সরকারের দৃঢ়তা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারীবাহিনীর তৎপরতার কারণে ভেস্তে গেল সরকার উৎখাতে বিরোধী দলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়ার নীলনকশা। বিপুল ভোটে নির্বাচিত একটি সরকারকে অপসারণে তিনি নানামুখী ছক আঁকেন, যার অংশ হিসেবে অবস্থান কর্মসূচির হুমকি দিয়েছিলেন। হেফাজতে ইসলামের ৫ মে’র ঢাকা অবরোধ ও সমাবেশের পর সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে আদাজল খেয়ে নামেন। গভীর রাত পর্যন্ত চলে তৎপরতা। দায়িত্ব দেওয়া হয় বিএনপির একাধিক নেতাকে।
তিনি নিজেও ছিলেন সক্রিয়। হেফাজতের আমির আল্লামা আহমেদ শফীকে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে না পাঠানোর পেছনে সব কলকঠি নাড়েন বিএনপি চেয়ারপারসন। তিনি এক পর্যায়ে কড়া ভাষায় হেফাজত নেতাদের জানিয়ে দেন, কথামতো শাপলা চত্বরে অবস্থান অব্যাহত না রাখলে বিএনপি ভবিষ্যতে আর সমর্থন দেবে না। সরকারি সূত্রগুলো বলছে, লোক সমাগম দেখে কার্যত উচ্চাভিলাসী স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন হেফাজতের নেতারা। তাদের ধারণা ছিল, এ সুযোগ আর পাওয়া যাবে না।
বেগম জিয়ার টোপ গিলে ফেলেন তারা। পরিকল্পনা অনুযায়ী, মাঝ রাস্তা থেকে ফিরে যান হেফাজত নেতা আল্লামা শফী। অন্যদিকে, মাদ্রাসার নাবালক শিক্ষার্থীদের বসিয়ে, জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়ে যান বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা। হুংকার দেওয়া হয়, যে কোনো মূল্যে অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার। বেগম জিয়ার পরিকল্পিত চিত্রনাট্যের প্রথম দৃশ্য ঠিকঠাক মতোই চলে।
নীলনকশার অংশ হিসেবে তিনি হেফাজতের কর্মীদের মুসাফির আখ্যা দেন। বিএনপিসহ ১৮ দলীয় জোটের নেতাকর্মীদের তাদের পাশে দাঁড়ানোর নির্দেশ দেন। যদিও বিস্ময়করভাবে তার নির্দেশে কোনো সাড়া পড়েনি। বিএনপি নেতাকর্মীরা ঘর থেকে বের হননি। তবে জামায়াতের সহযোগী সংগঠন ছাত্রশিবিরের অনেক নেতাকর্মী হেফাজতের কর্মীদের সঙ্গে মিলে ধ্বংসযজ্ঞ চালান।
সবকিছু প্লান মতোই এগিয়ে নিচ্ছিলেন খালেদা জিয়া। মতিঝিলে হেফাজতকে অবস্থান করতে বলে পরের দিন ৬ মে নয়াপল্টনে সমাবেশ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। অর্থাৎ দুই স্থানে নেতাকর্মী-সমর্থকরা অবস্থান নেবেন। লক্ষ্য একটাই, দেশ অচল করা, সরকারের পতন ঘটানো। তার পরিকল্পনার দ্বিতীয় পর্যায় ছিল এটা।
সে কারণে তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও এলজিআরডি মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের আহ্বানকেও উড়িয়ে দেন। বিএনপি নেত্রীর ধারণা ছিল, বিপুল মানুষের সমাবেশ হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কীভাবে ভেঙে দেবে? তাছাড়া হেফাজত কর্মীরা জীবনবাজি রেখে এসেছেন! তারাতো ‘শহীদ’ হতে চান! তাদের সরাতে হলে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ তার ভাষায় ‘গণহত্যা’ চালাতে হবে। বহু লাশ পড়বে। পতন হবে সরকারের। নীলনকশার দ্বিতীয় অংশ ব্যর্থ হয়ে গেল।
কারণ খালেদা জিয়া দুটি দিক বুঝতে ভুল করেছেন। একটি হল, তিনি একেবারেই বুঝতে পারেননি, হেফাজতের কর্মী-সমর্থকদের প্রায় সবাই বিভ্রান্ত। ভুল বুঝিয়ে তাদের নিয়ে আসা হয়েছে। একটি অংশ এসেছে বাধ্য হয়ে। আন্দোলনের অভিজ্ঞতা নেই তাদের।
অধিকাংশই ভালো করে ঢাকা চেনে না। দিনের বেলা নেতাদের শহীদ হওয়ার বক্তব্য শুনে উত্তেজিত হলেও এর মর্মার্থ তারা অনুধাবন করতে পারেনি। তাছাড়া সরকারের কড়া ঘোষণার পর প্রাণভয়ে নেতারা পালিয়ে যান। ভয় পেয়ে যায় নাবালকরা। ফলে মাত্র ১৩ মিনিটেই তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।
