ক্লিন'স অল্টারনেটিভ ওয়ার্ল্ড
গত কয়েক মাসে বেশ কয়েকজন মায়ের খবর পত্রিকায় এসেছে যারা সন্তান হত্যার সাথে যু্ক্ত । অন্যের সন্তান নয়, নিজের সন্তান। যাকে দশমাস ধরে গর্ভে নিয়েছেন।
বিজ্ঞান পড়েছি বলে জানি, সন্তান নিয়ে বাবার উৎপ্রেক্ষা থাকতে পারে। সন্তানটি আসলেই তার কি-না তা নিয়ে তার সংশয় হতে পারে।
ফলে অবচেতন মনে সন্তানের প্রতি তার অবহেলা এবং ঘৃণা জন্মানো অস্বাভাবিক নয়। বিশেষত যদি স্ত্রীকে ঘিরে তার সন্দেহ জোরদার থাকে। কিন্তু মায়ের দিক থেকে এরকম কোন মনোস্তাত্বিক সংকট তৈরী হবার আশংকা নেই। তিনি মা, সন্তানটি তারই। কোন সন্দেহ নেই।
একারণে, বিজ্ঞানের অভিমত হচ্ছে, সন্তানের প্রতি পিতার ভালোবাসায় খাদ থাকতে পারে, কিন্তু মায়ের ভালোবাসা সম্পূর্ণ নিখাদ।
গত কয়েক মাসে দেখলাম সেরকম নিখাদ ভালোবাসার বেশ কয়েকজন মা তাদের সন্তানকে হত্যা করেছেন বা হত্যার সাথে যুক্ত থেকেছেন। পত্রিকায় সেসব খবর পড়ে সাধারণ মায়েরা ছি ছি করেছেন, লজ্জায় মুখ লুকিয়েছেন- তারা যে মা জাতির কলংক সে ব্যাপারে নিরেট মত ব্যক্ত করেছেন। ব্লগ সাইটগুলোতে সেসব মাকে লক্ষ্য করে বর্ষিত হয়েছে ঘৃনার বিষবাণ। তাদেরকে বিবিধ প্রকারে শাস্তি দিয়ে জীবন নাশের মত ব্যক্ত করেছেন অনেকেই।
এসব কিছুর মাঝেই হঠাৎ হঠাৎ আমার মাথায় বুদবুদ উঠতো একটি প্রশ্নের- মায়েরা হঠাৎ এমন হন্তারক হয়ে উঠলো কেন? যে মায়ের উচিত তার সন্তানের জীবন বাচানোর জন্য অন্যকে খুন করা, সে কিনা নিজেরই সন্তানকে খুন করছে, বা খুনে সহযোগিতা করছে!! আমার কাছে বিস্ময় লেগেছে খুব। আমার সে বিস্ময়ের ঘোর কাটাতে আমি বেশ কয়েকটি বিষয় নিয়ে ভেবেছি। বেশ কিছু প্রশ্নের জবাব খোজার চেষ্টা করেছি।
প্রথম যে প্রশ্নটির জবাব দরকার সেটা হচ্ছে- একজন মা কি আসলে প্রথমে একজন মানুষ তারপর মা; নাকি প্রথমে মা তারপর মানুষ। যদি তার মানব সত্ত্বাকে গুরুত্ব দিই- তাহলে তার মানবীয় প্রয়োজনগুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে।
তারপর তার জৈবিক বিষয়গুলোকেও মর্যাদার সাথে বিবেচনা করতে হবে। আমাদের সমাজে মানুষ হিসেবে একজন মায়ের মর্যাদা কতটুকু? তার কাছ থেকে মাতৃত্বের ষোল আনা দাবী চাই, কিন্তু তার অভাব অভিযোগগুলোর দিকে দৃষ্টিপাতের আগ্রহ কত আনা আছে আমাদের?
