আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিরিশিরি ভ্রমন-১

আমি ক্লান্ত প্রাণ এক সেন্টমার্টিন, কক্সবাজার ট্যুর শেষ করে এসেছি প্রায় চার মাস হলো। আবার হঠাৎ ভূত চাপলো মাথায় কোথাও বেরিয়ে পড়বার জন্য। আগে হতোনা এমনটা কিন্তু ইদানিং নিস্তব্ধতা আর নিঃসঙ্গতা সহ্যই হয়না আর তাই বারবার ছুটে বেড়ানোর এই আকূলতা। আর এই আকূলতাগুলোকে আরো উজ্জীবীত করে আমাদের ফ্যাক্টরীর আইটি ডিপার্টমেন্টের একমাত্র কর্ণধার আমার কলিগ আমাদের সেলিম ভাই, সাথে আছে সালাউদ্দীন আর মুরাদ ভাই। রিপন ভাই, নূর ভাই, সাদ্দাম ভাই যারা সেন্টমার্টিন, কক্সবাজার ট্যুরে আমাদের সাথে ছিলো ব্যক্তিগত কারনে বাদ যায়।

কিন্তু এবার আবারো এতজন ছুটি নেয়া মুশকিল, তাই কাছকাছি কোন একটা স্পট ঠিক করার ক্ষেত্রে প্রথমেই মনে এলো বিরিশিরির নাম। আমার বন্ধু অর্পার (বাড়ি-বিরিশিরি, নেত্রোকোনা। চাকরি-নোয়াখালি) মাধ্যমে ওর ছোট ভাই লুইকে দিয়ে বিরিশিরি YMCA তে দুটো রূম বুকিং দিলাম। খরচ একেবারেই কম। দুই রূম নিলাম, প্রতি রূম ৩ বেড ভাড়া ৩৫০ টাকা মাত্র (ননএসি)।

আর প্রতি রূম ২ বেড ভাড়া ৮০০ টাকা মাত্র (এসি)। এতটা কম ভাড়ায় মুগ্ধ হলাম, সংশয় ও কাজ করলো মনে কিছুটা আসলেই দেখার মতো আছেতো কিছু! কিন্তু আমাদের ধারনাকে ভূল প্রমানিত করে আমাদের ট্যুর হয়ে উঠলো রোমান্চকর আর আনন্দের। কোর্স ভাইভার কারনে শেষ মূহুর্তে এবারও আমরা মুরাদ ভাইকে হারালাম। এখন মাত্র ৩ জন, দমলামনা তবু আমরা। বাধা ছিলো অনেক-দেশের বর্তমান রাজনীতিক পরিস্থিতি, অফিস থেকে আলাদা ছুটি নেয়া না লাগলেও রওনা করার দিন ২টায় অফিস থেকে বের হবার অনুমতি মেলা, হঠাৎ সহযাত্রীর সংখ্যা অর্ধেক নেমে আসা।

এতদস্বত্তেও পিছপা হলামনা। বুধবার, ১৩/০৩/২০১৩, বিকাল ২টায় বের হবো। অফিস থেকে ভোরে যারা আসে তাদেরকে নিয়ে একটা প্রাইভেট কার দুপুর ২টায় ঢাকার উদ্দেশ্য ছেড়ে আসে, ওটাতেই চলে আসার কথা। ফোনে যোগাযোগ ছিলো কমলাপুর বিআরটিসি বাস কাউন্টারে, ওরা আগে থেকে বুকিং নিতে নারাজ গেলেই নাকি সিট পাওয়া যাবে, ৪.৩০ টায় বাস ছাড়বে। আমাদের ঢাকা আনবে যে প্রাইভেট কার অফিসের কাজ সেরে বাইরে থেকে এসে দুপুরের খাবার খেয়ে যখন আমাদের নিয়ে রওনা হলো তখন ঘড়িতে ২.৪০ টা, এবার যা কখনোই হয়না আজ তাই হলো-ফ্যাক্টরী থেকে ঢাকার পথে অযথা রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশ আমাদের গাড়ি আটকালো ৩ বার।

