আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিরিশিরি পর্ব

আমি অবাক চোখে বিশ্ব দেখি, দৃশ্য সাজাই চোখের তারায়......

পরিকল্পনাটা কিন্তু এমন ছিল না। আগেই ভেবে রেখেছিলাম, বিরিশিরি যাবো ঢাকা থেকে সরাসরি বাসে। তা আর হলো কই! ভ্রমণসঙ্গী হুমায়ূন ভাইয়ের অনাহূত পেটের পীড়া সামলে মহাখালী বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছলাম যখন, ঘড়ির কাঁটা তখন নয়টা পেরিয়ে গেছে। শীতকালীন রাতের অন্ধকারও বেশ জাকিয়ে বসেছে। ঘন্টা দেড়েক আগে ছেড়ে গেছে বিরিশিরিগামী শেষ বাসটিও।

তাহলে উপায়! হুমায়ূন ভাই আকার- ইঙ্গিতে বোঝাতে চাইলেন, ফিরে যাওয়াই উত্তম। কিন্তু আমার যে জেদ চেপে গেছে। এই ইট- কাঠের জঙ্গলে আর না। সেহেতু আগেপিছে না ভেবেই স্ট্যান্ডে দাঁড়নো বাসটাতেই উঠে পড়লাম। এটার গন্তব্য ময়মনসিংহ।

আপাতত সেখানেই পৌঁছনো যাক, বাকিটা না হয় পরে দেখা যাবে! ময়মনসিংহ পৌঁছলাম রাত সাড়ে বারোটায়। মফস্বল শহরটা ততণে অর্ধরজনী পার করে, আগামী দিনের প্রহর গুনছে। বাসস্ট্যান্ডের পাশে কিছু টং দোকান এখনও খোলা আছে। দূরে কয়েকটা রেস্তোরাও খোলা দেখা যাচ্ছে। চায়ের দোকানের সামনে বেঞ্চে বসে ঢুলছে কিছু মানুষ।

রাস্তায় ইতস্তত বিপ্তি ঘোরাঘুরি করছে কয়েকটা নেড়ি কুকুর। ঘুমঘুম চোখে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকজন রিকশাচালক। বাস থেকে নামা যাত্রীদের দেখে তাদের মাঝে একটু চাঞ্চল্য দেখা গেল। প্রথমেই খোঁজ নিলাম, এখনই বিরিশিরি রওনা হবার কোনো উপায় আছে নাকি। উত্তর পেলাম ‘না’বোধক।

সেহেতু কাল সকালের চিন্তা করা ছাড়া গতি নেই। কোন একটা হোটেলেই কাটাতে হবে আজকের রাতটা। কিন্তু উঠব কোন হোটেলে! এগিয়ে এল একজন মধ্যবয়স্ক রিকশাচালক। মনের কথাটা যেন কেমন করে সে বুঝে ফেলেছে! আঞ্চলিক টানে নিজে থেকেই বলল, চলুইন বালা হোটেলো নিয়া যাই। গলায় স্পষ্ট আন্তরিকতার ছোয়া।

তবে হুমায়ূন ভাইয়ের শহুরে কেতায় এই আন্তরিকতা ধরা দিল সন্দেহজনক রূপে! তিনি বেশ কিছুণ চোখ পাকিয়ে চেয়ে রইলেন রিকশাচালকের দিকে। রিকশাচালক নির্বিকার। আবারও সে বলল, যাইবাইন? বালা হোটেল আছে সামনে। হুমায়ূন চাপা গলায় আমাকে বললেন, ঘটনা তো মিয়া সন্দেহজনক। এ পিছনে লাগছে কেন? ব্যাটা তো ঝামেলা পাকাবে।

আমি ঘটনার মধ্যে কোন সন্দেহ খুঁজে না পেলেও হুমায়ূনের ভাইয়ের কথায় দ্বিমত জানালাম না। তাতে হুমায়ূন ভাই ঝামেলা পাকাতে পারেন। হুমায়ূন ভাই বললেন, দাঁড়াও ভেবে দেখি, এরে কীভাবে বিদায় করা যায়। হুমায়ূন ভাই ভাবতে ভাবতে বাসস্ট্যান্ড ফাঁকা হয়ে গেল। বাকি সব রিকশাও ততণে বিদায় হয়ে গেছে।