অনেকে প্রাণপন দৌড়ে পালায়। অনেকে কান ধরে চলে যায়। হেফাজতে ইসলামের ধর্মব্যবসায়ী নেতারা ইসলাম কায়েমের নামে এই শিশু-কিশোরদের মাঠে নামিয়েছিল। এমন বিপন্ন-দুরবস্থায় পড়তে হবে, তারা তা ভাবতেও পারেনি। তবে নেতাদের পকেট ঠিকই ভরেছে।
বিএনপি-জামায়াত জোটের পক্ষ থেকে কত টাকা দেওয়া হয়েছে, তার খোঁজে নেমেছেন গোয়েন্দারা।
খালেদা জিয়া হয়তো জানতেন না, অন্যের ওপর ভর করে পরজীবি হয়ে বাঁচতে পারলেও কোনো কিছু হুট করে বদলে দেওয়া যায় না। তাইতো তার খোয়াব অনুযায়ী, না সফল হলো অবস্থান, না হলো গণহত্যা। তিনি কাঙ্খিত সংখ্যায় লাশ পেলেন না। যদিও হাজার মৃত্যুর হাস্যকর গুজব ছড়িয়ে চলেছেন।
ভেস্তে গেল বিপুল ম্যান্ডেটে একটি নির্বাচিত সরকারকে উৎখাতে তার নীলনকশা।
তারপরও প্রশ্ন থেকে যায়। খালেদা জিয়া সন্ধ্যায় বিবৃতি দিয়ে বলেন, হেফাজতে ইসলামের কর্মীরা মুসাফির। তাদের সব ধরনের দেখাশোনার জন্য তিনি বিএনপি নেতাকর্মীদের নির্দেশ দেন। কিন্তু কোথায় ছিল নেতাকর্মীরা? প্রধান বিরোধী দলের আতিথেয়তায় থাকাবস্থায় হেফাজতিরা কান ধরে বাড়ি গেল।
বিএনপি কেন তাদের পাশে দাঁড়াল না? বিএনপি নেতারা কেন নির্ঘুম রাত কাটানো, অভুক্ত বোধহীন মুসাফিরদের নিজেদের বাড়িতে নিয়ে আপ্যয়ন করলেন না? একমুঠো ডাল-ভাত খাওয়ালেন না? বিএনপি নেতারা তাদের শাপলা চত্বরে রেখে নিজেরা বাড়িতে শান্তিতে ঘুমালেন! পুলিশ অভিযান চালাল। হেফাজতের রক্ত গরম করা বক্তা, কথিত মুসলমানরা কোথায় পালালেন? তারা সন্ধ্যায় বলেছিলেন, শহীদ হতে এসেছেন। তারা না হলেন শহীদ, না গাজী। হলেন ভীরু তস্কর। ইসলামের হেফাজতের নামে কোমলমতি শিশু-কিশোরদের রাস্তায় নামানো এই ভ-দের হাতে কীভাবে শান্তির ধর্ম ইসলামের হেফাজত হবে? বেগম জিয়া হেফাজতি অলৌকিক পাল্কিতে চড়ে আবারও ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্নে বেঘোর হয়ে পড়েছিলেন।
তিনি কি হেফাজতের ১৩ দফা দাবি পড়েছেন? তিনি কি এগুলো মানেন? দেশের মানুষ বেগম জিয়া ও বিএনপির কাছে ১৩ দফার ব্যাপারে সুস্পষ্ট অবস্থান জানতে চায়। নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট আন্দোলন করছে। হেফাজতের ১৩ দফার কোথাও নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা নেই। আছে বাংলাদেশকে মধ্যযুগে নিয়ে যাওয়ার অবাস্তব দাবি। আরও আছে নারীকে অসম্মান করার অরুচিকর প্রস্তাব।
বিএনপি কার্যত হেফাজতের ১৩ দফা দাবি মানা না মানার একটা অস্পষ্ট অবস্থানে আছে। এভাবে তারা হেফাজতের ঘাড়ে চেপে দেশে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চায়।
এখন আর কোনো খবরই চাপা থাকে না। হেফাজতকে মাঠে নামিয়েছে মূলত জামায়াত। হেফাজতের মূল ঘাটি চট্টগ্রামের সাংবাদিকরা বলেছেন, জামায়াতের কর্মীরাই এখন হেফাজতের কর্মী।
হেফাজতের প্রধান এজেন্ডা আসলে বহুল প্রত্যাশিত একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার নস্যাত করা। জামায়াত বিএনপিকে বুঝিয়েছে, হেফাজতই হলো সরকারকে অপসারণের অব্যর্থ ওষুধ। ক্রমশ জামায়াত নির্ভর হয়ে পড়া বিএনপিও ভেজাল হেফাজতি ক্যাপসুল খেয়ে এখন নানা পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ায় ভুগছে। এভাবে কি ক্ষমতায় যাওয়া যায়? সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় জন্ম হয়েছিল বিএনপির। দীর্ঘদিন গণতন্ত্রের ছায়ায় কাটালেও পরিপক্কতা আসেনি।
দলটি এখনও বুঝতে অক্ষম, একটি নির্বাচিত সরকারকে অপসারণের একমাত্র পথ আরেকটি নির্বাচন। কোনো অপচেষ্টাই এক্ষেত্রে সফল হবে না। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।