ঢাকার মহান জ্যাম দয়াপরাবশ হওয়ার কল্যানে আমরা ৪.১৫টায় পৌছে গেলাম কমলাপুর, এবার আমাদের ভ্যাবাচ্যাকা খাবার পালা, যে বাসের জন্য আমাদের এত প্রতীক্ষা বিরিশিরিতে আজ সেই বাসই যাবেনা। সেই মূহুর্তে মহাখালী গিয়ে সরাসরি বিরিশিরির বাস ধরার ইচ্ছা বা সময় কোনটায় নাই, তখনই ছেড়ে যাচ্ছিল মদনগামী বিআরটিসি যেটা দিয়ে গেলে আমাদের নামতে হবে শিবগন্জ, ওখান থেকে বিরিশিরি। বাস পাবো কি না পাবো আর মহাখালী কেন যাচ্ছিনা অর্পার এই উৎকন্ঠাকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে উঠে পড়লাম বাসে। প্রায় ফাঁকা অবস্থাতেই বাস ছাড়লো ৪.৫০ টায়, বাসের মাঝে নতুনের হাতছানি পেয়ে আমরা উজ্জীবিত, স্ন্যাকস আর টুকিটাকি গল্পে শুরু হলো আমাদের যাত্রা। টঙ্গীর পর থেকে যাত্রী ওঠা শুরু হলো।

জ্যাম, কয়েকটি স্টপেজে যাত্রী ওঠানো, গ্যাস ফিলিং এর জন্য বিলম্ব সব ছাপিয়ে আমাদের কানে শুধু বিরিশিরির ডাক, ঝিরিঝিরি বৃ্ষ্টি আমাদের মনটাকে ভিজিয়ে গেলো কিছুক্ষন। শিবগন্জ এসে আমরা পৌছাঁলাম ১০.৩৫ টায়, বিরিশিরির একটি বাস সেই মূহুর্তেই ছেড়ে যাচ্ছিল, তড়িঘড়ি করে উঠে পড়লাম আমরা, ভয়াবহ ভাঙ্গাচুরা সেই রাস্তা পেরিয়ে আমরা বিরিশিরি বাসস্ট্যান্ডে পৌছালাম ১২.৩০ নাগাদ। বাসে অর্পার ভাই লুইর সাথে ফোনে কথা হচ্ছিল মাঝে মাঝে, ওকে দিয়েই রাতের খাবারের ব্যবস্থা নাকি করেছে অর্পা, আমাদের অপেক্ষায় থাকবে বললো কিন্তু বিরিশিরি নেমে ওকে না পেয়ে ওর বলে দেয়া পথ ধরে হেটে পেয়ে গেলাম YMCA, খোলামেলা পরিপাটি সাজানো স্থানটা দেখে সারাদিনের ক্লান্তি ভুলে গেলাম কিন্তু হতচ্ছাড়া ক্ষুধা জানান দিচ্ছিল খুব। গোসল সেরে অপেক্ষায় রইলাম দুমুঠো খাবারের জন্য। খাবার নিয়ে লুই এসে পৌছাল প্রায় দেড়টায়, গোগ্রাসে গিলে শান্ত হলাম আমরা।

এরপর রেষ্ট হাউসের সামনের ব্যালকনিতে দাড়িয়ে খোলা আকাশ, প্রান্তরে মন ডুবিয়ে আমাদের গল্প চললো রাত ০৩.৪৫ টা পর্যন্ত। সকালের ঘুরতে যাবার অধীর আগ্রহ নিয়ে চোখের পাতায় নেমে এলো রাজ্যের ঘুম। ১৪। ০৩। ২০১৩, সকাল ৮ টায় উঠে পড়লাম সবাই, গতরাতে লুইকে সকালে আসতে বলার পরও ওর মোবাইল যখন বন্ধ পেলাম একরকম দিশেহারা হয়ে পড়লাম আমরা, আমাদের এই উদ্বিগ্নতা বাড়িয়ে দিচ্ছিল অর্পার বারংবার ফোন, মেয়েটা চেষ্টা করে যাচ্ছিল আমাদের জন্য যথাসাধ্য করতে, একটু অপেক্ষা করলে ওর দুলাভাই কোন একটা ব্যবস্থা করতো আমাদের ঘুরতে যাবার জন্য কিন্তু অনেকটা বেলা হয়ে যাওয়ায় আমরা আর ঝুঁকি নিলামনা, মোটর সাইকেল আর রিকশার মধ্যে স্বাচ্ছন্দ্য আর অর্থের দিকে লক্ষ্য রেখে আমরা রিকশা বেছে নিলাম, তারা মিয়া আর এরশাদের রিকশা আমরা নিলাম, ৪/৫ টি দর্শনীয় স্থান যা আছে দেখিয়ে আনবে ৮০০ টাকা শেষমেষ ৬৫০ টাকায় ঠিক হলো।