অবশেষে...সেই ‘সন্দেহজনক’ রিকশাচালকের রিকশাতেই বসে আছি আমরা। সে আমাদের ‘বালা’ হোটেলে নিয়ে যাচ্ছে। হুমায়ূন ভাই কী করা উচিত বুঝে উঠতে পারছেন না। তবে বারবার আশেপাশে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছেন, কোনদিক থেকে কোন আক্রমণ আসে নাকি। নিঝুম রাত।

আকাশে চাঁদ নেই। কুয়াশায় ঢাকা চারপাশ। কোথা থেকে ভেসে আসছে মন্ত্রপাঠের আওয়াজ। এই মধ্যরাতে মন্ত্রপাঠ করে কে! শরীরটা কেমন যেন ছমছম করে উঠল। কোন অঘটন কী ঘটতে চলল নাকি! না, কোন অঘটন ঘটলো না।

রিকশাচালক নিজেই আমাদের একটা হোটেলে নিয়ে এল। হোটেলের নাম ‘আল ইমাম’। নিজদায়িত্বে আমাদের মালপত্র কাউন্টার পর্যন্ত টেনে নিল সে। তারপর চারশ টাকা ভাড়ায় একটা ‘স্পেশাল’ ডবল বেডের রুম ঠিক করে দিল আমাদের জন্য। হোটেল ম্যানেজার খুব বিনয়ের সঙ্গে জানালেন, আমাদের যে রুম দেওয়া হয়েছে, তাতে ডিশের লাইন আছে।

এক ফাঁকে রিকশাচালক জানিয়ে দিল, যে রুমে আমরা উঠছি, তার ভাড়া ছয়শ টাকা। সে হোটেল ম্যানেজারের পরিচিত। তাই দুশ টাকা ডিসকাউন্ট। হুমায়ূন ভাই বেশ আবেগপ্রবণ মানুষ। আমাদের প্রতি এই দরদ দেখে তিনি ভাড়ার সঙ্গে অতিরিক্ত পঞ্চাশটি টাকা বকশিশ দিয়ে দিলেন রিকশাচালককে।

হোটেলের ক্যান্টিনে রাতের খাওয়া সেরে রুমে ঢুকে প্রথমেই একটা ধাক্কা খেলাম। চারশ টাকায় যে ঘর ভাড়া করেছি, সেটাকে গুদাম ঘর বললেই ভালো বলা হবে। খাট দুটো আছে ঠিকই। কিন্তু দ্বিতীয় খাটের কাছে পৌঁছনো কোনো পথ নেই। প্রথম খাটের ওপর দিয়েই দ্বিতীয় খাটে যেতে হবে।

আর দ্বিতীয় খাট পাড়ি দিয়ে যেতে হবে বাথরুমে! ডিশের লাইনের একটা তার দেখা গেল। কিন্তু কোনো টিভির টিকিটাও দেখা গেল না! অবস্থা দেখে আমি হতবাক। হুমায়ূন ভাই বজ্রাহত! তবে আরো বড়ো ধাক্কা অপেমান ছিল। সেটা টের পেলাম মশারি টানিয়ে ঘুমাতে গিয়ে। মশারি জুড়ে মশাদের অবাধ যাতায়াত ব্যবস্থা।

যার ফলে নির্ঘুম রাত কেটে গেল, মশার সঙ্গে হাতাহাতি করতে করতেই। সকালে কোনোমতে হাত-মুখ ধুয়ে হোটেলের গুদাম ঘর থেকে বেরিয়েই মুখোমুখি হলাম পাশের রুমের দুই বাসিন্দার। তাদের একজন কোন ভূমিকা ছাড়াই জানতে চাইলেন, ঘর কত টাকায় ভাড়া করেছি? অবাক হয়েই টাকার অংকটা জানালাম। তা শুনে সেই দুজনের সে কী হাসি। হাসি থামার পর জানা গেল, আমরা বিশাল ধরা খেয়েছি।

তারাও আমাদের মত একটি রুমেই উঠেছেন। তবে চারশ টাকা নয় মাত্র দুইশ টাকা ভাড়ায়! হুমায়ূন ভাই চোখ পাকিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, বলেছিলাম না রিকশাওয়ালা ব্যাটা একটা সমস্যা পাকাবে! হোটেল থেকে বেরিয়ে প্রথমেই নাস্তা সেরে নিলাম। তারপর রওনা দিলাম বাসস্ট্যান্ডের দিকে। রাতের নির্জন শহরটা এখন ব্যস্ত মানুষের পদচারণায় মুখরিত। আমি আশেপাশে তাকিয়ে মানুষের ব্যস্ততা দেখছি।

