উন্নয়নশীল রাষ্ট্র গঠনে সামাজিক অঙ্গীকার
ফকির ইলিয়াস
========================================
একটি রাষ্ট্রের সরকারই যে সব পারবে, এমন কোন কথা নেই। মানুষকেও সজাগ হতে হয়। সতর্ক থাকতে হয়। রাষ্ট্রের পরিশুদ্ধ অবকাঠামো গঠনে জনগণের একটি সামাজিক অঙ্গীকার থাকা চাই। নাগরিককে বুঝতে হবে এই দেশটি আমার।
এর রক্ষণাবেক্ষণ এবং পরিচর্যার দায়িত্বটিও আমার।
পবিত্র রমজান মাস চলছে। অথচ বাংলাদেশে এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী চালাচ্ছে তুঘলকি কা-। তারা কিছুই মানছে না। নিয়ম-নীতি তাদের কাছে খুবই তুচ্ছ বিষয়।
তারা মনে করছে এটাই মুখ্য সময় অতিরিক্ত মুনাফা অর্জনের। এমন মানসিকতা, মানবতা বিবর্জিত। মানুষের এই মনটির পরিবর্তন কে করবে? সরকার পারবে? না পারবে না। কারণ তারা তো সরকারি নির্দেশ পর্যন্ত মানছে না।
দেশের আরেকটি ভয়াবহ সামাজিক সমস্যা 'ইভটিজিং'।
এই জঘন্য আচরণের শিকার হয়ে অনেক কিশোরী আত্মহত্যা পর্যন্ত করেছে। এরপরও তাদের বিরুদ্ধে তীব্র সামাজিক আন্দোলন এ পর্যন্ত গড়ে ওঠেনি। আবার দেখা যাচ্ছে কেউ কেউ রাজনৈতিক পরিচয় ও প্রতিপত্তি ঘটিয়ে এসব বখাটেকে বাঁচানোর জন্য তৎপর রয়েছে। পুলিশের কাছ থেকে ছাড়িয়ে আনছে। রাষ্ট্রের জন্য এটা তো হুমকি বটেই।
চলতি সংখ্যা 'টাইম' ম্যাগাজিনে একটি ছোট্ট সংবাদ ছাপা হয়েছে বাংলাদেশ বিষয়ে। তাতে বলা হয়েছে বাংলাদেশের স্কুলগুলোতে ছাত্রছাত্রীদের শারীরিক নির্যাতন করেন শিক্ষক সমাজ। তা বন্ধে সরকারি আইন প্রণীত হয়েছে। বেত্রাঘাতসহ বিভিন্ন প্রকার নির্যাতনে কোমলমতি শিশুদের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয় বলে উদ্বেগও প্রকাশ করেছে ইউনিসেফ। তারা তাদের জরিপে বলেছে ২০০৯ সালে বাংলাদেশের শতকরা ৮৮ ভাগ স্কুলে ছাত্রছাত্রীরা শারীরিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে।
এই যে সামাজিক সমস্যা জর্জরিত রাষ্ট্র- সেই রাষ্ট্রটির ভিতকে আরও দুর্বল করে দিয়ে তৎপর রয়েছে একটি মৌলবাদী চক্র। তারা ধর্মীয় তমদ্দুনের নামে জাতির গলায় পরিয়ে দিতে চাইছে আদিমতার মালা। বিশ্ব এগিয়ে গেলেও তাদের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটেনি। বিশেষ করে এই রাষ্ট্রে পরাজিত রাজাকার শক্তির জিঘাংসাপূর্ণ মানসিকতা আরও ভয়াবহ।
একটি ছোট্ট ঘটনার কথা বলি।
যুক্তরাষ্ট্রের আরকানসাস অঙ্গরাজ্যের একটি নিভৃত গ্রামে বসবাস করতেন মি. শেফার্ড রিভস্কি। তার একটি চিঠির সূত্র ধরেই মার্কিনি গোয়েন্দারা তার পিছু নেয়। বেরিয়ে আসে অনেক তথ্য। তা ১৯৮৮ সালের ঘটনা। শেফার্ডের ডাইরিগুলো সিলগালা করে নিয়ে যায় গোয়েন্দারা।
শেফার্ড নাৎসিবাদে বিশ্বাস করে যুদ্ধ করেছিলেন। মার্কিন কাঠগড়ায় তার বিচার হয় শেষ বয়সে। জেলেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