রাস্তার দুধারে বৃষ্টি গাছ পিছে রেখে আমরা পৌছালাম সোমেশ্বরী নদীর ব্র্রীজের উপর, দেখলাম নদী থেকে উত্তোলিত কয়লার স্তুপ। গারোদের কালচারাল একাডেমী ফেরার পথে দেখবো এই ইচ্ছা মনে নিয়ে চলতে চলতে আমরা প্রথম এসে থামলাম সুসং রাজার বাড়ি। বেশী আভিজাত্য নেই কিন্তু এর নির্মানশৈলী আর পরিপাটী সৌন্দর্য আমাদের মুগ্ধ করলো। জানলাম রাজা তাঁর সম্পত্তি সবটায় দান করে ভারত পাড়ি জমিয়েছেন। ওখান থেকে আবার রিকশায় উঠলাম, অতিরিক্ত বালু আর এবড়ো-খেবড়ো রাস্তায় বারবারই নামতে হচ্ছিল রিকশা থেকে, আমরা উপভোগ ও করছিলাম সেটা।

একটা মোড়ে এসে থামলো আমাদের রিকশা, দুদিকে দুটো সীমানা নির্দেশ করা, ডানে বারোমারী সীমান্ত ফাড়ি বামে নলুয়াপাড়া সীমান্ত ফাড়ি। স্থানীয় বিখ্যাত মালাই চা খেয়ে আমরা তারা মিয়ার সাথে বারোমারী সীমান্ত ফাড়ির দিকে রওনা হলাম, রুক্ষ পথ পাড়ি দিয়ে ক্ষেতের আল ধরে সামনে এগিয়ে রঙিন এক টিলার সামনে তারা মিয়া আমাদের দাড় করিয়ে দিয়ে বললো এটাই চীনামাটির পাহাড়, এই বিস্ময়কর অথচ ক্ষুদ্রতা দেখে আমরা আনন্দের পাশাপাশি কষ্টও পেলাম, শুনলাম অসৎ ব্যবসায়ীদের লালসার স্বীকার এটা, ডোবার মতো জমে থাকা স্বচ্ছ পানির পাশে আর তথাকথিত পাহাড়ে চড়ে ছবি তুললাম। ওখান থেকে সামনে এগিয়ে গারো পাহাড়ের দিকে যাবার পথে এক আদিবাসীর বাড়ির উঠোনের গাছের পাঁকা আতা তারা মিয়া আমাদের পেড়ে দিলো, আমরা ২৫ টাকায় গাছের মালিক থেকে ওটা কিনলাম। গারো পাহাড়ের কাছাকাছি যাবার সময় স্থানীয়রা BSF নেমেছে বলে আমাদের সতর্ক করে দিল। আমরা যতটুকু যাওয়া যায় সেই পণ নিয়ে পৌছালাম গারো পাহাড়ে, কয়েকটি পরিবার, ছোট ছোট বাচ্চাদের খেলতে দেখা গেল, পাহাড়ে দাড়িয়ে দেখলাম ভারতীয় সীমান্তে BSF র টহল।

পাহাড় থেকে নামার পথে দেখা হয়ে গেলো গারোদের মোড়ল প্রনাশ মারাকের সাথে। শতবর্ষী মানুষটা লাঠিতে ভর দিয়ে এই উঁচু পাহাড় বেয়ে কি অবলীলায় না উঠে এল। স্মৃতিচারনার মধ্যে দিয়ে অনেক হাসি-ঠাট্টা হলো উনার সাথে, ফিরে আসার আগে সেলিম ভাই ৫০ টাকার একটা নোট দিলে ফোকলা দাঁতে হেসে বললো-'এটা মুজিব শেখ'। ফেরার পথে আরেকটা পাহাড়ে উঠলাম আমরা, বড় বড় শাল গাছ বেষ্টিত পাহাড়, কারা যেনো আগুন লাগিয়েছে আগাছা পরিষ্কার করতে। কমলা, আনরসের বাগান পেরিয়ে ফেরার পথে একটা বন্ধ চার্চ দেখিয়ে বললো ওটা রবিবার ছাড়া বন্ধ থাকে।

তো কি, হয়ে গেলো আমাদের বিরিশিরি ভ্রমন। কিন্তু খচখচ করে উঠলো মনের মাঝে, অর্পা বারবার জিগ্গেস করছিলো-নদী পার হয়েছো কিনা? চার্চ, চীনামাটির পাহাড়, গারো পাহাড়, জিরো পয়েন্ট দেখেছো কিনা? হ্যাঁ, আমরাতো সবই দেখেছি, দুপূরবেলা খেয়ে রেষ্ট নিয়ে বিকালে যাবো কালচারাল একাডেমী আর নদী দেখতে এই ভেবে দুপূরে খেয়ে বিছানায় এলিয়ে নিলাম। কে জানতো কতটা প্রতারিত হয়েছি আমরা! ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।