আর হুমায়ূন ভাই অনুসন্ধিৎসু চোখে খুঁজে ফিরছেন গত রাতের রিকশাচালককে। চেষ্টা বৃথা গেল। বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে দেখি হাইহল্লা চূড়ান্ত। জিজ্ঞেস করতেই কেউ একজন দেখিয়ে দিল দূর্গাপুরগামী বাস। সরাসরি বিরিশিরি না যেতে হবে দূর্গাপুর।

সেখান থেকে হাঁটাদূরত্বে বিরিশিরি। দূর্গাপুরগামী বাসের চেহারা দেখে আমাদের মুখ শুকিয়ে গেল। কারণ ওগুলোকে বাস না বলে বাসের ধ্বংসাবশেষ বলা ভালো। আর কোন উপায় নেই, তাই ওই ধ্বংসাবশেষেই উঠলাম। ঠেলেঠুলে দুটো সিটও বাগিয়ে নেওয়া গেল।

কিন্তু ভোগান্তি তো তখনও শুরুই হয়নি। বাসে ওঠারও প্রায় ঘন্টাখানেক পর বাস চলতে শুরু করল। তার পর থেকেই হাতে কলমে বোঝা গেল, ভোগান্তি কত প্রকার ও কী কী! বাসে যাত্রী উঠেছেন ধারণ মতার চেয়েও কয়েকগুণ বেশি। সিটে বসে আছেন যতজন, দুপাশের সিটের মধ্যকার সরু রাস্তায় দাঁড়িয়েছেন তারচেয়েও বেশি মানুষ। তারপরও একটু পর পরই থামছে বাস।

উঠছে আরো যাত্রী। জানালার পাশের সিটে বসায় আমার অবস্থা মন্দের ভালো। হুমায়ূন ভাইয়ের পুরোটাই মন্দ। যাত্রীরা বাস ভাড়ার পুরো টাকা উসুল করার জন্য, যার যা ছিল তাই নিয়ে বোধহয় বাসে উঠে পড়েছে। কারো হাতে বেশ কয়েকটা পোটলা-পাটলি।

কেউ নিয়ে উঠেছেন মোরগ-মুরগী, হাঁস। এই প্রাণীদের কড়কড়ানি, মানুষের হাউকাউ, বাচ্চাকাচ্চাদের কান্নাকাটি, যাত্রীদের চাপাচাপি- ধাক্কাধাক্কি, বাসের ভেতরের ভ্যাঁপসা গরমÑসব মিলিয়ে একেবারে যাচ্ছেতাই অবস্থা। শীতের দিনেও শরীর দিয়ে দড়দড় করে ঘাম ঝরতে লাগল। এরমধ্যে পেছনের দিকে বসা কেউ একজন আবার সিগারেট ধরিয়ে অবস্থাটা আরো বিতিকিচ্ছিরি করে তুললেন। তারমধ্যে আবার একটা ছাগলের ডাকও শুনলাম বোধহয়! হঠাৎ হুমায়ূন ভাই হায় হায় করে উঠলেন।

কারণ বাস রাস্তা ছেড়ে খাদে নামছে যে! আমি আর হুমায়ূন ভাই শঙ্কিত, কিন্তু বাকিরা দেখি নির্বিকার। একটু পরেই অবশ্য বুঝলাম, খাদ না এটাই রাস্তা! জায়গাটার নাম শুকনাকুড়ি। কবে কোন আমলে এখানকার রাস্তাটা ভেঙে গেছে। তারপর আর সংস্কার হয়নি। স্থানীয় মানুষ বিকল্প হিসেবে খাদটাকেই পথ বানিয়ে নিয়েছে! প্রায় চার ঘন্টার পথপাড়ি দিয়ে বাস দূর্গাপুর পৌঁছল।

নামার সময়ও বেশ ঠেলেঠুলেই নামতে হল। বাস থেকে নেমে, ধরে প্রাণ ফিরিয়া পাইলাম বুঝি! তবে অবস্থা পুরোপুরি বিধ্বস্ত। খেয়াল করলাম ভালোমত দাঁড়াতেও পারছি না। হুমায়ূন ভাইয়ের অবস্থা দেখি আরো খারাপ। কাঁতরাতে কাঁতরাতে তিনি বলতেন, এই রাস্তা তো হেঁটে আসলেও দুই ঘন্টা লাগতো।