বিশ্বে এমন ঘটনা অনেক আছে। নাৎসিবাদের ভয়াবহতা এখনো কাঁপিয়ে দিচ্ছে মানবতার ভিতকে।
বিশ্বের মানুষ স্পষ্ট ভাষায় বলছে, 'যুদ্ধাপরাধের বিচার চাই। ' 'মানবতার বিচার চাই'।
এর বিপরীতে যারা পরাজিত শক্তি, তারা কী বসে আছে? না বসে নেই। তারাও তাদের বিষদাঁত শানাচ্ছে। পারলে আবারও আঘাত হানবে।
রক্তপ্লাবন ঘটাবে। পার্থক্য হচ্ছে এই, কোন সুসভ্য গণতান্ত্রিক দেশে যুদ্ধাপরাধীরা মাথা তুলে কথা বলতে পারছে না। কিন্তু তৃতীয় বিশ্বে পারছে। বাংলাদেশে পারছে। তারা প্রকাশ্যে বলছে, প্রতিশোধ নেবে!
বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক মৌলবাদী রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর একজন শীর্ষ নেতা ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের প্রকাশ্যে বলেছেন, তাদের দলের রিজার্ভ ফোর্স আছে।
সময়মতো সেই ফোর্স মাঠে নামবে।
একটি গণতান্ত্রিক শান্তিকামী রাষ্ট্রের সরকারকে এমন হুমকি প্রদান। সরকারকে চ্যালেঞ্জের শামিল। এই নেতা এমন দুঃসাহস কোথা থেকে পেলেন?
জামায়াতের কিছু নেতাকে যুদ্ধাপরাধ কিংবা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে। এসব তমদ্দুনপন্থি নেতা একাত্তর সালে কী কী কাজ করেছিলেন তা বাংলাদেশের মানুষের অজানা নয়।
তথ্য-প্রমাণ সাপেক্ষে তাদের হীন কর্মকা-ের ফিরিস্তি এখনো মিডিয়ায় নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। এরপরও এসব দাগি যুদ্ধাপরাধী এবং তাদের সহচরেরা তা ঢেকে দেওয়ার নিয়মিত চেষ্টা করে যাচ্ছে। বারবার চরম মিথ্যার আশ্রয় নিচ্ছে।
অতি সম্প্রতি নিউইয়র্কে একটি সমাবেশ করেছে বাংলাদেশে মৌলবাদ রাজনীতির সমর্থকরা। সড়ক ব্যবহারের অনুমতি নিয়ে তারা যে সমাবেশ করেছে তা ছিল মূলত বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে বিষোদগার।
লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, মুসলিম ইউনিটি অব নর্থ আমেরিকা (মুনা), ইসলামিক সার্কেল অব নর্থ আমেরিকা (ইকনা), দাওয়াতুল ইসলাম প্রভৃতি সংগঠনের ঐক্যবদ্ধ আয়োজনে মূলত এর নেপথ্যে ছিল জামায়াতের নেতৃত্ব। এই সমাবেশে যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সমর্থকও যোগ দিয়েছে। অবাক করার মতো কথা হচ্ছে, 'বাংলাদেশে ইসলাম বিপন্ন হচ্ছে'- এই ধুয়া তুলে কয়েকশত পাকিস্তানি আমেরিকানও যোগ দিয়েছে এই সমাবেশে। ধর্মের নামে বাংলাদেশের অস্তিত্বের প্রতি কটাক্ষ করবে যেসব পাকিস্তানি এখনো তৎপর তাদের একটি অংশই বিদেশের বিভিন্ন দেশে জামায়াত সমর্থক বাংলাদেশিদের সঙ্গে হাত মিলাচ্ছে। নিউইয়র্কের সড়ক ব্যবহার করে জামায়াত সমর্থকরা যে সমাবেশ করেছে তাতে মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ মুসলিম কিছু ইমাম ব্যক্তিত্বকে নিয়ে আসা হয়েছে।