সামিউলের মা কিংবা বিলাসী যারা তাদের সন্তানদের হত্যা করেছে কিংবা হত্যায় সহযোগিতা করেছে তাদের প্রত্যেকেরই দাম্পত্য জীবনটা অত্যন্ত বিষময় ছিলো। আমাদের দেশে এখনও একজন নারীকে তাদের মনের বিরুদ্ধে বিয়ে দেয়া হয়। এবং বিবাহিত জীবন যাপনে বাধ্য করা হয়। সেটা যে কত নির্মম একটা বিষয় তা ভেবে দেখার প্রয়োজন রয়েছে।
সামিউলকে যেদিন হত্যা করা হয় (বলে দাবি করেছে তার বাবা) সেদিন ভদ্রলোক নারায়নগঞ্জ থেকে এসে তার স্ত্রীর রুমে না গিয়ে আলাদা রুমে গিয়ে শুয়ে পড়েছিলেন। আর এই সুযোগে সামিউলের মা তার প্রেমিকাকে ছাদ থেকে ডেকে এনেছিলেন তার ঘরে। জানি সবাই এই মাকে ঘৃণা করবেন। তার জৈবিকতাকে আগুনে পোড়াতে চাইবেন। কিন্তু এ বিষয়টিও কী ভেবে দেখার প্রয়োজন নেই কেন তার স্বামী তার কাছে না গিয়ে অন্য রুমে শুতে গেলেন।
কেন গেলেন। তার তো উচিত ছিলো স্ত্রীর কাছেই থাকা। কেন তিনি স্ত্রীকে উপেক্ষা করেছেন? তার নপুংশক আচরণও সামিউলের মৃত্যুর জন্য কম দায়ী নয়। আমাদের দেশের অনেক বয়স্ক পুরুষ কম বয়সের মেয়েদের বিয়ে করে শেষমেষ শরীরের দাবিটি না মিটাতে পেরে পালিয়ে বেড়ান। সামিউলের বাবা কি তেমন কেউ ছিলেন।
এই শরীরি দাবীর বাইরে মানসিক সম্পর্কের বিষয়টা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। পাশ্চাত্যে দেখি অনেক তরুণী অনেক বয়স্ক পুরুষের সাথে সংসার করছেন। কিসের নেশায়? আমি তো মনে করি, দুটো মানুষের মনের সংযোগই তাদের যৌথ জীবনের প্রধান অনুঘটক। তারা সেটা করতে পারেন। মন যখন একসূত্রে গাথা থাকে, পরষ্পরকে জেনেশুনে তখন অনেক কিছু অবজ্ঞা করেও এক সাথে থাকা যায়।
আমাদের এখানে স্বামী স্ত্রীর এই মানসিক সংয়োগের বিরাট অভাব রয়েছে। যা স্ত্রীদেরকে সংসার বিমুখ করে তোলে।
স্বামী সংসাররের প্রতি এই বিমুখতা কী সন্তান হত্যার কারণ হতে পারে? এ প্রশ্নের জবাবে তাকাতে আমাদের সমাজের বর্তমান ট্রানজিশনের দিকে। পশ্চিমা সমাজের সাথে আমাদের পরিচয় পুরনো হলেও তাদের আচরণের সাথে নিজেদের মিলিয়ে নেয়ার দুরন্ত প্রবণতাটা নতুন। আগে টিভিতে আমি কোন বিমান দুর্ঘটনায় নিহত সন্তানের জন্য যখন পশ্চিমা কোন মা’কে কাদতে দেখতাম, তখন খুব অবাক হতাম।
ভাবতাম, এরা তো কেবল জৈবিক প্রেরণায় বাঁচে, সন্তানের জন্য এদের ভালোবাসা আসলো কোত্থেকে? পরে সময়ের সাথে বুঝেছি- তারা জৈবিক ভালোবাসটাকে সন্তান বাৎসল্য থেকে আলাদা করে নিয়েছে। তাই ছেলের কাছে মায়ের বয়ফ্রেন্ড কোন অভিযোগের বিষয় নয়। সেখানে নারী অনেক বেশী স্বাধীণ। যৌন বিষয়টা সেখানে নাওয়া খাওয়ার মতই সাধারণ কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এবং এই ইস্যুতে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে তাদের প্রয়োজন মেটানোর জন্য সবকিছু করার অধিকার রাখে।
আমাদের দেশে আমরা যৌন বিষয়ে পুরুষের পাশাপাশি নারীদের এ দাবীর বিষয়টি জানছি কেবল- কিন্তু তার স্বীকৃতি এখনো দিতে পারি নি। আমি বলছি না, পশ্চিমা বিশ্বের মতো যথেচ্ছ যৌনাকাঙক্ষাই আমাদের নারীদের তাড়িত করছে, কিন্তু এখন আকাশপ্রযুক্তির বদৌলতে তারা অনেক বেশী কিছু জানছে, ফলে তাদের মধ্যে একটা নুতন দাবিও তৈরী হচ্ছে। কিন্তু ঐ সমাজের মত বিষয়টা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করে এর একটা সুরাহা করার মতো পরিবেশ তৈরী হয় নি। ফলে গোপনে যৌনতার দাবি মেটানোর প্রবনতাটা অনেক বেশী জোরদার হয়েছে, অনেক বেশী বেপরোয়াও হচ্ছে।
এই বেপরোয়াত্বের এক চরম প্রকাশ হচ্ছে নিজের সন্তানকেও শত্রু হিসেবে বিবেচনা করা।
হয়তো নিজের জীবনের সকল আশার প্রদীপই যখন একে একে নিভে যেতে থাকে তখনই কেবল একজন মা হন্তারক হয়ে ওঠে। আর মায়েদের এই হন্তারকের ভূমিকায় নামানোর পেছনে দায়ী আমাদের এই বদ্ধ সমাজ। যেখানে একজন নারীর ইচ্ছা ও স্বাধীনতা খুব খুবই মূল্যহীন।
ক্লিন
রাত ১১.৩০
১৭.৮.১০
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।