুশ্চিন্তার ছাপ দেখতে পাচ্ছি। বুঝলাম কিছু একটা গড়বড় হয়েছে।
তাৎক্ষনিকভাবে কিছু বললাম না। আশা করলাম, পরে ঠিকই ফোন করে আমাকে জানিয়ে দেয়া হবে কী হয়েছে। আন্টির কাছে গেলাম বিদায় নিতে। বাসায় যাওয়া দরকার। সন্ধ্যার দিকে যেই জ্যাম লাগে রাস্তায়।
যত তাড়াতাড়ি বের হবো, ততই লাভ। কিন্তু আন্টি গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, রাতে থাকো। তোমার সাথে জরুরি কথা আছে। তোমার আম্মুর সাথে কথা হয়েছে আমার। তিনি তোমাকে থাকার অনুমতি দিয়েছেন।
আমি বুঝলাম ঘটনা মারাত্মক কিছু।
রাতে খাবার শেষ হবার পর আন্টি আমাকে নিয়ে বারান্দায় বসলেন। প্রথমে সূচনা করলেন অনেক কথা দিয়ে। সবশেষে আসল কথা বলতে শুরু করলেন।
হুজুরের সাথে কথা হয়েছে।
কিন্তু হুজুর আমাদেরকে যেই কথা শুনিয়েছেন, সেই কথা শুনে আমরা চিন্তিত।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আবারো শুরু করলেন তিনি। বললেনঃ তিনি বলেছেন, নকশীর ভ্যাম্পায়ার জীবন থেকে উদ্ধারের একটিই পথ আছে। তবে সেই পথ সবার জন্য খোলা নয়। কঠিন দায়িত্ব অভিশাপদানকারী সেই তান্ত্রিক শুধুমাত্র একজনের হাতেই অর্পণ করে গিয়েছেন।
আবার থেমে গেলেন তিনি। এক গ্লাস পানি সামনেই রাখা ছিল। আধা গ্লাস পানি পান করে আবার শুরু করলেন। পুরোটা সময় আমার দিকে তিনি তাকাচ্ছেন না। মাটির দিকে তাকিয়ে আছেন।
বলতে থাকলেনঃ নকশীর ভ্যাম্পায়ার জীবনে সর্বপ্রথম যে আক্রান্ত হয়েছে, নকশীকে বাঁচানোর সর্বময় ক্ষমতা তারই হাতে অর্পিত!
[চলবে]
তৃতীয় পর্ব
মন্তব্য করতে হলে সিরিজ শেষে সর্বশেষ পর্বের সর্বশেষ পোস্টে মন্তব্য করতে পারবেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।