হুমায়ূন ভাইয়ের কথার জবাব দেওয়ার আগেই দেখি হাসিমুখে একজন এসে দাঁড়ালো আমাদের সামনে। নতুন কোন আপদ নাকি! হুমায়ূন চোখ কুচকে তাকালেন। লোকটা পরিচয় দেওয়া পরই কুঁচকানো চোখ স্বাভাবিক হয়ে গেল। কারণ লোকটা আমাদের গাইড। ঢাকা থেকে আসার সময় এক বন্ধু তার পরিচিত স্থানীয় এই লোকটিকে আমাদের গাইড হিসেবে ঠিক করে দিয়েছিলো ফোনে।

গতকাল আমরা পৌঁছতে পারিনি রাতে ফোনে সে খবর বন্ধুটি পেয়ে গেছে। এবং এই খবরও পেয়ে গেছে যে আমরা আজ বিরিশিরি পৌঁছব। সেই মতেই সে যোগাযোগ করে গাইডকে পাঠিয়ে দিয়েছে নিজদায়িত্বে। গাইডের নাম আনোয়ার। তাঁর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সে সব কথাই হাসিমুখে বলে।

এমন কী ঘোর দুঃসংবাদও! যেমন সে হাসতে হাসতেই জানালো, ‘বিরিশিরিতে আমার জন্য কোন হোটেল বা রেস্ট হাউজে জায়গা জোগাড় করা সম্ভব হয়নি। ’ কারণ বিরিশিরিতে এখনও কোন আবাসিক হোটেল গড়ে ওঠেনি। ওয়াইএমসিএ-এর রেস্ট হাউজ আছে, তাতে ঘর খালি নেই। খালি নেই ওয়াইডব্লিউসিএ-এর রিসোর্টেও খালি নেই ঘর। বিরিশিরি কালচারাল সেন্টারের রেস্ট হাউজের সংষ্কার ও উন্নয়ন কাজ চলছে, সেখানেও থাকার উপায় নেই।

বাস থেকে নেমে যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, সেখান থেকে দেখা যাচ্ছে সোমেশ্বরী নদী। তবে আপাতত খুব বেশি পানি নেই। রবি ঠাকুরের চিকচিকে বালু আর হাঁটু জল সমৃদ্ধ ছোট নদীর সঙ্গে মিলিয়ে ফেলা যায় প্রায়। দূরে বিস্তীর্ণ পাহাড়ের সারি। কুয়াশার চাদর গায়ে জড়িয়ে আরো দূরে হিমালয়ের চূড়ারও কিছুটা দেখা পাওয়া যাচ্ছে বটে।

প্রকৃতির এই অপূর্ব রুপের মাঝে থাকার জায়গার চিন্তায় হুমায়ূন ভাইয়ের চিন্তিত মুখটা বেশ বেমানান মনে হল। হাসিমুখে আনোয়ার জানাল, আমাদের থাকার একটা ব্যবস্থা অবশ্য সে করেছে। সেটা তার নিজের বাড়িতেই। সঙ্গে নিশ্চয়তা, একেবারে রাজার হালে থাকতে পারবো। হুমায়ূন ভাই এভাবে হঠাৎ অন্যের বাড়িতে থাকতে যাওয়াটাকে মোটামুটি অসামাজিকতার পর্যায়ের কাজ বলে ভাবতে লাগলেন।

একটু আপত্তিও জানালেন। তবে আপত্তি টিকল না। কারণ থাকাতে তো হবেই। আনোয়ার ইতিমধ্যেই আমাদের ব্যাগ-ট্যাগ নিয়ে রওনা দিয়েছে। হুমায়ূন ভাই কী যেন ভাবছেন।

কিন্তু আমার শরীর ভেঙে আসছে। কিছু ভাবতেও ইচ্ছে করছে না। আমিও তাই আনোয়ারকে অনুসরণ করলাম। এখন তো নষ্ট করার মতো সময় নেই হাতে। একটু বিশ্রাম নিয়েই আবার বিরিশিরি ভ্রমণ সার্থক করতে বের হতে হবে না!


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।