এসব ইমামও বলতে চেয়েছেন, বাংলাদেশে নাকি ইসলাম বিপন্ন হচ্ছে! অথচ একাত্তরে যারা যুদ্ধাপরাধ, ধর্ষণ, খুন, রাহাজানি, অগি্নসংযোগের নেতৃত্ব দিয়েছিল তাদের বিচারের বিষয়টি বেমালুম চেপে গেছে এই আয়োজকরা। ইসলামের নামে তারা বিদেশেও হীন রাজনীতিতে তৎপর রয়েছে।
সন্দেহ নেই, বর্তমান যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রাক্কালে দেশে-বিদেশে সেই পরাজিত শক্তিরা বিষ ছড়াচ্ছে। তারা বলছে তাদের 'রিজার্ভ ফোর্স' দিয়ে মোকাবিলা করবে। বাংলাদেশে নাকি তাদের দুই-তিন কোটি সমর্থক রয়েছে!
গেল নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মৌলবাদী শক্তির চরম পরাজয় প্রমাণ করে, বাংলাদেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ-ধর্মভীরু।
কিন্তু তারা জঙ্গিবাদ, মৌলবাদকে প্রশ্রয় দেন না। তারপরও যারা বলছে, বাংলাদেশে তাদের কোটি কোটি সমর্থক আছে, তাদের মতলব হচ্ছে মানুষকে বিভ্রান্ত করে ঘোলাজলে মাছ শিকার করা।
ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের কৌশল বিশ্বে নতুন নয়। এই পরাজিত রাজাকার চক্র একাত্তরেও বলেছিল পাকিস্তান বিভক্ত হয়ে গেলে পূর্ব অঞ্চলে ইসলাম থাকবে না। পাক হানাদার ও তাদের দোসরদের চ্যালেঞ্জ, সশস্ত্র মোকাবিলা করেই বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।
এখন সেই চক্রটির লক্ষ্য বাংলাদেশকে তালেবানি জঙ্গি রাষ্ট্রে পরিণত করা। যা তাদের বিভিন্ন জবানবন্দিতেই বেরিয়ে আসছে।
মৌলবাদের কবলে পড়ে বর্তমান পাকিস্তানের অবস্থা কেমন, তা কারও অজানা নয়। এ নিয়ে চিন্তিত স্বয়ং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শাসকশ্রেণীও। তাদের ভাষ্য হচ্ছে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পাকিস্তান জঙ্গিবাদের চারণভূমি।
এবং বিশ্ব মানবতার বিকাশে পাকিস্তানি তালেবানরা অন্যতম অন্তরায়ও বটে। তাই যুক্তরাষ্ট্র কোনমতেই চাইছে না আরেকটি মুসলিম অধ্যুষিত দেশ বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের বিস্তৃতি ঘটুক। অথচ ইউরোপ-আমেরিকায় সেই পরাজিত জামায়াতি শক্তি নানাভাবে লবিংয়ের চেষ্টা করছে। তাই প্রতিটি সচেতন বাংলাদেশির উচিত যুদ্ধাপরাধী জামায়াতি চক্রের অতীত কৃতকর্ম এবং বর্তমান পরিকল্পনা বিশ্বের গণতন্ত্রকামী রাষ্ট্রগুলোর কাছে তুলে ধরা।
নিউইয়র্ক, ১৮ আগস্ট, ২০১০
-----------------------------------------------------------------------
দৈনিক সংবাদ ।
ঢাকা । ২০ আগস্ট ২০১০ শুক্রবার প্রকাশিত
ছবি - নালিনী রয়
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।